You dont have javascript enabled! Please enable it! আখাউড়া যুদ্ধ - সংগ্রামের নোটবুক
আখাউড়া যুদ্ধ
একাদশ ইষ্টবেঙ্গল সিলেট অগ্রসরমান পাকসেনাদের গতি রােধ করে। মেজর নাসিম ৩০ শে নভেম্বর মুকুন্দপুর, হরষপুর ইত্যাদি এলাকা নিজ নিয়ন্ত্রণে এনে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেন। মেজর মতিন উত্তর পশ্চিমাংশে দ্বিতীয় ইষ্টবেঙ্গলকে পাকসেনারা যাতে আঘাত না করতে পারে সেজন্য দুই কোম্পানী সৈন্যসহ প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করেন। ৩০/৩১শে নভেম্বর রাত একটার সময় মেজর মঈল হােসেন চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন দ্বিতীয় ইষ্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট পাকসেনার অবস্থানের উ’র আক্রমণ চালায়। আজমপু: রেল স্টেশনের  উত্তরাংশ ১লা ডিসেম্বর ভাের ছ’টার মধ্যে মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। ঐদিন বেলা তিনটার মধ্যে আজমপুর রেল স্টেশনের দাক্ষিণাংশ মুক্তিবাহিনী দখল করে নেয়। ১লা/২রা ডিসেম্বর রাতে পাকসেনারা মুক্তিবাহিনীর উপর পাল্টা আঘাত হানে। মুক্তিবাহিনী এই আক্রমণে কিছুটা পিছু সরে আসতে বাধ্য হলেও পরদিন ২রা ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী আখাউড়া দখল করে। ৩রা ডিসেম্বর যখন পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে সর্বাত্বক যুদ্ধ শুরু হয় তখন এস ফোর্স অধিনায়ক লেঃ কর্নেল শফিউল্লাহ আখাউড়া অবস্থান করছিলেন। দুটি পাকিস্তানী সেনার জেট জঙ্গী বিমান আখাউড়ারায় মুক্তিবাহিনী অবস্থানের উপর আক্রমণ চালায়। ভারতীয় জঙ্গী বিমান পাল্টা আক্রমণ চালালে পাকিস্তানী জঙ্গী বিমানগুলাে পালিয়ে যায়। সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হলে ৪ঠা ডিসেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৫৭ মাউন্টেন ডিভিশন আখাউড়ায় এসে ‘এস’ ফোর্সের সঙ্গে মিলিত হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণের ফলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চার ব্রিগেড সৈন্য এখানে আত্মসমর্পন করে। আখাউড়া থেকে ভৈরব যাবার পরিকল্পনা করে। অপর দিকে এস ফোর্স সিলেটের মাধবপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল হয়ে ভৈরব যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
পরিকল্পনা মােতাবেক এস ফোর্স মাধবপুর হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরাইল পৌছয় ৮ই ডিসেম্বর এবং আশুগঞ্জ পৌছয় ৯ই ডিসেম্বর। তার আগে ৬ই ডিসেম্বর লেঃ কর্নেল শফিউল্লাহ সেক্টর কমাণ্ডার নুরুজ্জামানকে মনতলা, তেলিয়াপাড়া দখলের নির্দেশ দেন। ‘এস’ ফোর্সের একাদশ ইষ্টবেঙ্গল রেজিমেন্টকে সামনে অগ্রসর হতে নির্দেশ দেওয়া হয় এবং দ্বিতীয় বেঙ্গলকে তাদের অনুসরণ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। একাদশ বেঙ্গলকে চান্দুরার উত্তরাংশে একটি রােড ব্লক করতে নির্দেশ দেওয়া হয় যাতে সিলেট থেকে পলায়নের পর পাকসেনারা এদিকে না আসতে পারে। চান্দুরা থেকে সরাইল পর্যন্ত শত্রুমুক্ত রাখার জন্য একাদশ বেঙ্গলকে নির্দেশ দেওয়া হয়। মেজর সুবেদ আলী ভূঁইয়ার নেতৃত্বে একটি কোম্পানী চান্দুরার উত্তরাংশের রােড ব্লক করার জন্য অবস্থান গ্রহণ করে এবং ব্যাটালিয়নের অবশিষ্ট সৈন্যদের চান্দুরা থেকে সরাইল পর্যন্ত এলাকা শত্রুমুক্ত রাখার জন্য নিয়ােজিত করা হয়। | মেজর নাসিম তার সৈন্যদেরসহ পাইকড়া নামকস্থানে এসে পৌছলেন। মুক্তিযােদ্ধাদের চান্দুরা হয়ে শাহবাজপুর, সরাইল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া অভিমুখে অগ্রসর হতে নির্দেশ দেওয়া হয়। লেঃ নজরুল অগ্রবর্তীদলের অধিনায়ক হিসেবে তার কোম্পানী নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল। ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর তখন ইসলামপুরে। এখানে ‘এস’ ফোর্স অধিনায়ক লেঃ কর্নেল শফিউল্লাহ, ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক মেজর নাসিম ও মাত্র ৮/১০ জন সৈন্য অবস্থান করছিল।
৬ই ডিসেম্বর এখানে একটি দুর্ঘটনা ঘটে। মুক্তিবাহিনীর ব্যাপক আক্রমণের ফলে পাকসেনারা পশ্চাদপসরণ করছিল। যদিও চান্দুরা-মাধবপুরের মাঝামাঝি স্থানে মেজর সুবেদ আলী ভূঁইয়া তার বাহিনী নিয়ে রােড ব্লক করে অবস্থান করছিল তবুও পাকসেনারা একটি গাড়িতে করে তেলিয়াপাড়া থেকে মেজর ভুইয়াকে অতিক্রম করে চলে আসে। এই বিষয়টি মেজর ভুইয়া বা লেঃ কর্নেল শফিউল্লাহ জানতেন না। লেঃ কর্নেল শফিউল্লাহ গাড়িটা দেখে নিজেদের গাড়ি মনে করে থামাতে বললেন। গাড়ি থামলে দেখা গেল গাড়িতে পাকসেনারা বসে। গাড়ির সামনের আসনে বসা পাকিস্তানী সুবেদার লাফিয়ে নিচে নেমে লেঃ কর্নেল শফিউল্লাহকে জড়িয়ে ধরে ধ্বস্তাধস্তি শুরু করে। পাকসেনারা গাড়ি থেকে নেমে গুলিবর্ষন শুরু করে। মুক্তিযোেদ্ধার একটি দল পেছনে ছিল। অপর দলটি ততক্ষণে অনেক সামনে এগিয়ে গেছে। পেছনের মুক্তিযােদ্ধার দলটি সামনে চলে আসে এবং পাকসেনাদের সাথে হাতাহাতি যুদ্ধে লিপ্ত হয়। লেঃ কর্নেল শফিউল্লাহ অক্ষত অবস্থায় প্রাণে বেঁচে গেলেন। মেজর নাসিম ও ১১ জন সৈন্য গুরুতরভাবে আহত হলেন। দু’জন মুক্তিযােদ্ধা শহীদ হলেন। ১১ জন জীবিত পাকসেনা ধরা পড়ে। লেঃ কর্নেল শফিউল্লাহ, মেজর মতিন, মেজর আজিজকে সঙ্গে করে ৭ই ডিসেম্বর পাইক পাড়ায় অবস্থান নেন। মেজর মতিনকে একাদশ ইস্টবেঙ্গলের অধিনায়ক নিয়ােগ করা হয়।
ভৈরবে পাকবাহিনীর চতুর্দশ ডিভিশনকে ঘিরে রাখার জন্য এক ব্যাটালিয়ন মুক্তিবাহিনীকে রেখে লেঃ কর্নেল শফিউল্লাহ লালপুর হয়ে নৌকাযােগে নদী অতিক্রম করে রায়পুর পৌঁছনে ১২ই ডিসেম্বর। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে মুক্তিবাহিনী নরসিংদী পৌঁছায়। নরসিংদীতে ইতিমধ্যে ই ভৈরব থেকে হেলিকপটার যােগে ভারতীয় সৈন্য এসে পৌঁছে ছিল। ভারতীয় দুই ব্যাটালিয়নের একটি ছিল ৩১১ ব্রিগেডের মাইফেন ডিভিশনের, অপরটি ছিল ৭৩ মাউন্টের ব্রিগেডের। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৩১১ মাউন্টেন ডিভিশনের ১০ বিহার রেজিমেন্ট দুর্গাপুরের দক্ষিণে, ১৮নং রাজপুত রেজিমেন্ট তাল শহরে এবং দুর্গাপুরের মাঝামাঝি স্থানে প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করে। | পাকসেনারা ভৈরব থেকে অবিরাম গােলন্দাজ কামান থেকে গােলাবর্ষণ শুরু করে। ৯ই ডিসেম্বর আজবপুর ও দুর্গাপুরে অবস্থানরত মুক্তিবাহিনী অগ্রাভিযান অব্যাহত রাখে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ১৮ রাজপুত রেজিমেন্ট পাকিস্তানী ব্যুহ ভেদ করে আশুগঞ্জ প্রবেশ করে ১০ই ডিসেম্বর। এস’ ফোর্স ৩ নং সেক্টরের মুক্তিযােদ্ধারা ও ভারতীয় রেজিমেন্টের ১০ বিহার রেজিমেন্ট বিপুল বিক্রমে আশুগঞ্জ দখলের উদ্দেশ্যে লাফিয়ে পড়ে। এক স্কোয়ার্ডন ভারতীয় ট্যাংক এই যুদ্ধে অংশ নেয়। উপায়ান্তর না দেখে পাকসেনারা ভৈরবপুলের আশুগঞ্জ সংলগ্ন অংশটি ডিনামাইট দিয়ে ধ্বংস করে দেয়। পাকসেনারা ১০/১২ই ডিসেম্বর আশুগঞ্জ ছেলে ভৈরর চলে যায়। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ১৯তম পাঞ্জাব রেজিমেন্টের দুটি কোম্পানী হেলিকপ্টার যােগে ১১ই ডিসেম্বর নদীর অপর তীরে অবতরণ করে। ভারতীয় বাহিনীর ৭৩ মাউন্টের ব্রিগেড ও মুক্তিবাহিনীর এক ব্যাটালিয়ান সৈন্য ভৈরব ঘিরে রাখে।
অপর দিকে ৩১১ মাউন্টেন ব্রিগেড ও ‘এস’ ফোর্স ভৈরবকে পাশ কাটিয়ে নরসিংদীর দিকে অগ্রাভিযান অব্যাহত রাখে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৪নং জাঠ রেজিমেন্ট হেলিকপ্টার যােগে নরসিংদী পৌঁছয় এবং ৩১১ মাউন্টের ১০ নং বিহার ও ১৮ নং রাজপুত ব্যাটালিয়ান পায়ে হেঁটে নরসিংদী অভিমুখে অগ্রসর হয়। এস’ ফোর্সের দ্বিতীয় ইষ্টবেঙ্গল ও ৩ নং সেক্টরের মুক্তিযােদ্ধারা ১২ ই ডিসেম্বর রায়পুরা ও ১৩ই ডিসেম্বর নরসিংদী পৌঁছয়। | লেঃ কর্নেল সফিউল্লাহ দ্বিতীয় ইষ্ট বেঙ্গলকে সঙ্গে নিয়ে ভুলতা, মুরাপাড়া, রূপগঞ্জ হয়ে ঢাকার দিকে অগ্রসর হন। সেখান থেকে কোণাকুনিভাবে পায়ে হেঁটে রূপগঞ্জ দিয়ে বালু নামক স্থান হয়ে নদী অতিক্রম করে ১৪ই ডিসেম্বর ডেমরা পৌঁছন। এস’ ফোর্সের একটি অংশ ডেমরা পৌঁছলে অপর অংশ বাসাবাে অবস্থান করে। এই সময় ভারতীয় বাহিনীর ১০ নং বিহার রেজিমেন্ট রূপসী পৌঁছয়। ১৬ই ডিসেম্বর বেলা ১২টা পর্যন্ত ডেমরায় পাকসেনাদের সঙ্গে মুখােমুখি সংঘর্ষ অব্যাহত ছিল।
অপরদিকে সাড়ে বারােটার পর পাকিস্তানী কমাণ্ডার কর্নেল খিলজী মাতােয়াল নামক স্থানে পাকসৈন্যসহ আত্মসমর্পন করেন। এমন সময় খবর এল বাংলাদেশে মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর থেকে বিশেষ প্রতিনিধিসহ ভারতীয় ইষ্টার্ণ কমাণ্ডের অধিনায়ক লেঃ জেনারেল  জগজিৎ সিং অরােরা সাড়ে তিনটায় আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানীদের আত্মসমর্পন গ্রহণ করার জন্য ঢাকা বিমান বন্দরে অবতরণ করবেন। এস’ ফোর্স কমান্ডার লেঃ কর্নেল শফিউল্লাহ ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার সাবেক সিং ডেমরা থেকে পাকবাহিনীর একটি গাড়িতে করে ঢাকা বিমান বন্দরে যান। পাকবাহিনীর লেঃ জেনারেল নিয়াজী ও ভারতীয় বাহিনীর মেজর জ্যাকভসহ কয়েকজন অফিসার জেনারেল অরােরার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে জেনারেল অরােরা হেলিকপ্টার যােগে ঢাকা বিমান বন্দরে অবতরণ করেন। বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসাবে ছিলেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন (অবসরপ্রাপ্ত এয়ার ভাইস মার্শাল) এ কে খােন্দকার ও বাংলাদেশের সদর দপ্তরের কয়েকজন কর্মকর্তা। মেজর হায়দার ও কাদের সিদ্দিকী এই সময় উপস্থিত ছিলেন। যে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে ৭ই মার্চ বিকেলে আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হয়েছিল স্বাধীনতার বজ্র কণ্ঠ নয় মাসের রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের পর একাত্তরের ১৬ই ডিসেম্বরের পড়ন্ত বিকেলে ইতিহাসের আর এক অধ্যায় রচিত হল। পলাশীর প্রান্তরে যে স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয়েছিল, ১৯৫৭ খৃষ্টাব্দে, সেই স্বাধীনতা সূর্য বর্ণাঢ্য আলােকসজ্জায় নবতর শপথে বাংলার আকাশে উদিত হল। পৃথিবীর মানচিত্রে সংযােজিত হল স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত