You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ২৫শে মে, শনিবার, ১১ই জ্যৈষ্ঠ, ১৩৮১

নজরুলঃ আত্মার পরম আত্মীয়

আজ বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৭৫তম জন্মবার্ষিকী। দেশের বিভিন্ন শিক্ষা ও সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠানসমূহ কবির জন্ম দিবস উপলক্ষে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। প্রতিবছর কবির প্রতি বাঙালি জাতি শ্রদ্ধাবনত চিত্তে সালাম জানায় এ দিনে। বাংলার মানুষের প্রাণ প্রিয় কবি নজরুল চিরদিনেই তাদের পরম শ্রদ্ধার পাত্র। ইতিহাসের অমোঘ দূত হিসেবে কবি বাঙালি মানস ও মননে চিরভাস্বর। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পর কবি নজরুল প্রায় দুবছর হলো বাংলাদেশে এসেছেন। তাকে সরকারি প্রযত্নে যেমন আনা হয়েছিল ঠিক তেমনি তাকে সরকারি প্রযত্নেই রাখা হয়েছে। বাংলাদেশ কবিকে আনার ঘটনাটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। জাতীয় কবির মর্যাদা দানের মহান লক্ষ্য ছিল কতৃপক্ষের সামনে। রুগ্ন স্মৃতিভ্রষ্ট কবি ঢাকায় এসে কিছুটা সুস্থ রয়েছেন বলে আমরা বিভিন্ন সময়ে শুনেছি। স্বাধীনতার পর কাজী নজরুল বাংলার মাটিতে যেদিন পা রেখেছেন সেদিন দেশের আবালবৃদ্ধবনিতা তাকে স্বাগত জানিয়েছিল। সরকার কবিকে জনগণের শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের সুযোগ করে দিয়েছিলেন। প্রায় দু বছর হতে চললো – আজও কবিকে প্রণাম জানাবার জন্য কবি ভক্তদের সমাগম ঘটে।
মূলতঃ কবির জন্ম দিবসকে সামনে রেখেই আমরা একটু বেশি পরিমাণে চঞ্চল হয়ে উঠি। কোভিদ কর্মজীবনের ব্যাপকতা অথবা তার জীবনের ফসল নিয়ে আমরা যথাযথ বা প্রতিনিয়ত কোন গবেষণা অথবা বাস্তব কোনো পর্যালোচনা করি না। জন্ম দিবসের দায়িত্ব পালনের জন্য আমরা সবাই একটু বেশি পরিমাণে তৎপর হয়ে উঠি। তারপর গোটা বছর কেটে যায় কবিকে আমরা আমাদের মানসপটে খুজিনা অথবা তাকে নিয়ে আমরা কোন বাস্তব পর্যালোচনা করি না। সে কারণে আমাদের ঐতিহ্য বহনকারী কতিপয় মহান ব্যক্তিত্ব ক্রমান্বয়ে শুধু জন্ম ও মৃত্যু দিবস পালনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। চিরকালের জন্য তাদের ঐতিহ্য ইতিহাস ধরে রাখার কোনো বাস্তব কর্মপন্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না। একটি জাতির জন্য এটা একটা দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার। ভবিষ্যৎ বংশধরদের কাছে তুলে ধরার মতো কোনো কৃতিত্বের স্বাক্ষর আমরা রাখতে সক্ষম হচ্ছি না।
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের আত্মার আত্মীয়। তার সারা জীবনের সাধনা হলো -দুঃখী মানুষের শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আগুন ছড়িয়ে দেওয়া। মানুষের জয়গান গাওয়াই কবির সাধনার মূল লক্ষ্য। তার সাহিত্য কর্মের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের প্রতিটি স্তরেই এ সত্য প্রমাণিত হয়েছে। তাই কবির মানবমুখী গান, কবিতা আবহমানকালের মানুষের কাছে বাণী হয়ে ধ্বনিত হবে। এতদসত্বেও কবি ছিলেন বাংলার ও বাঙালির কণ্ঠস্বর। ব্রিটিশ বেনিয়াদের শাসন থেকে জাতিকে মুক্ত করার জন্য তার যে তলোয়ারের ভাষা উদ্যত ফনার মত লেলিহান জিব্বা তুলে জাতিকে উদ্বুদ্ধ করেছে শোষকের বিরুদ্ধে খড়গ কৃপাণ হয়ে দাঁড়াতে তা শুধু অনবদ্যই নয় রীতিমতো বিস্ময়কর ব্যাপার। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে তার এইরূপ নতুন এবং জনাদৃত। কবি অন্যদিকে প্রেমের–নিতান্তই মানব প্রেমের অমোঘ সৌন্দর্য আকন্ঠ পান করে সুন্দরের অপরূপ পিয়াসী। তার সত্তা ললিতে এবং কঠোরে অপূর্ব হয়ে গড়া। তিনি কখনো অপরূপ কখনো ভয়ঙ্কর। তার এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণ তূর্য। তিনি সত্যের এবং সাহসের পূজারী। আর তিনিই একমাত্র কবি যিনি আমাদের ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসে একটি নতুন জনজাগরণের দিগন্ত উন্মোচন করেছিলেন। সেকালে তার পক্ষেই কেবল সম্ভব হয়েছিল বিশ্বখ্যাত কবি গুরুর কাছ থেকে আশীর্বাণী লাভের। রবীন্দ্র বলয়ের মধ্যে থেকে বেরিয়ে সেদিন তিনিই একটি নতুন আবর্তের জন্ম দিয়ে সাহিত্যে বিদ্রোহের সুর, নিপীড়িত মানুষের জয়গান ও আরব–তুরাণের ঐতিহ্যকে একীভূত ও সমন্বিত করে তুলে ধরেছিলেন। সাহিত্যকর্মের জন্য ও মানবতার জয়গানে জাতিকে উদ্বুদ্ধ করার দায়ে কবি নজরুল জেলের প্রকোষ্ঠেও কালাতিপাত করেছেন। কবির প্রতি সেই অমানবিক আচরণের কথা বাঙালি ও বাংলা সাহিত্য চিরকাল স্মরণ করবে। তার ঐতিহাসিক ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ যুগ যুগ ধরে সকল অত্যাচারিত মানুষের জবান বন্দী হিসেবে প্রতিধ্বনিত হবে।–‘যা অন্যায় বলে বুঝেছি, অত্যাচারকে অত্যাচার বলেছি, মিথ্যাকে মিথ্যা বলেছি,–কাহারো তোষামোদ করিনাই, প্রশংসার এবং প্রয়াসের লোভে কাহার পিছনে পোঁ ধরি নাই,–আমি শুধু রাজার অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করি নাই–সমাজের, জাতির, দেশের বিরুদ্ধে আমার সত্য তরবারির তীব্র আক্রমণ সমান বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে, তার জন্য ঘরে-বাইরের বিরূপ অপমান, লাঞ্ছনা, আঘাত আমার উপর অপর্যাপ্ত পরিমাণে বর্ষিত হয়েছে, কিন্তু কোনো কিছুর ভয়েই নিজের আপন ভগবানকে হীন করিনাই, লাভ লোভের বশবর্তী হয়ে আত্ম-উপলব্ধিকে বিক্রয় করি নাই, নিজের সাধনা লব্ধ বিপুল আত্মপ্রসাদকে খাটো করি নাই, কেননা আমি যে ভগবানের প্রিয়, সত্যের হাতের বীণা, আমি যে কবি, আমার আত্মা যে সত্যদ্রষ্টা ঋষির আত্মা।’
কবি নজরুলের এই পূণ্য জন্ম তিথিতে আমরা তার মঙ্গল কামনা করি।

দায়িত্ব বেশি কিন্তু বেতন নেই

শিক্ষকদের বেতন সংক্রান্ত সমস্যা বলিও এখন অন্যান্য নৈরাজ্যের অঙ্গীভূত হল। বেতন কম বা বেশি প্রাপ্তির প্রশ্ন নয় তারা এখন মোটে বেতন পাচ্ছেন না। পত্রিকান্তরে বিশেষ প্রতিবেদনে প্রকাশ করা হয়েছে বাংলাদেশের ৪০ হাজার প্রাথমিক স্কুল শিক্ষক গত দুই মাস থেকে বেতন পাচ্ছেন না এবং আগামী দুই মাস অর্থাৎ মে ও জুন মাসে তারা বেতন পাবেন না বলে জানা গেছে।
উক্ত সংবাদ সংস্থা আরো জানাচ্ছেন যে, বেসরকারি জরিপে জানা গেছে-রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর জেলায় প্রায় দশ হাজারের উপর সরকার নিয়ন্ত্রিত প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এরমধ্যে কেবলমাত্র রাজশাহীতে ২হাজার ১৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। এ বিদ্যালয়গুলিতে মোট ৮হাজার ৫শত ৫৬ জন শিক্ষক কর্মরত আছেন।
উক্ত সূত্র আরো জানাচ্ছেন, রাজশাহী জেলার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন দেওয়ার জন্য মাসে ২২ লাখ টাকা প্রয়োজন। এবং মার্চ, এপ্রিল, মে, জুন এ চার মাসের বর্তমান ঘাটতির জন্য স্থানীয় কর্তৃপক্ষ সরকারের কাছে ৭৫ লাখ টাকা চেয়ে পেয়েছেন মাত্র ১০ লাখ টাকা। এই প্রসঙ্গে আরও বলা হয়েছে, ওই পাঁচটি জেলার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন বাবদ প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ টাকার প্রয়োজন। কিন্তু প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জেলা কর্তৃপক্ষের কাছে নাকি বেতন দেওয়ার জন্য ওই পরিমাণ অর্থ নেই। এই অভিযোগের প্রেক্ষিতে জনশিক্ষা পরিচালকের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন যে, ওই অঞ্চলের শিক্ষকদের বেতন শোধ করার জন্য ইতিমধ্যেই তিনি জেলা কর্তৃপক্ষের নির্দেশ দিয়েছেন। জেলা কতৃপক্ষের তহবিলে অর্থ নেই। অথচ জনশিক্ষা পরিচালক বকেয়া বেতনসহ নির্দেশ দিয়েছেন-এ বৈপরীত্যের অর্থ আমাদের বোধগম্য নয়।
একথা অনস্বীকার্য যে, আমাদের দেশের শিক্ষক সমাজ সবচেয়ে অবহেলিত। অথচ তাদের হাতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্ব অর্পিত আছে। তবে সেসব আলোচনায় না গিয়ে একেবারে সুমুখের কথায় বলতে হয় যে, অল্প বেতনের শিক্ষকগণ দুই মাস বেতন না পেয়ে অশেষ দুঃখ কষ্টের মধ্যে জীবন যাপন করছেন। নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্যাদি সহ সকল প্রকার খাদ্য দ্রব্যের ঊর্ধ্ব মূল্যের বাজারে তারা দুই মাস বেতন না পেয়েও বেঁচে আছেন এটাই বিস্ময়।
স্বীকার করছি আমাদের দেশে শিক্ষা ও শিক্ষক সমস্যা নতুন নয়। এই সমস্যার সমগ্র উপমহাদেশটিরও সমস্যা বটে। তবে এও সত্য যে, শিক্ষাসংক্রান্ত সমস্যাবলী যে কোন জাতির উন্নয়নমূলক পরিকল্পনার প্রধান অন্তরায়। কারণ শিক্ষা একক কোনো কাজ নয়, তার সঙ্গে শিক্ষক ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত। আর শিক্ষক শুধু শিক্ষাই দেননা বলতে গেলে একটা জাতির ভিত্তিকে মজবুত করেন। সে দিক থেকে জাতীয় উন্নয়নের মূল স্তম্ভ তারাই। অথচ তারাই আজ অবহেলিত।
প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়-শিক্ষা ও শিক্ষক সংক্রান্ত কার্যাবলী তে সংশ্লিষ্ট দপ্তর সুচিন্তার বিন্যাস দেখাতে পারছেন না বলেই আমাদের ধারণা। কারণ দেশে কত বিদ্যালয় আছে, তার কতগুলি শিক্ষক আছেন এবং সবটাই মিলে সেই খাতে কত টাকা ব্যয় হতে পারে–এর একটা সুষ্ঠু হিসাবে যদি থাকে তাহলে শিক্ষকদের বেতন বাকি পড়ে কেমন করে? একি হিসেবে ভুল না উদাসীনতা অথবা তার চেয়েও নিকৃষ্ট কিছু?
শুধু তাই নয়–এর মধ্যে আবার নতুন স্কুল উদ্বোধন করা হয়। যদিও সরকারিভাবে মাধ্যমিক স্কুল প্রতিষ্ঠার কথা প্রায় না করা হয়েছে, তবুও বিশেষ সংবাদ সূত্রের মাধ্যমে জানা যাচ্ছে যে, গত এক বছরেই প্রায় দুশো স্কুল স্থাপন করা হয়েছে। এসব স্কুলের শিক্ষা উপকরণ স্কুলঘর ইত্যাদির অভাব স্বাভাবিকভাবেই থাকছে। এবং আরো থাকছে অর্থ সমস্যা। আঞ্চলিক স্বার্থে স্থাপন করা ওই সকল স্কুল পরে জনশিক্ষা দপ্তরের বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
বাংলাদেশের শিক্ষা সমপ্রসারণের জন্য বিদ্যালয় সংখ্যা বাড়াতে হবে এ অতি যথার্থ কথা। এবং এই কর্মসূচিতে ইউনিসেফের প্রদানের আশ্বাস নিয়ে এসেছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সম্প্রসারণ ও উন্নতির জন্য ইউনিসেফ ১৯৭৭২-৭৩ সালে ৩০ লক্ষ ডলার মুদ্রা সাহায্য করেছে এবং ১৯৮৪ সালে ৮০ লক্ষ ডলার, ১৯৭৫ সালে ১০০ লক্ষ ডলার ওই খাতে সাহায্য দেবে বলেও আশ্বাস দিয়েছে।
বাংলাদেশের শিক্ষা সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে ইউনিসেফের ওই সাহায্য খুবই উপকারে আসবে বলে আমরাও বিশ্বাস করি। কিন্তু তার এই পাশাপাশি প্রশ্ন জাগে কোন সাহায্যের আশ্বাসে বেহিসেবি বিদ্যালয় স্থাপন করা কি যুক্তিসঙ্গত? আর বেসরকারি হলেও তা বিদ্যালয় তো বটেই এবং তার যাবতীয় দায়-দায়িত্ব ক্রমে সরকারের উপর বর্তাবে। ফলে দেশে বিদ্যালয় স্থাপনের প্রশ্নের সংশ্লিষ্ট মহলকে অবশ্যই ওয়াকিবহাল থাকতে হবে। অন্যথায় ধরে নিতে হবে যে দেশে বিদ্যালয় স্থাপনের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। শিক্ষা জাতীয়করণের পথে এমন নজির শুভ নয়।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!