You dont have javascript enabled! Please enable it! কালিগঞ্জ রাজাকার ক্যাম্প দখল - সংগ্রামের নোটবুক
কালিগঞ্জ রাজাকার ক্যাম্প দখল
পাকহানাদারবাহিনী, রাজাকার বা মিলিশিয়াদের মুক্তিবাহিনী কোন সময় নির্বিঘ্নে, নিরাপদে ও স্বস্তির সাথে থাকতে দেয়নি। সকল বাধা বিপত্তি, ভয়ভীতিকে তুচ্ছ করে জীবন বাজি রেখে অবিশ্বাস্য রকম এক এক অভিযান চালায় মুক্তিবাহিনী । কখনও প্রকাশ্য যুদ্ধ আবার কখনও চোরাগুপ্তা আক্রমণের মাধ্যমে মুক্তিবাহিনী দুর্বার গতিতে হানাদার বাহিনী ও তার দোসরদের পর্যদস্ত করেছে। এই ধরণের আর এক নজির কালিগঞ্জের করীম গাইনের বাড়ির শক্তিশালী রাজাকার দুর্গ আক্রমণ ও দখল।  সময়টা ছিল সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহ। কালিগঞ্জে রাজাকারদের অত্যাচার; স্পর্ধা সীমাহীনভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্বাধীনতার পক্ষের লােকজনদের বাড়িতে হামলা করে সব লুটপাট করে নিচ্ছে, বাড়িতে নারী-পুরুষদের উপর চালাচ্ছে সর্বপ্রকার নির্যাতন, সবশেষে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে সবকিছু ভস্মিভূত করে দিচ্ছে—এসব যেন ধ্বংসের নটরাজ, জ্বালিয়ে পুড়িয়ে সব যেন খাঁক করে দিচ্ছে। লেঃ বেগ, ওয়াহিদ, আকবর, লিয়াকত, মনির, হাকিম, সামাদ, তােয়াক্কেল, মােকাররমসহ এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে মিলিত হলেন সন্ধ্যায়। সবার প্রশ্ন কিভাবে কালিগঞ্জের সাক্ষাৎ শয়তান রাজাকারদের উচিত শিক্ষা দেয়া যায়। এক একজনে এক এক প্রস্তাব দেয় আর তা নিয়ে আলােচনা হয়। চা পান করে মেজাজটাকে ঠিক করে নিল সবাই। অধিনায়ক বেগ বেশ কিছুক্ষণ চিন্তা করে কঠিন সিদ্ধান্ত দিলেন, ‘কোন কথা নয়—সরাসরি তুমুল আক্রমণ চালিয়ে রাজাকার ক্যাম্প দখল করে ওদের ধরে আনতে হবে, যায় যাক প্রাণ, তাই বলে চোখের মাথায় রাজাকারদের এ দৌরাত্ম্য ও আস্ফালন কোন অবস্থায় সহ্য করা যাবে না। সবার দিকে কঠিন প্রশ্নবােধক দৃষ্টিতে তাকালেন অধিনায়ক, কি জবার জানতে চাই। এক কথা, এক জবাব, ‘আমরা একমত, ওদের ক্ষমা নেই, নিস্তার নেই।
সভার সমাপ্তি ঘােষণা করে লে: বেগ ওয়াহিদুজ্জামানসহ পুনঃ বসলেন পুরােপুরি পরিকল্পনায়। গােপন গােয়েন্দা গেল কালিগঞ্জের অবস্থা ও রাজাকারদের খবর আনতে; একদিন পর খবর এল এটা শুধু তাে রাজাকার ক্যাম্প না, যেন মােঘল আমলের কোন দুর্গ, রাজাকারদের কমান্ডে আছে এক দুর্ধর্ষ জালেম পাঞ্জাবী পান্ডা, উপাধি যার রাজাকার জেসিও (জুনিয়ার কমান্ডিং অফিসার) ইয়াসিন। দুঃসাহসী ৪০ জন মুক্তিযােদ্ধা লেঃ বেগ ও ওয়াহিদের নেতৃত্বে রাত ৯টার দিকে উকশা সীমান্ত দিয়ে ইছামতি নদী পার হল। পদব্রজে তাদের যেতে হবে বেশ খানিকটা রাস্তা। কাদা আর পিচ্ছিলতা ওদের সামনে কোন বাধাই নয়। ঘুটঘুটে অন্ধকার যেন মুক্তিবাহিনীর আর এক সহযােগী। কারণ মিলিটারী আর রাজাকার অন্ধকারকে দারুণ ভয় পায়। সবকিছু করে এ যাত্রা বহু ছােটখাট বিপত্তি অতিক্রম করে তারা কালিগঞ্জ এল। চুপি চুপি এসে যখন রাজাকার ক্যাম্পের পাশে মুক্তবাহিনীর বিচ্ছ জানতে পেল না যে, কি কঠিন পরীক্ষা তাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
‘চালাও গুলি’ অধিনায়কের নির্দেশ এল। শুরু হল এলএমজি, এসএলআর এবং ২ ইঞ্চি মর্টার থেকে অবিরাম গােলাগুলি। তারাও জবাব দিতে শুরু করল একইভাবে। প্রায় মিনিট পাঁচেক আক্রমণের পর অধিনায়ক বেগ হুকুম দিলেন, কিছু সময়ের জন্য গােলাগুলি বন্ধ রাখতে। থেমে গেল গােলাগুলি, রাজাকাররা হাফ ছেড়ে বাঁচল। ভাবলেন মুক্তিবাহিনী অধিনায়ক। তাদেরকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানালেন; কিন্তু প্রতি উত্তরে তারা আত্মসমর্পণে অস্বীকার করে গুলি চালাতে থাকল।
পুনরায় লেঃ বেগ প্রচন্ডভাবে যুদ্ধ শুরুর নির্দেশ দিলেন এবং কয়েক মিনিট পর কয়েকজনকে সাথে নিয়ে অতর্কিতে ঢুকে পড়লেন ক্যাম্পের ভিতর, কোন শালা গুলি করলে তাকে খতম করে দেয়া হবে, সবাইকে আত্মসমর্পণ করতে হবে। অতঃপর আর কোন গতি না দেখে ১৮ জন রাজাকার, তাদের জেসিও কমান্ডার ইয়াসিন আত্মসমর্পণে বাধ্য হল। ভয়ে তখন ওরা সব কুঁচকে গেছে। বন্দি করা হল তাদের, বাকীরা যুদ্ধের মধ্যে পালিয়ে গেছে। রাজাকার জল্লাদ কাশেম আর জোবাহারকে ধরার একটা সাধ ছিল ওয়াহিদের। কিন্তু শালারা চম্পট দিয়েছে জানটা নিয়ে।
অতঃপর সিদ্ধান্ত হল এখানকার কালিগঞ্জ স্থানীয় বাজার ব্যাঙ্ক অপারেশনের । কয়েকজনকে বন্দি রাজাকারদের পাহারায় রেখে ওরা চলে গেল। ব্যাঙ্ক-তালা খুলে ভিতরে ঢুকলে কি হবে, ষ্টোররুম ভাঙ্গা কঠিন; বারুদের স্লাব লাগিয়ে বিস্ফোরণ ঘটানাে হল। এদিকে সময় দ্রুত শেষ হয়ে আসছে। রাতের আঁধার কম হয়ে যাচ্ছে। ভােরের আলাে এক্ষুণি দশদিক উদ্ভাসিত করবে। তাই অধিনায়ক ব্যাঙ্কে রাখা ১০/১৫টা বন্দুক নিয়ে আসাই শ্রেয় মনে করল। আজ আর মুক্তিবাহিনী দলের আনন্দের সীমা নেই। কারণ এ দুঃসাহসী দূর্বার অভিযান পুরােপুরি সফল। কারাে কোন ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই বন্দি রাজাকারের দলকে নিয়ে তারা মহানন্দে শিবিরে প্রত্যাবর্তন করল। (সূত্র : স্বাধীনতার দুর্জয় অভিযান, স. ম. বাবর আলী ।)

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত