You dont have javascript enabled! Please enable it!
চট্টগ্রাম বন্দর অপারেশন

১০ই আগষ্ট, ১৯৭১। গােধূলি লগ্নের ঠিক পরই কমাণ্ডো গ্রুপগুলি নগ্নপদে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। তাদের পরণে ছিল ছেড়া সার্ট, লুঙ্গি। যাত্রার পূর্বেই সকলে চলার পথের সঠিক নির্দেশনা সম্পর্কে অবহিত হয়েছিলেন মুক্তিযােদ্ধা গাইডের মাধ্যমে। এই সকল গাইডরা অভ্যন্তরের নিরাপদে চলার পথ, শত্রু সৈন্যদের গতিবিধি এবং পথে নিরাপদ আশ্রয়স্থল সম্পর্কে সঠিক ও নির্ভুল খবরাখবর রাখতেন। ফ্রান্স থেকে এসে স্বাধীনতা যুদ্ধে যােগদানকারী সাবমেরিনারগণ আগষ্টের প্রথম কমাণ্ডো হামলার সর্বোচ্চ নেতৃত্বে ছিলেন। তাদের অধীনে উপ-কমাণ্ডে ছিলেন কমণ্ডোদের দল নেতারা। চট্টগ্রাম বন্দরের অপারেশনকে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। কারণ বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ সামুদ্রিক বন্দর। এখানে নৌ-অবরােধ ছিল তাই অপরিহার্য। ফ্রান্স থেকে আগত সাবমেরিনারদের যিনি নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিলেন তার অধীনে ২০ জন করে তিনটি গ্রুপের লিডার নিযুক্ত হয়েছিলেন। তাঁরা হলেন ডাঃ মােহাম্মদ শাহআলম, মােহাম্মদ মজাহার উল্লাহ ও আবদুর রশিদ। যুদ্ধে অসাধারণ সাফল্য ও কৃতিত্বের অন্য আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী, শাহ আলম ও মজাহার উল্লাহ বীর উত্তম’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন। এছাড়া এ দলের আরও অনেক বিভিন্ন খেতাবে ভূষিত হয়েছেন। আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী বর্তমানে লেঃ কমাণ্ডার পদে নৌ-বাহিনীতে কর্মরত আছেন। মজাহার উল্লাহ চট্টগ্রামের সাধারণ সীমা কর্পোরেশন-এর খাতুনগঞ্জ শাখার এসিস্টেট ম্যানেজার হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। এবং ডাঃ শাহআলম দুরারােগ্য ক্যান্সার রােগে আক্রান্ত হয়ে ইহলােক ত্যাগ করেছেন।

বাংলাদেশ আগষ্টের প্রথম সমন্বিত ও সম্মিলিত কমাণ্ডে হামলা পরিচালনার সময় অপারেশনের সঠিক তারিখ ও সময়-এর গােপনীয়তা রক্ষা করার জন্য এক বিশেষ রকমের সংকেত প্রদান পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়। এই পদ্ধতিতে কলকাতা বেতরের একটি ফ্রিকোয়েন্সীতে নির্দিষ্ট সময়ে বেতারের সাধারণ অনুষ্ঠানসূচীতে ‘আমি তােমায় যাত শুনিয়াছিলাম গান কে যাবে শ্বশুর বাড়ি।’-এ দুটি বাংলা গান বাজানাের ব্যবস্থা নেয়া হয়। বেতারের ফ্রিকোয়েন্সী ও সময় শুধু মাত্র কমাণ্ডো দলনেতাদের পূর্বে জানিয়ে দেয়া হয়। প্রথম গানটি শুনলে বুঝতে হবে, সতর্ক হও, ৪৮ ঘন্টার অপারেশন এবং দ্বিতীয় গানে বুঝতে হবে, প্রস্তুতি নাও, ২৪ ঘন্টা পর নির্দিষ্ট সময়ে অপারেশন করতে হবে। উল্লিখিত বিশেষ সংকেত পদ্ধতিতে দলের সকল কমাণ্ডে ধরা পড়লেও উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর দৈহিক নির্যাতনেও যেন অপারেশনের তারিখ ও সময় প্রকাশ হয়ে না পড়ে। যুদ্ধকালে ওরকম ধরা পড়ার সম্ভাবনা সকল মুহূর্তেই ছিল। এই গানগুলি একই ফ্রিকোয়েন্সীতে পূর্ব নির্ধারিত সময়ে সকালে একবার ও বিকালে দ্বিতীয়বার বাজানাে হত এতে সুষ্ঠু যােগাযােগ এবং অপারেশনের তারিখ নিশ্চিত হত।
১৩ই আগষ্ট, ‘৭১ তারিখে চট্টগ্রাম বন্দরে অপারেশনের জন্য প্রেরিত তিনটি গ্রুপের মধ্যে ডাঃ শাহআলম ও মজাহার উল্লাহর গ্রুপটি পথে অসুবিধার সুমুখীন হলে তাদের পক্ষে আর প্রথম অপারেশনে যােগ দেয়া সম্ভব হয়নি। যা হােক এর একদিন পূর্বে অর্থাৎ ১২ই আগষ্ট কমাণ্ডোদের আনিত মাইন ও যাবতীয় অস্ত্রশস্ত্রের কিছু অংশ একজন বিএলএফ-এর যােদ্ধা জনাব আলম মিরেশ্বরাই-এর সমিতির হাট থেকে বিয়ের জন্য সাজানাে ভাড়া করা কারে শহরে নিয়ে আসেন। উল্লেখ্য, সমিতির হাটে একটি শরণার্থী হওয়া হিন্দু ভদ্রলােকের খালি বাড়িতে কমাণ্ডোরা একদিন আশ্রয় নিয়েছিলেন এবং যাবতীয় অস্ত্রশস্ত্র নিরাপদে রেখে চট্টগ্রাম শহরে জানে আলমকে ঐগুলি নিয়ে আসার জন্য সংবাদ প্রেরণ করেন। পূর্ব পরিকল্পনা মতে তিনি আনিত মাইগুলি আগ্রাবাদের হাজীপাড়াস্থ সবুজবাগে আবু সাইদ সর্দারের কাছে হস্তান্তর করেন। পরের দিন পুনরায় জানে আলম বাকী মাইনসহ অস্ত্রশস্ত্রগুলি আনার জন্য রাবেয়া ইঞ্জিনিয়ারিং-এর শাহজাহানসহ ওয়াপদার দুটি সিঁড়ি লাগানাে পিকআপ নিয়ে মীরেরশ্বরাই রওনা হন। পথে শাহজাহান সীতাকুন্ড পর্যন্ত পৌছে আর যেতে অস্বীকৃতি জানান ও তার চালিত পিকআপ সমেত ফেরত আসেন।  জানে আলম সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে অস্ত্রশস্ত্র বােঝাই করে শহরে নিন্তর করেন। পরের দিন ঐ ওয়াপদার গাড়িতে করেই মাইনগুলি নদীর ওপারে পার করার জন্য অভয়মিত্র ঘাট পর্যন্ত পৌঁছানাে হয়। ওয়াপদার তৎকালীন এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার আলতাফ হােসেন ও সিফ-ইন-চার্জ আবু তাহের নৌ-কমাণ্ডোদের অস্ত্রশস্ত্র বিহন করার জন্য দুটি পিকআপের ব্যবস্থা করে দিয়ে সেদিন যে ঝুঁকি নিয়েছিলেন তা প্রশংসনীয় এবং তাঁদের দেশপ্রেশ প্রশ্নাতীত। 
শহরের অবস্থা তখন খুবই খারাপ। পথে পথে হানাদার পাকিস্তানী সৈন্যদের তল্লাশি। সন্দেহ হিলেই গুলি। মুক্তিযােদ্ধাদের অতর্কিত হামলায় তারা দিশেহারা। একটা থমথমে ভাব। রাতের নিস্তব্ধতা ভাঙ্গে মুক্তিযােদ্ধাদের নিক্ষিপ্ত গ্রেনেড ইত্যাদির শব্দে। এ সময় হানাদার বাহিনীর অত্যাচার-উৎপীড়নও চরম রূপ ধারণ করেছিল এবং বাঙ্গালির ঘরে কোন যুবক ছেলের খোঁজ দিতে না পারলে ঘর জ্বালিয়ে দেয়া, যার ঘরে ইচ্ছে, ঢুকে মাবােনদের পেলে অত্যাচার করা, দিনের বেলায় অতর্কিত কোন পাড়ায় প্রবেশ করে হাঁসমুরগী, গরু-ছাগল ইত্যাদি লুট করা এমনি কত অত্যাচার এ স্বল্প পরিসরে যার বর্ণনা দেয়া অসম্ভব। কমাণ্ডোরা শহর থেকে ছদ্মবেশে দেশি ডিঙ্গি জাতীয় নৌকায় করে কর্ণফুলীর অপর পাড়ে চরে যান। তাঁদের ব্যবহৃত মাইন ও অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্রগুলি কাঁচা তরকারি দিয়ে ঢেকে নৌকায় করে পার করে নেয়া হয়। খুবই সতর্কতার সাথে ঐ সব পারাপার করানাে হয় হানাদার বাহিনীর নাকের ডগা দিয়ে। যা তারা কোন ক্রমেই টের পায়নি। যথাসময়ে কমাণ্ডো দলগুলি এবং তাদের অস্ত্রশস্ত্র নদীর ওপারে নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছে যায়। কমাণ্ডোরা অপারেশনের জন্য প্রস্তুত হতে থাকেন। নদীর ওপারে মাইনসহ যাবতীয় মালামাল পার করা এবং কমাণ্ডোদেরকে আশ্রয় দান ও অপারেশনের ব্যাপারে কালামিয়া সওদাগর, ডাঃ আইউব ও ইউনুছ সাধ্যাতীতভাবে সাহায্য সহযােগিতার হাত প্রসারিত করেছিলেন। ফলে কমাণ্ডারা স্থলভাগ অসুবিধার সম্মুখীন না হয়ে এ অপারেশন সাফল্যমণ্ডিত করতে পেরেছিরেন। কমাণ্ডো দলনেতারা ইতিমধ্যে রেকী করে অপারেশন।
করার নির্দিষ্ট জাহাজগুলির অবস্থান এবং অপারেশনের কৌশল ও প্রকৃতি ঠিক করে নেয়। ইতিমধ্যে ১৩ই আগষ্ট ও ১৪ই আগষ্ট ফ্রিকোয়েন্সী মারফত কমাণ্ডো দলনেতারা ওয়ার্নিং সিগন্যাল ও একশন জেনে যান। সুতরাং ১৫ই আগষ্ট, ‘৭১ বাংলাদেশে সর্ব প্রথম কমাণ্ডো অপারেশনের তারিখ নির্ধারিত হয়। প্রতীক্ষিত সময় এসে গেল। ১৫ই আগষ্ট, ১৯৭১। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে একটি বিশেষ স্মরণীয় দিন। আমাদের ঐতিহ্যমণ্ডিত সশস্ত্র যুদ্ধের উজ্জ্বলতম একটি দিন। কমাণ্ডোদের কষ্টকর প্রশিক্ষণের মাধ্যমে লালিত স্বপ্নকে বাস্তবে রূপদানের দিন। মধ্যরাতে কর্ণফুলীর ওপারে অপারেশনের ঠিক এক ঘন্টা পূর্বে কমাণ্ডোরা চূড়ান্ত প্রস্তুতি গ্রহণ করে। পরিকল্পনা মতে প্রতিটি টার্গেট করা জাহাজে তিনটি করে মাইন লাগানাের জন্য তিনজনের ছােট ছােট কমাণ্ডো দলে বিভক্ত হয়। বুকের উপর গামছা দিয়ে পাঁচ কেজি ওজন বিশিষ্ট লিপেট ‘মাইন বেঁধে দ্রুত সাঁতার কাটার জন্য দু’পায়ে ফিস্ লাগিয়ে সুইমিং কষ্টিউম পরিধান করে এবং হাতে একটি কমাণ্ডো ছুড়ি নিয়ে নিঃশব্দে কর্ণফুলীর পানিতে কমাণ্ডের ডুব দেয় টার্গেট করা প্রতিটি জাহাজ লক্ষ্য করে। কনকনে শীতের রাতে প্রতি তিনজনই হাত ধরাধরি করে কখনও ডুব দিয়ে, কখনও নাক ও চোখ ক্ষণিকের জন্য পানির উপরে তুলে পাকিস্তানী হানাদার সৈন্যদের সকল কড়া পাহারার ফাঁক গলে তারা টার্গেট করা জাহাজগুলির দিকে অগ্রসহ হয়। পলাশী প্রান্তরে ১৭৫৭ সালের অস্তমিত বাংলার স্বাধীনতা সূর্যকে পুনরুদ্ধারের শপথ এ সময় তাদেরকে দ্বিগুণ বেগে এগিয়ে নিয়ে যায়।
সমুদ্রে দীর্ঘদিন জাহাজ চলাচল করার ফলে জাহাজের গায়ে শক্ত আঠাল ময়লার আস্তরণ পড়ে। কালক্রমে ঐ ময়লার আস্তরণ কঠিন মরিচা জাতীয় পদার্থে রূপ নেয়। কমাণ্ডোদের ব্যবহৃত লিমপেট মাইনের সাথে শক্তিশালী চুম্বক লাগানাে থাকলেও যাতে মাইনগুলি সহজেই জাহাজের গায়ে লাগতে পারে তার জন্য মাইন লাগানাের নির্দিষ্ট স্থানটি ছুড়ি দিয়ে পরিষ্কার করে নিতে হত। চট্টগ্রাম বন্দরে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এ সময় সকল অবস্থানকারী জাহাজকে অধিক আলােকিত করে রাখার নির্দেশ দিয়েছিল। এবং তদনুসারে সকল দেশি-বিদেশি জাহাজ অত্যুজ্জ্বল আলােয় পানিতে ভাসছিল। আর নৌবাহিনীর গানবােটগুলি কিছুক্ষণ পরপর একবার উজানে আবার ভাটায় কড়া পাহারায় রাখছিল। এত আলােয় শত্রু সৈন্যের দৃষ্টি এড়িয়ে অপারেশন করা কত যে কঠিন ছিল তা তখনকার বন্দরের অবস্থা চক্ষে না দেখলে অনুমান করা যাবে না। হানাদার সৈন্যদের নজরে পড়া মাত্র আর রক্ষা ছিল না কমাণ্ডোদের। কারণ, পানিতে অবস্থানকালে সরাসরি যুদ্ধ করার মতাে কোন অস্ত্র বহন করা বা অস্ত্র চালানাে তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। দশ থেকে পনের মিনিটের মধ্যে সকলেই টার্গেট করা জাহাজগুলির কাছে পৌছে যান। পৌছেই দেখতে পান প্রতিটি জাহাজের উপর হানাদার সৈন্যরা প্রহরারত। কিঞ্চিৎও তখন টের করতে পারেনি।
তৎক্ষণাৎ কমান্ডোরা ডুব দিয়ে পানির ৬ ফুট পরিমাণ নিচে প্রতিটি জাহাজের গায়ে মাইন লাগানাের জায়গাগুলি ছুরি দিয়ে পরিষ্কার করে নেন। বুক থেকে। গামছা খুলে লিমপেটগুলি ভাসিয়ে দেন ঐ নির্দিষ্ট স্থানসমূহ। এখানে উল্লেখ্য, প্রতিটি মাইনের সাথে থাকত সলিউবল ফ্লাগ আর সেফটিপিন। পানিতে পিন খুলে দিলে সলিউবল ৪৫ মিনিটে গলে যেত। সলিউবল প্লগ গলে যাওয়ার সাথে সাথে মাইনের অভ্যন্তরে ডেটনেটর-এ আঘাত লাগত এবং মাইনকে প্রবলভাবে বিস্ফোরিত করত।  সেফটিপিন খুলে দিয়ে কমাণ্ডো গ্রুপগুলি নিঃশব্দে ডুব দিয়ে দ্রুত গতিতে সাঁতার কেটে নদীর পাড়ে শত্রুর নাগালের বাইরে চলে যেতে থাকে। চট্টগ্রাম বন্দরে প্রথম অপারেশনের সময় এদিন দুর্ভাগক্রমে একটি মাইন একটি জাহাজের গায়ে লাগানাের অল্পক্ষণের মধ্যে প্রচণ্ড শব্দে বিস্ফোরণের শব্দে শত্রু সৈন্যরা চকিত হয়ে এলােপাথাড়ি গুলিবর্ষণ করতে থাকে। কমাণ্ডোরা সকলেই তখন পানিতে। শত্রু সৈন্যদের টার্গেটহীন গুলি কমাণ্ডোদের আশে-পাশে পানিতে আঘাত করলেও সৌভাগ্যক্রমে তাদের কাউকে আঘাত করেনি। কারণ তখনও হানাদার বাহিনী আঁচ করতে পারেনি এ বিস্ফোরণ কিসের। সকলে নির্বিঘ্নে কুলে পৌছে উধ্বশ্বাস দৌঁড়ে দূরে তাদের নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান। একটু পরেই ঘটেছিল বিভীষিকাময় শব্দ আর ধ্বংসযজ্ঞ। গগনবিদারী অসংখ্য বজ্রপাত যেন চট্টগ্রাম বন্দরে একই সাথে পতিত হল। একটির পর একটি জাহাজ বিকট শব্দে কর্ণফুলীর শীতল জলে সলিল সমাধি রচনা করল। শহরের সকল ঘুমন্ত মানুষ বিছানা ছেড়ে কেঁপে উঠল। প্রলংয়ঙ্কারী শব্দে শেষ বিদায়ের কথা মনে করিয়ে দিল। চারদিকে বন্দর এলাকায় চাপা কান্নার শাের ভেসে উঠল। বন্দরের স্থলভাগের সশস্ত্র শত্রু সৈন্যরা তাড়াতাড়ি বাঙ্কারে প্রবেশ করে এলােপাথাড়ি গুলিবর্ষণ শুরু করে দিল। এখনই বুঝি তাদের মৃত্যু আসবে। সারারাত ধরে গুলিবর্ষণ করতে করতে তাদের শেষ বুলেটটিও যেন ফুরিয়ে যায় কিন্তু শত্রুর দেখা আর মেলেনি। চট্টগ্রাম বন্দরের এ অপারেশনে ৩২টি মাইন ব্যবহৃত হয়েছে এবং ১০টি দেশিবিদেশি। জাহাজ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। এগুলাের মধ্যে এমভি হরমুজ, এমভি, আল-আব্বাস বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। ধ্বংসপ্রাপ্ত জাহাজগুলিতে অস্ত্রশস্ত্র ও খাদ্যদ্রব্য বহন করা হয়েছিল।
চট্টগ্রাম বন্দরে প্রথম সাফল্যজনক এ অপারেশনের পর পরই বন্দর এলাকায় জনসাধারণের প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এ সময় যাকে সামনে পেয়েছে নির্দয়ভাবে প্রহার ও হত্যা করছে। পরদিন নদীর অপর পারে আনােয়ারা থানা এলাকায় প্রচুর গােলাবর্ষন করেছে। কত নিরীহ লােক যে তাদের এ অমানুষিক অত্যাচারে প্রাণ হারিয়েছে তা হিসেবে করে বলা যাবে না । কমাণ্ডোদের এ হামলার ফলে পাকিস্তানী বাহিনীর প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে যে অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হয়েছে আমাদের চূড়ান্ত বিজয় পর্যন্ত তার প্রভাব ছিল সুস্পষ্ট। পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যমে, সাময়িকী, বিশেষ ফিচার ইত্যাদিতে এ অপারেশন প্রধান শিরােনামে মর্যাদা লাভ করে। আর এদেশে স্বাধীনতার আশায় বসতি স্থাপনকারী মানুষেরা দ্বিগুণ অনুপ্রেরণা পায় এবং মুক্তিযােদ্ধারা পায় দারুণ উৎসাহ।
স্বাধীনতা যুদ্ধে নৌ-কমাণ্ডোদের আত্মত্যাগ ও দেশপ্রেম তাদেরকে গৌরবময় দুঃসাহসিকতা পূর্ণ অপারেশনের মাধ্যমে সার্থক বীরের মর্যাদা দান করেছে। এ অদ্বিতীয়। কৃতিতু শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা পৃথিবীতে বিপুলভাবে প্রশংসিত হয়েছে। চট্টগ্রাম, খুলনা, মংলা ও নারায়ণগঞ্জে একই সময়ে প্রথম কমাণ্ডো হামলায় পাকিস্তানী বাহিনীর প্রচুর ক্ষতি সাধিত হয়েছে। বাংলাদেশে তাদের মনােবল একেবারেই ভেঙ্গে গেছে। বন্দরগুলির চলাচল পথে ধ্বংসপ্রাপ্ত জাহাজগুলাে ডুবে থাকায় বন্দর দিয়ে অস্ত্রশস্ত্র, সৈন্য ও খাদ্যদ্রব্য আনয়ন বন্ধ হয়ে যায়। বিদেশি জাহাজগুলাে বন্দরে প্রবেশ করতে অস্বীকৃতি জানায়। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যেও প্রতিরােধের সৃষ্টি হয়। এরপরও নৌ-কমাণ্ডোর সারাদেশে অনেক সার্থক অপারেশন করে চূড়ান্ত বিজয়ের জন্য বাঙালি জাতির যুদ্ধজয়ের পথে নতুন গতি পথের সন্ধান দিয়েছি।  নৌ-কমাণ্ডোদের চট্টগ্রাম অপারেশনের সময় সর্বোতভাবে সাধ্যমতাে যারা সাহায্য ও সহযােগিতা করেছেন তাঁদের মধ্যে মাওলানা সৈয়দ আবু সাঈদ সর্দার, হাজীপাড়ার আবু,, ছাত্রনেতা হারিস, জালাল, রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে মইনউদ্দিন খান বাদল, আতাউর রহমান খান, কায়সার, ইউছুফ, ডাঃ আজিজুল হক, নাসিরাবাদের কাকলীর তাহের মাওলা সাহেব ও তাঁর স্ত্রী, আজিজুর রহমান, ইঞ্জিনিয়ার মতিন এবং আরও অনেকে। এদের সকলের সহযােগিতায় নৌ-কমাণ্ডো অপারেশন সার্থক ও সাফল্যমণ্ডিত হয়েছে। (সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে নৌ-কমান্ডো, মেজর রফিকুল ইসলাম, পিএসসি রচিত)

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!