কেয়ারগাতি বড়দল ইউনিয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রাম। আশাশুনি থানা ও বড়দল বাজারের মধ্যবর্তী স্থানে মরিচ্চাপ নদীর টোটায় এই গ্রামের অবস্থান। এখানে আশরাফ উদ্দীন মকবুল নামে এক ধনী মুসলীম নেতার বাস। তিনি বড়দল ইউনিয়নের চেয়ারম্যানও ছিলেন। তার দোতালা বাড়িকে কেন্দ্র করে এখানে গড়ে ওঠে অত্যাচার আর অনাচারের শীর্ষবিন্দু। যখন শরণার্থীরা এই পথে ভারতের বুকে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে চৌদ্দপুরুষের ভিটামাটি ফেলে চলে যাচ্ছিল, তখন তাদের নৌকার বহর এবং ডাঙ্গাপথের কাফেলাকে এখানে থামিয়ে তাদের সর্বস্ব কেড়ে নেয়া হত। তাদের কথা ছিল, ‘পাকিস্তানের সম্পদ তারা কেন পাচার করে ভারতে নেবে?’ এই পথই ছিল ভারতে যাওয়ার সহজ এবং একমাত্র নদীপথ। তাই বাগেরহাট, রামপাল, মােরেলগঞ্জ, দাকোপ, বাটিয়াঘাটা, পাইকগাছা, আশাশুনি থানাসহ আরাে অন্যান্য এলাকার লােকজন এই নদী পথ ব্যবহার করত। দিবারাত্র হাজার হাজার নৌকা যােগে লক্ষ লক্ষ আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা শান্তি কমিটির লুটেরা রাজাকারদের অত্যাচার ও হানাদারবাহিনীর নৃসংশতা এড়ানাের জন্য তারা এই সহজ নদী পথে ভারতের দিকে যেত। কারণ এই নদী আশাশুনি, কালিগঞ্জ হয়ে ইছামতিতে মিশে গেছে। আর ইছামতি নদীই ভারত ও বাংলাদেশ এই দুটো রাষ্ট্রের সীমানা ঘােষণা করে বয়ে চলেছে। কেয়ারাগতির এই মােহনায় এলে জোরপূর্বক শরণার্থীদের নৌকা থামিয়ে তাদের নগদ অর্থকড়ি, সােনাদানা,অলংকার, কাপড় চোপড় যা কিছু শরণার্থীরা আনত সবই এখানে দিয়ে যেতে হত, এটা ছিল এখানকার একটি চেকপােষ্টের মতাে।
আবার কেউ কেউ আমাদের অস্ত্রশস্ত্রে হাত দিয়ে স্পর্শ করল। অনেকেই জীবনে প্রথম মুক্তিবাহিনী দেখে অত্যন্ত পুলকিত হল এবং আল্লাহর দরবারে আমাদের সফলতার জন্য দু’হাত তুলে মােনাজাত করল। সম্ভবতঃ এই সময় কোন রাজাকারদের চর অথবা তাদের আত্নীয়-স্বজন মুক্তিবাহিনীর আগমণের খবর রাজাকার ক্যাম্পে পৌছে দেয়। এই খবর পেয়ে রাজাকাররা ভয়ে দ্রুত অন্যত্র পালিয়ে যায়। আমরা এসে যখন ঐ বাড়ি আক্রমণ করি তখন শিকার পালিয়ে গেছে; অগত্যা এই বাড়ি পুনর্বার যাতে রাজাকাররা ব্যবহার করতে না পারে সে জন্য ঐ বাড়ি পুড়িয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেই । ঐ দিন এক দুর্ঘটনার হাত থেকে হরিঢালীর লতিফ আশ্চর্যজনকভাবে বেঁচে যায়। গাজী রফিকের দায়িত্ব ছিল যেন এই বাড়ি থেকে কেউ বের হয়ে পালিয়ে যেতে না পারে। কিন্তু লতিফ কোন সঙ্কেত না দিয়ে রফিকের সামনা দিয়ে হঠাৎ করে এমনভাবে যাচ্ছিল যে, রফিক মনে করে এই বাড়ির লােক বা রাজাকার পালাচ্ছে। অমনি সে গুলি করে, কিন্তু গুলি তার কানের নিকট দিয়ে চলে যায় এবং লতিফ বেঁচে যায়। তা নাহলে সেমসাইডে লতিফকে প্রাণ হারাতে হত। বাড়িতে লুটপাটের জিনিষে ভরা। প্রতি কক্ষে ছিল শরণার্থীদের পিতল-কাসা, কাপড়চোপড় ইত্যাদি, এমনকি হিন্দুদের পূজার সামগ্রী পর্যন্ত ছিল । কি আর করা যাবে শিকার না পাওয়ায় মনটা খারাপ, ছেলেরা আধা ঘন্টা যাবত খোঁজ করার পরও কাউকে না পাওয়ায় বাড়িতে আগুন দেয়া হয়। এই বাড়িতে একজন সম্ভবত পুড়ে মারা যায় এবং এক মহিলা তার স্বামীকে আগুনের মধ্যে থেকে বের করে। ছেলেরা তাদের মুক্তি দেয়। এইভাবে কেয়ারগাতির মকবুল চেয়ারম্যানের বাড়ির রাজাকার ঘাঁটির পতন ঘটে। রাজাকাররা পরে আর এই ঘাঁটি ব্যবহার করেনি। মুক্তিবাহিনী এই গুরুত্বপূর্ণ স্থানটি দখলে আনার পর এই অঞ্চলে গড়ে তােলে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ঘাঁটি। এই অভিযানে আমার সাথে অপারেশনে অংশ নেয় আবুল কালাম আজাদ, আবুবকর বাকু, আশাশুনির মনিরুজ্জামান, মান্নান, লখােলার আরশাদ প্রমুখ। (সূত্র : স্বাধীনতার দুর্জয় অভিযান, স, ম, বাবর আলী । )
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত