You dont have javascript enabled! Please enable it!
প্রথম নেভাল আক্রমণ
আমাদের নৌ-পথে বাংলাদেশে প্রথম কর্মতৎপরতা শুরু হয় আগষ্ট মাসের তৃতীয় সপ্তাহের প্রথম দিকে। আমি কিছুসংখ্যক ছেলেসহ কলকাতা হয়ে আগরতলায় আসি ভারতীয় বােমারু বিমানের চড়ে। আগরতলা থেকে প্রয়ােজনীয় গােলাবারুদসহ আমার সঙ্গে বিশজন ছেলে নিয়ে আমি কুমিল্লা অভিমুখে রওনা দিই। আমার টারগেট ছিল কুমিল্লা-চাঁদপুর ফেরীঘাটসহ জাহাজ বিধ্বস্ত করা। বিশজনের একটি গেরিলা দল নিয়ে আমি বক্সনগর বর্ডার দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করি। পথটি ছিল পাহাড়ী ও বন্ধুর। দুই পাশে পাকসেনার প্রহরাশিবিরের মধ্য দিয়ে গভীর রাতে আমরা পাড়ি জমাই। স্থানীয় গ্রামবাসীরা এ ব্যাপারে আমাকে সাহায্য কবেছিলেন। সীমানা পার হয়ে আমি প্রথমে আমাদের বাংলাদেশে পদার্পণ করি এবং সামনের দিকে এগিয়ে চলি। কোথাও ধানক্ষেত, কোথাও বন-জঙ্গল, কোথাও আবার ডােবা-নালা-বিল। অতি সংগােপনে আমরা সিএণ্ডবি’র বড় রাস্তা পার হয়ে নৌকা নিয়ে চলতে থাকি। এভাবে কিছুদূর যাওয়ার পর আমরা পায়ে হেঁটে ভিতরে প্রবেশ করতে লাগলাম, এমন সময় সকাল হয়ে গেল। আমরা এক মাস্টার সাহেবের বাড়িতে উঠি। মাস্টার সাহেব আমাদের সাহায্য করেছিলেন। সন্ধ্যার প্রারম্ভে আবার আমরা যাত্রা শুরু করি এবং চাঁদপুরের নিকট সফরমারী গ্রামে ইব্রাহিম মাস্টার বিটি সাহেবের বাড়িতে এসে উঠি। মাস্টার সাহেবের দুই ছেলে সাজু ও দুলু আমার সঙ্গে ছিল। এর পরদিন আমরা ওখান থেকে গিয়ে উঠে এম. সি. এ. মিজানুর রহমান সাহেবের বাড়িতে। ওখানে নিরাপত্তাবােধ না হওয়ায় আমরা আবার এসে উঠি এক বিখ্যাত মুসলিম লীগ নেতার বাড়িতে।
সেখানে জোরপূর্বক তার বড় ছেলেকে জিম্মা হিসাবে আটক রেখে এই হুশিয়ারি দিই যে, আমাদের অবস্থানের কথা জানিয়ে দিলে আমরা তার ছেলেকে হত্যা করব। এতে বেশ কাজ হয়। আমরা মাঝির ছদ্মবেশে রাতে চাঁদপুরের নিকট দিয়ে নদী পাড়ি দিই। এমন সময় আমরা ঝড়ের মুখে পতিত হই। এর ফলে আমাদের চরের মধ্যে বেশ কিছু সময় নৌকা নিয়ে অপেক্ষা করতে হয়েছিল। রাত ১১টা থেকে ৩টা পর্যন্ত। আমাদের অভিযান চলার কথা ছিল। আমরা ঠিক সময় আমাদের অভিযান আরম্ভ করি কিন্তু দুঃখের বিষয় ভাগ্য আমাদের সুপ্রসন্ন ছিল না। সবই আল্লাহর ইচ্ছা। অবশ্য আমাদের। অভিযানের সংকেতধ্বনি বাজানাে হয়েছিল তখনকার বাংলাদেশ বেতারকেন্দ্র থেকে।
আমাদের সংকেত ছিল পঙ্কজ মল্লিকের লেখা একটা গানের কলি-বধূ আসবে পালকি চড়ে ইত্যাদি। আমাদের অভিযান শুরু হওয়ার কথা ছিল ১৪ই আগষ্ট দিবাগত রাতে। কিন্তু ঐ দিনটি মেঘাচ্ছন্ন দুর্যোপূর্ণ থাকায় এবং আমাদের পৌছানোের নিরাপত্তা না থাকায় অভিযান দু’দিন পিছিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ১৭ই আগষ্ট রাত ১১টায় আমি আবার প্রথম অভিযান চালাই। এর আগে আমি দিনের বেলায় চাঁদপুর শহর ও নদীপথ ভালভাবে পরিদর্শন করে আসি-যাকে রেকী বলা হয়। আমি ছেলেদের ছয়টি দলে ভাগ করে প্রত্যেককে একটি করে লিমপেট মাইন পেটে বেঁধে উল্টাভাবে সাঁতার দিয়ে টারগেটের দিকে অগ্রসর হিতে নির্দেশে দিই। সেই সাথে আমিও পিছনে রওনা অদই দুটি মাইনসহ । দু’জন ছাড়া সবাই তাদের টারগেট মাইন লাগাতে সমর্থ হয়। আমার লক্ষ্য ছিল সবচাইতে বড় একটি গমের জাহাজ। এজন্য আমি দুটি মাইন নিয়ে অন্য দু’জন ছেলেসহ প্রথমে গমের জাহাজের নিচে ডুব দিয়ে নিজ হাতে মাইন লাগাই এবং সঙ্গে সঙ্গে আমার সঙ্গী দু’জনও মাইন লাগায়। এরপর আমরা সতরিয়ে পদ্মার মুখে এসে পড়ি। এমন সময় সৈন্যবাহী জাহাজ গাজী’ আমাদেরকে বাধা দেয়। তখন এদিকে জাহাজে লাগানাে মাইন ধুম ধুম শব্দে ফুটতে শুরু করেছে। জাহাজের ভেতর তখন হৈ-হুল্লোড় চিৎকার শুরু হয়ে গেছে। দু’ধার থেকে তখন প্রহরাবাহিনী নদীর মধ্যে অজস্র গুলি ছুঁড়তে আরম্ভ করেছে। আমার দল তখন গুলির মুখে টিকতে না পেরে ছত্রভঙ্গ হয়ে যে যার দিকে সম্ভব আত্মরক্ষার জন্য দ্রুত সরে পড়ে। অন্য দু’দলসহ আমরা ছয়জন তখন পদ্মা নদীর মুখে ‘গাজী জাহাজের সামনে বাধাপ্রাপ্ত হই। তখন আমি একটা বার্জ-এর গা ধরে কিছু সময় নিজেকে লুকিয়ে রাখি। প্রায় ভাের হয়ে আসছিল।
এদিকে জাহাজও আর সরে না, আমরাও আমাদের পথ চলতে পারি না। কিছু সময় অপেক্ষা করার পর আমার দলের শেষে লাগানাে একটি মাইন জেটির কাছে বিস্ফোরিত হয় এবং গাজী’ তাড়াতাড়ি পদ্মার মুখ পার হয়ে এক পাটক্ষেতের পাশে ঢুকে পড়ি। ততক্ষণে সকাল হয়ে গেছে। আমরা তখন ৬জন মাত্র একত্রে আছি, বাকী যে যার মতাে পেরেছে নিজেকে বাঁচানাের জন্য ছুটে গেছে। পূর্বনির্দেশ মােতাবেক যেখানে আমাদের নৌকায় উঠানাের কথা ছিল সেই পূর্বনির্ধারিত স্থানে নৌকা না পাওয়ায় আমরা সবাই বিমূর হয়ে পড়ি। আমাদের তখন শূন্য হিত, কোন অস্ত্র নেই। আছে শুধু সাঁতার কাটার জন্য পায়ে ফিন। এ অবস্থায় আমি তখন দলবলসহ এক পাশের বাড়িতে গিয়ে উঠি এবং জোরপূর্বক এক নৌকায় উঠে বসি। নৌকার মালিক আমাদের দেখে জোরে চিৎকার দেয়। আমরা নৌকা নিয়ে অল্প কিছুদূর গিয়ে মাত্র এমন সময় চারদিক থেকে আমাদের প্রায় ১০০ নৌকা ঘিরে ফেলে। নৌকাগুলি ঐ সময় নদীতে ইলিশ মাছ ধরছিল। মাঝিরা আমাদেরকে ঘেরাও করে আমাদের দিকে আসতে থাকে। নিকটে আসার পর আমাদের অবস্থা বুঝতে পেরে আমাদেরকে ডুবুরী বলে চিৎকার দেয় এবং আমাদেরকে হিন্দুস্থানী বলে চিহ্নিত করে। আমার নৌকা প্রায় ধরা পড়ার উপক্রম। সামনে-পিছনে সবদিকে পথ বন্ধ। সব নৌকার মাঝিরা চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে। তখন দিনের আলাে, আমাদেরকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এমন সময় আমার মাথায় উপস্থিত বুদ্ধি খেলে যায়। আমি আমার ছেলেদেরকে সবগুলি ফিন উপরের দিকে উঁচিয়ে ধরতে বলি। যে বলা, সেই কাজ।
আমি তখন চিৎকার করে বলি, আমাদের পথ ছাড়, নতুবা আমরা তােমাদেরকে গুলি করে মেরে ফেলব । আমার হাতে টর্চ লাইট থাকায় সেটা তাদের দিকে উঁচিয়ে ধরি এবং পথ ছাড়তে বলি। ওদিকে অনবরত চাঁদপুর বন্দরে আমাদের লাগানাে মাইন ফাটা আরম্ভ হয়েছে। আমি তাদেরকে ভয় দেখিয়ে বলি, ঐ যে শব্দ শুনতে পাচ্ছ আর এই যে আমাদের কাছে বােমা দেখছাে, এটা তােমাদের উপর ছেড়ে দেব। যেমন বলা, আর যায়  কোথায়, সবাই তখন নৌকা নিয়ে যে যার দিকে পালাতে শুরু করল। এর ফলে আমরা নৌকা বদল করে নানা নামক এক ছেলের অন্য এক নৌকায় উঠি। পরে শুনতে পাই, আমাদেরকে সাহায্য করার জন্য ছেলেটিকে পাকবাহিনী গুলি করে মেরে ফেলে। এরপর আমি সােজা পশ্চিম দিকে নৌকা চালিয়ে কলমচোরা গ্রামে গিয়ে উপস্থিত হই। ওখানকার চেয়ারম্যান দেওয়ান সাহেব তার বাড়িতে দুপুর বারােটার সময় আমাদের খাবারের ব্যবস্থা করেন। ক্ষুধায় আমাদের তখন জান বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। আমাদের পরনে তখন মাত্র একটা জাংগিয়া ছাড়া আর কিছু ছিল না। অবশ্য তিনি আমাদের প্রত্যেককে একখানা করে লুঙ্গি দিয়েছিলেন। আর কাউকে বা গেঞ্জী, আর কাউকে বা শার্ট। আমরা খাওয়ার সময় সংবাদ পাই যে, আমাদেরকে ধরার জন্য পাকসেনা ও বেশকিছু রাজাকার আমাদের দিকে আসছে। এমতাবস্থায় আমরা তাড়াতাড়ি কিছু নাকে-মুখে দিয়ে ওখান থেকে সরে পড়ি। সন্ধ্যায় স্টুয়ার্ড মুজিবুর রহমানের বাড়িতে গিয়ে উঠি এবং রাত্রি যাপন করি অন্য এক বাড়িতে। সারারাত কোন রকমে অনিদ্রায় কাটিয়ে দিই। সকাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি ছেলেদের খোজে বের হই। অনেক খোঁজাখুঁজির পর দু’জনের দেখা পাই এবং তাদেরকে সঙ্গে করে আমি চলে আসি সফরমানি গ্রামে ইব্রাহিম সাহেবের (হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক) বাড়িতে।
এসে শুনতে পাই গতকাল চাঁদপুর বন্দরে যে অভিযান চালানাে হয় তার জন্য মাস্টার সাহেবকে পাকবাহিনী দায়ী করে এবং পরের দিন তাকে গুলি করে হত্যা করে। বাড়িতে যা কিছু মালামাল ছিল সব লুট করে নিয়ে যায়। নারী নির্যাতন করতেও ছাড়েনি। ঘটনা শুনে মনে ভীষণ ব্যথা পাই এবং প্রতিজ্ঞা করি যে, এর প্রতিশােধ নেবই নেব-খােদা যদি বাঁচিয়ে রাখেন। মাস্টার সাহেবের দুই ছেলে সাজু ও নিলুসহ আমি আমাদের শিবির আগরতলায় যাওয়ার জন্য তৈরি হতে থাকি। এমন সময় আরও দু’জন বিমান বাহিনীর লােক আমার সঙ্গে যােগ দেয়।  শিবিরে এসে শুনতে পাই আমি পাকসেনাদের হাতে ধরা পড়েছি এবং তাদের নিকট আত্মসমর্পণ করেছি। এই খবর পাকিস্তান রেডিও জোরে ফলাও করে প্রচার হয়েছিল। অবশ্য প্রথম অভিযানের দীর্ঘ ১১দিন আমার কোন রকম খোজখবর ছিল না। এতে আমার শিবিরের সকলের মনে দারুণ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল। আমার আগমনে সবাই একসঙ্গে হর্ষধ্বনি দিয়ে আমাকে ঘাড়ে উঠিয়ে আনন্দে হাততালি দিতে শুরু করল। দু’দিন যেতে না যেতে আমার ডাক পড়ে কলকাতা ফিরে যাওয়ার জন্য। আমাকে বােমারু বিমানে করে কলকাতা নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে এসে শুনতে পেলাম অন্যান্য নৌ-অভিযানের মধ্যে সবচাইতে বেশি জাহাজ চাদপুরে ডুবেছিল। এবং চাদপুরের সংবাদ বিবিসি সংবাদ সংস্থা পর্যন্ত পরিবেশন করেছিল। (সূত্র : কমান্ডো বদিউল আলমের স্মৃতিচারণ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, অষ্টম খন্ড)

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!