You dont have javascript enabled! Please enable it!
চিলমারী ব্যাটল ইস্টবেঙ্গলের গর্ব
১৫ই আগষ্ট ১৯৭১। আর্টিলারিসহ এক ব্যাটেলিয়ান পাকহানাদার ও তিন শতাধিক রাজাকার চিলমারীতে বীর ইস্ট বেঙ্গলের মুখােমুখি হয়। ইস্ট বেঙ্গলে ছিল কম্বাইণ্ড ফোর্স। এখানে ছিলেন সিও মেজর জামিল (থার্ড বেঙ্গল), সিও মেজর জিয়াউদ্দীন (ফাস্ট বেঙ্গল) ও সিও মেজর আমিনুল হক (৮ম বেঙ্গল) আর ছিল মুক্তিবাহিনীর দুটি কলাম। মূল কমাণ্ডে ছিলেন জেড ফোর্সের অধিনায়ক মেজর জিয়াউর রহমান। ১৫ ও ১৬ই আগষ্ট হানাদার পাকবাহিনী নেক টু নেক ফাইট করেছে তাদের মােস্ট লেটেস্ট ও মােস্ট সফিস্টিকেড আর্মস নিয়ে। কখনাে বা মনে হয়েছে পাকহানাদাররা পিষ্ট করে দেবে ইস্ট বেঙ্গলের বীরদের। কিন্তু না, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট দাতে দাত কামড়ে পজিশন আগলে রেখে দু’দিন ধরে তাদের আক্রমণ রেজিস্ট করে গেছে। দু’দিন ধরে মুক্তিযােদ্ধারা জঙ্গল ও বনের ফাঁক দিয়ে সংগ্রহ করে হানাদার বাহিনীর ডিফেসের ফাঁক-ফোকর। ১৭ই আগষ্টে চিলমারীর পূর্বদিক দিয়ে এগিয়ে গেল ৮ম ইস্ট বেঙ্গল । নাশ হয়ে গেল দু’টি হানাদার পজিশন। নিহত হল ৪জন পাক হানাদার। জায়গা বদল করে এগুচ্ছে বঙ্গ শার্দুল ফাস্ট বেঙ্গল, থার্ড বেঙ্গল। রক্তক্ষয়ী চিলমারীর বুকে অসীম বীর বিক্রমে তিনদিন-তিনরাত লড়ে যাচ্ছে বীরের বাহিনী ইস্ট বেঙ্গল, শত্রুর লেটেস্ট আর্টিলারি ও সফিস্টিকেটেড আর্মস-এর সামনে ক’টা এস এল আর, থ্রি নটথ্রি নিয়ে। অকুতােভয় বীর যােদ্ধারা হানাদারদের ইঞ্চি ইঞ্চি করে পিছু হঠাচ্ছে চিলমারীর বুক থেকে আর গ্রামের কৃষকজনতা সবাই তাদের পেছনে ভলান্টিয়ারের কাজ করছে। জনগণের শ্রদ্ধা ও ভালােবাসায় উদ্দীপ্ত ইস্ট বেঙ্গলের জোয়ানরা পাকবাহিনীর মরণ আঘাত উপেক্ষা করে প্রতি প্রহরে সামনে এগিয়েছে নিখুঁত নিশানে হানাদার বাংকারে গুলি ছুঁড়েচে।
এল ১৯শে আগষ্ট। সারাদিনের পর সন্ধ্যায় হঠাৎ যেন দুলে উঠল হানাদার পজিশন, বাংকার ইস্ট বেঙ্গল ও মুক্তিবাহিনী আক্রমণ শানিয়ে তুলল। সন্ধ্যার আঁধার নামার সাথে সাথে বীরদর্পে অসীম দুঃসাহসে থার্ড বেঙ্গল মেজর জামিলের সাথে আরাে কয়েক গজ এগিয়ে সামনের একটা হানাদার বাংকার দখল করে নিল। বাংকারেই হত্যা করল ৪জন হানাদারকে। রাতের আঁধারে যুদ্ধ আরাে রক্তক্ষয়ী ও হিংস্র হয়ে উঠল। পাকিস্তানী স্ট্রং আর্টিলারির কভারিং থাকা সত্ত্বেও চিলমারীর বুক থেকে পালাতে চায় ১ ব্যাটেলিয়ান হানাদার । জেড ফোর্সের অধিনায়ক জিয়ার অর্ডার ও ওদেরকে রিট্রিট করতে দেয়া হবে না। চিলমারীর বুকে ওদের কবর হবে।’ মুক্তিযােদ্ধারা সন্তর্পণে ক্ষিপ্র গতিতে গিয়ে পজিশন নেয় হানাদারদের পেছনে। ভাের রাতে জোর কদমে ইস্ট বেঙ্গল ঢুকে পড়ে পাকিস্তানী বাংকারে, পজিশনে, ডিফেন্স লাইনে। ইস্ট বেঙ্গলের নির্ভীক যােদ্ধাদের নিশ্চিত আঘাতে ভেও ভেঙে পড়তে লাগল ওদের বাংকার, গুঁড়াে গুঁড়াে হয়ে গেল পাকিস্তানী ডিফেন্স । প্রানভয়ে তারা চিলমারী ডিফেন্স ছেড়ে পালাচ্ছে ৭০০ পাকহানাদার ডেড বডি ও আহতদের নিয়ে ৭/৮ মাইল দূরে, চিলমারী রেলওয়ের দিকে। পালাবার পথে প্রাণ দিচ্ছে ওৎ পেতে থাকা মুক্তিযােদ্ধাদের গুলির ঘায়ে!  ২০শে আগষ্ট মুক্ত হয়ে গেল চিলমারী। রক্তক্ষয়ী পাঁচদিন-পাঁচ রাত যুদ্ধের পর শত প্রাণশক্তিতে ভরপুর ইস্ট বেঙ্গলের বরি জোয়ানরা এগিয়ে চলল পলাতক পাকহানাদের পরবর্তী ডিফেন্স লাইন চিলমারী রেলওয়েতে আঘাত হানার জন্য। পশ্চাতে পড়ে থাকল রক্তস্নাত চিলমারী।

আনন্দ উদ্বেলিত জনগণ চিলমারীর রণক্ষেত্রে এসে দেখতে পেল বাঙ্কারে পড়ে আছে শতাধিক হানাদার ও রাজাকারের লাশ পাকহানাদারদের ডিফেন্স লাইন রক্তে ভেসে যাচ্ছে। মুক্তিযােদ্ধারা নিহত হানাদারদের চিলমারীতে কবর দেয়ার ব্যবস্থা করে। পাকিস্তানীদের ২টি লঞ্চ ধরা হয় ২টি স্পীডবােট ধ্বংস হয়। ধ্বংস হয় কয়েকটি সাঁজোয়া গাড়ি। ইস্ট বেঙ্গলের ৩জন সামান্য আহত হয় মাত্র। ব্যাটেল ফিল্ডের স্মৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা চিলমারীর বুকে সেই স্মৃতি নিয়ে প্রতিদিন সূর্য সেই বীর ইস্ট বেঙ্গলকে জানাবে রক্তিম সালাম। সমগ্র জাতি চিরদিন স্মরণ করবে বীর ইস্ট বেঙ্গলের বীরত্বগাথা আর আত্মদানের স্মৃতিকে।  (সূত্র : মুক্তিযুদ্ধ হৃদয়ে মম, মুসা সাদিক)

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!