You dont have javascript enabled! Please enable it! ইছামতির কূল রক্তে ভেজা - সংগ্রামের নোটবুক
ইছামতির কূল রক্তে ভেজা
টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া রণাঙ্গণে, কর্ণফুলি থেকে ইছামতি নদীর কূলে কূলে হানাদার বাহিনীর সাথে পাঞ্জা লড়তে লড়তে যারা হাসিমুখে দিয়ে গেছেন প্রাণ তাঁদের নাম ধরে জেগে আছে বাংলাদেশ। শহীদ খােকন, কাজল তােমাদের আত্মদানের স্মৃতি আজও জেগে আছে ইছামতির নদীর কলকল স্রোতােধারায়। সাতক্ষীরা কলেজের প্রথম বর্ষ আই. এস. সির ছাত্র ছিল খােকন। আর কাজল ছিল সাতক্ষীরা প্রাণনাথ হাই স্কুলের প্রবেশিকা পরীক্ষার্থী। যুদ্ধ শুরু হয় ২৫শে মার্চ। তবে সাতক্ষীরায় খানসেনারা হানা দিল ২০শে এপ্রিল সন্ধ্যায়। পাকিস্তানীরা ঢুকেই যে বর্বরতা শুরু করে সাতক্ষীরার মাটি পর্যন্ত কেঁপে ওঠে সে বর্বরতায়। যশােহর থেকে সাতক্ষীরা প্রবেশের পতে শহরের উপকণ্ঠে পড়ে সাতক্ষীরা সরকারী হাই স্কুল। সেই প্রাঙ্গণে বর্ষণসিক্ত ২০শে এপ্রিল সন্ধ্যায় খানসেনারা সীমারে মতাে নিষ্ঠুরভাবে প্রথমে গুলি ও পরে বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করল তিনশ’রও বেশি নারী-পুরুষ ও শিশু। | ২৭শে মার্চের পর থেকে সাতক্ষীরার বিভিন্ন গ্রাম ও থানা থেকে শত শত পরিবার ও খুলনার নিম্মাঞ্চলের দাকোপ থানা বাগেরহাট, পিরােজপুর এলাকা থেকে দুই শতাধিক পরিবার সাতক্ষীরার পথ ধরে ভােমরা সীমান্তের দিকে চলে যাচ্ছিল। টাউন হাই স্কুল ছিল সেই পথের ধারে। সেই দিন বৃষ্টি হওয়ায় সীমান্তগামী বহু পবাির সন্ধ্যায় উক্ত স্কুলের লম্বা পাকা বিল্ডিংয়ে বৃষ্টি শেষ হওয়ার অপেক্ষায় থামে। এই সময়ই যশােহর ক্যান্টনমেন্ট থেকে এসে পড়ে কয়েক ট্রাক খুনী জল্লাদ। তারা এসে ওঠে সাতক্ষীরা প্রাণনাথ হাই স্কুলের দিকে, অর্থাৎ ৩/৪ মাইল দূরে ।

কিন্তু স্থানীয় মুসলিম লীগ ও জামাতে ইসলামের নেতারা, বিশেষ করে বাকী চেয়ারম্যান তাদেরকে গিয়ে খবর দেয় যে, ৩/৪ মাইল দূরে টাউন হাই স্কুলে শত শত শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছে, তারা ভারত যাচ্ছে। স্থানীয় মুসলিম লীগ ও জামায়াতের ইসলামী নেতাদের আসল উদ্দেশ্য ভারতগামীদের সােনার গহনা ও টাকা পয়সা লুট করা। সে জন্যই তারা ডেকে আনে খানসেনাদের। সাতক্ষীরা টাউন হাইস্কুলে এত লােক দেখে সাথে সাথে ঘিরে ফেলে খানসেনারা। দোতলা বিরাট লম্বা বিল্ডিংটার প্রত্যেক রুমে ঢুকে তারা সার্চ করে করে সুন্দরী তরুণী ও কুমারী বালিকাদের টেনে হিচড়ে বের করে আনে। যে বাবা-মা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে 

তাদেরকে বুটের লাথি ও রাইফেলের গুঁতােয় থেতলে দেয়। কাউকে কাউকে গুলি করে মেরে ফেলে সেখানে। বাছাই করা মেয়েদের চিলে ছো মারার মতাে করে চুল ধরে, ঘাড় ধরে তারা নিচে এনে তাঁদের ২/৩ টা ট্রাকের ওপর তােলে এবং তাদেরকে ট্রাকে শুয়ে পড়তে বাধ্য করে। আর্তনাদ, চিৎকার আর অশ্রুপাতের মধ্যে দিয়ে মা-বাবা থেকে বিচ্ছিন্ন বালিকা ও তরুণীরা যখন ট্রাকের ওপর গাদাগাদি করে শুয়ে পড়ে ছটফট করছিল, তখন স্কুলের ঘরগুলােয় আটকে পড়া তাদের প্রিয় মা-বাবার ওপর আগ্নেয়স্ত্রধারী খানসেনারা নরকের দরজা খুলে দেয়। গুলি ও বেয়নেট চালিয়ে তারা নিরীহ শত শত নিরস্ত্র মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। দু’ঘন্টারও বেশি সময় ধরে তারা এক নাগাড়ে গুলি চালিযে নারকীয় হত্যাকাণ্ড চালায়।
এক একটা পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে সে এ সন্ধ্যায়। তরুণ-তরুণী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা একের ওপর আরেকজন ঢলে পড়ে। মা’র কোলে ছিন্ন ভিন্ন করে মা’র কলিজার টুকরা বাচ্চাকে । মারে মা’কে, বাবাকে। দুই ঘন্টারও অধিক সময় ধরে ভয়াবহ আর্তনাদ আর চিৎকার সাতক্ষীরা শহরের আকাশ-বাতাস শােকে যন্ত্রণায় কাঁপিয়ে তােলে। টাউন হাই স্কুল সংলগ্ন এলাকার লােকজন ঘরবাড়ি ছেড়ে নিঃশব্দে পালায় অন্যান্য পাড়া প্রতিবেশীর বাড়িতে। হত্যাযজ্ঞ চালাবার পর স্কুলের পেছনের একটি ডােবার মধ্যে মরা, আধ মরাদের টেনে নিয়ে ফেলে পাকসেনারা। স্কুল সংলগ্ন বাড়িগুলাে থেকে তােক ধরে এনে খানসেনারা তাদের ওপর দিয়ে এ কাজ করায়। ডােবায় তাদেরকে ফেলে দূরের দোচালা ঘরের চাল ভেঙ্গে এনে ডােবার ওপর দিয়ে চাপা দিয়ে দেয়। তারপর ট্রাকে বন্দীসেই তরুণী ও কুমারী মেয়েদের আর্তনাদ আর আহাজারীর মধ্যে তারা যশােহরের দিকে সন্ধ্যায় চলে যায়। তাদের চলে যাবার পর টাউন স্কুলের আশপাশের লােকজন ছুটে আসে। টাউন স্কুলের সামনের রােডের অপর পাশে ঢাকার সুন্দরবন হােটেলের মালিকের বাবা থাকতেন। অন্যদের সাথে তিনিও এগিয়ে আসেন। উৎসুক লােকজন কাছে এলে সেই ডােবা থেকে পানি পানি’ আওয়াজ শুনতে পায়। কেউ কেউ ডােবার ওপরের চাল ধরে টানতে থাকে। এমন সময় হানাদারদের একটা ট্রাক ফিরে আসে। ট্রাকের শব্দ শােনামাত্র প্রাণ ভয়ে সবাই পালিয়ে যায়। সারা রাত খানসেনারা টাউন স্কুল পাহারা দেয়।
গণহত্যাকারী খানসেনারা এই সন্দেহ করে পুনরায় ফিরে আসে যে কেউ হয়ত গণ কবরের লাশ তুলতে পারে। এই আশঙ্কার তারা ফিরে এসে এ কাজ থেকে জনগণকে দূরে রাখে। তাদের নির্মম ও লােমহর্ষক হত্যাকাণ্ডে সারা রাত সাতক্ষীরায় নেমে আসে মৃত্যুর নীরবতা। টাউন হাই স্কুলের গণহত্যায় নিহত শত শত নারী, শিশু ও পুরুষের লাশ যাদের বাড়ির ডােবায় ফেলে মাটি চাপা দেয়া হয়েছিল সেই দীনেশ চন্দ্র কর্মকার ‘৭১ এর পর তার ভিটে বাড়িতে ফিরে এসে রাতে সেখান থেকে কান্নার আওয়াজ শুনতে পেত। প্রতিবেশীরাও গভীর রাতে কান্নার আওয়াজ পেত। শেষ পর্যন্ত ভয়ে ও আতঙ্কে শ্রী দীনেশ কর্মকার তার পরিবার পরিজন নিয়ে তার সেই প্রিয় ভিটে মাটি ছেড়ে চিরদিনের জন্য ভারতে চলে গেল। পরদিন থেকে সাতক্ষীরার বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন গ্রামে ঘটতে থাকে, আর অত্যাচার আরও বর্বরতা। সাতক্ষীরায় পাকহানাদারদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল পাইকারী হত্যার । কেননা যুদ্ধ শুরুর সাথে সাথে মুক্তিযােদ্ধারা সাতক্ষীরার পাঞ্জাবী এসডিও খালিদ মাহমুদকে ধরে নিয়ে যায়। কিন্তু তাকে মারেনি। যুদ্ধের পর সে চলেও গেছে। পাকিস্তানে। তার বদলা নিতে খানরা সাতক্ষীরায় ঢােকার প্রশত দিন থেকে গণহত্যা শুরু করে। ফলে ওখানকার তরুণ-কিশােরেরা পালাতে তাকে। হাবলু, এনামুল, ইমামবারী, কাজল, থােকন মুক্তিযুদ্ধে যােগদান করার জন্য লুকিয়ে সীমান্তের দেবহাটায় চলে যায়। তরুণদের নিয়ে সেখানে সংগঠিত হচ্ছিলেন দেবহাটা হাই স্কুলের হেডমাস্টার জনাব শাহজাহান, যিনি পরে ক্যাপ্টেন পদে উন্নীত হন।
হাবলু, এনামুল, ইমামবারী, কাজল, খােকন ছিল শাহজাহান মাস্টারের গ্রুপের সবচেয়ে কম বয়সী কিশাের। কাজল ও খােকনের তাে গোঁফের রেখা পর্যন্ত দেখা দেয়নি। দেবহাটা, কুলে, শ্যামপুর ও ইছামতি নদীর কূলে কূলে ওরা বহুবার পাঞ্জা লড়েছে পাকহানাদারদের সাথে। ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওদের দু’জনকে প্রায়ই সতর্ক হতে বলতেন। ওদের দুজনকে নিয়ে গর্ব করতেন তিনি। জুলাই মাসে পর পর পাঁচটি অপারেশনে থােকন আর কাজল পঁয়ত্রিশ জনেরও বেশি পাকহানাদারদের খতম করেছে। বসিরহাটের টাটরা ক্যাম্প থেকে ইছামতি নদী সাঁতরে পার হয়ে যখন কোন গ্রুপ অপারেশনে বের হত তখন ওরা দু’জনে জুটি বাঁধত। সাপের মতাে নিঃশব্দে পৌছে যেত শত্রু শিবির ও বাংকারে। ওদের হাতের গ্রেনেড বজ্রের মতাে ভেঙ্গে পড়ত চকিতে, হতবিহ্বল হানাদারদের বাংকারে, পজিশনে। আশ্চর্য ক্ষিপ্রতায় হানাদারদের যুদ্ধ কৌশল তছনছ করে দিয়ে ফিরেছে ওরা। শত্রু শিবিরে, বাংকারে খােকন ও কাজলের হানা দেওয়ার কৌশলে ক্যাপ্টেন শাহজাহানও বিস্ময় মানতেন। অপারেশনে বেরিয়ে নিঃশব্দে ওরা দু’জন কখন কোন পথে শত্রু খতম করে ফিরত, নিজের দলের লােকেরাও অনেক সময় টের পেতাে না।
প্রবাসী সরকারের তদানীন্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামরুজ্জামান সাহেব সেপ্টেম্বরে ইছামতির মুক্তাঞ্চলে এসে খােকন ও কাজলের সাথে গভীর আবেগে কোলাকুলি করে বলেছিলেন, দেখাে তােমরা আমার ছেলের মতাে-তােমাদের নাম সবার প্রিয় নাম সাবধানে থেকো’। থােকন তার মায়াভরা বড় বড় চোখ তুলে বিকণ্ঠে বলেছিল, ‘বেশি সাবধান হতে চাইলে যুদ্ধ হবে না। স্বাধীনতার জন্য কাউকে কাউকে তাে মরতে হবে। এই ছিল তাদের দেশপ্রেমের বিশ্বাস। সেদিন কে জানত কিশাের খােকন কতবড় কঠিন সত্র উচ্চারণ করেছিল। তার দেড় মাস পরে, মুক্তিযােদ্ধাদের সেই প্রিয় জুটি থােকন-কাজল ভরা বর্ষার এক রাতের শেষ প্রহরে ইছামতি নদীর কূলে দেবহাটায় হাসিমুখে দিয়ে গেল প্রাণ। ক্যাপ্টেন শাহজাহান তার বাহিনীর পঁচিশজন সাহসী যােদ্ধাকে নিয়ে নৌকায় ইছামতি পার হন রাতের অন্ধকারে। দেবহাটার পাকবাহিনীর পজিশন তাদের লক্ষ্য। সকালের রেকীতে খবর পাওয়া গেছে হানাদার বাহিনীর বিশ পঁচিশজনের একটি দল দেবহাটায় পজিশন নিয়ে বাংকার করে আছে। বাংকার যাদের দিয়ে খুঁড়িয়েছিল পাকবাহিনীর লােকরা তাদেরকে হত্যা করে মেরে সেই বাংকার থেকে ইছামতি নদীর কূলে ভাসিয়ে দেয়। এ সব খবর দিয়ে দেবহাটা কূলে শ্যামপুরের লােকেরা শাহজাহান মাস্টারকে এগিয়ে আসতে বলে এবং এই জানােয়ারদের হাত থেকে গ্রামবাসীকে রক্ষার জন্য আবেদন করে।
শাহজাহান মাস্টার, যিনি নিজে ছিলেন হাই স্কুলের হেড মাস্টার, তার ছাত্রদের নিয়ে ‘জয় বাংলা’ বলে অস্ত্র হাতে তুলে লড়েছেন বীরের মতো, নিজের স্ত্রীর গহনা বিক্রি করে গড়ে তুলেছেন মুক্তিযােদ্ধাদের ক্যাম্প। তিনি এ আহ্বানে স্থির থাকতে পারলেন না। উচিত শিক্ষা দেয়ার জন্য তাঁর সাহসী যোদ্ধাদের নিয়ে ২৫শে সেপ্টেম্বরের এক চাদনী রাতে পার হলেন ইছামতি। হাবলু, এনামুল, খােকন, কাজলদের নিয়ে তিনি সন্তর্পণে হামগুড়ি দিয়ে রাত সাড়ে তিনটায় পৌছে গেলেন টার্গেটে । খানদের তাঁবুর কয়েক গজের মধ্যে পৌঁছে গেলেন নিঃশব্দে । এটা সম্ভব হওয়া তাদের জন্য ছিল এক সৌভাগ্য। এত কাছে থেকে পজিশন পেয়ে শাহজাহান মাস্টার ফায়ার বলে চিৎকারের সাথে সাথে এক সঙ্গে গর্জে উঠল পচিশটি মুক্তিযােদ্ধার রাইফেল। তবু বা ট্রেঞ্চ থেকে মাথা তুলতে দেয়নি খানদের। যে তাঁবুতে যেভাবে ছিল সেই তাঁবুতে সেখানেই তারা শেষ হয়ে গেল। যে ট্রেঞ্চে তারা গ্রামের মেয়েদের ধরে এনে নির্যাতন করেছে আগের সন্ধ্যা পর্যন্ত, সেই ট্রেঞ্চে নিজেদের রক্তের মধ্যে ডুবে গেল তারা। বিজয় উল্লাসে চারদিক যখন ‘জয় বাংলা’ ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে মুখরিত, দেবহাটায় গ্রামগুলাে জেগে উঠছে বিজয়ের গৌরবে, তখন রাজাকারেরা গােপনে বিলের পথ ধরে দুই শতাধিক খানসেনাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসে দেবহাটায়। রাত সাড়ে চারটায় দুই দিক দিয়ে ঘেরাও হয়ে শাহাজাহান মাস্টার যুদ্ধে লিপ্ত হয়। আটগুণ হানাদার ফোর্সে রিইনফোর্সমেন্ট হওয়ায় তিনি দাড়তে পারলেন না। মুক্তিযােদ্ধাদের একটা বুলেটের মুখে হানাদাররা আটটা বুলেট ফায়ার করছিল। এই অসম যুদ্ধ বেশিক্ষণ চালালে সঙ্গী-সাথীদের ক্ষয়ক্ষতি রােধ করা যাবে না এই চিন্তা করে ক্যাপ্টেন শাহজাহান রিট্রিট করে যায় ইছামতির দিকে।
কিন্তু হায়! রাজাকাররা ইছামতির নদী তীরে নৌকাগুলি ডুবিয়ে দিয়ে গেছে যখন তারা পাকিস্তানীদের সাথে মুখােমুখি সমরে লিপ্ত। কিভাবে পাড়ি দেবে তারা ইছামতি নদী? সামনে শত্রু, পশ্চাতে ইছামতির ঢেউ.। কি করে বাঁচাবেন তিনি তাঁর প্রানপ্রিয় মুক্তিযােদ্ধাদের? নিজের জীবন তিনি উৎসর্গ করে হলেও বাঁচাতে চান বাংলার এই তরুণ কিশােরদের যারা তারই ছাত্র। দেবহাটার স্কুল থেকে চিৎকার করে ভারতীয় পার বসিরহাট টাটার লােকদের সাহায্যের জন্য বলতে থাকেন। তখনাে রাতের আঁধার কাটেনি। এপার থেকে তাদেরকে কেউ ভাল দেখতে পায় না। গােলাগুলির শব্দের প্রচণ্ডতায় শাহজাহান মাস্টারদের কথা ডুবে যায়।
পাকসেনারা এতক্ষণে বুঝে যায় যে মুক্তিযােদ্ধারা পার হতে পারছে না। তাদেরকে ঘিরে ধরে মেরে ফেলার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে তারা। হাবলু, এনামুল আহত হয়। কাজল, খােকনদের কোন সাড়া শব্দ শােনা যায় না, তাদের শেষ পজিশন যেখানে ছিল সেখানেও তারা নেই। প্রমাদ গােনেন শাহজাহান মাস্টার। খানসেনার ইছামতি।
নদীর ওপর তারাবজীর মতাে গুলি ছুঁড়তে যাতে কোন সাহায্য বা নৌকা দেবহাটার ইছামতি নদীর পাকিস্তানের পারের তীরে ভিড়তে বা পারে। প্রতি মিনিটে বাড়ছে দুই শত পাকিস্তানীর মারমুখাে চাপ। সে চাপ প্রতিরােধের ক্ষমতা পঁচিশ জনের মধ্যে সক্ষম আঠার উনিশ জন মুক্তিযােদ্ধার যে কোন সময় ভেঙ্গে পড়বার উপক্রম হয়। ইতিমধ্যে পূর্বের আকাশ কিছুটা নজড়ে পড়ে। বসিরহাটের টাটারা ক্যাম্পের মুক্তিযােদ্ধারা শাহজাহান মাস্টারদের মুক্তিযােদ্ধাদের বাঁচাবার জন্য এগিয়ে আসে। কিন্তু পাকিস্তানীদের প্রচণ্ড গােলাগুলির মুখে পিছিয়ে যায়। | তবে কি শাহজাহান মাস্টার সেদিন তাঁর ছাত্রদের নিয়ে পাকবাহিনীর হাতে নির্মম মৃত্যুবরণ করবেন? ইতিহাসের সত্য বলে আজ উল্লেখ করতেই হবে সেই ঘটনা । শাহজাহান মাস্টার, বীর যােদ্ধা এনামুল, হাবু আহত হয়েও আজ বেঁচে আছেন। কে নৌকা নিয়ে ইছামতির কূলে সাঁতার দিয়েছিল? কে সেই দেবতা নামের মানুষ ইছামতির বুকে ‘জয় বাংলা বলে নৌকা নিয়ে ঝাপিয়ে পড়েছিল? যখন পঁচিশজন মুক্তিযােদ্ধার নিশ্চিত মৃত্যু এগিয়ে এসেছে, টাটরা ক্যাম্পের মুক্তিযোদ্ধারা যখন এগিয়ে যেতে ব্যর্থ, ইছামতির ঢেউ এর ওপর প্রতি সেকেণ্ডে খানসেনাদের দু’শ বুলেট এসে পড়ছে, তখন বসিরহাটের দুই নক্সাল তরুণ বীর শহীদ হবার প্রেরণায় দুই নৌকা নিয়ে বাঙালী মুক্তিযােদ্ধাদের বাচাবার জন্য ভারতীয় কূল থেকে ইছামতির ঢেউ এর ওপর সাঁতার দেয় প্রাণ হাতে নিয়ে। বাঙালী মুক্তিযােদ্ধের রণধ্বনি তারাও সেদিন কণ্ঠে তুলে নিয়ে এই অসম্ভব কাজটি করেছিল।
শাহজাহান মাস্টাররা যখন সবাইকে নৌকায় তুলল খুঁজে পেল না সেই তরুণ কাজল ও থােকন। যারা অতীতে বহুবার এই নদী পার হয়ে বহু চোরা হানায় খতম করেছে হানাদার পাকবাহিনীকে তাদেরকে পাওয়া গেল না। কিন্তু ইতিমধ্যে আরাে ৩/৪ জন আহত হওয়ায় তাদেরকে নিয়ে ফিরে এলেন শাহজাহান মাস্টার। তীরে ফিরে জড়িয়ে ধরলেন বসিরহাটের সেই দুই তরুণকে। (যাদের নাম স্মরণে নেই বলে আন্তরিকভাবে লজ্জিত ও দুঃখিত)। আর কলেজের ছাত্র শহীদ নাজমুল আবেদীন খােকন ও প্রবেশিকা পরীক্ষার্থী শামসুজ্জোহা খান কাজলের জন্য ততক্ষণে সবার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়াতে লাগল। পরদিন সূর্য উঠেছে। পাকিস্তানীরা পতাকা দুলিয়ে ইছামতির দেবহাটা কূল থেকে পাকিস্তান জিন্দাবাদ ধ্বনি তুলতে। টাটরার ভারতীয় পারে ক্যাম্পে ক্যাপ্টেন শাহজাহান আর তার সহযােদ্ধারা অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে, দেবহাটার দিকে, যেখানে হানাদাররা ব্যবচ্ছেদ করছে তরুণ বীর থােকন-কাজলের তরুণ নিস্পাপ দেহ। সেই দুঃখের নদীর এ পারে অশ্রুসজল দৃষ্টিতে সেদিন কি তারা কেউ কল্পনা করেছিল মুক্তিযােদ্ধাদের দেহ ব্যবচ্ছেদকারী পাকিস্তানীদের সেই উল্লাস ধ্বনি জিন্দাবাদ’ আবার ফিরে আসবে মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলাদেশের বুকে?
স্বাধীনতার পর ইছামতির তীরের সাতক্ষীরার দুই বীর শহীদের নাম চিরস্থায়ী করে রাখার জন্যে সাতক্ষীরার হাতপাতালের নাম শহীদ নাজমুল হাসপাতাল এবং সাতক্ষীরার নাম কাজলনগর’ রাখা হয় এবং সাতক্ষীরা মিউনিসিপ্যালটি কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিক ঘােষণাও দেন। | কিন্তু ‘৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু নিহত হবার পর সেই জাতীয় বীরের স্মৃতিবাহী সাতক্ষীরার কাজলনগর’ এবং ‘শহীদ নাজমুল হাসপাতাল’ সাতক্ষীরার বুক থেকে মুছে ফেলা হয়। কারা মুছে দেয় আমাদের জাতীয় বীরদের নাম? মহান বীরদের স্মৃতি? কারা তারা? বাংলাদেশের বুকে কোন পাঞ্জাবী জনক তাদের? (সূত্র : মুক্তিযুদ্ধ হৃদয়ে মম, মুসা সাদিক)

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত