মাদরা বা বেলেডাঙ্গা অভিযান
মাদরা বা বেলেডাঙ্গায় পাকহানাদাররা একটি শক্তিশালী ক্যাম্প স্থাপন করে। স্থানটা ছিল কলারােয়া থেকে ৯ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। বাঙ্কার দিয়ে ক্যাম্পটি ছিল সুরক্ষিত। এই ক্যাম্প থেকে বিভিন্ন দিকে বিভিন্ন সময় পাকসেনা ও রাজাকারসহ প্যাট্রোল পার্টি যেত, যারা প্রায়ই চরম অত্যাচার নির্যাতন চালাত স্থানীয় লােকজনদের উপর। গরু, ছাগল ধরে আনত, লুটপাট করত এবং ধরে আনত মেয়েদের। মাদরা ক্যাম্পের কারণে মিলিটারীদের কড়া পাহারা আর দৃষ্টি ফাঁকি দিয়ে মুক্তিবাহিনীর লােকজনের যাতায়াত করতে চরম অসুবিধার সৃষ্টি হত। তাই ক্যাপ্টেন মাহবুব, ক্যাপ্টেন শফিকউল্লাহ, তৌফিক এলাহী চৌধুরী এই মাদরা ক্যাম্প আক্রমণ করে মিলিটারীদের উৎখাত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। ৯ই নভেম্বর। ভাের রাত ৪টায় ক্যাপ্টেন মাহবুব ও শফিউল্লাহর নেতৃত্বে মাদরা মিলিটারী ক্যাম্পে আক্রমণ চালান হয়। প্রায় ১৫০ জন মুক্তিযােদ্ধা এই অভিযানে অংশ নেয়। মুক্তিযােদ্ধা কমান্ডার মােসলেমের নেতৃত্বে ৫০ জন মুক্তিযােদ্ধা বাগআচড়া থেকে যাতে মিলিটারী এসে মাদরা ক্যাম্পে যােগ দিয়ে তাদের শক্তি বৃদ্ধি করতে না পারে সেজন্য সুবিধা মতাে স্থানে অবস্থান নেয়। মােসলেমের দল কোটা গ্রামের ভেতর দিয়ে আসা আর একটি রাস্তা পাহারা দেবারও দায়িত্ব নেয়। যদি এ পথে বাগআচড়া থেকে মিলীটারী আসার অপচেষ্টা করে তবে মােসলেমের বাহিনী ৪টা এলএমজি, ১২টা এসএলআর, ২ইঞ্চি মর্টার রাইফেল এবং গ্রেনেড দিয়ে তাদের প্রতিহত এবং ধ্বংস করে দেবে। পক্ষান্তরে কমান্ডার আব্দুল গফফারের নেতৃত্বে ৪০ জনের একটি শক্তিশালী দল কলারােয়া-কোমরপুর রাস্তা বন্ধের দায়িত্ব পালন করে। কমান্ডার গফফারের নিকটও অনুরূপ অস্ত্রশস্ত্র ছিল যেন ঐ পথে মিলিটারী এসে এদের সাথে যােগ দিতে না পারে।
মূল আক্রমণকারী দলে ছিলেন ক্যাপ্টেন মাহবুব ও ক্যাপ্টেন শফিকউল্লাহ। তাঁদের সাথে প্রায় ৬০ জন মুক্তিযােদ্ধা অংশ নেয়। ইপিআর সুবেদার তাবারাক উল্লাহ, ইপিআর হাবিলদার ইলিয়াস পাটোয়ারীসহ ইপিআর ও অন্যান্য দুঃসাহসী মুক্তিযােদ্ধারা এই দলের মূল শক্তি। বীরবিক্রমে মুক্তিযােদ্ধারা মাদরা ক্যাম্পের শক্তিশালী হানাদারবাহিনীর শিবিরে আক্রমণ পরিচালনা করে। শুরু হয় তুমুল প্রলয় কান্ড কিন্তু গােপন গােয়েন্দা ও রেকি বাহিনীর খবর ছিল অপ্রতুল। এই ক্যাম্পের শক্তি, অস্ত্রশস্ত্র গােয়েন্দার রিপাের্টের চেয়েও প্রায় দ্বিগুণ ছিল, ভারী কামান তাদের প্রতিরক্ষা সুদৃঢ় করেছিল। তাই যুদ্ধের গতি হয়ে যায় মন্থর। দুর্ধর্ষ পাকবাহিনী তাদের কংক্রীটের বাঙ্কারের মধ্যে থেকে বৃষ্টির মতাে গােলাবর্ষণ করতে থাকে এবং তাদের গােলাবর্ষণ ছিল পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে সঠিক। তাই মুক্তিযােদ্ধাদের পজিশনে টিকে থাকা এক কঠিন ব্যাপার হয়ে দাড়ায়। পাকাবাহিনী অত্যন্ত বেপরােয়াভাবে মুক্তিবাহিনীর উপর ঝাপিয়ে পড়ে। ফলে মুক্তিযােদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। এমন সময় আহত হয় ক্যাপ্টেন মাহবুব। তাঁর আহত হওয়ার ঘটনায় মুক্তিযােদ্ধারা অনেকটা বিহ্বল হয়ে পড়ে, তবুও যুদ্ধ চলতে থাকে। কিছুক্ষণ পর ক্যাপ্টেন শফিকউল্লাহও আহত হন। একই সঙ্গে দু’জন অধিনায়কের আহত হওয়ার ঘটনা মুক্তিযােদ্ধাদের দারুণভাবে বিচলিত করে। তাদের ফায়ার কমে যায়। তখন পাকসেনারা আরাে বেপরােয়া হয়ে গােলাবর্ষণ বৃদ্ধি করে, মুক্তিফৌজরা তখন অনেকটা বিশৃঙ্খল অবস্থায় পড়ে যায়। খেঁকশিয়ালের চতুরতা ও ব্যাঘ্রের ক্ষিপ্রতা নিয়ে খানসেনারা তখন মুক্তিবাহিনীর দুর্বলতার সুযােগ পুরােমাত্রায় গ্রহণ করে পিছু ধাওয়া করে। এই চরম অবস্থায় জাকারিয়া, এমাদুদ, শফিক চৌধুরীসহ মােট ২৭জন মুক্তিযােদ্ধা প্রাণপণে যুদ্ধ করতে করতে প্রাণ দেয়।
পাকবাহিনীর অগ্রগতি ঠেকাতে সুবেদার তাবারক উল্লাহ এককভাবে যুদ্ধ করতে থাকে। কিন্তু ইতিমধ্যে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করাকালীন সময়ে তার অজান্তে সুবেদার তাবারক উল্লাহকে পাকসেনারা ঘিরে ফেলে। তবুও তাবারক উল্লাহর হাতিয়ার গর্জন করতেই থাকে, পাকবাহিনীরও ব্যাপক ক্ষতি হয়। কিন্তু পাকবাহিনীর জোয়ানরা অত্যন্ত বিপদের ঝুঁকি নিয়ে কয়েকজনের জীবনের বিনিময়ে সুবেদার তাবারক উল্লাহকে ঘিরে ফেলে। সে দিন সুবেদার তাবারক উল্লাহ ইচ্ছা করলে পশ্চাদপসারণ করে অতি সহজে নিজের জীবন রক্ষা করতে পারত। কিন্তু তাহলে পাকবাহিনী আরাে দ্রুত অগ্রসর হত আর মুক্তিবাহিনীর আরাে কত জীবনের ক্ষয়ক্ষতি হত তা কেউ জানে না। তাই তিনি নিজে যুদ্ধ করতে করতে পাকবাহিনীর উপর ঝাপিয়ে পড়লেন কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পিছু হটেননি। সহযােদ্ধাদের জীবন বাঁচাতে দেশপ্রেমের উজ্জ্বল নজির স্থাপন করে তিনি চির অমর হয়ে রইলেন। ইতিমধ্যে হাবিলদার ইলিয়াস পাটোয়ারী যুদ্ধের গুরুতর অবস্থা উপলব্ধি করে সহযােদ্ধা মােসলেমকে বলল, “মােসলেম, চল আমরা দেশের জন্য এবং আমাদের মুক্তিযােদ্ধাদের রক্ষা করতে জীবন দেই। সাথে সাথে মােসেলম রাজী হয়ে যায়—তারা দুটো এলএমজি নিয়ে অতি দ্রুত বিভিন্ন দিক থেকে বিভিন্ন স্থানে গিয়ে বেপরােয়া ফায়ার করতে থাকে যাতে হানাদারবাহিনী বােঝে যে, মুক্তিযােদ্ধারা নতুন করে শক্তি বাড়িয়ে পুনঃ যুদ্ধ শুরু করেছে। ইলিয়াস পাটোয়ারী আর মােসলেমের এলএমজির ফায়ার পাকসেনাদের সাময়িকভাবে হতভম্ব করে দেয় এবং তাদের অগ্রযাত্রা পুরােপুরি থামিয়ে দেয়।
তারা এসে থামে এক পুকুরের ধারে। দেখা গেল পুকুরের মধ্যে অনেক মুক্তিযােদ্ধারা বিভিন্ন স্থান থেকে আশ্রয় নিয়েছে। তারাও এগিয়ে এল। ধীরে ধীরে পশ্চাদপসারণের সিদ্ধান্ত হল। ক্ষুধায়, পিপাসায় আর ক্লান্তিতে সবার শরীর অবসন্ন। আরাে ঘন্টাখানেক অতিবাহিত হল, পাকবাহিনীর গােলাগুলি স্তিমিত হয়ে এলে মুক্তিযোেদ্ধারা ধীরে ধীরে এক নিরাপদ স্থানে জমা হল। ইতিমধ্যে মােসলেম ও ইলিয়াস পাটোয়ারী ছাড়া আর সকলে এসে একত্রিত হয়েছে—সবার দুশ্চিন্তা এই দু’জনও কি শহীদ হল? চলল খোঁজাখুঁজি। না কিছুক্ষণের মধ্যে তারাও এসে পড়ল। এ দু’জনকে পেয়ে সবাই সাময়িক ভাবে আনন্দিত হল, কিন্তু মাদরার এ সর্বনাশা যুদ্ধে ২৭ জন মুক্তিযােদ্ধা শহীদ হওয়ায় সবাই মুষড়ে পড়ল। একক কোন যুদ্ধে এত মুক্তিযােদ্ধার শহীদ হওয়ার ইতিপূর্বে আর ঘটেনি। এ যুদ্ধ মুক্তিযােদ্ধাদের বেশ হতাশ করে। কিন্তু মাত্র কয়েক দিনের বিশ্রামের পর নতুন করে আবার তারা শুরু করে সহযােদ্ধার রক্তের প্রতিশােধের অন্বেষায় নতুন নতুন আক্রমণ। (সূত্র : স্বাধীনতার দুর্জয় অভিযান, স, ম, বাবর আলী।)
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত