বাঙলাদেশকে স্বীকার করুন মুক্তিযােদ্ধাদের সাহায্য দিন
সংসদের উভয় কক্ষে ভারত সরকারের কাছে সুস্পষ্ট দাবি
নয়াদিল্লী, ২৫ মে (ইউ এন আই)-আজ সংসদের উভয় কক্ষই বাঙলাদেশ সম্পর্কিত বিতর্কে উত্তপ্ত ছিল। প্রায় সকল সদস্যরাই অবিলম্বে বাঙলাদেশকে স্বীকৃতিদানের দাবি সােচ্চার করেন। তারা মুক্তিযােদ্ধাদের সর্বপ্রকার সামরিক সাহায্য দিতে ভারত সরকারকে অনুরােধ জানান। লােকসভায় কমিউনিস্ট পার্টির অধ্যাপক হীরেন মুখার্জি ও রাজ্য সভায় শ্রীএস জি সরদেশাই ঐ দাবির সমর্থনে জোরালাে বক্তব্য রাখেন।
রাজ্যসভায় এতৎসংক্রান্ত বিতর্কের জবাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রী শ্রীশরণ সিং বলেন, “যখন প্রয়ােজন বােধ করব তখন দ্বিধা না রেখেই আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেব।” | বাঙলাদেশ সম্পর্কে রাজ্যসভায় দীর্ঘ পাঁচঘণ্টা বিতর্ক শেষে পররাষ্ট্র মন্ত্রীর উত্তর দেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রীর উত্তর সভার দাবি মেটাতে সক্ষম হয় নি। লােকসভায় এ সম্পর্কে আলােচনা অসমাপ্ত থাকে।
লােকসভায় বিতর্কের সূচনা করেন মি. সেন। তিনি বলেন, জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করার সময় এসেছে এবং আমাদের বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত। কিন্তু একই দলের অপর সদস্য শ্রীবি, ভগত মনে করেন ভারতের তাড়াহুড়াে করে কোন ব্যবস্থা গ্রহণের দরকার নেই, কারণ, পাকিস্তান আমাদের ফাঁদে ফেলতে চাইছে। তাই আমাদের সতর্ক পদক্ষেপ ফেলা দরকার।
অধ্যাপক হীরেন মুখার্জী
অধ্যাপক হীরেন মুখার্জী সরকারকে এই মর্মে সতর্ক করে দেন স্বীকৃতিদানে গড়মসি করলে ভারত ও বাঙলাদেশ উভয়েরই ক্ষতি হবে। তিনি বলেন, বাঙলাদেশকে সাহায্য করার প্রথম পদক্ষেপ স্বীকৃতিদান। এতে ঝুঁকি আছে ঠিকই। কিন্তু আমাদের এ ঝুঁকি নিতে হবে।
অধ্যাপক মুখার্জী ১৭৭৮ সালে ফ্রান্স কর্তৃক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে স্বীকৃতিদানের ঘটনা ইন্দোনেশিয়ার মুক্তিযুদ্ধে ভারতের উল্লেখযােগ্য ভূমিকা গ্রহণের কথা এবং অনুরূপ আরাে অনেকগুলি দৃষ্টান্ত তুলে ধরে তাঁর বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি বলেন, ভারত সরকার কর্তৃক বাঙলাদেশকে স্বীকৃতিদান কোন আবেগ প্রসূত দাবি নয়। এই ব্যাপারে জনমত সংগ্রহের জন্য জাতিসংঘের ভারতীয় দূতের ভূমিকার প্রশংসা করেন। অবশ্য মার্কিন দেশে এ ব্যাপারে ভারতীয় দূতের ভূমিকার কঠোর সমালােচনা করতে তিনি ভােলেন নি।
তিনি আরাে বলেন, বাঙলাদেশের সঙ্গে ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্ক আছে। তাই ভারত আরাে সক্রিয়ভাবে বিশ্বের দরবারে তথ্য উপস্থাপিত করতে পারেন।
অধ্যাপক মুখার্জি কঠোর সমালােচনা করে বলেন, যখন ঢাকায় ভারতের কূটনীতিকদের অপমান করা হচ্ছে, তখন কলকাতার পাকিস্তান হাই কমিশনারকে তারা জামাই আদরে রেখেছেন। পাকিস্তান বাহিনী ভারতের সীমানায় অনুপ্রবেশ করছে, অথচ ভারতীয় সীমান্তরক্ষী তাদের প্রতিরােধ করছে না দেখে তিনি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ।
সি পি এমের শ্রীদশরথ দেব বলেন, শুধু সহানুভূতি দেখিয়ে আর প্রস্তাব পাশ করিয়ে বাঙলাদেশকে প্রকৃত সাহায্য দেওয়া যাবে না। তাদের সামরিক সাহায্য দিতে হবে।
আর এসপির শ্ৰত্রিীদিব চৌধুরী বলেন ভারতের অর্থনীতি শরণার্থীদের চাপে ভেঙে পড়ার আগে ভারত সরকারকে বাঙলাদেশকে স্বীকৃতি দিন।
রাজ্যসভায় আলােচনা
ইন্দিরা কংগ্রেসের পূরবী মুখার্জি বলেন, দেশের স্বনির্ভর পররাষ্ট্র নীতিকে আর স্বনির্ভর বলে মনে হচ্ছে না। অপর দেশ কি করল সে দিকে তাকিয়ে থাকা বৃথা। বাঙলাদেশকে এখুনি সার্বভৌম রাষ্ট্র বলে স্বীকার করে নেওয়া উচিত এবং ওই দেশকে সর্বপ্রকার সাহায্য দেওয়া উচিত। তিনি সরকারকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, বাঙলাদেশ হারলে সমগ্র পূর্বভারতও হারবে।
কমিউনিস্ট দলের শ্রীএস, জি, সরদেশাই বাঙলাদেশকে স্বীকৃতি দানের ব্যাপারে সরকারী ব্যর্থতার সমালােচনা করেন। তিনি বলেন, ভারতের এ ব্যাপারে উদ্যোগের অভাব ভারত ও বাঙলাদেশ বিরােধী শক্তি জোরদার হবে। তিনি বাঙলাদেশ মুক্তিফৌজকে সর্বপ্রকার সামরিক সাহায্যদান করতে বলেন।
এস এস পি নেতা শ্রীরাজ নারায়ণ বাঙলাদেশকে স্বীকৃতিদানের দাবিতে ডিভিশান দাবী করেন। কিন্তু রাজ্যসভার ডেপুটি চেয়ারম্যান শ্ৰী বি ডি খােবড়াগারে তাঁকে অনুমতি দেন নি। ফলে তিনি রাজ্যসভা থেকে ওয়াক আউট করেন।
বিতর্কের জবাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রী শ্রীশরণ সিং বলেন, ভারত সরকার কোন অনমনীয় মনােভাব গ্রহণ করেন না। শান্তি, জাতীয় স্বার্থ এবং বাঙলাদেশের জনগণের স্বার্থে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেবার প্রয়ােজন। বােধ করলে কোন দ্বিধা করব না।
শ্রীশরণ সিং বলেন, যা ছিল পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় তা এখন আন্তর্জাতিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। তিনি জানান, বাঙলাদেশ প্রশ্নে মন্ত্রীসভায় কোন মতবিরােধ নেই।
শ্রীসিং ঘােষণা করেন পাকিস্তান জঙ্গীবাহিনী দমনপীড়িনে বাঙলাদেশের জনগণকে কিছুতেই দমিয়ে রাখতে পারবে না।
সূত্র: কালান্তর, ২৬.৫.১৯৭১