কাকডাঙ্গা যুদ্ধ
কাকডাঙ্গা সাতক্ষীরা মহকুমার কলারােয়া থানার ভারত সীমান্তের অতি নিকটে অবস্থিত। কাকডাঙ্গা, বেলেডাঙ্গা ও হঠাৎগঞ্জ পাশাপাশি অবস্থিত। পাকবাহিনীর শক্তিশালী ঘাটি এখানে, কারণ মুক্তিবাহিনীর শিবির বাংলাদেশের ভূখন্ডে, অন্য প্রতিরক্ষা ভারতীয় এলাকায়। মুক্তিযােদ্ধারা এখানে কখনও পাকবাহিনীর এই অবস্থানকে শান্তিতে নির্বিঘ্নে থাকতে দেয়নি। প্রতিদিন কোন না কোন ভাবে তাদের উপর আক্রমণ চলত। খানসেনাদের অতি মজবুত বাঙ্কার, ট্রেঞ্চ গড়ে ওঠে। পক্ষান্তরে কাকডাঙ্গা থেকে কিছু দূরে ক্যাড়াগাছিতে মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটি এবং ভারতীয় এলাকায় মূলঘাঁটি। এটা অবশ্য ৮ নম্বর সেক্টর মেজর মঞ্জুরের নেতৃত্বাধীন ছিল। এই এলাকায় খান সেনারা যেমন তৎপর ছিল, তেমনি তৎপর ছিল মুক্তিবাহিনী। এলাহী বক্স কমান্ডার নামে সর্বজন পরিচিত একযােদ্ধা ও তার সহােদর ভাই খানসেনাদের ত্রাস ছিল। জীবনের উপর বার বার ঝুঁকি নিয়ে ঐ পাকাসেনাদের প্রতিরক্ষা এলাকায় গেরিলা কায়দায় ঢুকে একটা কিছু তছনছ করে দিয়ে চলে আসতেন তিনি। সারাজীবন তিনি নিয়মিত আনসার কামান্ডার এবং সহােদর মহাজন সরদার আনছার বাহিনীর সদস্য। গােটা সাতক্ষীরা এলাকায় এলাহি বক্স কমান্ডার হিসেবেই তিনি। সুপরিচিত। একবার দিনের বেলা রেকি করতে গিয়ে হঠাৎগঞ্জ এলাকার আইচগােড়া গ্রামের আমবাগানে খানসেনারা এর ক্ষুদে দলকে ঘিরে ফেলে, তারা বেঁচে যান। কিন্তু তার ভাই খান সেনাদের হাতে ধরা পড়ে।
বহু কৌশল প্রয়ােগ করে ৩/৪ জন খান সেনা হত্যা করে চলে আসতে সক্ষম হন তিনি। একবার আগডদারীতে তার ভাই একরাম রেকি করতে গিয়ে কৃষক বেশে ধরা পড়ে। শত অত্যাচার সহ্য করেও সে মুখ খােলেনি । ১২দিন পর সে পুনরায় এসে চিকিৎসার পর মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেয়। চোরাগুপ্তা ঝটিকা আক্রমণই ছিল এলাহী বক্স কমান্ডারের রণকৌশল। কাকডাঙ্গায় পাকসেনা ও মুক্তিবাহিনীর মুখখামুখি অবস্থান মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বজায় ছিল। কখনও কিছুটা পাকবাহিনী পিছিয়ে আবার মুক্তিবাহিনী এগিয়ে গেছে। আবার কখনও প্রচন্ড যুদ্ধে পরাস্ত করে পুরােপুরি অপসারণ করতে পারেনি। তাই উভয় পক্ষ ছিল সতর্ক। অষ্টম সেক্টর কমান্ডার মেজর মঞ্জুর ক্যাপ্টেন মাহবুব, ক্যাপ্টেন শফিকউল্লাহ, এ আর চৌধুরী মিলিত হয়ে পাকসেনাদের উপর আক্রমণ চালানর সিদ্ধান্ত নিলেন। মেজর মঞ্জুর প্রতিরক্ষা পর্যবেক্ষণ করেন ও ছবি নেন। তারপর তিনি স্বয়ং এ যুদ্ধে অংশ নেন। পুরাে অষ্টম ও নবম সেক্টরে এ যুদ্ধ ছিল ঐতিহাসিক ও স্মরণীয়।
নায়েক সুবেদার ইমদাদুল হক, সুবেদার তাবারাক উল্লাহসহ নিয়মিত সৈন্যবাহিনীর সেনারা ও প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ে এ যুদ্ধ শুরু হয়। এ যুদ্ধ ছিল প্রচলিত নিয়ম মাফিক যুদ্ধ; উভয় পক্ষই ভারী কামান সমূহ অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র ব্যবহার করে; দীর্ঘ পাঁচদিন চলে এ যুদ্ধ। এ যুদ্ধের কামানের গর্জন সুদূর কোলকাতা থেকে এবং বাংলাদেশের খুলনা শহর থেকে পর্যন্ত শােনা যেত। রাতে এলাকার লােকজন ঘুমুত না, ত্রাসে আতঙ্কে সবাই সন্ত্রস্ত থাকত। এই যুদ্ধে কাট অফ পার্টির গুরুদায়িত্ব ছিল নায়েক সুবেদার ইসমাইলের নেতৃত্বাধীন দলের উপর। ক্যাপ্টেন মাহবুব, ক্যাপ্টেন শফিকউল্লাহ বিরাম বিশ্রামহীনভাবে যুদ্ধক্ষেত্রে থেকে সৈন্যদের নিয়ন্ত্রণ করেন, যুদ্ধ পরিচালনা করেন। সুবেদার তাবারাক উল্লাহ দুঃসাহসিক ভাবে যুদ্ধ করতে করতে অগ্রসর হন এবং সরাসরি পাকসেনাদের প্রতিরক্ষার ভেতরে প্রবেশ করেন, সাথে সাথে পাকবাহিনী তাকে ঘেরাও ধরে ফেলে। যুদ্ধের পঞ্চম দিনে নায়েক সুবেদার ইসমাইল হােসেন প্রচন্ড গােলাগুলির চাপের মুখে কাট অফ লাইন ত্যাগ করে সবার অজ্ঞাতে প্রত্যাহার করে চলে আসেন। খান সেনারা এই সুযােগে মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষা এলাকায় ঢুকে পড়ে। ফলে চরম বিপর্যয় দেখা দেয়। কিন্তু মেজর মঞ্জুরের দূরদর্শিতা, বিচক্ষণতা ও ক্যাপ্টেন মাহবুবের যুদ্ধপরিচালনা ও রণকৌশলের ফলে বিপর্যয় থেকে রক্ষা পান। পাকসেনারা প্রচন্ড চাপের মুখে কাকডাঙ্গা থেকে প্রত্যাহার করে হঠাৎগঞ্জে প্রতিরক্ষায় চলে যেতে বাধ্য হয়। মুক্তিবাহিনী সগৌরবে কাকডাঙ্গা দখল করে নিজস্ব ডিফেন্স আরাে মজবুত করে।
এই যুদ্ধে খানসেনাদের ১০/১২ জন এবং রাজাকারদের ২০/২৫ জন নিহত হয়। মুক্তিবাহিনীর পক্ষে একজন হাবিলদারসহ মুনসুর আলী, আকবর আলী শহীদ হয়, বীর যােদ্ধা তাবারক উল্লাহ ধরা পড়ে। কাকডাঙ্গা গ্রাম নিবাসী আফতাব সরদারের পুত্র মুনসুর আলী খানসেনাদের সেলিংএর আঘাতে মৃত্যুবরণ করেন। হালখালি গ্রামের ৩ জন লােককে খানসেনারা মুক্তিবাহিনীর গােয়েন্দা সন্দেহে নির্মম নির্যাতনের পর হত্যা করে। যুদ্ধ শেষ হয়েছে, স্বাধীনতা এসেছে, কাকডাঙ্গা যুদ্ধের স্মৃতি অমর। এ যুদ্ধে মেজর মঞ্জুর ও ক্যাপ্টেন মাহবুবের বীরত্ব গাঁথা আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের অমর কাব্য। কমান্ডার এলাহী বক্সসহ অন্যান্য যােদ্ধাদের নাম কি ইতিহাস আদৌ স্মরণ করবে? ( সূত্র ও স্বাধীনতার দুর্জয় অভিযান, স. ম. বাবর আলী।)
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত