You dont have javascript enabled! Please enable it!
তেলিয়া পাড়ার চা বাগানে
কর্নেল ওসমানী (পরবর্তীকালে জেনারেল) ৪ঠা এপ্রিল মেজর শফিউল্লাহর সদর দপ্তর সিলেটের তেলিয়াপাড়ায় আসেন। কর্নেল রব (পরবর্তীকালে মেজর নােবেল) ও মেজর খালেদ মােশাররফ ও অন্যান্য অফিসারবৃন্দ এই সময় উপস্থিত ছিলেন। রাজনৈতিক সমর্থন, সরকার গঠন ও গােলা বারুদ সংগ্রহ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ আলােচনা হয়। ৩রা এপ্রিল মেজর জিয়াউর রহমান তেলিয়াপাড়ায় এসে মেজর শফিউল্লার সঙ্গে সাক্ষাত করেন। মেজর জিয়াউর রহমানের সৈন্য ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়ায় মেজর শফিউল্লাহর কাছ থেকে এক কোম্পানী এবং মেজর খালেদের কাছ থেকে এক কোম্পানী সৈন্য নিয়ে তাঁর সদর দপ্তরে ৪ঠা অথবা ৫ই এপ্রিল ফিরে যান। পাকবাহিনীর ৩১তম বেলুচ রেজিমেন্ট নরসিংদীতে অবস্থিত মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের উপর ৮ই এপ্রিল ভোের ছটায় আক্রমণ শুরু করে। মুক্তিযােদ্ধারা রাস্তার দু’পাশে ৪ টি এলএমজি নিয়ে পাকবাহিনীকে এ্যামবুস করে। এতে আনুমানিক ১৫৫ জন পাকসেনা নিহত হয়। অতর্কিত হামলায় পর্যুদস্ত হওয়ায় পাকবাহিনী পশ্চাদপসরণ করে। পাকসেনারা পুনরায় ৯ই এপ্রিল বােমারু বিমান ও গােলন্দাজ বাহিনীর সমর্থনে মুক্তিবাহিনীর উপর আক্রমণ করে।
সারাদিন যুদ্ধ চলার পর মুক্তিযােদ্ধাদের গােলাবারুদ প্রায় নিঃশেষ হওয়ার ফলে তাঁরা পিছু হটে আশুগঞ্জে এসে অবস্থান গ্রহণ করে। মুক্তিবাহিনী ১৩ই এপ্রিল ভৈরব রামনগর সেতুর কাছে প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করে। কিন্তু ১৩ই এপ্রিল পাকবাহিনী একযােগে বিমান হামলা ও কামানের গােলা নিক্ষেপ করতে থাকে। হেলিকপ্টার যােগে দুই কোম্পানী সৈন্য মেঘনার পূর্ব তীরে অবতরণ করে। কয়েক ঘণ্টা তুমুল সংঘর্ষের পর মুক্তিযােদ্ধারা নদী অতিক্রম করে তেলিয়াপাড়া পৌঁছয়। | অপর দলটি সুবেদার ফরিদের নেতৃত্বে ময়মনসিংহ হয়ে মধুপুর পৌছায় এবং সুবেদার জিয়াউল হকের বাহিনীর সাথে মিলিত হয়। সুবেদার জিয়াউল হক মধুপুর গড়কালীহাতি পুল জামরুকী এলাকায়, সুবেদার আবদুল হাকিম জামালপুর মহকুমা (ধনবাড়ী, জগন্নাথগঞ্জ ঘাট ও বাহদুরাবাদ ঘাট পর্যন্ত) এবং সুবেদার আজিজুল হক নেত্রকোনা ও কিশােরগঞ্জ মহকুমার পাকবাহিনীর মােকবিলা করে। এ সময় মেজর শফিউল্লাহ ভারতীয় বিএসএফ কর্মকর্তাদের সঙ্গে যােগাযােগের জন্য ক্যাপ্টেন আজিজকে পাঠান।
আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ সর্বজনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম, রফিউদ্দিন ভূঁইয়া, সৈয়দ আবদুস সুলতান, আবদুল মান্নান ও ক্যাপ্টেন আজিজ ভারতীয় বিএসএফ অফিসারদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীকে অস্ত্রশস্ত্র গােলাবারুদ দিয়ে সাহায্য করার বিষয়ে বেশ কয়েক বার বৈঠকে মিলিত হন। | সুবেদার জিয়াউল হক পাকসেনাদের প্রতিহত করার জন্য কালিহাতি সেতুটি ধ্বংস করতে গেলে পাকসেনাদের সাথে সংঘর্ষ হয়। মধুপুর সেতুটিকে ১৪ই এপ্রিল ধ্বংস করা হয়। সুবেদার জিয়াউল হক মুক্তাগাছায় তার বাহিনীকে স্থানান্তর করে। ১৪ই এপ্রিল থেকে পাকসেনারা মুক্তাগাছ, রসুলপুর, ঘাটাইল, জামালপুর, গফুরগাও ও ময়মনসিংহ এলাকায় এমন বেপরােয়া আক্রমণ চালাতে থাকে যে, একান্ত বাধ্য হয়ে মে মাসের প্রথম দিকে ভারতের বাংলা, ঢালু ও যুরাঘাসিয়ায় অবস্থান গ্রহণ করে। | লেঃ মাের্শেদ ১৪ই মে মাধবপুরে পাকসেনাদের এ্যামবুস করেন। মাত্র ১২ জন মুক্তিযােদ্ধা নিয়ে রাত দু’টোর সময় ব্রাক্ষণবাড়িয়া-সিলেট সড়কের বিকল্প পথে ট্যাংক বিধ্বংসী মাইন পুতে চুপচাপ অপেক্ষা করতে থাকেন। অন্ধকার রাত্রি ঝম ঝম করে বৃষ্টি হচ্ছিল। অন্ধকারের মধ্যে মুক্তিযােদ্ধারা বৃষ্টিতে ভিজে শত্রুদের অপেক্ষা করতে লাগল ।
পরদিন সকাল ৮টা পর্যন্ত পাকসেনাদের গাড়ি ঐ পথে না আসায় লেঃ মাের্শেদ তার সৈন্যদের নিয়ে বিশ্রামের জন্য পাশের গ্রামে যান। কিছুক্ষণ পরে পাকসেনাদের একটি কনভয় সিলেট থেকে ঢাকার দিকে যাচ্ছিল। প্রথমে একটি জীপ ও পরে একটি তিনটন ট্রাক মাইন ফেটে বিধ্বস্ত হয় এবং বেশ কিছু সৈন্য হতাহত হয়। ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান নালুয়া চা বাগানে সিলেট সড়কের উপর পাকসেনাদের এ্যামুস করে। এই এ্যামবুসে পাকবাহিনীর দুটি গাড়ি ধ্বংস, দুটি গাড়ি বিকল ও ৬৫ জন পাকসেনা নিহত হয়। পাকসেনাদের ১৬ই মে তারিখে তেলিয়াপাড়ায় আবার এ্যামবুস করা হয়। এই এ্যামবুসে ৪০ জন পাকসেনা নিহত হয়। নালুয়া চা বাগানের নিকট পাকসেনাদের সাহায্যার্থে চুনারঘাট থেকে কিছু পাকসেনা আসে এবং সম্মিলিত ভাবে তারা ব্রাক্ষণবাড়িয়ার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ক্যাপ্টেন মতিন তার বাহিনী নিয়ে তেলিয়াপাড়ায় পাকসেনাদের উপরে অতর্কিতভাবে আক্রমণ চালান। এই ভয়াবহ যুদ্ধে পাকবাহিনীর একটি গাড়ি ধ্বংস ও ৪০জন সৈন্য নিহত হয়। তেলিয়াপাড়ায় মুক্তিযােদ্ধারা ১৯শে মে পুনরায় পাকসেনাদের হতাহত করে। লেঃ মাের্শেদ ১৫ জন মুক্তিযােদ্ধাসহ তেলিয়াপাড়া চা বাগানের সন্নিকটে সিলেট সড়কে ট্যাংক বিধ্বংসী মাইন বসিয়ে পাকসেনাদের অপেক্ষা করছিল। অগ্রসরমান পাকসেনাদের দুটি গাড়ি বিধ্বংস হওয়ায় পাকসেনারা গাড়ি থেকে পড়ে এবং সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর মেশিনগান এক সঙ্গে গর্জে ওঠে।
এই আক্রমণে প্রায় এক কোম্পানী পাকসেনা নিহত হয়। প্রথাগত যুদ্ধ ছাড়াও এই সেক্টরে গেরিলা বাহিনী রায়পুরা, নরসিংদী, কাপাসিয়া, মনােহরদী, কুলিয়ারচর, কুটিয়াদী ইত্যাদি এলাকায় গেরিলা যুদ্ধ অব্যাহত রাখে। পাকবাহিনীর এক কোম্পানী সৈন্য ট্রেন যােগে আখাউড়া থেকে মুকুন্দপুর হয়ে হরষপুর যাচ্ছিল। লেঃ মাের্শেদ মুকুন্দপুর ও হরষপুরের মাঝামাঝি রেল লাইনে ট্যাংক বিধ্বংসী মাইন বসিয়ে ১৩/১৪ই সেপটেম্বর রাতে অপেক্ষা করতে থাকে। ইঞ্জিন-এর সামনে দুটি মালগাড়ি বগী পার হয়ে যাবার পর ইলেকট্রিক ডেটোনেটরের মাধ্যমে মাইন বিস্ফোরণ ঘটান হয়। দু’জন পাক অফিসারসহ ২৭ জন পাকসেনা নিহত হয়। ইঞ্জিনসহ বেশ কয়েকটি বগী সম্পূর্ণ রূপে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। | ক্যাপ্টেন আজিজের নেতৃত্বে ২৪শে সেপটেম্বর কালেংগা জঙ্গলে পাকসেনাদের উপরে হামলা চালিয়ে একজন অফিসারসহ ৬১ জন পাকসেনাকে হত্যা করে। মুক্তিবাহিনীর সাফল্যে উত্তেজিত হয়ে নায়েক মান্নান দাঁড়িয়ে জয় বাংলা’ বলে চিৎকার করতে থাকে। তারপর জীবিত পাকসেনা ধরে আনার জন্য শক্রর অবস্থানের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ফলে এত সাফল্যের মধ্যেও পাকসেনার বুলেটে এই সাহসী মুক্তিযােদ্ধা শহীদ হন।
সেপটেম্বর মাসের প্রথমে সপ্তাহে মেজর শফিউল্লাহ হেজামারায় তার সদর দপ্তর স্থানান্তর করেন। সেপটেম্বর মাসেই বাংলাদেশ বাহিনীর সদর দপ্তর থেকে ‘এস’ ফোর্স গঠনের নির্দেশ এলেও অক্টোবরে গঠিত হয়। মেজর শফিউল্লাহ কিছুদিন ‘এস’ ফোর্স ও তিন নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক ছিলেন। পরে ‘এস ফোর্সকে তিন নম্বর সেক্টর থেকে আলাদা করা হলেও বস্তুতঃ মেজর সফিউল্লাহ ‘এস’ ও তিন নম্বর সেক্টরের অপারেশন পকিল্পনার ক্ষেত্রে একক দায়িত্ব পালন করেছেন। | ৩রা ডিসেম্বর পাকিস্তান বিমান বাহিনী অমৃতসর, জোধপুর ও আগ্রায় বিমান হামলা চালিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে অঘােষিত যুদ্ধের সূচনা করে। ৩০ শে নভেম্বর থেকে ১লা ডিসেম্বর পর্যন্ত এস ফোর্স পাকবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। এ যুদ্ধে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল, একাদশ ইষ্টবেঙ্গল ও ৩নং সেক্টরের দুটি কোম্পানীকে নিয়ােগ করা হয়।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!