শালদা নদী যুদ্ধ
শালদা নদী এলাকায় পাকসেনাদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর প্রচন্ড যুদ্ধ হয় সেপ্টেম্বরে। শালদা রেলওয়ে স্টেশন নানা দিক দিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান ছিল। এই স্টেশনের সঙ্গে চট্টগ্রাম, ঢাকা, কুমিল্লা ও সিলেটের রেল যােগাযােগ ছিল। খালেদ মােশাররফ শালদা রেলওয়ে স্টেশন দখল করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। পাকবাহিনীর ৩৩ বেলুচ রেজিমেন্টের সৈন্যরা কুটি ও কসবা এলাকায় প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করে। শালদা নদীর দক্ষিণে নয়নপুরে ৩০ রেজিমেন্ট অবস্থান করছিল। খালেদ মােশাররফের পরিকল্পনা অনুসারে ক্যাপ্টেন পাঞ্জাব এক কোম্পানী সৈন্য নিয়ে নয়নপুর সড়কের সন্নিকটে অবস্থান নিলেন। মেজর সালেক চৌধুরী সালদা নদী অতিক্রম করে শালদা রেলওয়ে স্টেশনের পশ্চিম গােডাউন এলাকায় অবস্থান নিলেন। ক্যাপ্টেন আব্দুল আজিজ পাশা প্রথম মুজিব ব্যাটালিয়ন কামান নিয়ে মন্দভাগে অবস্থান করছিলেন। সুবেদার জব্বার মর্টার সেকশন নিয়ে ব্যারেকের পিছনে অবস্থান করছিলেন। খালেদ মােশাররফ নিজে এই যুদ্ধের সার্বিক পরিচালনার ভার নেন। তখন সেপ্টেম্বরের শেষ সকাল। ৬টা বেজে ৩০ মিনিট। ক্যাপ্টেন পাশা প্রথম আর্টিলারীর গােলা নিক্ষেপ শুরু করেন এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মুক্তিবাহিনী চতুর্দিক থেকে পাকসেনাদের উপর আক্রমণ শুরু করে। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের মুখে পাকসেনারা নয়নপুর ছেড়ে শালদা রেল স্টেশন এলাকায় আশ্রয় নেয়। ক্যাপ্টেন গাফফারও বীর বিক্রমে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু মেজর সালেকের গােলা বারুদ শেষ হয়ে যাওয়ায় তিনি পেছনে সরে আসেন। শালদা স্টেশন দখল করতে মুক্তিবাহিনী ব্যর্থ হয়।
খালেদ মােশাররফ শালদা নদী রেল স্টেশন এলাকার দায়িত্ব ক্যাপ্টেন গাফফারের উপর অর্পণ করেন। ৮ই অক্টোবর পুনরায় পাকসেনাদের সাথে সংঘর্ষ শুরু হল। গাফফার শালদা নদী রেলওয়ে স্টেশন দখল করার জন্য নিম্নরূপ পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এক কোম্পানী সৈন্যকে ৪ প্ল্যাটুনে বিভক্ত করে শত্রুর উপর আঘাত হানতে থাকে। পাকসেনারা যখনই মুক্তিবাহিনীকে আক্রমণ চালাবে তখন মুক্তিবাহিনীর দুই কোম্পানী সৈন্য শালদা নদী স্টেশন আক্রমণ করবে। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী ৯ই অক্টোবর সকালে তিন দিক থেকে পাকসেনা অবস্থানের উপর আক্রমণ করা হয়। পাকসেনারা তাদের দুটো অবস্থান ছেড়ে অন্যত্র দুটি স্থানে অবস্থান গ্রহণ করে। সুবেদার বেলায়েত দ্রুত শালদা নদী অতিক্রম করে পাকসেনাদের পরিত্যাক্ত বাংকারে অবস্থান নেয়। ফলে পাকসেনারা বাজার এলাকা থেকে শালদা নদীর রেলওয়ে স্টেশনের সাথে সংযােগ হারিয়ে ফেলে এবং পেছনে সরে নয়নপুরে চলে যেতে বাধ্য হয়। শালদা নদী রেলওয়ে স্টেশন মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে। পাকবাহিনীর রেল স্টেশনটি পুনর্দখলের জন্য পাল্টা আক্রমণ করেও স্টেশন পুনর্দখল করতে পারেনি। ক্যাপ্টেন গাফফারের সাহসে মুগ্ধ হয়ে এবং বাহিনীর এই অভূতপূর্ব সাফল্যে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান কর্নেল (পরে জেনারেল ওসমানী) নীচের সংবাদটি প্রেরণ করেন।
কসবা গঙ্গা সাগর, আখাউড়া সাব সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন আয়েনউদ্দিন খালেদ মােশাররফের নির্দেশে কসবা দখলের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। কসবা এলাকায় পাকিস্তানীদের এক কোম্পানী সৈন্যের দৃঢ় প্রতিরক্ষা অবস্থান ছিল। ২২শে অক্টোবর ক্যাপ্টেন আয়েনউদ্দিন কসবা আক্রমণ করলেন। খালেদ মােশাররফ স্বয়ং পরিচালনা করছিলেন। পাকসেনাদের সাথে যখন মুক্তিবাহিনীর প্রচন্ড যুদ্ধ চলছিল ঠিক সেই সময় পাকবাহিনীর একটি সেলে প্রিন্টার খালেদ মােশাররফের মাথায় লাগে। ক্যাপ্টেন আয়েনউদ্দিন যুদ্ধ চালিয়ে যান এবং কসবা দখল করে নেন। খালেদ মােশাররফকে গুরতরভাবে আহত অবস্থায় হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত