You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ২৬শে ফেব্রুয়ারী, মঙ্গলবার, ১৪ই ফাল্গুন, ১৩৮০

রাষ্ট্রপতি সাদাতের বাংলাদেশ সফর

বাংলার অকৃত্রিম বন্ধু, আরব জাতীয়তাবাদের অন্যতম উদগাতা এবং আরব জগতের জাগৃতির প্রতীক মহান জামাল আব্দুন নাসেরের প্রিয়তম ও বিশ্বস্ত সহকর্মী মিসরের রাষ্ট্রপতি আনোয়ার সাদাত একদিনের সফরে বাংলাদেশের মাটিতে পদার্পণ করেছিলেন। মিশরীয় জনগণের শুভেচ্ছা, প্রীতি ও বন্ধুত্বের বাণী নিয়ে রাষ্ট্রপতি সাদাত বাংলাদেশ সফরে এসে এদেশের জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত প্রাণঢালা ভালবাসার পরিচয় পেয়েছেন। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ রাষ্ট্রপতি সাদাতের বাংলাদেশ সফরে আনন্দিত হয়েছেন। অভিভূত হয়েছেন। রাষ্ট্রপতি সাদাতের বাংলাদেশ সফর একটি স্মরণীয় ঘটনা। আরব রাষ্ট্রপ্রধানদের মধ্যে রাষ্ট্রপতি সাদাতই প্রথম বাংলাদেশ সফর করলেন।
মিশরে সঙ্গে বাংলাদেশের জনগণের আত্মিক সম্পর্ক আজকের নয়-দীর্ঘদিনের। পাকিস্তানি শাসনামলেও বাংলাদেশের জনগণ মনেপ্রাণে মিশরীয় জনগণের সর্বাঙ্গীণ উন্নতি কামনা করেছেন। মিশর সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিষাক্ত ছোবল থেকে পরিত্রান পেয়ে সুখে ও শান্তিতে বসবাস করুক এ প্রার্থনা এদেশের জনগণের। মিশরের নয়নমণি পরলোকগত রাষ্ট্রনায়ক নাসেরের জোট নিরপেক্ষ নীতিকে বাংলাদেশের জনগণ স্বাগত জানিয়েছে। মিশর ও বাংলাদেশের জনগণ একই চিন্তায় বিশ্বাসী। নির্যাতন, নিপীড়ন, সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের বিরোধী।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মিশর সরকার এগিয়ে আসেন সাহায্য সহযোগিতা ও বন্ধুত্বের হস্ত সম্প্রসারিত করে। অন্যদিকে আরব-ইসরাইল সংঘর্ষ শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গেই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আরবীয় জনগণের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন। ইসরায়েলি হামলার প্রতিবাদ করতে গিয়ে এগিয়ে আসেন সর্বপ্রথম। শুধু তাই নয়, ইসরাইলের সঙ্গে সংঘর্ষে মাতৃভূমির সম্মান ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় নিয়োজিত বীর সৈনিকদের জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে চা পাঠান। এ দান হয়তো প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সামান্য। কিন্তু এ উপহার ছিল বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রাণের স্পর্শে সঞ্জীবিত।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়ে যেকোনো কারণেই হোক না কেন ভুল বোঝাবুঝির কালো মেঘ সঞ্চিত হয়েছিল পারস্পরিক বন্ধুত্বের আকাশে। কিন্তু তাও বেশিদিন টিকে থাকেনি। বাস্তবতা উদ্ভাসিত হয়েছে সূর্য লোকের মতো। বাংলাদেশের বাস্তবতাকে পরবর্তী পর্যায়ে সকলে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন।
জাতির জনক ও বাংলার নয়নমণি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে যোগদান করার সময় তিনি আরব রাষ্ট্রনায়কদের সঙ্গে মিলিত হন। তাদের সামনে তুলে ধরেন বাংলাদেশের জন্ম ইতিহাস ও বাস্তবতাকে। স্বাধীনতা সংগ্রামের সূর্য সৈনিক বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনায় মিলিত হয়ে সকলেই সেদিন আসল সত্যকে মনেপ্রাণে উপলব্ধি করতে সক্ষম হন। জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে মিশরীয় রাষ্ট্রপতি আনোয়ার সাদাতও উপস্থিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু ও রাষ্ট্রপতি সাদাত সেদিন বন্ধুত্বের আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। এ আলিঙ্গন ছিল দু’টি দেশের দু’জন মহান নেতার মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতা ও বন্ধুত্বের আলিঙ্গন।
মিশর ও আরব বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্ব কত নিবিড়, কত অন্তরের স্পর্শে সিক্ত রাষ্ট্রপতি শাহাদাতের বাংলাদেশ সফরেই তার জ্বলন্ত প্রমাণ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশ স্বাধীন হবার আগে এবং পরে ঘোষণা করেছেন, সংগ্রামী আরবদের পাশে বাংলাদেশের মানুষ সব সময় ছিল, এখনো আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। এটা যে শুধুমাত্র কথা আর কথাই ছিল না বাংলাদেশের মানুষ তার পরিচয় সবসময়ই দিয়েছে এবং ভবিষ্যতেও দেবে। এ সত্যকে আরব বিশ্ব আজ উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন বলেই ইসলামীর শীর্ষ সম্মেলনের প্রাক্কালে আরবের নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশের বাস্তবতাকে শর্তহীনভাবে পাকিস্তান মেনে নিক এটাই কামনা করেছেন। পাকিস্তান আজ বাংলাদেশের বাস্তবতাকে মেনে নিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর ভাষায় বলতে গেলে সত্যের জয় হয়েছে অবশেষে।
রাষ্ট্রপতি আনোয়ার সাদাতের বাংলাদেশ সফরের মধ্যে মাধ্যমে দু,টো দেশের মধ্যে যে বন্ধুত্বের সেতুবন্ধ আরো সুদৃঢ় হলো এতে কোন সন্দেহ নেই। এই বন্ধুত্ব চির অক্ষয়, অমর হোক এটাই আমরা কামনা করি।

জাতীয় স্বার্থে পারস্পরিক সমঝোতা

সমঝোতার পথ পরিহার করে উত্তেজনা ও হিংসাত্মক পথ অবলম্বনের প্রবণতা একশ্রেণীর মানুষের মনে উদ্বেগজনক ভাবে দানা বাঁধছে। জাতীয় সমস্যাই শুধু নয় সামাজিক নানা সমস্যা এমনকি পারিবারিক মনোমালিন্য অবসানের জন্যও হিংসাত্মক পথ অনুসরণের নানা খবর দৈনিক খবরের কাগজগুলোতে ছাপা হচ্ছে। শান্তিকামী মানুষ এতে আশঙ্কিত হচ্ছে, নিরাপত্তার অভাব অনুভব করছে সাধারণ মানুষ। যে সমস্যার সমাধান রাজনৈতিকভাবেই করা সম্ভব অথবা যে সমস্যাগুলো পারস্পরিক আলোচনা এবং উপলব্ধির মাধ্যমে অত্যন্ত সহজ সরল ধারায় সমাধানের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব উত্তেজনাকর মোকাবেলার নীতি অথবা বলপ্রয়োগে সেই সমস্যাগুলিই প্রকট করে তুলছে।
একশ্রেণীর লোক রয়েছেন যারা বাঁকা পথে চলায় বিশ্বাসী। কেউবা আবার ব্যক্তি অথবা গোষ্ঠীস্বার্থে বাঁকা পথে চলার প্ররোচনা দিয়ে থাকেন। রাজনৈতিক সংগঠন ও নেতৃত্বের মধ্যে জল ঘোলা করে মাছ শিকারের একটা কৌশল অতীতকাল থেকেই অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।
স্বাধীনতা-উত্তরকালে আমরা জাতীয় ভিত্তিতে পারস্পরিক সমঝোতা ও উপলব্ধির মাধ্যমে জাতীয় লক্ষ্য অর্জনের সকল শ্রেণীর মানুষকে এভাবে এগিয়ে আসবার আহ্বান জানিয়েছিলাম। কিন্তু চক্রান্তকারী ও বিভেদ পন্থীদের মনে আমাদের সে আহ্বান সাড়া জাগাতে পারেনি। বিভেদ ও অনৈক্য সৃষ্টিতে তারা গোড়া থেকেই সাধারণ মানুষকে প্ররোচিত করে আসছিল। অর্থনৈতিক স্বার্থে নানা গোষ্ঠীর উদ্ভব হয়ে চলেছে, এবং তাদের মুখপত্র, হিসেবে অনেক রাজনৈতিক দল তাদের স্বার্থরক্ষায় নিরন্তর ক্রিয়াশীল রয়েছে।
সমস্যা কণ্টকিত দেশে সমাধানের কোনো পথ মিলবে না এমন কোন কথা নেই। প্রশ্নটি শুধু আন্তরিকতা ও উপলব্ধির। দাবি উত্থাপন করে স্বীয় গোষ্ঠীর স্বার্থে দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে একটা সমাধান খাড়া করলেই তা সর্বজনগ্রাহ্য হয়ে ওঠে না। সমাধান সেটাই গ্রহণীয় জাতীয় স্বার্থের অনুকূল।
সম্প্রতি একটি রাজনৈতিক সংগঠন ঘেরাও করে দাবি আদায় করবেন বলে প্রস্তাব নিয়েছেন। তারা বলেছেন, ঘেরাও করে বাধ্যতামূলকভাবে বিভিন্ন গোষ্ঠীকে নিজের স্বার্থ আদায় করে নিতে হবে। নইলে রয়েছে জ্বালিয়ে দেয়ার অস্ত্র। বলপ্রয়োগে নিজের স্বার্থ উদ্ধার অথবা ধ্বংস করে দেয়া-এর মধ্যে আর যা-ই থাকুক জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নটিই সম্পূর্ণরূপেই অনুপস্থিত। বলপ্রয়োগে যারা স্বীয় স্বার্থ উদ্ধারে বিশ্বাসী তারা জাতীয় স্বার্থের তোয়াক্কা করবেন এমনটি আশা করা যায় না। আর শেষ অস্ত্র যাদের জাতীয় সম্পদের সার্বিক ধ্বংসসাধন তারা জাতীয় শত্রু ছাড়া আর কোন ভাবেই আখ্যায়িত হতে পারে না।
গত রোববার ব্যাংক কর্মচারী ফেডারেশন ৪ঠা মার্চ থেকে তাদের দুই দফা দাবি আদায়ের জন্য অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট আহ্বান করেছেন। এ ধর্মঘটের রূপ চরিত্র কেমন হবে আমরা জানিনা কিন্তু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক সমূহ ধর্মঘট পালিত হলে দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় যে মারাত্মক সংকট নিয়ে আসবে সে দিকটা বিবেচনা করে কি সমঝোতার কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে? তা না করে চরমপন্থা গ্রহণের যারা ইন্ধন যোগাচ্ছে তারা জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নটি কতটুকু বিবেচনা করেছেন সেটাই আজ তলিয়ে দেখবার বিষয়।
আমাদের সামনে দৃষ্টান্ত রয়েছে চটকল ফেড়ারেশনের দূরদর্শিতা। কথা ছিল পহেলা মার্চ থেকে তারা ধর্মঘটে নামবেন। সমঝোতা এবং পারস্পরিক উপলব্ধি থেকে তারা সরে যায়নি। আলোচনা হয়েছে এমনকি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তারা তাদের দাবি-দাওয়া বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলেছেন। পারস্পরিক সমঝোতা ও জাতীয় স্বার্থের অনুকূলে তারা তাদের ধর্মঘট প্রত্যাহার করেছেন। আর এই ধর্মঘট প্রত্যাহার করার ফলে কি তাদের দাবি-দাওয়া সব লাটে উঠেছে? না! বরং সমঝোতা এবং আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে তাদের সমস্যা এবং সেই সমস্যা সমাধানের একটা জাতীয় স্বার্থানুকূল পথ খুঁজে পাওয়া গেছে। পাশাপাশি পোস্ট অফিস কর্মচারীদের ধর্মঘট আজ জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। উভয়পক্ষের অনমনীয় মনোভাবের দরুণ সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে। অথচ মূল ইস্যুতে সরকার ও ধর্মঘটী কর্মচারীদের মধ্যকার মতপার্থক্য বিস্তর নয়।
নিজেকে অথবা নিজ গোষ্ঠীকে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী থেকে আলাদা করে ভাববার পুঁজিবাদী মানসিকতা থেকে আমাদের পরিত্রান পেতে হবে।
কিন্তু সেই নূতন সমষ্টির সার্থকভাবে মানসিকতা অর্জনের দায়িত্ব কার? আমি দেশের জন্য ভাববো আর দেশের অপরের কথা ভাববে এমনটিও আশা করা যায় না। সমষ্টির চেতনা গড়ে তুলতে সরকার তথা রাষ্ট্রযন্ত্রকেও সেভাবে এগিয়ে আসতে হবে। সরকারকে মানুষের অভাব অভিযোগ সমস্যার গুরুত্ব অনুধাবন করতে হবে। একই সঙ্গে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে প্ররোচনাকারী শত্রু শক্তির উপর।
পারস্পরিক আলোচনা ও সমঝোতা যে সমস্যার সমাধান সহজে খুঁজে বের করতে পারে চাপ প্রয়োগ অথবা চরমপন্থা অনুসরণে সেই সমস্যাকেই আবার জটিলতর করে তোলে। জাতীয় স্বার্থের দিকে লক্ষ রেখে আমরা আশা করব সমঝোতা ও আলোচনার মাধ্যমে জাতীয় জীবনের নানা ক্ষেত্রে বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করা হোক।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!