বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন চার রাত
মুক্তিযুদ্ধের দশ বছর পরেও ক’জন জানেন যে, আমাদের ৩১৫ জন মুক্তিযােদ্ধা ৪ দিন আটকা পড়ে শুধু পানি খেয়ে বেঁচে ছিল? ৬নং এইচ. কিউতে বসে সেক্টর কমাণ্ডার খাদেমূল বাশার সাহেব পর্যন্ত প্রায় ধরে নিয়েছিলেন তারা মারাই গেছে। সেই ইতিহাস আপনারা কেউ কি কখনাে জানতে চেয়েছেন? মুক্তিযুদ্ধের সুবাদে চকচকে রাজধানীতে বসে, যারা জৌলুস বাড়াচ্ছে, ধন-সম্পদ, ক্ষমতা নিয়ে কাড়াকাড়ি আর বাড়াবাড়ি করছে তাঁদের কাছে সেই দুঃখের চার রাতে’ ইতিহাসের কি কোন মূল্য আছে? সেই দুঃখের চার রাত’ ছিল ৩ সেপ্টেম্বর থেকে ৬ সেপ্টেম্বরের রাত। এই রাতের শুরু হয়েছিল আরাে আগে তিস্তায় গা বেয়ে শঠিবাড়ি বন্দরের বুকে। মুক্তিবাহিনীর পজিশন ছিল শঠিবাড়ির উত্তর ও পূর্ব দিকে। তাদের এক মাইল পেছনে তিস্তা নদী বয়ে চলেছে। তিস্তা নদীর অপর পাড়ে পশ্চিম ও দক্ষিণ দিকে এফএফ. কোম্পানী নং-৭ এর কমাণ্ডার হারেসউদ্দীন সরকার (বীর প্রতীক) ৩১৫ জন এফএফ. নিয়ে প্রস্তুত হচ্ছেন। হানাদার পাকিস্তানীদের ডিফেন্স হচ্ছে শঠিবাড়ি বন্দরে দক্ষিণ এবং পশ্চিম সাইডে। এক কোম্পানী ফোর্স নিয়ে। সিমেন্টের মজবুত বাঙ্কারে মেজর হায়াত শক্তিশালী ডিফেন্স নিয়ে দীর্ঘ ছয় মাস বসে আছে। তাদের সাথে আছে ই. পি. ক্যাপ ইপিআর-এর ধরনের সেই সময় পাক ফোর্সদের গঠিত আরেকটি বাহিনী) এর ১ কোম্পানী, রাজাকার ছিল শ’তিনেকী। তার ওপর পেছনে ছিল আর্টিলারী। হেভি মেশিনগান, সিক্স ইঞ্চ মর্টার, এল এম জি, রকেট লাঞ্চার, থ্রি ইঞ্চ মর্টার এসব ছিল পাকহানাদারদের যুদ্ধাস্ত্র । অপরদিকে মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে ছিল ৪টি এল এম জি, ১টি থ্রি ইঞ্চ মর্টার কিছু স্টেনগান আর বাকী সব থ্রি নট থ্রি ।
সেক্টর কমাণ্ডার খাদেমূল বাশার সাহেবের নিকট থেকে ৭ নং কোম্পানী কমাণ্ডার নির্দেশ পান শঠিবাড়ির হানাদারদের ওপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য। প্রথম দিকে মুক্তিযােদ্ধারা হিট এণ্ড রান পদ্ধতি অনুসরণ করে পুরা আগষ্ট মাস। সেপ্টেম্বর মাসের ২ তারিখ পর্যন্ত তাদের ব্যস্ত রাখে। ইতিমধ্যে মুক্তিযােদ্ধারা গড়ে তােলে পাকা বাঙ্কার। শঠিবাড়ি বন্দরের পূর্ব ও উত্তর দিকে পাকহানাদারদের এক হাজার গজ দূরে এই সব বাঙ্কার । এই সব বাঙ্কার তৈরি করে মুক্তিযােদ্ধারা মনােবল বাড়িয়ে তােলে। এবং এই সময় মুক্তিযােদ্ধা ও পাকহানাদাররা যার যার পজিশনে থেকে গােলাগুলি বিনিময় করতে থাকে। সেপ্টেম্বরের ২ তারিখ। কোম্পানী কমাণ্ডার হারেসউদ্দীন সরকারের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা পাকহানাদারদের ৬০০ গজ দূরত্বের মধ্যে চলে আসে। ২রা সেপ্টম্বর রাত ৩টায় কমাণ্ডার নিজে এস এল আর নিয়ে হানাদার পজিশনে ফায়ার ওপেন করে দেয়। শুরু হয় মরণ যুদ্ধ। হারেসের ছেলেরা প্রতিজ্ঞা করে শঠিবাড়ি বন্দর দখল না করে তারা পিছু ফিরবে না। শঠিবাড়ি হাই স্কুলের ভেতরে নির্মিত দুর্ভেদ্য ঘাঁটি থেকে শেল বর্ষণ করে খানসেনারা। শুরু হল তুমুল যুদ্ধ। খানসেনাদের মুহুর্মুহু শেল ও রকেটের আঘাত এসে পড়েছে মুক্তিবাহিনীর ওপর। ভাঙ্গছে বাঙ্কার, আহত হচ্ছে মুক্তিসেনা। ধরাধরি করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তাকে পেছনে সামনে এগুচ্ছে আরেকজন মুক্তিসেনানী করছে আঘাত শত্রুর বাঙ্কারে, পজিশনে। গােলাগুলি আর আর্তনাদে ভরে উঠল ডিমলা থানায় শঠিবাড়ি বন্দর। সমান গতিতে যুদ্ধ চলছে। ঘন্টার পর ঘন্টা। কেউ এক ইঞ্চি পিছু হটছে না। সমানে সমান বুঝে যাচ্ছে একে অপরকে। একদিকে কমাণ্ডো করছেন হানাদারবাহিনীর দুর্ধর্ষ মেজর হায়াত। অন্যদিকে শ্যামল বাংলার এক তরুণ বীর হারেসউদ্দীন সরকার। এক বাহিনী চুড়ছে কামানাের গােলা, রকেট ও শেল ।
অন্য বাহিনী দু’য়েকটি এল এম জি আর থ্রি নটথ্রি দিয়ে তার জবাব দিচ্ছে। ঘন্টার পর ঘন্টা পার হয়ে যাচ্ছে। ৪ তারিখ শনিবার সকাল থেকে যুদ্ধের তীব্রতা বেড়ে গেল। হারেসউদ্দীন সরকার কয়েকজন সাহসী সাথীকে নিয়ে পর পর কয়েকটি সম্মুখের বাঙ্কার পার হয়ে এ্যাডভান্স করে গেল সমুখপান। হানল এল এম জি’র নিখুঁত অঘাত হানাদার বাহিনীর যেন পজিশন শঠিবাড়ি স্কুলের ভেতরের বাংকারে। দুপুর বারােটার দিকে চাঞ্চল্য দেখা গেল হানাদারদের বাংকারে ও ডিফেন্স পজিশনে। দ্বিগুণ শক্তিতে হারেসের নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধারা ছুটে যেতে লাগল সম্মুখপানে। সে এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। শঠিবাড়ি বন্দর আর কয়েক মিনিটের মধ্যে মুক্তিযােদ্ধাদের করায়ত্ত হবে। প্রতিটি বাংকারের মুক্তিযােদ্ধারা বৃষ্টির ঝাঁকের মতাে গুলি ছুঁড়ছে। হানাদারবাহিনী নট থ্রি ট্রিগার । জয় তারা ছিনিয়ে আনবেই। হানাদারকে পালাতে হবে শঠিবাড়ি থেকে। ট্রেনড পাকিস্তানী বাহিনী তাজ্জব বনে গেল। এক তরুণ মুক্তিযােদ্ধার কমাণ্ডে এগিয়ে আসছে থ্রি নট থ্রি হাতে বাঙলী তরুণ বালক। অব্যর্থ গুলি ছুড়ছে তাদের বাংকারে। ছেড়ে যেতে হচ্ছে তাদের ডিফেন্স পজিশন। কোম্পানী কমান্ডার হারেসউদ্দীন ঘােষণা করে দিল ৪ঠা সেপ্টেম্বর সূর্য ডােবার আগেই শঠিবাড়ি বন্দর মুক্ত হয়ে যাবে। তিনশ’ মুক্তিযােদ্ধা দম ধরে গুলি চালিয়ে যাচ্ছে হানাদারদের প্রত্যেকটা বাঙকারে। শঠিবাড়ি বন্দরে জয় অত্যাসন্ন। আক্রমণের মুখে আর দাঁড়াতে পারছে না হানাদাররা। আর কয়েক মিনিটের মধ্যে পতন হয়ে যাবে। মুক্তিযোদ্ধারা পতাকা তুলে ধরে জয়ে বাংলা’ বলে চিৎকার করছে।
এমন সময় হানাদার এল আকাশ পথে। ৪ঠা সেপ্টেম্বরের শঠিবাড়ি বন্দরে যখন মুক্তিযােদ্ধারা স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলনের জন্য উদ্যোগ নিচ্ছে, পশ্চিম গগনে সূর্য যখন ঢলে পড়েছে, ঠিক তেমন সময় গর্জন করতে করতে এল দুটি হেলিকপ্টার। হারেসউদ্দীন ও তার বাহিনীর বাংকারের পজিশনে বৃষ্টির মতাে বােমা ফেলল তারা। আক্রোশে-ক্ষোভে মুক্তিযােদ্ধারা এল এম জি’র ফায়ার করল। হেলিকপ্টার দুটো চলে গেল। প্রায় ২ ঘন্টা ধরে মুক্তিযােদ্ধাদের বিভিন্ন পজিশনে বােমা বর্ষণ করে। ডান পায়ে এবং ডান হাতে এবং কপালে বােমার আঘাতে আহত হলেন সেই বীর তরুণ যিনি ছিলেন সেই তিনশ’ পনের জন মুক্তিযােদ্ধার বীর নায়ক। আহত হল আরাে অনেকে। এক নিমিষেই নিভে গেল সেই মুক্তিযােদ্ধাদের জয়ের আশা। রক্তাক্ত ক্ষত-বিক্ষত আহতদের ব্যাণ্ডেজ ও ফাস্ট এইড শুরু হল। বিছিন্ন হয়ে গেল ৬নং এইচ কিউ এর সাথে সকল যােগাযােগ। খাবার ও অন্যান্য সামগ্রীর উপর বােমা পড়ায় সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেল। যদিও অস্ত্র ও গােলাবারুদের তেমন কোন ক্ষতি হয়নি। মুক্তিযােদ্ধাদের বাংকার এবং ডিফেন্স থেকে গুলি বন্ধ হওয়ায় হানাদার বাহিনী শুরু করল নতুন উদ্যমে গুলি গােলাবর্ষণ। সেই অসহায় অবস্থায় ৪ঠা সেপ্টেম্বর রাত্রে অনেক মুক্তিযােদ্ধা যখন হতাশ হয়ে পড়ছিল তখন রক্তাপুত কোম্পানী কমাণ্ডার চিৎকার করে বললেন, যুদ্ধ চলবে, মৃত্যু পর্যন্ত যুদ্ধ চলবে। কেউ এক ইঞ্চি পিছু হটবে না। কাউকে যদি পিছনে তাকাতে দেখি, এই আহত অবস্থায় তার উপরে আমি গুলি চালাব। জন্মভূমির বুকে বীরের মতাে লড়ে প্রাণ দাও সবাই। হেড কোয়াটার থেকে আমরা তিনশ’ জন বিচ্ছিন্ন, বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন। ধরে নাও আমরা সবাই মরে গেছি।
তিনি সবাইকে অনুরােধ করে বললেন, মৃত্যুর আগে একবার শেষ লড়াই লড়ে যাও। মুখে কলেমা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ তুলে নিয়ে এসাে মাকে মুক্ত করার জন্য আমরা এখানে মরে যাই। মুক্তিযােদ্ধারা প্রাণ ফিরে পেল। আবার ফিরে গেল বাংকারে। হাতে তুলে নিল থ্রি নট থ্রি। এমনিভাবে পার হয়ে গেল চার তারিখ রাত। পাঁচ তারিখ সারাদিন যুদ্ধ চলল। সন্ধ্যায় দু’পক্ষেই ফায়ার বন্ধ হল। সারা রাত আহতদের সেবা-শুশ্রুষা হল । ছয় তারিখ ভােরে হানাদারবাহিনী সিক্স ইঞ্চ মর্টার ও রকেট লাঞ্চার দিয়ে তুমুল আক্রমণ শুরু করল। | একদিকে খাবার নেই। আড়াই দিন পার হয়ে যাচ্ছে। শুধু পানি খেয়ে ও লতা পাতা চিবিয়ে বেঁচে আছে তিনশ’ পনের জন মুক্তিযােদ্ধা। শুধু ব্যাণ্ডেজ বেঁধে আহতরা পড়ে আছে বাংকারে। সামনের দিক থেকে ছুটে আসছে পাকিস্তানী কামানের গােলা, মেশিনগানের গুলি। সবকিছু অনিশ্চিত। সবদিক দিয়ে বিচ্ছিন্ন তবু মুক্তিযােদ্ধারা লড়াই চালিয়ে গেল। সবকিছু অনিশ্চিত জেনেও দাঁতে দাঁত কামড়ে জীবন বাজি ধরে লড়ে গেল শঠিবাড়ি বন্দরে। কেউ জানল না তাদের বীরত্ব গাঁধা। কেউ জানতে পারল না কি অসীম বীরত্বে, ধৈর্যে অনিশ্চিত অন্ধকারের মধ্যে বিচ্ছিন্ন অভুক্ত বঙ্গ জননীর তিনশ’ বীর সন্তান কি অসীম তেজে লড়েছিল।
ছয় তারিখ রাত আটটায় শঠিবাড়ির ডান দিকের মুক্তিযােদ্ধারা আকস্মিকভাবে তিনশ’ গজ ছুটে গিয়ে হানাদারদের কয়েকটি ডিফেন্স পজিশন দখল করে নেয়। এটা ছিল একটি আত্মঘাতী পদক্ষেপ। সেই ডিফেন্স লাইনে ছিল প্রায় দেড়শ’ রাজাকার। তারা অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করে। আহত কোম্পানী কমাণ্ডারের নির্দেশ মােতাবেক সেই রাজাকারদের মুক্তিযােদ্ধাদের ফ্রন্ট লাইনে বসিয়ে হানাদারদের বিরুদ্ধে গুলি চালাবার আদেশ দেয়া হয়। ধত রাজাকাররা সে আদেশ পালন করে। এর ফলে মুক্তিযােদ্ধাদের মনােবল বেড়ে যায়। চাঙ্গা হয়ে ওঠে তারা। ৬ই সেপ্টেম্বর সারারাত গুলি, পাল্টা গুলি চলতে থাকে। ৭ই সেপ্টেম্বর সকাল ৭টা ২০ মিনিটে শঠিবাড়ি বন্দরের বুকে উড়ল মুক্তির পতাকা। রণক্লান্ত হয়ে পাকিস্তানী হানাদাররা ভেগে গেল ৩/৪ মাইল পেছনে। শঠিবাড়ি বন্দরের বুকে তিন দিন এবং চার রাত যারা অভুক্ত ছিল সারা দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল, শুধু পানি খেয়ে ও লতা-পাতা খেয়ে জন্মভূমির জন্য বীর বিক্রমে লড়ে গেল। স্বাধীন বাংলাদেশে আজ তােমরা কেমন আছ বন্ধুরা?
ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনিস্টিটিউটের সামনে ৮০ সালের সেপ্টেম্বরের এক সন্ধ্যায় দেখা হয়েছিল বীর প্রতীক হারেসের সাথে । গাল ভর্তি দাড়ির মধ্যে হাত দিয়ে খেদোক্তি করে বললেন ঃ তাই এ কি অবিচার। ৭১ এর এই মাসে ৪ দিনের অভুক্ত নিঃসাড় ও আহত আমার তিনশ’ মুক্তিযােদ্ধাদের শঠিবাড়ি থেকে ঘাড়ে করে বয়ে আনতে আপনি দেখেছেন। তারা অনেকে বাংলাদেশের অনাহারে অর্ধাহারে বিনা চিকিৎসায় মরে গেল। তাদের মা-বাবারা খেতে পায় না! ভাই-বােনেরা স্কুলের খরচ জোগাতে পারে না। চাকরি বাকরি পায় না! আর পাকিস্তান আমলে ঢাকার মতিঝিলে ইস্পাহানী-আদমজীর ব্যাগ বয়ে, জুতাে বয়ে যারা বেড়াতাে তারা হয়ে গেল কোটিপতি! ওষুধ কোম্পানীর সেলসম্যানরা হয়ে গেল ওষুধ কোম্পানীর মালিক! শত শত কোটি টাকার হুণ্ডির ব্যাগ নিয়ে তারা ঘুরে বেড়াচ্ছে সিংগাপুর-হংকং-ব্যাঙ্কক! তারা ঘুরছে লণ্ডন-প্যারিস! আর আমার ছেলেরা যারা বুক দিয়ে ইঞ্চি ইঞ্চি করে এদেশের মাটি মুক্ত করেছে, তারা এসে আমাকে গালি দিয়ে। যাচ্ছে! চোখের পানি ফেলে তারা বলছে, শঠিবাড়ি বন্দরে ৬ই সেপ্টেম্বরে কেন আমি তাদের মেরে রেখে আসলাম না!
একটু থেকে নিঃশ্বাস নিয়ে বীর প্রতীক হারেসউদ্দীন বললেন, সেক্টরের ওয়ার ফ্রন্টে ৭১ সালে আমি যেভাবে কমাণ্ড দিয়ে বলতাম, স্বাধীনতার জন্য মৃত্যুর মুখে ঝাঁপিয়ে পড়াে-আজ আমি তাদের সামনে মুখ উঁচু করে দাঁড়াতে পারি না। ফ্রন্টে জান বাজি রেখে আমার মুক্তিযােদ্ধারা দেশ স্বাধীন করল কি মতিঝিল, গুলশানের কয়েকশত ফড়িয়ালুটেরা-লম্পট-চরিত্রহীন দেশপ্রেমহীন দালাল-মাস্তানদের কোটিপতি হবার জন্যে?’ ‘৭১ এর রণাঙ্গনে যাকে দেখছি ভীষণ কঠিন কঠোর চেহারার, কথা বলার সময় যার দুচোখের মণি বাঘের চোখের মতাে অবিরাম ডাইনে, বামে পেছনে, উপরে, নিচে ঘুরতে (ফ্রন্টে পাকসেনাদের মুখােমুখি থাকতে থাকতে তার চোখ চারদিকে অবিরাম ঘুরাতে ঘুরাতে অভ্যেস হয়ে যায়। সেই বীর প্রতীক জল টলমল চোখে ডুকরে ডুকরে বললেন, ভাই, আমি তাদের বলেছি, ‘৭১ সালে আমার কথায় যেভাবে তােমরা হানাদারদের খতম করতে, আজ আমি বলছি আমাকে খতম করে যাও। যে দেশ মুক্তিযােদ্ধারা স্বাধীন করল আজ রাজাকার-আলবদর মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী হল পাকিস্তানীরা ঘাটে ঘাটে বসে গেল, খুনখারাবী করে রাতারাতি লুটেরারা কোটিপতি হয়ে গেল। আর মুক্তিযােদ্ধাদের রাস্তার ভিখারী বানলাে! মুক্তিযােদ্ধাদের মা-বাবাকে রাস্তার ভিখারী বানালাে! আর আপনারা বঙ্গভবনে-সচিবালয়ে বসে কলম ধরেন দুর্নীতিবাজ-লুটেরা-কোটিপতি নালায়েকদের পক্ষে! আমি আপনাদের মুখে থু থু দেই……বলে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনষ্টিউটের সামনে মাটিতে থু থু ফেলে চোখের পানি মুছতে মুছতে সােহরাওয়ার্দী উদ্যানের সামনের মাওলানা ভাষানী রােডের জনতার মাঝে সেপ্টেম্বর মাসের এক সন্ধ্যায় মিশে গেলেন সেই বীর।
৬ নম্বর সেক্টরের রণাঙ্গনে ৭১ এর ৯ মাস ব্যাপী উল্কার বেগে যিনি পাকহানাদের ধাওয়া করে বেড়াতেন, দুই হাতে যার স্টেনগান এবং এস এল আর চলত তীব্র ক্ষিপ্রতায় আমি সেই বীরের আঁখিজলের কসম কেটে বলছি, বঙ্গভবেন সচিবালয়ে বসে যারা এটাকে পাকিস্তান বানাচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে বাংলাদেশকে নিয়ে যাচ্ছে….তাদের সামনে এই বীরেরা ফিরে আসবে ঐ জনতার মাঝ থেকে, অশ্রুসিক্ত নয়নে নয়, একাত্তরের আগ্নেয়াস্ত্র হাতে! আসবে নতুন প্রজন্মের মুক্তিযােদ্ধারা, তাদের সাথে মাটি খুঁড়ে উঠে আসবে ত্রিশ লক্ষ শহীদ মুক্তিযােদ্ধা! ‘৭১ এর ঢেউ ওঠার বছর আবার। এখন যৌবন যার সে যােদ্ধা হয়ে যাবে আবার। এখন যৌবন যার বাঙলার মাটি ডাকে আবার । প্রিয়তমার হাত ধরে রণ সাজে সাজবে সে আবার। জননী জন্মভূমির আঁখিজল মােছাবে সে আবার। (সূত্র : মুক্তিযুদ্ধ হৃদয়ে মম, মুসা সাদিক)
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত