You dont have javascript enabled! Please enable it! গােপালপুর যুদ্ধ - সংগ্রামের নোটবুক
গােপালপুর যুদ্ধ
ভাদ্র মাস। বৃষ্টি আর কাদায় এলাকায় চলাফেরা কষ্ট। মুক্তিযােদ্ধারা লেঃ বেগের নেতৃত্বে শ্যামনগর থানা সদরে সদর্পে অবস্থান করছিল, সাথে বেশ কিছু প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত মুক্তিফৌজ, ইপিআর সদস্য এবং বাকীরা সবেমাত্র অস্ত্রের শিক্ষানবীশী করছে। সব মিলে প্রায় ৫০০ জন হবে। রাত প্রায় ১১টার দিকে ক্যাপ্টেন হুদা অনুরূপ ৫০০ জন মুক্তিফৌজ নিয়ে শ্যামনগর এসে লেঃ বেগের সাথে আলাপ করে মুক্তিযােদ্ধাদের রেখে মাত্র ৮/১০ জনসহ তিনি জরুরি কাজে বের হয়ে গেলেন। বড়জোর তিনি আধাঘন্টা পয়তাল্লিশ মিনিট শ্যামনগর ছিলেন। থানার পুলিশ মুক্তিবাহিনীকে সহায়তা করছে, তাই এলাকার লােকজনসহ মুক্তিবাহিনী স্বস্তিতে ছিল কিন্তু রােজই শােনা যাচ্ছে পাকহানাদার বাহিনী রাজাকারদের নিয়ে শ্যামনগর আসছে, কিন্তু আসে না। লেঃ বেগের নেতৃত্বে এত মুক্তিযােদ্ধা, পক্ষান্তরে মিজানুর রহমানের নেতৃত্বেও বেশ কিছু মুক্তিযােদ্ধা এখানে অবস্থান করছিল। সবার লক্ষ্য এ এলাকায় মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থান সুদৃঢ় করা এবং হানাদারবাহিনী বা রাজাকারদের আগমণ প্রতিহত করা। কৈখালী ইপিআর ও ফরেস্ট ক্যাম্প কমান্ডার ইব্রাহিম ঢালীও আছেন শ্যামনগর। প্রায় হাজার খানেক লােকের থাকা, খাওয়া-দাওয়া যােগার করা, ঘুমানাের ব্যাপার ইত্যাদি নিয়ে সমস্যা হচ্ছিল-অনেকটা অগােছালাে মতাে অবস্থা।
কেউ ঘুমিয়ে, কেউ গল্প করছে, কেউ এদিক-ওদিক খাওয়া দাওয়া বা শােয়ার জন্য ব্যস্ত। রাত বাজে ২.৩০ মিনিট। হঠাৎ সার্চ লাইটের মতাে দুটো আলাে জ্বলে ওঠে। চারদিকে সবাই বেশ সজাগ হয়ে ওঠে, ঘটনাটা সবাই ঠিক মতাে আঁচ করতে পারছে না। কেউ ভাবল পাকসেনাদের আগমণ, আবার কেউ ভাবছে শুধু রাজাকার। পুরােপুরি তথ্য কারাে কাছে নেই। মুক্তিযােদ্ধাদের নিকট এন্টি ট্যাঙ্ক ও এন্টি পারসন মাইন এলএমজি, এসএলআর, রাইফেল, এস. এম. জি. প্রভৃতি অস্ত্র-গােলাবারুদও কম নেই। হঠাৎ শুরু গােলাগুলি। ইতিমধ্যে বােঝা গেল এরা শুধু রাজাকার নয়—পাকসেনাদের একটা কোম্পানী শ্যামনগর দখল করার জন্য এই নৈশ অভিযান। মুক্তিবাহিনী খানিকটা অপ্রস্তুত অবস্থায় যে যেখানে সুবিধা পেল অস্ত্র হাতে নেমে পড়ল।-যুদ্ধ চলছে তাে চলছেই। সময় বেশ গড়িয়ে গেল, ধীরে ধীরে উভয় পক্ষ কাছাকাছি আসছে। মুক্তিবাহিনী আর পাকসেনারা মুখােমুখী মাত্র ১৫০ গজ দূরত্বে। একে অপরকে ভালভাবেই দেখতে পারছে। মুক্তিযােদ্ধাদের সংখ্যাধিক্য থাকা সত্বেও রাতের অন্ধকারে কে কোন দিকে গেছে ঠিক বােঝা যাচ্ছে না। পক্ষান্তরে এর অধিকাংশের বাড়ি বরিশাল, কুষ্টিয়া জেলাসহ অন্যত্র।
তাই তাদের পথঘাট সব অজানা-অচেনা। মুক্তিবাহিনীর লােকেরা পুরােপুরি ওদের অয়ারলেস সেট দেখতে পাচ্ছে, তাদের কথাবার্তা কিছু কিছু শােনা যাচ্ছে। পাকসেনারা গােপালপুর-শ্যামনগর রাস্তার (বর্তমান শহীদ মুক্তিযােদ্ধা সড়ক) পাশেই অবস্থান নিয়েছে। ভাের হয় এমন সময় পাকবাহিনীর পক্ষ থেকে মুক্তিযােদ্ধাদের আত্মসমর্পনের আহ্বান জানান হয়। যুদ্ধ চলছে। কিন্ত এলাকায় এত মুক্তিফৌজ থাকায় জনসাধারণ মনে করছে মুক্তিবাহিনীর লােকেরা প্রশিক্ষণ নিচ্ছে, যুদ্ধের কলাকৌশল শিখছে এবং গােলাগুলি করে হাতের নিশানা ঠিক করছে—যা অন্য অনেক আগ্রহী যুবক দেখার জন্য গাছেও উঠেছে। যুদ্ধের গতি কখনও বা মন্থর আবার কখনও তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আবারও পাকসেনারা আহ্বান জানাচ্ছে আত্মসমর্পণের।  মুক্তিযােদ্ধা জোবেদ আলী অনেকের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় ২/৩ জনসহ হানাদার বাহিনীকে মােকাবিলা করে চলেছে। হঠাৎ তার একসঙ্গী মাথা উঁচু করে গুলি ছুড়তে যাওয়ার সাথে সাথে মাথায় গুরুতর আঘাত পায়, সাথে সাথে শহীদ হয়, আহত হয় অপরজন। তখন সে একটি ধানক্ষেতে নেমে পড়ে। চারিদিক পানি থৈ থৈ করছে। আহত সঙ্গীকে নিয়ে জোবেদ আলী গােপালপুর দীঘির মধ্যে যখন পৌছল তখন সেও প্রায় সজ্ঞাহীন।
সকাল ৮টা বেজে গেছে। পাকসেনারা তখন মুক্তিযােদ্ধাদের তাড়া করছে আর মুক্তিযােদ্ধারা বিশৃঙ্খল অবস্থায় কে কোন দিকে গেছে ঠিক নেই। বহু কষ্টে আহত সঙ্গীকে নিয়ে জোবেদ আলী ঋষি পাড়ায় ঢােকে, কিছু দূরে বাঁশঝাড়ের অভ্যন্তরে একদল মুক্তিবাহিনী অবস্থান নিয়েছে। ইতিমধ্যে পাকসেনারা প্রায় আরাে দুই কিলােমিটার এগিয়ে এসেছে। মুনসুর সরদার নামে একজন পুস্তক ব্যবসায়ী আহত মুক্তিযােদ্ধার করুণ অবস্থা দেখে গজ, তুলা, ডেটল ইত্যাদি এনে ক্ষতস্থান পরিচর্যা করল। মুক্তিবাহিনী দেখল রাজাকার মাহমুদ, নূরুল ইসলাম, ইফিল মাস্টার প্রমুখ পাকবাহিনীকে পথ দেখিয়ে সাথে আনছে। ইমাম আলীর পিতা আব্বাস গাজীকে নৌকা থেকে উঁকি মারার দায়ে কবুতরের মতাে গুলি করে মারে পাকবাহিনীরা। একজন ঋষিকেও বেয়নেট দিয়ে হত্যা করল। ইতিমধ্যে একজন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসহ দু’জনকে ওরা ধরে ফেলেছে। গুরুপদ ঋষি আহত হল, দু’জন কৃষককেও তারা নির্মমভাবে হত্যা করল। ওরা না বুঝে পাকসেনাদের পাশ দিয়ে ধানের পাতা নিয়ে অন্যত্র যাচ্ছিল এটাই তাদের অপরাধ ছিল।
তখনও লেঃ বেগ যুদ্ধ করে কভারিং দিয়ে পশ্চাদপসরণ করছিল। এসময় ফজলু নামে আর একজন মুক্তিযােদ্ধাকে পাকবাহিনী সুকৌশলে ধরে ফেলে। যুদ্ধ করতে করতে কৃষ্টিয়া জেলার ইপিআর সুবেদার ইলিয়াস, কুষ্টিয়া জেলার আবুল কালাম আজাদ ও আব্দুল কাদের শহীদ হন। বেলা ৯টা বাজে। তখনও এ অসম যুদ্ধ চলতে থাকে। আরাে একজন নামজাদা মুক্তিযােদ্ধা শহীদ হয়। তারপর পাকসেনারা ফিরে যায় আর মুক্তিবাহিনীও এলােমেলাে ভাবে ভারতে প্রত্যাবর্তন করে। গােপালপুর যুদ্ধের যে শিক্ষা লাভ তা হল শুধু সৈন্য সংখ্যা বা অস্ত্রের আধিক্যই যুদ্ধ জয়ের মাপকাঠি নয় বরং সুশৃঙ্খল বাহিনীও প্রয়ােজন। | শ্যামনগর থানা জামে মসজিদের ইমামের নেতৃত্বে শহীদের জানাজা ও দাফন কাফন করা হয়। স্বাধীনতার পরে শ্যামনগর মুক্তিযােদ্ধা সংসদের কমান্ডার লিয়াকত আলীর নেতৃত্বে শহীদদের কবর নির্মাণ করা হয় এবং একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। | গােপালপুর যুদ্ধে অনেকেই অংশ নেয় যাদের সবার নাম সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। তবে কিছু যােদ্ধার নাম দেয়া গেল। যথা ঃ-আবুল হােসেন, ইব্রাহিম ঢালী, গাজী মুজিবর, এন্তাজ, হালিম, ফজলু, বারেক, গাজী নওসের প্রমুখ। অনেক রক্তঝরা স্মৃতি পিছনে ফেলে ওরা চলেছে। সাতক্ষীরার কুলিয়ার শ্রীরামপুর ব্রীজ। যুদ্ধকালীন পথে মেজর জলিল ডানে, মাঝে জেলারেল ওসমানী ও বামে ক্যাপ্টেন হুদা (জুলাই-১৯৭১)। ( সূত্র : স্বাধীনতার দুর্জয় অভিযান, স, ম, বাবর আলী ।)

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত