You dont have javascript enabled! Please enable it!
মন্দভাগ অপারেশন  
২নং সেক্টরেও মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা ব্যাপকভাবে শুরু হয়। জুলাই মাসে পাকসেনারা কসবা এবং মন্দভাগ পুনঃদখলের প্রস্তুতি নেয়। কুটিতে ৩১তম বেলুচ রেজিমেন্ট এবং গােলন্দাজ বাহিনীর সমাবেশ ঘটায়। মন্দভাগ সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন গাফফার তার বাহিনী নিয়ে শত্রু সেনার মােকাবিলায় প্রস্তুত হন। ১৯শে জুলাই পাকসেনাদের ৩১তম বেলুচের একটি কোম্পানি শালদা নদী দিয়ে। মন্দভাগের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এই সংবাদ পেয়ে সুবেদার ওহাবের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি প্লাটুন পাকসেনাদের অগ্রবর্তী দলটিকে বাধা দেওয়ার জন্যে অগ্রসর হয়। সুবেদার ওহাব তাঁর প্লাটুন নিয়ে মন্দভাগ বাজারের নিকট পৌছে অতর্কিতে পাকসেনাদের উপর আক্রমণ করে। উভয়পক্ষের গুলি বিনিময়ে পাকসেনাদের অন্ততঃ ৬০ জন হতাহত হয় বলে জানা যায়। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের তীব্রতায় পাকসেনারা নদীতে ঝাঁপ দেয়া শুরু করলে অধিকাংশই জলে ডুবে মারা যায়। নিহত পাকিস্তানীদের মধ্যে ৩১তম বেলুচ রেজিমেন্টের অধিনায়ক কর্নেল কাইয়ুম, ৫৩তম গােলন্দাজ বাহিনীর অফিসার বােখারী এবং আরও ৩/৪ জন অফিসারসহ বেশ কয়েকজন জুনিয়র কমিড অফিসার ছিল বলে পরে শােনা যায়। পঁচিশে মার্চের পর থেকে কুমিল্লা শহরে একাধিক নৃশংস হত্যাকাণ্ডের জঘন্যতম নায়ক ছিল এই নিহত ক্যাপ্টেন বােখারী। ২নং সেক্টর ট্রপস্ মে মাস থেকে যে তৎপরতা চালাচ্ছিল তা সবিশেষ উল্লেখযােগ্য।
মে মাসে পাকসেনারা বেলুনিয়া অধিকার করার চেষ্টা করে। সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মােশাররফ ক্যাপ্টেন জাফর ইমামকে পাকসেনাদের অগ্রগতি রােধ করার নির্দেশ দেন। ছাগলনাইয়াতে তখন পাকসেনাদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর সংঘর্ষ চলছিল। পাকসেনা ফেনীর দিক থেকে মুক্তিবাহিনীর অবস্থান ছাগলনাইয়ার উপর এবং একই সঙ্গে চট্টগ্রাম সড়কের উপরও আক্রমণ চালায়। সংঘর্ষে পাকিস্তানীরা ২০/২৫ জনের মৃতদেহ ফেলে রেখে পিছনে সরে যায়। পাকিস্তানীরা পিছনে সরে গেলেও কয়েকদিন পর পুনরায় শক্তি সঞ্চয় করে ছাগলনাইয়ার দক্ষিণ থেকে ফেনী-চট্টগ্রাম পুরােনাে সড়ক ধরে অগ্রসর হয়ে আকস্মিকভাবেই ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের বাহিনীর উপর ঝাপিয়ে পড়ে। পাকসেনাদের প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে মুক্তিবাহিনী বেশ কিছু-সংখ্যায় হতাহত হয়ে পিছনে সরে রাজনগরে এসে প্রতিরক্ষাব্যুহ রচনা করে। এই পিছনে সরে যাওয়াকে পাকসেনারা অত্যন্ত ভীতির চোখে দেখল। আর তাই পাকসেনারা ভীত হয়ে বেলুনিয়া ছেড়ে ফেনীতে মূল প্রতিরক্ষা। ঘটি প্রস্তুত করল। মুক্তিবাহিনীও বেলুনিয়া ছেড়ে ফেনীতে মূল প্রতিরক্ষা ঘাঁটি প্রস্তুত করল। মুক্তিবাহিনী বেলুনিয়া রক্ষার জন্য ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের নেতৃত্বে একটি কলাম বান্দরুয়াতে (ফেনী থেকে ২ মাইল উত্তরে) এবং লেঃ ইমামুজ্জামানের নেতৃত্বে অপর কলাম অপরদিকে প্রতিরক্ষাব্যুহ রচনা করে। মূল সেক্টর বাহিনী দিয়ে ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের কমাণ্ডে মুন্সীরহাটে আর একটি মজবুত ঘাঁটি গড়ে তােলা হয়। বেলুনিয়া বাঙ্ক সামরিক দিক থেকে ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান।
এই বাঙ্কের দৈর্ঘ্য ছিল ১৭ মাইল এবং প্রস্থ ছিল ১৬ মাইল। বান্দুয়ার অবস্থান সম্পর্কে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফ তার সাক্ষাৎকারে বলেছেন :  “১৭ই মে পর্যন্ত আমাদের মুন্সীহাটে ডিফেন্স এবং বান্দুয়ার অবস্থানটি বেশ শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এ জায়গাটি আমরা এ জন্যে প্রতিরক্ষা ঘাঁটির জন্যে মনােনীত করেছিলাম যে, জায়গাটির সামনে কতগুলাে প্রাকৃতিক বাধাবিঘ্ন ছিল যেগুলি শত্রুসেনার অগ্রসরের পথে বিরাট বাধা স্বরূপ। এতে শত্রু সেনাদের নাজেহাল করার যথেষ্ট সুযােগ ছিল। আমাদের অবস্থানটি মুহুরী নদীর পাশ ঘেঁষে পশ্চিম দিক থেকে ছিলােনিয়া নদী ছেড়ে পশ্চিম সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ব্যহটি কমপক্ষে ৪ মাইল চওড়া ছিল। আমরা এই অবস্থানটি এইভাবে পরিকল্পনা করেছিলাম যে শত্রুসেনাদের বাধ্য হয়ে আমাদের ঘাঁটি আক্রমণ করার সময় প্রতিরক্ষাব্যুহের সম্মুখ দিক ছাড়া আর কোন উপায়ে অন্য কোন দিক থেকে আসার রাস্তা ছিল না। আমাদের মুন্সীরহাটে প্রধান ঘাঁটি সম্বন্ধে শত্রুদের ধোকা দেওয়ার জন্যে বান্দুয়া রেলওয়ে স্টেশনের কাছে এবং ছিলনিয়া নদীর উপর একটি অগ্রবর্তী ঘাঁটি স্থাপনের নির্দেশ দিই। এটা ছিল একটি ডিলেয়িং পজিশন। এই পজিশনের সামনে রাস্তা ও রেলের সেতুগুলি ধ্বংস করে দেয়া হয় যাতে শত্রুদের অগ্রসরে আরাে বাধার সৃষ্টি হয়। শত্রুসেনা অগ্রসরে রাস্তার পশ্চিম এবং পূর্বপাশে রাস্তার দিকে মুখ করে আমরা বেশ কতকগুলাে উঁচু জায়গায় এবং পুকুরের উঁচু বাঁধে মজবুত বাঙ্কার তৈরি করি এবং তাতে সব সময় হালকা মেশিনগান প্রস্তুত রাখা হয়। এ ছিল এক রকমের ফাদ যাতে একবার অবস্থানের ভিতরে অগ্রসর হলে দু’পাশের গুলিতে শত্রুসেনা ফিরে যেতে না পারে।

সুতারকান্দি অপারেশন
মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাকসেনাদের সংঘর্ষ অব্যাহত ছিল। ২৪শে মে সুতারকান্দিতে পাকসেনাদের সঙ্গে এক বড় রকমের সংঘর্ষ হয়। পাকিস্তানবাহিনীর সি-১৩০ বিমানযােগে সৈন্যবৃদ্ধি ও সেই সঙ্গে অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র দ্বারা মুক্তিবাহিনীর উপর ক্রমাগত আক্রমণের ফলে মুক্তিবাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। অস্ত্রশস্ত্র এবং গােরাবারুদের অভাব, সৈন্যসংখ্যার স্বল্পতা, অফিসারের অভাব ইত্যাদি কারণেই সেদিন মুক্তিযােদ্ধাদের পিছু হটতে হয়েছে। মুক্তিবাহিনী গােপালগঞ্জ ডিফেন্স ছেড়ে বড়গ্রাম বিওপি এলাকাতে নতুন ডিফেন্স গড়ে তােলে। মুক্তিবাহিনীর লক্ষ্য ছিল পাকসেনাদের শেওলাঘাট থেকে কুশিয়ারা নদী অতিক্রম করে আক্রমণাত্মক অভিযানে কুশিয়ারা নদী এলাকাতেই বাধা দেওয়া। এই সময় মুক্তিবাহিনীর আধিপত্য না থাকলেও বিয়ানীবাজার এবং জাকীগঞ্জও মুক্ত ছিল। পাকিস্তানসেনাবাহিনীর ৩১তম পাঞ্জাব রেজিমেন্টের একটি কোম্পানি শেওলাঘাটে ডিফেন্স নেয় মে মাসের প্রথম সপ্তাহে। দ্বিতীয় সপ্তাতে পাকসেনাদের সৈন্যসংখ্যা দ্বিগুণ হয়। মুক্তিবাহিনীর একটি কোম্পানি বড়গ্রাম থেকে ক্যাপ্টেন রবের নেতৃত্বে পাকসেনাদের উপর মাঝে মধ্যে আক্রমণ করছিল। মে মাসের ২০ তারিখে পাকিস্তানসেনাবাহিনী কুশিয়ারা নদী। অতিক্রম করতে সমর্থ হয়। ২৩শে মে। রাত ১১টা। ক্যাপ্টেন রব তার প্রতিরক্ষা পরিখায় ছিলেন, এমন সময় দু’জন লােক দৌড়ে এসে তাকে জানাল একদল পাকসেনা তাদেরকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করছে। ক্যাপ্টেন রব ঘটনার গুরুত্ব উপলব্ধি করে শাহবাজপুর (লাতু) রেলওয়ে স্টেশনে পাঠান একটি প্ল্যাটুনকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে আসার নির্দেশ দিলেন। অন্যান্য সূত্র থেকেও ঘটনার সত্যতা নিরূপণ করা হল। দেখা গেল, সত্যিই পাকিস্তানীদের দুটি কোম্পানীর অধিক সৈন্য মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
২৪শে মে সকাল ৬টা। পাকসেনাদের দুটি কোম্পানি ক্রমশঃ আরাে এগিয়ে চলল। পাকসেনারা মুক্তিবাহিনীর অবস্থান সম্পর্কে পূর্বেই জেনেছিল। ক্যাপ্টেন রব এবং তার বাহিনী সম্পূর্ণ প্রস্তুত ছিলেন। পাকসেনারা রাইফেলের আওতায় আসা মাত্র তিনি গুলি ছোড়ার নির্দেশ দিলেন। শুরু হল বৃষ্টির মতাে গােলাবর্ষণ। পাকসেনারা ঘটনার আকস্মিকতায় বিমূঢ় হয়ে পড়ল। কিন্তু সে ছিল কিছুক্ষণ মাত্র। তারপরই পাকিস্তানীরা আর্টিলারী এবং অন্যান্য স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের সাহায্যে পাল্টা আঘাত হানল। পাকসেনাদের দুটি কোম্পানির একটি সুতরারকান্দি অপরটি লামাশাল হয়ে বড়গ্রাম আক্রমণ করে। মুক্তিবাহিনী সংখ্যায় মাত্র এক কোম্পানী থাকলেও বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে এমনভাবে প্রতিরক্ষাব্যুহ রচনা করে অবস্থান করছিল যে পাকসেনারা চরমভাবে ভেদ করে কিছুতেই সামনে অগ্রসর হতে পারছিল না। ঐ তারিখ সকালে ৭টা ৩০ মিনিটের সময় পাকসেনারা সম্মুখ এবং ডানদিক থেকে পুনরায় ব্যাপকভাবে হামলা চালায়। বেলা ১০টা পর্যন্ত মুক্তিবাহিনী সম্মুখযুদ্ধে নিজ ঘাঁটিতে অটুট থাকে। কিন্তু বেলা সাড়ে ১১টার দিকে দেখা গেল মুক্তিবাহিনীর গােলাবারুদ প্রায় শেষ। অথচ কোনদিক থেকে কোন সাহায্যও এল না। অবশেষে বাধ্য হয়েই ক্যাপ্টেন রব তার বাহিনী নিয়ে পিছনে সরে গেলেন। বেলা ১২টার মধ্যে পাকসেনা সমগ্র এলাকাতে তাঁদের আধিপত্য বিস্তার করে। এই যুদ্ধে ৩৯জন পাকসেনা নিহত এবং ২ জন মুক্তিবাহিনীর হাতে বন্দি হয়, অপরদিকে দু’জন মুক্তিবাহিনী পাকসেনাদের হাতে ধরা পড়ে ও বেশ কিছু আহত হয়। 
ক্যাপ্টেন রব তার বাহিনী নিয়ে পিছনে সরে এসে ১০ই জুন বড় পুঞ্জীতে প্রধান ঘাঁটি স্থাপন করেন। এই সময় থেকে সেক্টরের প্রতিটি সাব-সেক্টর কমান্ডারগণ ব্যাপকভাবে নিজ নিজ এলাকাতে পাকিস্তানসেনাবাহিনীর উপর আক্রমণ, এ্যামবুশ, সড়ক-সেতু ধ্বংস ইত্যাদি কর্মকাণ্ড করতে থাকেন। অপরদিকে যুবক ছেলেদের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের সংখ্যা দিন দিন বাড়াতে লাগলেন। এই সময় এই সেক্টরের বেশ কয়েকটি লক্ষ্য ছিল। এক, পাকসেনাদের নির্ভাবনায় থাকতে না দিয়ে মুক্তিবাহিনীর অবস্থিতির খবর জানিয়ে দেয়া। দুই, চা বাগানগুলােকে অকেজো করে দিয়ে পাকিস্তানী অর্থনীতিতে দারুণভাবে চাপ সৃষ্টি করা। তিন, সড়ক সেতু ধ্বংস করে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সহজ চলাচলে বাধা সৃষ্টি করা। মুক্তিবাহিনী সমগ্র সেক্টর এলাকাতে প্রাথমিক লক্ষ্য তিনটি সামনে রেখে তাদের জয়যাত্রা অব্যাহত রাখে। তারা শেওলা, সদাখাল, বারইগ্রাম এবং কাংলী ফেরীর উপর আক্রমণ চালিয়ে ফেরী ধ্বংস করে দেয়। রাজকী, ফুলতলা, মেওলা, পৃথ্বিপাশা, সমনভাগ, সােনা-রূপা, হাসনাবাদ, চূড়ামনি, সাগরনীল ইত্যাদি চা-বাগান বিনষ্ট করে দেয়া হয়।
অপরদিকে মুক্তিবাহিনী পাকসেনাদের ঘাঁটি বড়লেখা ফুলতলা এবং আটগ্রামের উপর হামলা অব্যাহত রাখে। | ১৮ই জুন সেক্টর হেড কোয়ার্টার থেকে বড়পুঞ্জী সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন রবকে একটি কোম্পানি নিয়ে ভারতীয় বিওপি কুকিতালে রিপাের্ট করতে বলা হল । উদ্দেশ্য ছিল, পাকিস্তানীদের শক্ত ঘাঁটি লাঠিটিলা আক্রমণ করা। ক্যাপ্টেন রব একটি কোম্পানি নিয়ে ১৮ই জুন রাতেই কুকিতাল বিওপিতে পৌঁছেন। পৌছানাের পর পরই ৭ নং রাজপুত রাইফেলস্ রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার লেঃ কর্নেল দেব সেন ক্যাপ্টেন রবকে লাঠিটিলায় পাকসেনাদের একটি প্ল্যাটুনের খবর এবং আক্রমণের বিভিন্ন দিক বুঝিয়ে বললেন। লেঃ কর্নেল দেব সেন তাঁর পক্ষ থেকে সব রকম সাহায্যে আশ্বাস দিলেন। ক্যাপ্টেন রব চাচ্ছিলেন নিজে রেকি করে যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করে নিজের মনমতাে একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে। কিন্তু তিনি সে সুযােগ পেলেন না। মিত্রবাহিনীর ক্যাপ্টেন কুমার ও লেঃ কর্নেল দেবের ত্বরিত পরিকল্পনায় সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। কিন্তু কোন উপায় না দেখে তাকে চুপ থাকতে হল।
ক্যাপ্টেন রব রাত ৪টায় ১৯শে জুন, তার কোম্পানি নিয়ে লাঠিটিলার দিকে অগ্রসর হলেন। ভাের ৫টা ৪৫ মিনিটের মধ্যে তিনি তাঁর কোম্পানি নিয়ে লাঠিটিলা পাকঘাটি চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে টেলিফোন লাইন বিচ্ছিন্ন করে দেন। পাকসেনাদের অবস্থান ছিল একটি একটি ছােট টিলার উপর। টিলাটি এমনভাবে শেলফ করে, ক্যামােফ্লাইজ করে রাখা হয়েছিল যে, ১০০ গজ দূর থেকেও কোন কিছু বােঝার উপায় ছিল না। পরিকল্পনা হল ৪জন সিপাই গ্রেনেড নিয়ে যতদূর সম্ভব পাকবাংকারের নিকটে গিয়ে গ্রেনেড ছুঁড়বে এবং তারপরেই পাকসেনাদের পাল্টা জবাবে তাদের শক্তি এবং অবস্থিতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা জন্মালে মিত্রবাহিনীর আর্টিলারি গােলাবর্ষণ শুরু হবে। এর কিছুক্ষণ পরই ক্যাপ্টেন রব তার বাহিনী নিয়ে লাঠিটিলা বিওপি চার্জ করবেন। ৪ জন সিপাই পাঠানাে হল। কিছুক্ষণ পর তারা ফিরে এসে পাকসেনাদের অবস্থিতির সঠিক সংবাদ দিতে পারল না। কিছুক্ষণ পর পুনরায় একজন হাবিলদার এবং দু’জন সিপাই পাক অবস্থানে খুব নিকটে গিয়ে বাংকার অনুমান করে একটি গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। সঙ্গে সঙ্গে পাকসেনারা পাল্টা জবাব দিতে থাকে। পাকসেনাদের গুলিতে ৩জনই গুরুতর আহত হয়ে কোন মতে হেড কোয়ার্টারে ফিরে আসে। এর পরই ভারতীয় বাহিনী পাক বিওপি-এর উপর আর্টিলারীর আঘাত হানতে থাকে। বিশ মিনিটের মধ্যে প্রায় ৫০০ গােলা পাক ব্যাংকারে নিক্ষেপ করা হয়। আর্টিলারীর ফায়ার বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্যাপ্টেন রব তার বাহিনী নিয়ে বিওপি চার্জ করেন। মুক্তিবাহিনীর ঘন ঘন ‘জয় বাংলা’ শ্লোগানে পাকসেনারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে এবং পরে এদিক-ওদিক পালাবার চেষ্টা করে। পাকসেনারা পালাতে গিয়ে অধিকাংশই বুলেট বিদ্ধ হয়।
এই সময় একজন অর্ধনগ্ন মহিলাকেও পালাতে দেখা যায়। রাইফেলের বুলেট তাকেও রেহাই দিল না। বিওপি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়। বিওপি থেকে প্রচুর গােলাবারুদ উদ্ধার করা হয়। ২২তম বেলুচ রেজিমেন্টের একজন হাবিলদার এবং একজন সিপাই মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। মুক্তিবাহিনীর পক্ষে কেউ নিহত না হলেও ৪ জন আহত হয়। লাঠিটিলায় মুক্তিবাহিনীর বীরত্ব ও সাহসিকতা যে কোন মানুষ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। জুন, জুলাই এবং আগস্ট মাস পর্যন্ত এই সেক্টর এলাকাতে ব্যাপকভাবে গেরিলা তৎপরতা চালান হয় আর সেক্টরগুলােতে মুক্তিবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধির সাথে সাথে তারা আক্রমণের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। আগস্ট মাস পর্যন্ত কেবলমাত্র বড়পুঞ্জী সাব-সেক্টরেই নিয়মিত বাহিনীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১ হাজার। এই সেক্টরের আওতাধীন গেরিলাবাহিনীকে দেশের অভ্যন্তরে বেশ প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে তাদের তৎপরতা অব্যাহত রাখতে হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্থানীয় অধিবাসীরা গেরিলাদের সাহায্য না করে বরং গেরিলাদের ধরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে পাকসেনাদের সঙ্গে পূর্ণ সহযােগিতা করতে থাকে। পাকসেনাদের সহযােগী এই সব রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস এবং দালালদের নানা কীর্তিকলাপ জানা যায়। কোন কোন এলাকাতে পাকসহযােগী দালালরা গাছের উঁচু ডালে টিন বেঁধে রাখত। গেরিলারা সেই গ্রামে ঢুকলেই সেই টিন বাজানাে শুরু হত । টিনের এই শব্দে সবাই সতর্ক হয়ে যেত এবং পাকসেনারা বুঝত মুক্তিবাহিনী গ্রামে প্রবেশ করেছে। কোন কোন গ্রামে মুক্তিবাহিনী প্রবেশ করলে মসজিদে আজান দেওয়া শুরু হত।
পাকসেনারা বুঝত গ্রামে মুক্তিবাহিনী এসে গেছে। এমনিভাবে পাকসেনারা তৎপরতা চালিয়ে বহু গেরিলাকে ধরে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। বলা বাহুল্য, সিলেট এলাকাতেই পাকিস্তানী দালাল ও তাঁর সহযােগীদের এইরূপ তৎপরতা ছিল সর্বাপেক্ষা বেশি। এদিকে এই সেক্টরের কুকিতলা সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন অব্যাহত রাখলেন । ক্যাপ্টেন শরিফুল হক জুলাই মাসের মাঝামাঝি দিলখুশ এবং জুরী এলাকাতে পাকিস্তানী ঘাঁটির উপর ব্যাপক হামলা চালিয়ে পাকসেনাদের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করেন।
জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে দিলখুশে পাকসেনাদের শক্ত ঘাঁটি তৈরির খবর জানা গেল। সেক্টর হেডকোয়ার্টার থেকে ক্যাপ্টেন হককে নির্দেশ দেওয়া হল দিলখুশ আক্রমণের জন্যে। ক্যাপ্টেন শরিফুল হক ছিলেন আর্টিলারীর অফিসার। তিনি তাঁর বাহিনীকে সব কিছু বুঝিয়ে দিয়ে নিজে দিলখুশ থেকে প্রায় এক মাইল দূরে একটি লম্বা গাছে চড়ে (যেখানে থেকে প্রায় সমগ্র দিলখুশ দেখা যায়) ভারতীয় আর্টিলারীর কাছে টারগেট নির্দেশ পাঠান শুরু করলেন। মিত্র বাহিনীর আর্টিলারীর গােলা সঠিক স্থানে পড়ায় পাকসেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ল। মুক্তিবাহিনীর জয়ের পূর্ব মুহূর্তে একটি ৩ স্টারের গােলা ক্যাপ্টেন হক যে গাছে ছিলেন সে গাছে এসে পড়ে। ক্যাপ্টেন হক গাছ থেকে পড়ে গুরুতররূপে আহত হলেন। ওদিকে বিওপির নির্দেশ না পেয়ে মিত্রবাহিনীর অনেক গােলা মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন অবস্থানে এসে পড়তে থাকে। পাকসেনারা এ সুযােগের সদ্ব্যবহার করল। তারা দিলখুশ ঘাটিতে টিকে থাকবার আপ্রাণ চেষ্টা করল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের চেষ্টা ব্যর্থ হল। ক্যাপ্টেন শরিফুল হককে আহত অবস্থায় হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হল। আগস্ট মাসেই লুবাছড়া, কারাবালা, মােকামটিলা, আমলাসিদ ও নমােজা মুক্তিবাহিনীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। মুক্তিযুদ্ধের শেষদিন পর্যন্ত এইসব এলাকা পাকিস্তানীরা বার বার চেষ্টা করেও কখনাে দখল করতে পারেনি।
বসন্তপুর আক্রমণ
৯ নং সেক্টরেও মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা অব্যাহত ছিল। মেজল জলির সেক্টরের দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রাথমিক পর্যায়ে পাকঘাটি শ্রীপুর, বসন্তপুর এবং কৈলাখী দখলের জন্যে তার বিপরীতে টাকি, হিঙ্গলগঞ্জ এবং শমসেরনগরে মুক্তিবাহিনীর সুদৃঢ় ঘাঁটি নির্মাণের পরিকল্পনা নিলেন। প্রথমে টাকিতে হেড কোয়ার্টার স্থাপন করে হিঙ্গলগঞ্জে ক্যাপ্টেন হুদার নেতৃত্বে প্রথম বেইস ক্যাম্প স্থাপন করলেন। হিঙ্গলগঞ্জে ভারতের ৭২ নং সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর একটা স্থায়ী ফাডি। ক্যাপ্টেন পান্ডে ছিলেন এর অধিনায়ক। তিনি তাঁর ফাঁড়ির এক মাইল দক্ষিণে একটি ঘাঁটি বানাতে ক্যাপ্টেন হুদাকে সব রকম সাহায্য করলেন। এ ঘাঁটিটা ইছামতি নদীর তীর থেকে আধমাইল ভিতরে। এর ঠিক উল্টো পাড়ে পাক হানাদারদের সুদৃঢ় পর্যবেক্ষণ।
আগস্ট মাসের প্রথমদিকে মেজর জলিল তার পরিকল্পনানুযায়ী শমসেরনগরে সাবসেক্টর স্থাপন করলেন। কমাণ্ডে নিযুক্ত হলেন ফ্লাইট সার্জেন্ট সলিমুল্লাহ। অবশ্য পরবর্তীতে ক্যাপ্টেন বেগ এই সাব-সেক্টরটির দায়িত্ব নিয়েছিলেন। শমসেরনগরে ভারতীয় সীমান্তবতী ফাড়ির আধ মাইল দক্ষিণে নদীর তীরে বাঁশ দিয়ে একটা ঘাঁটির মতাে তৈরি করা হল। এর চুতর্দিকে কাদা-পানি। গেরিলা তৎপরতা বৃদ্ধির জন্যে মেজর জলিল একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করে তা আর্মী হাইকমান্ড থেকে অনুমােদন করিয়ে নিলেন। তার পরিকল্পনা অনুযায়ী ফরিদপুর, বরিশাল, খুলনা ও পটুয়াখালী এই চারটি জেলাকে ১৯টি অঞ্চলে বিভক্ত করা হল। আগের কার্যক্রম অনুযায়ী এক একটি অঞ্চলে দু’ থেকে তিনটি থানা রইল। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আগে থেকেই গেরিলা ঘাঁটি ছিল সর্বমােট প্রায় ৮৩টি। প্রতিটি জেলা, প্রতিটি অঞ্চল, প্রতিটি থানার দায়িত্ব যথাক্রমে একজন সামরিক অফিসার, অথবা অভিজ্ঞ নন-কমিশন্ড অফিসার এবং বাছাই করা একজন ছাত্রের উপর ন্যস্ত করা হল। সকল পর্যায়ে এদের সাথে রইল একজন করে সহ-অধিনায়ক।
 এই সেক্টরে পাঁচটি লঞ্চকে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করে গানবােট হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। এই গানবােটগুলাে খুলনা, চালনা এবং সুন্দরবন এলাকাতে নদীপথে পাকিস্তানীদের উপর হামলা চালিয়ে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছিল। উল্লেখ্য যে, এই লঞ্চগুলাে প্রায় সবই ছিল ইপিআর বাহিনীর। শুধু এই সেক্টরেই নয়, অন্যান্য সেক্টরেও ইপিআর বাহিনীর লঞ্চগুলােকে ব্যাপকভাবে কাজে লাগান হয়েছে। পাকসেনাদের শক্ত ঘাঁটি ছিল শংকরা, শ্রীপুর, দেবহাটা, খানজী, বসন্তপুর, উকসা এবং কৈখালী। ক্যাপ্টেন নূরুল হুদা বসন্তপুর পাকঘাটি আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিলেন। একই সময়ে টাকি বেইস থেকে মীরপুর পাকঘাঁটি আক্রমণেরও সিদ্ধান্ত হল। হাবিলদার সােবহান ইছামতী পেরিয়ে রেকি করে সকল তথ্য সংগ্রহ করলেন। ১২/১৩ই জুন রাতে ক্যাপ্টেন নূরুল হুদা মুক্তিবাহিনীর একটি প্লাটুন নিয়ে বসন্তপুর পাকঘাটির দিকে অগ্রসর হলেন।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!