You dont have javascript enabled! Please enable it! খুলনা বিজয় - সংগ্রামের নোটবুক
খুলনা বিজয়
নয় নম্বর সেক্টরে ফ্রগম্যানরা নদীপথে তৎপরতা চালিয়ে বেশ সাফল্য অর্জন করতে থাকে। এই সব দক্ষ ফ্রগম্যানদের ভারতীয় তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। মেজর জলিল তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, “জুনের শেষ সপ্তাহ বিভিন্ন যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে ওদের যােগাড় করা হয়। এবং নবাব সিরাজদ্দৌলার ঐতিহাসিক মুর্শিদাবাদের পলাশী নগরে ভারতীয় নৌ-বাহিনীর তত্ত্বাবধানে এই সব ছেলেদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।  ভারতীয় নৌ-বাহিনীর লেঃ কমাণ্ডার মার্টিস ও লেঃ দাসের সহযােগিতায় প্রশংসনীয়ভাবে মাত্র দু’মাসের ভেতর এ সমস্ত তরুণ গ্রাম্যছেলেরা দক্ষ ফ্রগম্যানশীপ ট্রেনিং নিয়ে বেরিয়ে আসে। নৌ-বাহিনীর রহমতুল্লাহর নেতৃত্বে ফ্রগম্যানদের অপর দল নভেম্বর মাসেও অত্যন্ত সফল অভিযান চালায়। রহমতুল্লা নৌ-বাহিনীর একজন দক্ষ অফিসার। তাঁর আত্মত্যাগ, সাহসিকতা, নিরলস নিষ্ঠা এদেশের নিষ্ঠা এদেশের মানুষ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। ইতিমধ্যে ক্যাপ্টেন জিয়া, ক্যাপ্টেন শাজাহান, ক্যাপ্টেন মেহেদী, স্টুয়ার্ড মুজিবও তাদের আক্রমণাত্মক অভিযান অব্যাহত রেখেছিলাম। ফ্লাইট সার্জেন্ট সলিমুল্লাহও শসসেরনগর থেকে পাকসেনাদের উপর আক্রমণ চালিয়ে বুড়িগােয়ালিনী, হরিনগর এবং মুন্সীগঞ্জ দখল করেন। সামরিক স্ট্র্যাটেজির দিক থেকে বুড়িগােয়ালিনী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান ছিল। কারণ এখানে থেকে বিভিন্ন ‘পাক পকেটে সরবরাহ এবং সবার গতিবিধির উপর অতি সহজে নজর রাখার সুবিধে ছিল। বুড়িগােয়ালিনী মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসায় মুক্তিবাহিনীর চলাচলের পথ বিশেষ করে নদীপথে যাতায়াত অনেক সহজ হয়। অক্টোবর মাসে নয় নম্বর সেক্টরে বেশ কয়েকজন তরুণ অফিসার যােগদান করেন । লেঃ মােহাম্মদ আলী, লেঃ আহসান উল্লাহ এবং লেঃ সুচীনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। এই তিনজন অফিসার ক্যাপ্টেন হুদার নেতৃত্বে কালিগঞ্জ, পারুলিয়া ইত্যাদি অপারেশনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। অক্টোবর মাসে সেক্টর টপস গঠনের জন্য মেজর জলিল নির্দেশ দেন।
নভেম্বরের ২০ তারিখে কালিগঞ্জে পাকিস্তানীদের সঙ্গে একটি সংঘর্ষ হল। কালিগঞ্জের ওয়াপদা কলােনিতে পাকসেনাদের একটি কোম্পানী অবস্থান করছিল। এ ছাড়াও ছিল পশ্চিমা রেঞ্জার এবং বেশকিছু রাজাকার। ক্যাপ্টেন নুরুল হুদা তার বাহিনী নিয়ে হেড কোয়ার্টার উকসা থেকে রওয়ানা হয়ে টারগেটের নিকট এসে পৌছলেন। এই সময়ে একটি কলাম নিয়ে লেঃ আহসানউল্লাহ এবং নায়েব সুবাদার সােবহান শত্রুঘাঁটির কাছাকাছি এসে পড়লেন। সঙ্গে ছিলাে মাত্র দুটি প্লাটুন। কম্যাণ্ডার ক্যাপ্টেন নুরুল হুদা নিজে একটি কলাম নিয়ে বসন্তপুর হয়ে কালিগঞ্জ পৌছলেন। নায়েব সুবেদার গফুরও একটি প্লাটুন নিয়ে অপরদিকে অবস্থান নিলেন। নভেম্বরের ২০/২১ তারিখ ভাের ৫টায় মুক্তিবাহিনী প্রথম পাকিস্থানীদের উপর হামলা চালাল। মিত্রবাহিনীর ৩য় রাজপুত হিংগলগঞ্জ থেকে মুক্তিবাহিনীকে আর্টিলারী সাপাের্ট দেয়। ভাের ৫টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত উভয়পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ চলে। এই দু’ঘন্টা স্থায়ী সংঘর্ষে কোন পক্ষেরই কোন হতাহতের সংবাদ পাওয়া যায়নি। তবে প্রায় ৪০জন পাকসেনা মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। লেঃ আহসান উল্লাহ নিজেই ২২ জন পাকসেনাকে বন্দী করেন। নায়েব সুবেদার গফুরও ৬ জন খানসেনাকে বন্দী করেন। কালিগঞ্জ শত্রুমুক্ত হয়। পাকিস্তানীরা পালিয়ে আলীপুর নামক স্থানে অবস্থান নেয়। তারা আলীপুরে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তােলার পূর্বেই পারুলিয়া কাঠের এবং আলীপুর লােহার সেতু ধ্বংস করে। মুক্তিবাহিনীও পিছু ধাওয়া করে, কিন্তু পাকিস্তানীদের ব্যাপক আর্টিলারী ফায়ারের মুখে বেশিদূর অগ্রসর হতে পারেনি।
নভেম্বর মাসে দেশের অভ্যন্তরে গেরিলাবাহিনী তাদের উপস্থিতি সর্বত্র ঘােষণা করে চলছিল। ২০শে নভেম্বর আনােয়ার হােসেন (মজনু) ৬০ জনের একটি দল নিয়ে পটুয়াখালী জেলার বামনা থানা আক্রমণের জন্য রওয়ানা হন। কিন্তু পরে সংবাদ পাওয়া যায় তিনটি পাকিস্তনী গানবােট সেদিকেই আসছে। কম্যাণ্ডার আনােয়ার হােসেন তাঁর বাহিনী নিয়ে খােলপটুয়ার নিকট বিশখালী নদীর চরে অবস্থান নেন। ভাের সাড়ে পাঁচটায় গানবােটগুলাে রাইফেল রেঞ্জের আওতায় এলে একসঙ্গে রাইফেলগুলাে গর্জে ওঠে গেরিলাদের সঙ্গে অন্যান্য অস্ত্রের মধ্যে ৩০টি রকেট ল্যাঞ্চারও ছিলাে। পাকসেনারা দেশের অভ্যন্তরে একটি জাতীয় ব্যাপক আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল না। ফলে, বেশ বােঝা গেল তারা খানিকটা ভীত হয়ে পড়েছে। গােলাগুলি দু’ঘন্টা স্থায়ী হয়। একটি গানবােট সম্পূর্ণ ডুবে যায়। আনােয়ার হােসেন মজনু তার বাহিনী নিয়ে ঐদিনই বামনা থানা ঘেরাও করলে পুলিশ এবং রাজাকারদের দল অস্ত্রসমেত গেরিলাদের নিকট আত্মসমর্পণ করে। মুক্তিবাহিনীর এই দলটির যারা দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন রণাঙ্গনে বিশেষ কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন তাঁরা হলেন সুবেদার মেজর মজিদ, নায়েক আব্দুল মান্নান, আব্দুল মালেক ও মমিন উদ্দিন। এদিকে নভেম্বর মাসের প্রথম দিকে মিত্র বাহিনীর চার্লিসেক্টর হেডকোয়ার্টার কৃষ্ণনগরে এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হলাে। সভায় জরুরি অবস্থান বিরাজ করলে অথবা ভারত যুদ্ধ ঘােষণা করলে মুক্তিবাহিনীর কর্তব্য ইত্যাদি বিষয় বিশদ আলােচনা হয়। এই সভা সম্পর্কে মেজর এম এ জলিল তার সীমাহীন সময়’ গ্রন্থে লিখেছেন ।
সাতক্ষীরার বাঁ দিক থেকে একটা সৈন্যবাহিনী পাঠিয়ে সাতক্ষীরা -দৌলতপুর বরাবর শত্রু ঘাটিগুলাে নিশ্চিহ্ন করার জন্য যশােহরের উত্তর দিক থেকে প্রথম আক্রমণ পরিচালনা করা হবে। তাছাড়া আমার মুক্তিযােদ্ধারা পাকবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর গােলাবর্ষণের মাঝখানে পড়ে যাতে বিপর্যস্ত না হয়, সেই জন্য মিত্রবাহিনীর আগে আমার সৈন্যবাহিনী পাঠাতে বারণ করা হল। আমাকে জানান হল যে, মিত্রবাহিনী বাংলাদেশের প্রবেশ করার পর মিত্রবাহিনী কোন প্রশাসনিক অসুবিধার সম্মুখীন হলে তা দূর করার জন্য তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসা। তৃতীয়তঃ ঘনিষ্ঠভাবে মিত্রবাহিনীকে অনুসরণ করা এবং তাদের সংস্পর্শে থাকা। আমাকে বলা হল যে, যেহেতু বাংলা অঞ্চল (বেঙ্গল এরিয়াভারতীয় সেনাবাহিনীর ঘাঁটি) আমার নিকটবর্তী, সেইজন্য আমার সেক্টরকে এখন থেকে বাংলা অঞ্চলের প্রশাসনিক আওতাধীনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তাছাড়া দক্ষিণ দিকের সুন্দরবন এলাকায় সম্পূর্ণ জলপথ বাংলা অঞ্চলের অধীনে এন এর দ্বায়িত্ব ন্যস্ত করা হয় মেজর জেনারেল পি. কে. রায় চৌধুরীর উপর। চার্লি সেক্টরের সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে মেজর জলিল ১৫ই নভেম্বর সাব-সেক্টর কম্যাণ্ডারদের নিয়ে একটি কনফারেন্স করলেন। কনফারেন্সে বেশ কিছু সিদ্ধান্তে নেয়া হলাে। এ সম্পর্কে মেজর জলিল লিখেছেন : খুলনা শহরের নিকট রূপসা নদীর পশ্চিম তীরে আক্রমণবৃহ তৈরি করার জন্য লেঃ জিয়াকে সুন্দরবন অঞ্চল থেকে ঘাটি গুটিয়ে ফেলার জন্য প্রয়ােজনীয় আদেশ দিলাম। বাগেরহাট সুবেদার তাজুল ইসলামের অধীনে যেসমস্ত সৈন্য ছিল তাদের লেঃ জিয়ার নিয়ন্ত্রণে কাজ করার জন্য নির্দেশ দিলাম। শত্রুপক্ষ যাতে নৌ-পথ ব্যবহার করতে না পারে, সেজন্য মিঃ নােমান উল্লাকে তেরখাদা ও মােল্লারহাটে যেসমস্ত মুক্তিযােদ্ধা ছিল, তাদের সাথে সমন্বয় স্থাপন করে খুলনার উত্তর-পূর্ব দিক থেকে এসে এক জায়গায় জড়াে হয়ে পরিস্থিতি মােকাবিলা করার জন্য সতর্ক থাকতে বললাম। আরও বললাম যে, তারা যেন পরবর্তী নির্দেশের অপেক্ষায় সর্বদা প্রস্তুত থাকে।
খুলনার দক্ষিণে পাইকগাছা, তালা ও আসাশুনি অঞ্চলে লেঃ আরেফিন গেরিলা হিসাবে কর্মরত ছিল। তাকে বললাম, সে যেন গেরিলাদের সঙ্গে নিয়ে সামনের দিকে খুলনা শহরের কাছাকাছি কোথাও প্রস্তুত হয়ে থাকে। ক্যাপ্টেন হুদার দুই ব্যাটালিয়নের

বেশি মুক্তিযােদ্ধা ছিল। তাঁকেও সামনের দিকে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দিলাম। আমি দুটো দলকে প্রস্তুত করে লেঃ বেগের নেতৃত্বাধীন বরিশালের দিকে নৌকায় পাঠিয়ে দিলাম। প্রথম দলটি, ক্যাপ্টেন ওমরের (শাজাহান) সাথে সংযােগ স্থাপন করে বরিশালের উদ্ভুত পরিস্থিতির মােকাবেলা করবে। আর দ্বিতীয় দলটি সেকেন্ড লেঃ মুয়িনের নেতৃত্বে পটুয়াখালী পাঠানাে হল। উপরিউক্ত পরিকল্পনা কার্যকর করার জন্য সেক্টর এ্যাডজুটেন্ট মােস্তফা যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে সবাইকে স্ব-স্ব স্থানে পাঠিয়ে দিলেন। এদিকে ক্যাপ্টেন নূরুল হুদা সামনে অগ্রসর হতে লাগলেন। প্রশংসনীয় উদ্যম ও মনােবল নিয়ে ক্যাপ্টেন হুদা দীর্ঘ বারাে মাইল পথ হেঁটে তার বাহিনীসহ মিঃ শাজাহানের লােকজনের কাছে পৌছে হানাদারদের সম্মুখ থেকে আঘাত হানল। তখন ওরা দিশেহারা হয়ে পারুলিয়ার দিকে পালাতে শুরুকরে । ওদিকে শাজাহানের নেতৃত্বে টাকি থেকে যে সৈন্যদলটি এসেছিল, তারা পলায়নপর হানাদারবাহিনীর একটি দলকে মাঝ পথে অবরােধ করে বসল। এদিকে হুদা জানতে পারল যে হানাদাররা পারুলিয়া সেতু উড়িয়ে দিয়ে ওপারের আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিয়েছে। সেতুর চার মাইল দূরে অবস্থান নিয়ে ক্যাপ্টেন হুদা দ্রুত মিঃ চৌধুরী ও শাজাহানের নেতৃত্বাধীন মুক্তিবাহিনীকে তার লােকজনের সাথে একত্র করে পুনর্বিন্যাস করল। ২৭শে নভেম্বর কর্নেল এম. এ. ওসমানী মুক্তিবাহিনীর অগ্রবর্তী ঘাঁটিগুলাে পরিদর্শন করলেন। উভয়পক্ষে তখনও গুলি বিনিময়ে চলছিলাে। এই অবস্থানের ঠিক বাঁ দিকে ৮নং সেক্টরের সাব-সেক্টর কমাণ্ডার ক্যাপ্টেন মাহবুব তর ট্রপস নিয়ে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে হামলা চালাচ্ছিলেন। নয় নম্বর সেক্টর তখন জোরকদমে সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী ১লা ডিসেম্বর আলীপুর ছেড়ে আরও পিছনে সরে গেল। ইতিমধ্যে হাবিলদার আফজালের নেতৃত্বে ২০০ মুক্তিযােদ্ধাকে সাতক্ষীরা পাঠান হয়। ৩রা ডিসেম্বর সাতক্ষীরা হানাদার মুক্ত হয়। ২৯শে নভেম্বর ঠুকরা নামক স্থানে পাকসেনাদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর এক বড় রকমের সংঘর্ষ হয়। পাকবাহিনীর মার খেয়ে পিছনে সরতে থাকে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব এ এইচ এম কামরুজ্জামান মুক্তাঙ্গন পরিদর্শন করেন। কামরুজ্জামান উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যে এক ভাষণে বলেন ঃ “Let the hig powers play their own politics. We shall do our own job). ১০ই ডিসেম্বর মিত্র ও মুক্তিবাহিনী খুলনা পৌঁছে যায়। ওদিকে ৭ই ডিসেম্বর বরিশাল মুক্ত হয়। ক্যাপ্টেন বেগ এবং নূরুল ইসলাম মঞ্জুরের নিকট পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করে। ১৬ই ডিসেম্বর ঢাকায় আত্মসমর্পণের পালা চুকলেও খুলনায় বিয়ােগান্ত নাটকের পরিসমাপ্তি ঘটলাে ১৭ই ডিসেম্বর। মেজর জলিল আত্মসমর্পণের চিত্রটি সুন্দর করে তার গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন। তিনি লিখেছেন : “জেনারেল দলবীর সিং-এর সাথে সাক্ষাৎ করলাম। তিনি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছেন। কেননা প্রধান ষ্টাফ অফিসার আত্মসমর্পণকারী পাকিস্তানী কম্যাণ্ডারদের নিয়ে ইতিমধ্যেই রওয়ানা হয়েছেন, এখনও এসে পৌছাননি। সময় অতি মন্থরগতিতে চলতে লাগল। এক একটি মুহূর্ত যেন এক একটি ঘন্টা। মিত্রবাহিনীর ৯নং ডিভিশনের ষ্টাফ অফিসার কর্নেল দেশপাণ্ডে জেনারেল দলবীর সিংকে বললেন, ব্রিগেডিয়ার হায়াত খান ও তার সাথের সাতজন লেঃ কর্নেল এসে পৌছে গেছেন।
উত্তেজনার চরম মুহূর্ত। জেনারেল দলবীর সিং গম্ভীর স্বরে হুকুম দিলেন, ওদের এখানে নিয়ে আসুন। আমরা হেড কোয়ার্টার বিল্ডিং-এর উপরতলায় বসা ছিলাম। নিচের দিকে চাইতেই দেখলাম সাংঘাতিক অবস্থা। সামরিক বাহিনীর ফটোগ্রাফাররা এতদিন ধরে পাগলের মতাে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাে। | যা হােক, পাকিস্তানী কম্যাণ্ডারদের নিয়ে আসা হল। আমি চারদিকে তাকাচ্ছিলামওদের ভেতর আমার চেনা কেউ আছে কিনা। হ্যা, ওদের ভেতর আমার চেনা দু’জন ছিল। একজনের নাম লেঃ কেনল ইমতিয়াজ। পাকিস্তান মিলিটারী একাডেমীতে যখন আমি ক্যাডেট ছিলাম তখন ওখানে তিনি ক্যাপ্টেন ছিলেন। অপরজন লেঃ কর্নেল শামস। তার সাথে আমার জানাশােনা ছিল। বিগ্রেডিয়ার হায়াতকেও একবার কি দু’বার পশ্চিম পাকিস্তানে দেখেছি। তখন তাদের মনে হত খুব ভদ্র, বিনয়ী। কিন্তু বাংলাদেশে তারাই , অভদ্র অযােগ্য প্রমাণিত হয়েছে। বসতে তাঁদের চেয়ার দেয়া হল। জেনারেল দলবীর সিং অত্যন্ত সৌজন্যমূলক ব্যবহার করলেন ওদের সাথে। বিজয়ী ও বিজিতের কোন সামঞ্জস্য রাখলেন না। তিনি ওদের চা পানে সত্যিই আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। তিনি বিগ্রেডিয়ার হায়াতের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন এই যে ইনি হচ্ছেন মুক্তি কম্যাণ্ডার আগে আপনাদেরই একজন ছিলেন। আত্মসমর্পণের খুঁটিনাটি বিষয় সমাপ্ত হল। ব্রিগেডিয়ার হায়াত খান তাঁর বিগ্রেড মেজরকে ডেকে বললেন, মেজর ফিরােজ তুমি এখনই চলে যাও।
এবং সৈন্যদের হুকুম। শুনিয়ে দাও, যে যেখানে আছে সেখানেই অস্ত্র সংবরণ করতে। ওদের বলে দিও আমরা আত্মসমর্পণ করেছি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে আত্মসমর্পণকারী ইতালীর সৈন্যের মতাে হানাদার দীর্ঘ লাইন দিয়ে চলতে লাগলাে। ধীরে ধীরে আমরা খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিলের ভেতর ঢুকলাম। এখানে ব্রিগ্রেডিয়ার হায়াত খানের হেডকোয়ার্টার। চারদিকে শান্ত, নীরব । মিত্রবাহিনীর একজন ব্রিগ্লোডিয়ারের তত্ত্বাবধানে আত্মসমর্পণকারী সৈন্যদল মার্চ করে এগিয়ে এল। চেয়ারে বসে ব্রিগেডিয়ার হায়াত খান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ভদ্রমহােদয়গণ, পূর্ব পাকিস্তানে বসে শেষবারের মতাে এককাপ চা দিয়ে আপ্যায়ন করা ছাড়া দেয়ার মতাে আমার আর কিছুই। নেই। মৃত পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে বাংলাদেশ বলবেন কি? আমি একথা বলতেই ব্রিগেডিয়ার হায়াত অসহায়ের মতাে আমার দিকে চেয়ে রইলেন। উপায়ন্তন না দেখে নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাঁর ভুল সংশােধন করে নিলেন। চা খেয়ে আমরা সবাই সার্কিট হাউসে যাবার জন্য প্রস্তুত হলাম। এই যাত্রাটা খুবই আনন্দকর। আমরা খুলনা শহরে কাছাকাছি আসতেই রাস্তার দু’পাশের লােকজন গগনবিদারী চিৎকারে আমাদের স্বাগত জানাল। জয় বাংলা’ ধ্বনিতে চারিদিক মুখরিত। আজ মনে হল, জয় বাংলা বাস্তব সত্য। প্রত্যেক বাড়ির চূড়ায়, দোকানে বাংলাদেশের পতাকা। প্রতিটি নারী-পুরুষ ও শিশুর হাতেই বাংলাদেশের পতাকা। হাত নেড়ে উল্লসিত জনতার অভিনন্দনের জবাব দিলাম। সবার মুখেই হাসি। শিগগিরই আমরা সার্কিট হাউসে পৌঁছলাম। আমাদের মুক্তিযােদ্ধারা। দলে দলে এদিকে আসতে লাগল। সার্কিট হাউসের উপরে বাংলাদেশের পতাকা শােভা পাচ্ছে। বুকটা ফুলে উঠল। সমুন্নত পতাকার দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম। হাজার হাজার উৎসুক মানুষ সার্কিট হাউস ঘিরে রয়েছে। এবং সবাই সামনে আসার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে।
যে পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীরা নিরীহ বাঙালীদের উপর এতদিন অমানসিক নির্যাতন চালিয়েছে, তাদের এক নজর দেখার জন্য জনতা বাধভাঙা স্রোতের মতাে ছুটে আসতে চাইল। জনতার অসম্ভব ভিড় নিয়ন্ত্রণ করার জন্য মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ােগ করা হয়েছে। কিন্তু জনতার চাপ এত বেশি যে, মুক্তিযােদ্ধারা কিছুতেই ওদের সামলাতে পারছে না। সার্কিট হাউসের দরজায় নামতেই এত ভিড়ের মধ্যেও পিষ্ট হতে হতে জনতা আমাদের দেখার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা কিরতে লাগল। কেউ আনন্দে হাততালি দেয়, কেউ গলা ফাটিয়ে চিল্কার করে, কেউ বা পাগলের মতাে ছুটে এসে চুমাে খায়। কি অপূর্ব দৃশ্য। মানবতার কি মহান বহিঃপ্রকাশ। সব হারাবার দুর্বিষহ জ্বালা ভুলে গিয়ে নতুন দিনের নতুন সূর্যকে কত আপন করে কাছে নিতে চায়। মহামানবের তীর্থ সলিলে অবগাহন করে অবহেলিত জনতা আজ যেন নতুন প্রাণের সন্ধান পেয়ে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। ওরা আজ মুক্ত, ওরা আজ স্বাধীন। প্রতিটি জিনিস ওদের নিজস্ব। ইতিমধ্যেই একটা হেলিকপ্টার জেনারেল দলবীর সিংকে নিয়ে সার্কিট হাউসে অবতারণ করল। লম্বা, উন্নত চেহারার অধিকারী জেনারেল দলবীর সিং সার্কিট হাউস পর্যন্ত হেঁটে আসলেন এবং আত্মসমর্পন পর্বের খুঁটিনাটি বিষয় ঠিক না করা পর্যন্ত তিনি অপেক্ষা করলেন সবুজ ঘাসের উপর লাল কার্পেট বিছানাে তার উপর একটি টেবিল ও একটি চেয়ার। ঐতিহাসিক মুহূর্তটি সমাগত। সুশিক্ষিত আট হাজার পাকিস্তানী সৈন্য ও তাদের কমাণ্ডারদের আত্মসমর্পণ। যে দাম্ভিক পাকিস্তানী সৈন্যরা হিংস্র কুকুরের মতাে ঘেউ ঘেউ করত তারা আজ নিরীহ মেষশাবকের মতাে আত্মসমর্পণ করল। জেনারেল দলবীর সিং চেয়ারে উপবিষ্ট। ব্রিগেডিয়ার হায়াত খান তাঁর সাথের আটজন কর্নেল নিয়ে মার্চ করে তার সামনে এসে থামলেন। পাকিস্তানী কমাণ্ডাররা যখন সার্কিট হাইস থেকে বেরিয়ে মার্চ করে আসছিল, তখন বাইরে অপেক্ষমান হাজার হাজার লােক আনন্দে ফেটে পড়ল। কেউ হাততালি দেয়। কেউ বা শিষ দেয়। গ্লানিকর পরাজয়।
কত বড় শাস্তিমূলক অনুষ্ঠান। জেনারেল দলবীর সিং-এর পাশে দাঁড়িয়ে দেখলাম, পাকিস্তানী অপরাধীগুলাে এটেনশন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অনুষ্ঠান খুবই সাদাসিদা। জেনারেল দলবীর সিং আত্মসমর্পনের দলিল পাঠ করলেন এবং পাকবাহিনীর পরাজিত কম্যাণ্ডার ব্রিগেডিয়ার হায়াত খান মাথা নুইয়ে কম্পিত হাতে দলিল স্বাক্ষর দিলেন। সােজা ব্রিগেডিয়ার হায়াত খান ও তাঁর সাথের অন্যান্য অফিসার কোমরের বেল্ট খুলে মিত্রবাহিনীর কাছে অর্পণ করলেন। এই সময় সমস্ত ফটোগ্রাফার ফটো নেয়ার জন্য উঠে-পড়ে লেগে গেলেন। দেখে মনে হল যেন একটা বিয়ের পর্ব। ঊর্ধ্বতন সামরিক অফিসারদের পক্ষে এই রকম গ্লানিকর আত্মসমর্পন আমি আর কখনও দেখিনি। অত্যন্ত অপমানজনক পরাজয়।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত