বীর শ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর ও জাতি যার জন্য গর্বিত
পীরগঞ্জে ১ কোম্পানী খানসেনাদের স্ট্রং ডিফেন্স ছিল। এই ডিফেন্স থেকে তারা আমাদের মুক্তিযােদ্ধাদের হয়রান করত ও তাদের ওপর প্রায়ই হামলা চালাত। সেক্টর কমাণ্ডার কিউ এম. জামানের নির্দেশে এই থানার পজিশন থেকে খানসেনাদের হটাবার পরিকল্পনা নেয়া হয়। ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর, ক্যাপ্টেন ইদ্রিস খান, সুবেদার রহমান, সুবেদার সুলতান সুবেদার হাসানসহ সর্বমােট ৫০ জন মুক্তিযােদ্ধার একটি গ্রুপ রওয়ানা দেয় ৩ ইঞ্চি মর্টার, এলএমজি এবং জি-থ্রি রাইফেল নিয়ে । পীরগঞ্জ পাকডিফেন্স ছিল বর্ডার থেকে ১০ মাইল অভ্যন্তরে। হাতিয়ার নিয়ে ৪ঠা আগষ্ট রাতের আঁধারে মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা এগুতে থাকে। রাত ১টার দিকে পীরগঞ্জ থানার ৫০ গজের মধ্যে পৌছে যায় মুক্তিবাহিনী। থানার চতুর্দিক থেকে ক্রলিং করে এগিয়ে পজিশন নেয়। ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর ওয়াচ করে দেখতে পান যে থানার ভেতরে ৮ জন খানসেনা বসে আছে এবং বাইরে মাত্র ২ জন পুলিশ সেন্ট্রি দাঁড়িয়ে। তিনি দেখলেন থানা একেবারে অরক্ষিত। অথচ রেকি অনুযায়ী এখানে ১ কোম্পানী সৈন্যের স্ট্রং পজিশন। থানার চারপাশে তার বাহিনীর অর্ধেককে পজিশনে থাকতে বলে ২০/২২ জনকে নিয়ে ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর থানায় ঢােকার পরিকল্পনা নিলেন। রাত ১-২০ মিনিটের দিকে সাঁড়াশী আক্রমণের মতাে থানার তিন দিক দিয়ে ফায়ার করতে করতে ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান দিয়ে তিনটি গ্রুপ পীরগঞ্জের থানার ভেতরে ঢুকতে থাকে। আচমকা হামলায় থানার খানসেনারা দিশেহারা হয়ে থানা থেকে পেছনের স্টাফ কোয়ার্টারের দিকে লাফ দিয়ে পড়ে অন্ধকারের মধ্যে দৌড় দিয়ে চিৎকার করে উঠলাে ও খালেকো, রহিমাে, মুক্তি এটাক কার দিয়া, পিছে ভাগাে, হালত খারাপ হয়।’
অবাক বিস্ময়ে মুক্তিযােদ্ধারা দেখল অন্ধকারের মধ্যে শুধু ঝুপ ঝুপ করে পলায়নের দৃশ্য। কিছুক্ষণ পর ফায়ার বন্ধ করে দিয়ে ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর কয়েকজনকে বললেন ওদের অনুসরণ করতে। তারা ফিরে এসে বলল অন্ধকারে তীরবেগে জান নিয়ে তারা ভেগে। গেছে। সবাই অবাক হয়ে গেল যে তারা সামান্যতম কোন রেজিষ্ট্রেশনের চেষ্টা করেনি। মুক্তিযােদ্ধারা সবাই আনন্দে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরল। বিনা যুদ্ধে দখল হয়ে গেল পীরগঞ্জ থানা। পাওয়া গেল বহু অস্ত্র ও গােলাবারুদ। সেক্টর কমাণ্ডার নূরুজ্জামানের নির্দেশে ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর চাঁপাইনবাবগঞ্জকে হানাদার মুক্ত করার জন্য প্রস্তুত হন। ১০ই ডিসেম্বর ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর, লেঃ কাউয়ুম, লেঃ আউয়াল ও ৫০জন মুক্তিযােদ্ধা নিয়ে ১টি এস এল আর কয়েকটি অটোমেটিক রাইফেল এবং থ্রি নট থ্রি নিয়ে এগিয়ে চললেন চাপাইনবাবগঞ্জের পশ্চিমে বারঘরিয়া এলাকায়। বারঘরিয়া এসে তার বাহিনী রেস্ট নেয় ও প্রয়ােজনীয় রেকি করার জন্য তিনি দু’জনকে পাঠান। মহানন্দা নদীর পূর্বের অংমের চর ও বাঁধ এলাকা থেকে রেকি করে এসে তাকে রিপাের্ট দেয় যে, সেখানে ২ কোম্পানী পাকিস্তানী ফোর্স স্ট্রং ডিফেন্স নিয়ে বসে আছে। ১১ই ডিসেম্বর ব্রিগেডিয়ার প্রেম সিং বাহিনীর সাথে তার যােগাযোেগ হয় এবং ঠিক হয় যে, প্রয়ােজনীয় আর্টিলারী কভারিং তারা পাবে। ১৪ই ডিসেম্বর সকাল ৮টায় বারঘরিয়া থেকে ৩/৪টি নৌকাযােগে রেহাইচর এলাকা দিয়ে মরণ নদী মহানন্দা পার হন ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর ও ২০/২৫ জন মুক্তিযােদ্ধা। নদী অতিক্রম করার সাথে সাথে পাকহানাদারদের বাংকার থেকে প্রচণ্ড গােলাগুলি এসে পড়তে থাকে তাদের ওপর।
পরিকল্পনা অনুযায়ী সেই দিনই বা পরদিন ১২ই ডিসেম্বর মহানন্দার ওপার থেকে মিত্রবাহিনীর গােলা গিয়ে পড়বে নদীর পূর্ব অংশের চর ও বাঁধ এলাকায় ঘাঁটিগুলাের ওপর। জাহাঙ্গীর ও তার মুক্তিবাহিনী ১১ই ডিসেম্বর সারাদিন অপেক্ষা করল। ১২ই ডিসেম্বরও পার হয়ে গেল। মহানন্দার ওপারে কোন গােলাবর্ষণ হল না। এ্যালাইড ফোর্স কি কারণে যেন কভারিং দিতে ফেল করল। কিন্তু সেক্টর কমাণ্ডারের আদেশ পালন করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ জাহাঙ্গীর ফিরে যাবেন না । চাপাইনবাবগঞ্জ মুক্ত করার জন্য আর একদিন ছটফট করে অপেক্ষা করলেন ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর। পরদিন ১৪ই ডিসেম্বর মরণ নদী মহানন্দা ডাক দিয়ে নিয়ে গেল বীর জাহাঙ্গীর ও তাঁর সাথীদের বারঘরয়া থেকে ৩/৪টি নৌকায় করে চর এলাকা দিয়ে মহানন্দা নদী পার হল সকাল ৮টায়। পার হওয়ার সাথে সাথে মুখােমুখি হল তারা পাক হানাদারের বৃষ্টির মতাে ঝাক গুলির। জাহাঙ্গীর তাকিয়ে দেখল তার পেছনে নদী, সামনে গুলির ঝক। তারুণ্যদীপ্ত। বলিষ্ঠ চেহারার জাহাঙ্গীরের সিদ্ধান্ত ঘােষণার মতাে করে বললাে, ভয় পাওয়ার কিছু নেই, মাতৃভূমির মুক্তির জন্য আমিই যাব সামনে, ইউ ফলাে মি। চাঁপাইনবাবগঞ্জ আজ মুক্ত হয়ে যাক।
হাতের এস এর আর উঁচিয়ে ফায়ার করতে করতে বীরদর্পে এগুলেন তিনি পাকপজিশন ও বাংকারের দিকে। মহানন্দার উত্তর দিকের বাংকারের হানাদারদের ওপর আঘাত হানলেন তারা মুক্তিযােদ্ধাদের গুলির মুখে শত্রুসেনাদের ট্রেঞ্চ ধসে ধসে পড়তে লাগল। সবার আগে সেই বীর ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর। পাকডিফেন্সের যেখান থেকে আসে রেজিষ্ট্রন্স সেখানেই স্থির হয় জাহাঙ্গীরের এস এল আর-এর নিশানা, সেই ট্রেঞ্জেই ঝাপিয়ে পড়ে সে বাঘের মতাে। মহানন্দার তীরে বাংলার বাঘরা লড়ছে ১৪ই ডিসেম্বরের সকালে। লড়ছে বীর মুক্তিযােদ্ধারা। কদম কদম এগিয়ে চলেছে মুক্তিসেনারা। এগিয়ে চলেছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ মুক্ত করার পথের বাধা গুড়িয়ে গুড়িয়ে। তাদের নির্ভীক কমাণ্ডার ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরের এস এল আর এর গুলির ঘায়ে মহানন্দার উত্তর দিকে ১৮টি ট্রেঞ্জ ও আরাে ২০/২২ টি হানাদার বাংকার সহাযযাদ্ধাদের গুলিতে যখন চিরস্তব্ধ, কমাণ্ডারের দুঃসাহসিক দুরন্ত আক্রমণ ধারায় হানাদার বাহিনী যখন ট্রেঞ্জ ছেড়ে, পজিশন ছেড়ে ভেগে যাচ্ছে, তখন ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর তার বাহিনীকে মহানন্দার দক্ষিণের বাঁধ এলাকার পাকডিফেন্স এ্যাটাক। চলাবার জন্য নতুন পজিশন নিতে বলছেন। সেই সুযােগে শহরের উপকণ্ঠে বাধের পাকডিফেন্স থেকে ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্সের (যুদ্ধের সময় পাকবাহিনী দেশীয় দালালদের মধ্যে থেকে এই বাহিনীর সৃষ্টি করে) ১০/১২ জন দৌড়ে চর এলাকায় এসে এক সাথে ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরের ওপর অতর্কিত ফায়ার করলে তার কপালের ওপরে গুলি লাগল।
মহানন্দার তীরে ঢলে পড়লেন বঙ্গবীর জাহাঙ্গীর। ৭নং সেক্টরের প্রায় প্রতিটি যুদ্ধে মাথা ভরতি চুল আর মায়া ভরা আঁখির যে লম্বা সুঠামদেহী তরুণ অসীম বীরত্বে লড়েছে, দীর্ঘ ৯ মাস ধরে বীর বিক্রমে হানাদার পাঞ্জাবীদের সাথে পাঞ্জা লড়ে গেছে, দেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র দুই দিন আগে মহানন্দা নদীর তীরে সেই মহাবীর তরুণ ঢলে পড়লেন। মহানন্দ সাঁতারে এসে সহযােদ্ধারা এ খবর যখন ৭ নং সেক্টরে পৌছালাে শিশুর মতাে কাঁদলেন কমাণ্ডার মেজর নূরুজ্জামান। কেঁদে উঠল সমগ্র ৭নং সেক্টর। মিত্রবাহিনীসহ মুক্তিবাহিনীর একটি সম্মিলিত ফোর্স গেল বঙ্গবীর হত্যার প্রতিশােধ নিতে। বিকেলেই মহানন্দার এপার-ওপার কেঁপে উঠল মুক্তিযােদ্ধাদের পদভারে। নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল চাপাইনবাবগঞ্জের খানসেনাদের ডিফেন্স ও পজিশন। মুক্ত হল চাঁপাইনবাবগঞ্জ। সবাই ছুটে গেল মহানন্দার তীরে। ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের রক্তভেজা মৃতদেহ পাওয়া গেল একটি ট্রেঞ্চে। ঐদিনই সােনা মসজিদের সীমানায় এই বীরকে সমাহিত করা হল, লাস্ট পােস্ট বাজানাের মধ্য দিয়ে ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরকে মুক্তিযুদ্ধের সরকার সর্বোচ্চ জাতীয় খেতাব ‘বীরশ্রেষ্ট’ সম্মান দেন এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জের বুকে মাতৃভূমির জন্য বীরবিক্রমে জাহাঙ্গীর লড়েছিল, বুকের তপ্ত রক্ত দিয়ে মুক্ত করেছিল, সেই চাপাইনবাবগঞ্জের নাম দেন জাহাঙ্গীরাবাদ’। (সূত্র ও মুক্তিযুদ্ধ হৃদয়ে মম, মুসা সাদিক)
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত