You dont have javascript enabled! Please enable it!
ভােমরার যুদ্ধ
ভােমরা সাতক্ষীরা শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলােমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় অবস্থিত। এখানে কাস্টমস্ অফিস ও বিওপি আছে; পার্শ্ব দিয়ে উত্তরদক্ষিণে ছােট্ট একটা মরা খাল প্রবাহিত যা ভারত ও বাংলাদেশের সীমান্ত নির্দেশ করছে। ওপারে ভারতের ঘােজাডাঙ্গা এবং ইস্টইন্ডিয়ার সীমান্ত গ্রাম। সাতক্ষীরা ট্রেজারী থেকে অস্ত্র সংগ্রহ ও ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে অপারেশনের আগেই এম এ গফুর ও সুবেদার আয়ুবের প্রচেষ্টায় ভােমরা কাস্টমস অফিসকে কেন্দ্র করে এখানে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প গড়ে ওঠে এবং সাতক্ষীরার আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ও ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ ভােমরায় সমবেত হন। এখান থেকেই স্বাধীনতার পরবর্তী কার্যক্রম পরিচালিত হতে থাকে। প্রাথমিক পর্যায় অর্থাৎ এপ্রিল মাসেই ভােমরায় ইপিআরদের সহায়তায় এখানে মুক্তিবাহিনীর অস্ত্র প্রশিক্ষণ শুরু হয়। কিছু আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মী এবং ছাত্রলীগের ছেলেরাই এখানে প্রথমে অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিতে এবং যুদ্ধবিদ্যা রপ্ত করতে শুরু করে। তারপর সাতক্ষীরা ট্রেজারী ও ন্যাশনাল ব্যাংক অপারেশনের পর ভােমরা ক্যাম্পে এসে আশ্রয় গ্রহণ করেন। প্রকৃতপক্ষে এই সময় মুক্তিযুদ্ধের জন্য কোন সেক্টরও গড়ে ওঠেনি বা আনুষ্ঠানিকভাবে কোন ক্যাম্পও খােলা হয়নি। অষ্টম ও নবম সেক্টরে এটাই ছিল প্রথম ক্যাম্প। 
ভােমরা গ্রামটা ছিল ভারত ও বাংলাদেশের স্থল সীমান্ত। এই সময় সীমান্তে এলাকা বলে কিছুই ছিল না, অবাধে লােকজন যাতায়াত করত। ২৯শে এপ্রিল, সকাল বেলা মুক্তিযুদ্ধে যােগ দিতে ইচ্ছুক ও যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শিতা অর্জনে আগ্রহীদের পিটি প্যারেড শেষ করে অস্ত্রের প্রশিক্ষণ ক্লাস ও গুলি করার প্রথম অভিজ্ঞতা লাভ করি আমরা ৩০-৪০জন। ইপিআর এর কয়েকজন প্রশিক্ষক অতি আন্তরিকভাবে আমাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। মুস্তাফিজ, কামরুল, সালাম, ইউনুস ভাই, আমিসহ অন্যান্যরা বেলা ৯টার দিকে সকালের রুটিন ওয়ার্ক শেষে ভােমরা পুকুর পাড়ে গােসল করার প্রস্তুতি নিচ্ছি এবং অস্ত্র পরিচালনার রােমাঞ্চকর প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে মতামত বিনিময় করছি। অনেকেই পুকুরে গােসল করছে, কেউ কেউ আশেপাশে স্বাধীনতা যুদ্ধের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে নানা রকম আলােচনায় রত। প্রায় বেলা ১০টা বেজে এসেছে, এমন সময় শুরু হল গুলির আওয়াজ। আমরা অনেকটা বিশেষ করে নতুন অস্ত্র শিক্ষার্থীরা অতি দ্রুত ভােমরা থেকে দৌড়ে ভােমরা খাল পার হয়ে রাস্তার ওপারে চলে গিয়ে ইপিআরদের সাথে মিশে অস্ত্র ধরি। ততক্ষণে ইপিআর বাহিনীও গােলাগুলি শুরু করেছে। এটাই ছিল এ অঞ্চলে অষ্টম ও নবম সেক্টরে পাকসেনাদের সাথে মুক্তিবাহিনীর প্রথম সংঘর্ষ। পাকসেনারা অতি সন্তর্পণে গাড়িযােগে সরাসরি ভােমরায় আসে অথচ আমাদের খবর পর্যন্ত কেউ দেয়নি। প্রায় ঘন্টা দু’য়ের জোর লড়াই চলে। তারপর পাকসেনারা ভােমরা ছেড়ে পুনরায় সাতক্ষীরায় প্রত্যাবর্তন করে। এই যুদ্ধে ইফু মিয়া নামক একজন ইপিআর সদস্য মারা যান।
প্রত্যক্ষ যুদ্ধে তিনিই মুক্তিবাহিনীর প্রথম শহীদ। এই যুদ্ধে সুবেদার আয়ুবের নেতৃত্বে ইপিআর-রাই মূল ভূমিকা পালন করে। আমরা তাদেরকে সহযােগিতা করে এবং এলােপাথাড়ি গুলি করে যুদ্ধক্ষেত্রে অস্ত্রচালনায় প্রথম অভিজ্ঞতা লাভ করি। খানসেনারা চলে গেলে আমরা সবাই ভােমরায় ফিরে আসি। আমাদের ক্যাম্প ছিল অক্ষত, খানসেনারা কোন কিছুই নিয়েও যায়নি বা ক্ষতি করেনি। তবে এ যুদ্ধ নিয়ে ব্যাপক আলাপ-আলােচনা চলতে থাকে।  এরপর থেকে শুরু হয় আরাে প্রশিক্ষণ, অতি কড়া প্রশিক্ষণ। বহু ছাত্র-যুবক এত কষ্ট করতে অস্বীকার করে এবং কঠিন নিয়ম শৃঙ্খলা মেনে চলতে অপারগ হওয়ায় ক্যাম্প থেকে বিভিন্ন সুবিধা মতাে স্থানে চলে যায়। কিন্তু আমাদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ চলতে থাকে। ইতিমধ্যে কুষ্টিয়া থেকে ইপিআর এর এক বাহিনী মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর নেততে ইস্টইন্ডিয়ায় চলে আসেন, সাথে ছিলেন ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দীন ও মেহেরপুরের তরুণ এসডিপিও মাহবুব। তাকে ক্যাপ্টেন র্যাঙ্ক’ দেওয়া হয়। আরাে ছিলেন তরুণ ছাত্রনেতা ও যােদ্ধা এএফএম মুরাদ। ফলে এখানে ক্যাম্পের জনবল, অস্ত্রবল বেড়ে যায় এবং সবাই খুব উৎসাহী হয়ে ওঠে।
এমনিভাবে দিন যায়, সপ্তাহ যায়, আসে ২৯শে মে। পাকহানাদারবাহিনী ভােমরা মুক্তিবাহিনী প্রতিরক্ষা ব্যুহ আক্রমণ করে। এ আক্রমণ ছিল আকস্মিক তবে অপ্রত্যাশিত নয়। বিপুল সমরাস্ত্র ও সৈন্য সমাবেশ ঘটিয়ে পাকবাহিনী প্রচন্ডভাবে মুক্তিবাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং ভারী ভারী সব অস্ত্র ব্যবহার করে। ইতিমধ্যে মুক্তিবাহিনীও বেশ চমত্তার প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধ ও অস্ত্র পরিচালনায় পারদর্শী হয়ে ওঠে। শক্তিশালী ইপিআর বাহিনী এ যুদ্ধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করে। এই যুদ্ধ পরিচালনায় যারা সাহায্য করেন তারা হলেন সুবেদার আয়ুব আলী, সুবেদার শামসুল হক ও সুবেদার আব্দুল জব্বার। প্রায় দুই কোম্পানী ইপিআর মুজাহিদ, আমাদের বাহিনী ও নতুন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযােদ্ধারা এ যুদ্ধে অংশ নেয়। খানসেনারা অত্যন্ত দুঃসাহসিকভাবে মুক্তিবাহিনীর উপর প্রথম চার ঘন্টা প্রচন্ড আক্রমণ চালায়। মুক্তিবাহিনী উঁচু রাস্তার পেছনে বাঙ্কার ও ট্রেঞ্চে অবস্থান নিয়ে পাকবাহিনীকে সাহসের সাথে মােকাবিলা করতে থাকে। এক পর্যায়ে হানাদারবাহিনী ক্রলিং করে মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষা ব্যুহের দিকে আসতে থাকলে মুক্তিবাহিনী ব্যাপক গােলাগুলি করতে থাকে।
২২ এফএফ পাকবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেনসহ ৩/৪ জন নিহত হয়। পাকবাহিনীর ক্যাপ্টেন প্রথমে গুলিতে গুরুতরভাবে আহত হয়ে তার বাহিনীকে বলতে থাকে, ‘ইয়ার হামকো গুলি লাগা, তােম সব আগে বাড়াে।’ অর্থাৎ বন্ধুগণ আমার গুলি লেগেছে, তােমরা এগিয়ে যাও। কিন্তু তার এ নির্দেশ শেষ হতে হতে সে মারা যায়। ফলে তার বাহিনী আর অগ্রসর হতে পারেনি। পাকক্যাপ্টেন নিহত হওয়ায় মুক্তিবাহিনী বেশ উল্লাসিত হয় এবং কয়েকজন ঐ লাশ আনতে যায়। তিন বীর মুক্তিযােদ্ধা ঐ লাশ আনতে গিয়ে শহীদ হন। এবং ঐ ক্যাপ্টেনের লাশ আনা হয়। তিন তিনটি মূল্যবান জীবন দিতে হয় ঐ লাশ আনতে। এছাড়া এ যুদ্ধে সুবেদার শামসুল হক বাঙ্কার থেকে মাথা তুলে এলএমজি চালাতে গেলে হঠাৎ করে পাকবাহিনীর গুলির আঘাতে তিনি প্রাণ হারান। অন্যদিকে সুবেদার আব্দুল জব্বার পেটে গুলি খেয়ে মারাত্মকভাবে আহত হন। তাঁর নাড়িভূড়ি বের হয়ে যায়। কিন্তু তিনি বেঁচে যান। এই যুদ্ধ প্রায় ১৬/১৭ ঘন্টা চলে। ভােমরা যুদ্ধে ইপিআর বাহিনী অপূর্ব রণকৌশল প্রদর্শন করে এবং পাকবাহিনী ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। খানসেনাদের মৃতদেহ ট্রাকে করে সাতক্ষীরা হয়ে যশাের ক্যান্টনমেন্টে নেয়া হয়। ভােমরা থেকে সাতক্ষীরা শহর পর্যন্ত রক্ত পড়তে পড়তে মাটি ভিজে যায়। তাদের কত লােক মারা যায় এ সম্পর্কে সঠিক তথ্য নেই। আর যেহেতু মুক্তিবাহিনী এবং ইপিআর মজবুত প্রতিরক্ষায় ছিল এবং পাকবাহিনী মাঠের ভিতর দিয়ে আসে তাই তাদের ক্ষয়ক্ষতি ছিল মারাত্মক রকমের। ভােমরার মাটিতে খানসেনাদের এই রক্তের দাগ দীর্ঘদিন বিদ্যমান ছিল।
ইপিআর বাহিনীর সুবেদার হাসান উদ্দীন ফকির, সুবেদার আবদুল জব্বার, সুবেদার রফিক, সুবেদার আবদুল ওদুদ, নায়েব সুবেদার কাজী আলী মােস্তফা, জাবিউল, লুৎফর রহমান, আবদুল মান্নান (শহীদ), লুৎফর রহমান (আহত), নানু মিয়া, হাবিলদার তরিকুল্লাহ (শহীদ), দুদু মিয়া, মােহাম্মদ আশরাফ উদ্দীন, মােঃ ইউনুস, আবদুল ওহিদ, মুজিবর রহমান, হাবিলদার জব্বার, মহীউদ্দীন, সালেহ আহমেদ, বাচ্চু মিয়া, আবদুর রাজ্জাকসহ অন্যান্যরা অতীব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মুখােমুখি এ যুদ্ধে খানসেনারা মুক্তিবাহিনীর উপর বার বার অসীম সাহসিকতা নিয়ে প্রচণ্ড আক্রমণ রচনা করে। কিন্তু সেই দিনের ইপিআর বাহিনীর শৌর্যবীর্য ও রণকৌশলের কাছে সুদক্ষ পাকবাহিনীর সব আক্রমণই চুরমার হয়ে যায়। মুক্তিবাহিনীর সম্মুখ সমরের ক্ষমতা দেখে সেদিনই খানসেনারা উপলদ্ধি করেছিল যে, পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল টিক্কা খান এক মাসের মধ্যে বিদ্রোহী বাঙালিদের শায়েস্তা করার যে মনমানসিকতা ও দম্ভোক্তি করেছিল তা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হবে।  মুক্তিবাহিনী এ যুদ্ধে ৯টি এলএমজি, দুই ইঞ্চি মর্টার, এসএলআর, ৩০৩ রাইফেল ও গ্রেনেড ব্যবহার করে। পাকসেনারাও অনুরূপ অস্ত্র ব্যবহার করে। তবে তাদের ছিল অটোমেটিক চাইনীজ রাইফেল। মান্ধাতার আমলের ৩০৩ রাইফেল তারা ব্যবহার করেনি। অথচ মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে মুক্তিবাহিনীর মূল হাতিয়ার ছিল ৩০৩ রাইফেল। ইপিআর বাহিনী ছাড়া অন্যান্যদের মধ্যে যারা এ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে তারা হলেন, মুস্তাফিজ, এএফএম মুরাদ, সালাম, কামরুল, হাবলু, আব্দুল মােমেন কাজল, নাজমুল, মাসুদ, আমি নিজে এবং আরাে অনেকে। (সূত্র : স্বাধীনতার দুর্জয় অভিযান, স, ম, বাবর আলী।)

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!