দ্বিতীয় নেভাল আক্রমণ
কলকাতা থেকে আবার পলাশী শিবিরে চলে আসি। ইতিমধ্যে আমার জন্য নতুন করে অভিযান চার্ট তৈরি রাখা হয়েছে। আমাকে খুলনার মংলা পাের্ট অপারেশন করতে হিবে। এর আগে যে দলকে আমরা মংলা পাের্ট অপারেশন করতে দিয়েছিলাম তারা বেশ একটা সুবিধা করে উঠতে পারেনি। প্রথম মংলা দলের অধিনায়ক ছিলেন আমার বন্ধু আহসানউল্লাহ। আমি এবার ৩০ জন ছেলে সঙ্গে করে মংলা অপারেশনের জন্য তৈরি হতে লাগলাম। আগষ্ট মাসের শেষদিন আমি ৩০ জন ছেলেসহ কলকাতার ব্যারাকপুর চলে আসি। ওখানে আমাদে জন্য বিশ্রাম শিবির তৈয়ার করা ছিল। ব্যারাকপুর থেকে আমরা প্রয়ােজনীয় গােলাবারুদসহ ৯নং সেক্টরে মেজর জলিল সাহেবের সঙ্গে যােগ দিই। আমাকে সাহায্য করার জন্য মেজর জলিল আমাকে লেঃ শামসুল আরেফিন সাহেবকে সঙ্গে দেন। আরও দেন ২০০ জন স্থল গেরিলাবাহিনী। স্থল গেরিলাবাহিনী আমাদেরকে সাহায্য করবে আর প্রয়ােজনবােধে পাকবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ চালাবে। বাকুন্দিয়া শিবির থেকে আমরা আবার হিঙ্গলগঞ্জ শিবিরে চলে আসি এখানে দু’দিন অপেক্ষা করার পর লেঃ শামসুল আরেফিনসহ আমি দলবল নিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করি। আমরা সাধারণত রাত্রিবেলায় চলাফেরা করতাম। দিনের বেলায় কোন জংগলে অথবা গ্রামের নির্জন বাড়িতে শিবির করতাম। এবং সব সময় যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতাম যাতে পাকবাহিনী আমাদেরকে আক্রমণ করলে আমরা তার মােকাবেলা করতে পারি। এভাবে দু’দিনে ৮০ মাইল পথ পেরিয়ে প্রায় ৩০০ লােকের একটা গেরিলা দল নিয়ে আমরা মংলা পাের্টের কাছে কৈলাশখালী গ্রামে আমাদের শিবির স্থাপন করি।
কৈলাশখালী গ্রামে লােকজন বেশি ছিল না। অধিকাংশ বাড়ি ছিল পরিত্যাক্ত । আমরা সুন্দরবনের ধারে এক হিন্দু ভদ্রলােকের বাড়িতে আশ্রয় নিই। আর অন্যান্য স্থলবাহিনী ছেলেদেরকে আমরা কয়েক ভাগে ভাগ করে পরিত্যক্ত বাড়িতে রাখি, যাতে আমাদের উপর হঠাৎ পাকসেনা আক্রমণ করলে সুবিধা করে উঠতে না পারে। | কৈলাশখালী গ্রামে একদিন বিশ্রামের পর আমি ও আমার বন্ধু শামসুল আরেফিনসহ আমরা মংলা পাের্টে রেকী’ করার জন্য যাই ছােট এক নৌকাযােগে। ঐ সময় খিজির নামে এক মুক্তিযােদ্ধার সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়। মংলা পাের্ট-এর নিকট আগে থেকেই গেরিলা তৎপরতা চালাচ্ছিল। আমাদের পেয়ে সে আরও সহজ অর্জন করল। খিজির ওখানকার বাসিন্দা হওয়ায় আমাদের রাস্তাঘাট চলাচলে সুবিধা হয়েছিল। আরেফিন, আমি, খিজির নৌকা চালানাের জন্য আরও কয়েকজন ছেলেসহ আমরা ঠিক সন্ধ্যার আগে মংলা পাের্টে রেকী করে আসি। পরদিন আমরা সন্ধ্যায় ছ’খানা নৌকায় মংলা পাের্টের কাছে এসে উঠি। স্থলবাহিনীকে আমরা তিন জায়গায় পজিশন মত বসিয়ে রাখি। যদি কোনরূপ আক্রমণ হয় তারা পাল্টা জবাব দেবে। অবশ্য আরেফিন সাহেব এসব বন্দোবস্ত করেন। আমি আমার নৌ-কমাণ্ডো ছেলেদেরকে বুকে বাঁধা মাইনসহ বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে নিজে এক দলসহ নদীতে সাঁতার দিই। আমাদের সঙ্গে থাকত শুধু ছােট একটি ছুরি, একজোড়া ফিন আর একটা লিমপেট মাইন।
আর গ্রুপ লিডারের কাছে থাকত একটি অথবা দু’টি করে হাতবােমা। অনেক সময় আমরা ওয়াটার প্রুফ গ্রেনেড ব্যবহার করতাম। প্রত্যেক জাহাজের জন্য গ্রুপ ভাগ করা থাকত। কোন জাহাজে চারজন, কোন জাহাজে ছ’জন এইভাবে ভাগ করা ছিল। আমার সঙ্গে ছিল চারজন। আমার যে জাহাজটাতে মাইন লাগানাের কথা তা নদীর অপর প্রান্তে বাঁধা ছিল। যাদের টারগেট নিকটবর্তী ছিল তারা সেখানে তা লাগিয়ে যে যার মত নিজেকে নিয়ে কেটে পড়ে। আমার জাহাজে যখন পৌঁছি তখন আমার একজন ছেলে তীব্র স্রোতের মধ্যে দলছাড়া হয়ে যায়। আমি দ্রুত আমার কাজ শেষ করে অন্য ছেলে দুটিসহ ফিরে আসার চেষ্টা করি। এমন সময় জাহাজ থেকে খুব জোরে হুইসেল বাজানাে আরম্ভ হয়। অনবরত এস ও এস (সেভ আওয়ার সােল) সংকেত ধ্বনিত হতে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে বন্দরক্ষী বাহিনী আমাদের লক্ষ্য।
করে নদীর মধ্যে গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। নদীর মধ্যে বৃষ্টির মতাে গুলি চলছে। আমাদের মােতায়েনরত স্থলবাহিনীও পাল্টা জবাব দিচ্ছে। উভয়পক্ষে তখন ভীষণ রকম গােলাগুলি। নদীর উপরে আকাশ লালে লাল। সমস্ত বন্দরের আলাে নেভানাে। আমি দলসহ নদীর কিনারায় আসতেই আমার উপর উঠে পড়ে একটি ছােট উদ্ধারকারী লঞ্চ। লঞ্চটির আলাে বন্ধ ছিল। আর আমি উল্টাভাবে সাঁতার দিচ্ছিলাম। আমার মাথায় লঞ্চটি জোরে আঘাত করে। জোরে আঘাত পাওয়ায় আমার জ্ঞান হারানোের অবস্থা হয়। আমি তখন জোরে ডুব দিয়ে নিজেকে রক্ষা করার জন্য স্রোতের অনুকূলে পানির উপর ভেসে উঠে আমার কোন সঙ্গে পেলাম না। তখন একা একা স্রোতের প্রতিকূলে গা ভাসিয়ে সাঁতার কাটতে থাকি। রাত প্রায় তিনটার সময় আমার পায়ের নিচে মাটি লাগে, তখন আমি সঁতার ছেড়ে বুকে ভর দিয়ে নদীর কিনারায় উঠে বসি। এমন সময় আমার কানের পাশ দিয়ে শাে শাে শব্দে গুলি চলে যায়। আবার মাটিতে শুয়ে পড়ি। লক্ষ্য করে দেখি আমার থেকে মাত্র বিশত্রিশ গজ দূরে পাকসেনাদের বাংকার। ওর মধ্য থেকে অনবরত আমার দিকে গুলি আসছে। কোন উপায় না দেখে আমার কোমর গড়িয়ে পড়লাম। আমার গ্রেনেডটি বের করলাম । গ্রেনেডের চাবি ছুঁড়ে মারলাম এবং নিচের দিকে গড়িয়ে পড়লাম। আমার গ্রেনেড শব্দ করে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বাংকার থেকে গুলি ছোঁড়া বন্ধ হয়ে যায়। আমি তাড়াতাড়ি উঠে আমাদের নৌকা যেদিকে ছিল সেদিকে দৌড় দিই। কিছুদূর যাওয়ার পর আমার সঙ্গে একজন ছেলের দেখা হয়, ওকে সংগে করে আমি আবার পথ চলতে শুরু করি। এদিকে নদীর উভয় পাশ থেকে ভীষণ গােলাগুলি চলছে। আমরা মাথা নিচু করে নৌকার দিকে আসতে থাকি। প্রকৃতপক্ষে আমি এত দূরে চলে গিয়েছিলাম যে, নির্দিষ্ট স্থানে আসতে প্রায় দু’ঘন্টা লাগে। আমার জন্য সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল। নদীতে ছ’টার মধ্যে পাঁচটি জাহাজ ডুবে গেছে আর একটি জাহাজ কাত হয়ে পড়ে আছে।
আমাকে পাওয়ার পর শামসুল আরেফিন ও খিজির সঙ্গে সঙ্গে গােলাগুলি বন্ধ করার জন্য আমাদের বাহিনীকে নির্দেশ দেন। গেরিলাবাহিনী একত্র করার পর লােক গণনাকালে আমার দু’জন নৌ-কমাণ্ডো কম দেখতে পাই। তাদের জন্য আরও প্রায় আধ ঘন্টা অপেক্ষা করা হল। এদিকে পূর্ব আকাশ একেবারে ফর্সা হয়ে আসছে। আর অপেক্ষা করা সম্ভব নয় দেখে আমি নৌকা ছাড়ার জন্য আদেশ দিই। পাকসেনার আওতার বাইরে এসে এক নারিকেল বাগানে কিছু ডাব ও নারিকেল পেড়ে খেয়ে সকালের নাস্তা সেরে দুপুরে শিবিরে ফিরে দেখি আমার ছেড়ে আসা ছেলে দুটি আগেই শিবিরে পৌছেছে। ঐদিন বিকাল বেলায় পােষ্ট মাস্টার সাহেব আমাদেরকে জানান যে, পাকসেনাদের মনােবল খুবই ভেঙ্গে পড়েছে। আরও জানা গেল, গােলাবারুদ ভর্তি দুটি জাহাজ চিটাগাং বন্দরে পাঠানাের জন্য একেবারে নদীর ধারে রাখা হয়েছে। এ ছাড়া আশেপাশে কয়েকখানা খাদ্য জাহাজও আছে। আমি বিকালবেলা আমার সহকর্মী দ্বিতীয় কমাণ্ডার মালেকের সঙ্গে অল্প কয়েকজন বাছা বাছা নৌ-কমান্ডো ছেলে এবং আরেফিন ও খিজিরের একটি গ্রুপসহ মাত্র বারটা লিমপেট মাইন নিয়ে দুটি নৌকা করে অবার নদীর ধারে চলে আসি। আগের দিন আমাদের আক্রমণ উল্টা দিক থেকে চালানাে হয়েছিল। এবারে বনের পাশ ঘেঁষে সন্ধ্যার আগেই সিএণ্ডবি রাস্তায় এসে পড়ি। রাস্তা থেকে জাহাজের সমস্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা দেখতে পাই। তাতে মনে হল আমাদের কাজ খুব সহজ হবে। তিনটি জাহাজের উপর মাত্র কয়েকজন লােক দেখলাম ।
আমার দ্বিতীয় কমাণ্ডার মালেক জাহাজ তিনটির অপারেশনে নিজে সঙ্গে থাকার অনুমতি চাইল । কালবিলম্ব না করে সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসার সাথে সাথে সে জন্য দু’দলসহ চারটি করে মাইন নিয়ে নদীতে নেমে পড়ে। দূরত্ব বেশি না থাকায় ১৫ মিনিটের মধ্যে জাহাজের গায়ে মাইন লাগিয়ে আমার নিকট ফিরে আসে। তাদেরকে নৌকায় যেতে নির্দেশ দিয়ে আমরা গাছের আড়ালে আত্মগােপন করে মাইন ফাটার অপেক্ষায় থাকলাম। এত তাড়াতাড়ি যে আমরা তিনটি জাহাজে মাইন লাগাতে পারব তা ধারণা করতে পারিনি। বেশি সময় অপেক্ষা করতে হল না। ১৫ মিনিটের মধ্যেই গােলাবারুদ ভর্তি জাহাজে প্রথম মাইন বিস্ফোরিত হয়। সঙ্গে সঙ্গে বিকট আওয়াজ করে তিনটি জাহাজ প্রায় আধঘন্টার মধ্যে ডুবতে আরম্ভ করে। যখন বন্দররক্ষীদের নিকট থেকে গুলি ছোঁড়া আরম্ভ হয় তখন আমরা আমাদের অবস্থান গােপন রাখার জন্য পাল্টা গুলি ছুঁড়তে আমার প্রতিরক্ষা বাহিনীকে নিষেধ করি। ওখানে আর কালবিলম্ব না করে দলবলসহ শিবিরে ফিরে আসি। পরদিন দুপুরে কোন রকমে চারটা পেটে দিয়ে আমরা ওখান থেকে নৌকাযােগে সরে পড়ি এবং গােলাবারুদ সংগ্রহ করার জন্য পুনরায় বাকুন্দিয়া শিবিরে মেজর জলিল সাহেবের নিকট ফিরে আসি। মেজর জলিল আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন এবং আমাকে অশেষ ধন্যবাদ দেন। তিনি পরদিন আমাকে ব্যারাকপুরে যেতে নির্দেশ দেন।
মংলা পাের্টে পর পর দুইটি অপারেশনে নয়টা জাহাজ ডুবেছিল এ সংবাদ বড় বড় অক্ষরে আনন্দবাজার প্রত্রিকায় ফলাও করে প্রচার করা হয়। তাছাড়া পৃথিবীর অন্যান্য সংবাদ সংস্থা যেমন বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা থেকেও নাকি প্রচার করা হয়েছিল। তখন হিন্দুস্থান নেভী নাকি এস ও এস সংকেত ডায়মণ্ড হারবার থেকে শুনতে পেয়েছিল। আমরা চালনা বন্দরেও ছােট ছােট দলে ভাগ হয়ে অপারেশন চালাতাম। ছােট নৌকা আমাদের কাছে যথেষ্ট ছিল। ছােট নৌকায় যেমন দ্রুত চলাচল করা যেত, তেমনি নিরাপদও ছিল। আমরা যে জায়গায় থাকতাম, সেখান থেকে অনেক দূরে গিয়ে অপারেশন করে আসতাম। ফলে আমাদের অবস্থান পাকসেনাদের দৃষ্টিগােচর হত না। একদিন দিনের বেলা মাঝি সেজে এক জাহাজের মাইন লাগিয়ে চলে আসি। এক ঘন্টা পর জাহাজখানা ডুবে যায়। একদিন সংবাদ পেলাম যে, দুটি আমেরিকান জাহাজ পাের্টের মধ্যে নােংগর করেছে তার মধ্যে একখানাতে বােমা ও একখানতে অস্ত্র, গােলাবারুদ রয়েছে। এ কথা শােনার পর ভীষণ আলাড়নের সৃষ্টি হল। যেমন করে হােক জাহাজ দুটি ডুবাতেই হবে। ঐ রাতে আকাশের অবস্থা খুবই খারাপ ছিল, প্রবল বেগে বাতাস বইছিল। নদীতে খুব বড় বড় ঢেউ উঠেছিল। তখনই আমাদের লক্ষ্যের জন্য উপযুক্ত সময় মনে করে সন্ধ্যার পর পরই ২৪ জন ছেলেসহ আমি নিজে তৈরি হলাম। রহমত উল্লা, আরেফিনও নদীর ধারে পজিশন নেওয়ার জন্য প্রস্তুত হলেন।
বনের মধ্যে থেকে বের হয়ে আমাদের ছােট ছােট নৌকা বিলের মধ্য দিয়ে পাের্টের দিকে অগ্রসর হতে লাগল । লক্ষ্যের নিকটবর্তী হয়ে আমরা কিছু সময় সুযােগের অপেক্ষায় থাকলাম। এর মধ্যে স্থলবাহিনীকে বিভিন্ন স্থানে পজিশন নিয়ে পাল্টা আক্রমণের জন্য তৈরি থাকতে বললাম। এদিকে পাের্টে থেকে সার্চলাইটে নিয়ে চারিদিকে নজর রাখা হচ্ছে। কিছু সময় অপেক্ষা করার পর এক সুযােগে নেমে পড়ি চার ভাগে ভাগ হয়ে ৪টা জাহাজ ডুবানাের জন্য। আমর জাহাজটা ছিল একটু দূরে। ঐ জাহাজটাতে ছিল অনেক গােলাবারুদ, তাতে কড়া পাহারা ছিল। কোন ছেলে ঐ জাহাটাতে যেতে সাহস পেল না। তখন আমি ৬ জন সাহসী ছেলেসহ নিজে রওয়ানা দিলাম। এদিকে বাকী তিনটি জাহাজে ছেলেরা প্রায় পৌছে গেছে। আমি জাহাজের নিকট পৌঁছা মাত্র আমার উপর সার্চলাইট এসে পড়ে। পাহারারত সান্ত্রী আমাকে দেখতে পেয়ে আমার দিকে গুলি চালায়। গুলি আমার বাম হাতের কনুইয়ে লেগে যায়। তখন আমি আমার কোমর থেকে একটা গ্রেনেড বের করে দাঁত দিয়ে পিনটা খুলে ফেলি। গুলি করার সঙ্গে সঙ্গে আমি পানিতে ডুব দিয়েছিলাম, ফলে বাকী গুলি আমার আর লাগেনি উপর থেকে আমাদের উপর ডেপথ চার্জ করা হয় এবং পাহারাদার চিৎকার করে বলতে থাকে, ক্যাপ্টন সাহাব, ক্যাপ্টন সাহাব, মুক্তি আ’ রাহা হয়।
আমি আমার গ্রেনেড জাহাজের উপর ছুঁড়ে মারি। সঙ্গে সঙ্গে জাহাজে আগুন ধরে যায়। এদিকে সার্চলাইট লক্ষ্য করে আমার দল গুলি চালায়, ফলে সার্চলাইট বন্ধ হয়ে যায়। আমার দুটি ছেলে ডেপথ চার্জের ফলে ভীষণভাবে আহত হয়। আমি তখন বাকী ৪ জনসহ ডুব দিয়ে জাহাজের গায়ে মাইন লাগিয়ে দিই। তখন আমার মৃত্যুভয় চলে গেছে। মরার আগে আমি জাহাজকে ডুবিয়ে মরবাে। গ্রেনেড মারার ফলে জাহাজে আগুন ধরে যাওয়ায় আমাদের উপর আর আক্রমণ হয়নি। তদুপরি আমাদের স্থলবাহিনী ওপার থেকে পাল্টা আক্রমণ চালাচ্ছিল। ভীষণ গােলাগুলি চলতে থাকে। পাের্টে ব্ল্যাক আউট ঘােষণা করে আমাদেরকে ধরার জন্য স্পীডবােট নিয়ে নদীর মধ্যে খোঁজাখুঁজি শুরু করে দেয় পাকসেনারা। আমি তখনও জাহাজের গা ধরে কচুরীপানা মাথায় দিয়ে জাহাজের নিচে অপেক্ষা করছিলাম। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে পারলাম না। কেননা, আমার নির্দিষ্ট সময় পার হয়ে গেলে মাইন ফেটে যাবে। আমার মাইন-এর সময় ছিল ৪৫ মিনিট। এ সময়ের মধ্যে ৫০০ গজ দূরে না যেতে পারলে মাইন-এর শব্দে বুক ফেটে মারা যাব। আর দেরি করা নিরাপদ নয় দেখে বাধ্য হয়ে ওখান থেকে আহত ছেলে দুটোকে সঙ্গে করে রওয়ানা দিতে গিয়ে দেখি তারা তখনও মাইন লাগাতে পারেনি। ফিরে চেয়ে দেখি আমার সঙ্গী বাকী ৪ জন আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। আহত ছেলে দুটির অবস্থা এত বেশি খারাপ হয়ে পড়েছিল যে, ডুব দিয়ে জাহাজের গায়ে মাইন লাগানাের ক্ষমতা ছিল না। তাড়াতাড়ি মাইন দুটি নিয়ে জাহাজের গায়ে লাগিয়ে দিই। এবং দুজনকে আমার সঙ্গে আমার বাহুতে এক হাত রেখে সাঁতার দিতে বলি। তারা এত দুর্বল ছিল যে, সাঁতারের ক্ষমতা তাদের রহিত হয়ে গিয়েছিল। আমারও বাম বাহু থেকে তখন রক্ত বার হচ্ছিল।
কিছুদূর সাঁতার কাটার পর আমিও বিষম পরিশ্রান্ত হয়ে পড়ি। এমন সময় আমার দিকে একখানা স্পীডবােট আসতে দেখে ৩ জন মিলে ডুব দিই। স্রোত এত বেশি ছিল যে, ডুব দেওয়ার পর আমরা দল ছাড়া হয়ে পড়ি। তখন ছেলে দুটি যে কোন দিকে চলে গেলে দেখতে পেলাম না। স্পীডবােট উপর দিয়ে চলে গেলে আমি পানির উপর উঠে আর ওদের সাথী হতে পেলাম না। তখন একাই কূলে গিয়ে উঠি। তখনও উভয় পক্ষে ভীষণ গােলাগুলি চলছে। খুব বেশি রক্ত ঝরাতে আমিও প্রায় অবশ হয়ে পড়ি। ছেলে দুটোকে রক্ষা করতে না পেরে মনের অজান্তে চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। বেশ কিছু সময় বিশ্রাম নেয়ার পর কোমরের গামছা ছিড়ে হাতে বাধন দিই, তাতে রক্ত ঝরা বন্ধ হয়ে যায়। ছেলে দুটোকে রক্ষা করতে না পেরে ভারাক্রান্ত মনে ওয়াপদা বাঁধ পার হয়ে আমার নির্দিষ্ট জায়গায় দিকে এগােতে থাকি। এমন সময় নদীর মধ্যে মাইন ফাটা আরম্ভ হয়ে গেছে। এস ও এস শব্দে সারা পাের্ট ধ্বনিত হয়ে উঠেছে। শিবিরে ফেরার পর আমরা বেশ কয়েক দিনের জন্য অবরুদ্ধ হয়ে পড়ি। তখন বনের পার্শ্ববর্তী নদীমুখ গানবােট দিয়ে পাকবাহিনী পাহারা দিতে আরম্ভ করেছিল । বেশ কয়েকটি গানবােট আমাদের চলার পথে বাধা সৃষ্টি করে। আমাদের ঐ সময় গােলাবারুদ প্রায় শেষ হয়ে আসে। এ সময় পাকিস্তানীরা ঘােষণা করে যে, মংলা বন্দরে কোন জাহাজ ৭২ মাইলের মধ্যে আসতে পারবে না। যে সমস্ত জাহাজ ঐ সময়ে ছিল সেগুলিকেও সমুদ্রের মধ্যে চলে যেতে নির্দেশ দেয় পাক সরকার। তখন বন্দর খালি হয়ে যায়। ঐ সময়। গানবােট ও প্রয়ােজনীয় জাহাজ ছাড়া আর কোন জাহাজ বন্দরে ছিল না। আমাদের তৎপরতায় মংলা বন্দরে জাহাজ চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। আমরাও প্রায় অবরুদ্ধ হয়ে পড়ি।
তাছাড়া আমাদের গােলাবারুদ শেষ হয়ে যাওয়াতে অপারেশন একরূপ বন্ধ হয়ে যায়। এই অবস্থায়ও আমি পাক জাহাজ অর্থাৎ গানবােটের উপর আক্রমণ চালানাের চেষ্টা করি, কিন্তু গােলাবারুদ কম থাকায় সম্ভব হয়ে উঠেনি। তবে আমরা কলাগাছে মাইন বেঁধে জোয়ারের সঙ্গে ছেড়ে দিতাম। কিছু সময় পর জোয়ারের স্রোতের সঙ্গে ভেসে গিয়ে মাইন নদীর মধ্যে ফেটে যেত। এতে পাকসেনারা ভীষণভাবে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ত। আমরা কচুরিপানা একত্র করে তাকে ডিলে পেন্সীল সেট করে জোয়ারের সঙ্গে ভাসিয়ে দিতাম। কিছু সময় পর নদীর মধ্যে বন্দরে কাছে গিয়ে তাতে আগুন ধরে যেত, এতে সারা নদীতে আগুন ধরে যেত । এইভাবে আমরা পাকসেনাদের মনে প্যানিক সৃষ্টি করি। আমাদের তৎপরতায় পাকসেনারা অতিষ্ঠ হয়ে আমাদের জোর অনুসন্ধান চালাতে আরম্ভ করে। হেলিকপ্টারযােগে বনের উপর দিয়ে ভয়ে ভয়ে আমাদের সন্ধান করতে থাকে। পরে আমাদের গােপন শিবির জানতে পেয়ে আমাদের উপর একদিন হঠাৎ বিমান আক্রমণ চালায়। এতে আমাদের বেশ কয়েকটি ছেলে আহত হয়। আমরা শিবির পরিবর্তন করে আরও গভীর বনের মধ্যে চলে যাই এবং নতুন শিবির স্থাপন করি।
গােলাবারুদ শেষ হয়ে আসায় আমি এ সময় রহমত উল্লা সাহেবকে শিবিরে রেখে আবার মেজর জলিলের নিকট চলে যাই গােলাবারুদ সংগ্রহ করার জন্য। আমাকে তখন কলকাতায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আমি কলকাতা চলে আসি। ৮নং থিয়েটার রােডে ওসমানী সাহেবের সঙ্গে আমাকে দেখা করিয়ে দেওয়া হয়। তখন ওসমানী সাহেব আমাকে আমাদের চৌধুরী সাহেব ও নজরুলের সঙ্গে মিলিয়ে দেন এবং আমাদেরকে শিবিরে অপেক্ষা করতে নির্দেশ দেন। আমি কয়েকদিন অপেক্ষার পর কল্যাণী শিবিরে চলে আসি। ওখান থেকে আবার আমাদের পলাশী শিবিরে প্রেরণা করা হয়। পলাশীতে পেলাম শিবিরে আমার জন্য ২০০ ছেলে অপেক্ষা করছে ফুলছডিঘাট অপারেশন করতে গিয়ে অনেকে মারা পড়েছে। শুনতে পেলাম চলতি জাহাজে রকিব অপারেশন করতে গিয়ে মারা পড়েছে। জেনেছিলাম জাহাজে মাইন লাগাতে গিয়ে জাহাজের নিচে পড়ে তিনি মারা যান। রকিব আমার বিশিষ্ট বন্ধু ছিল। তার মৃত্যুতে আমার মনে ভীষণ আঘাত লাগল। বেশ কয়েকদিন পর আবার আমি তৈরি হতে থাকি। এমন সময় এক সন্ধ্যায় শুনতে পেলাম পাকসরকার হিন্দুস্থানের সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করে দিয়েছে। (সূত্রঃ কমাণ্ডে বদিউল আলমের স্মৃতিচারণ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, অষ্টম খন্ড)
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত