You dont have javascript enabled! Please enable it! কানাইঘাট যুদ্ধ - সংগ্রামের নোটবুক
কানাইঘাট যুদ্ধ
সিলেট জেলার পূর্বাঞ্চল খােয়াই-শায়েস্তাগঞ্জ রেললাইন ছাড়া পূর্ব ও উত্তর দিকে সিলেট ডাউকি সড়ক নিয়ে গঠিত হয় চার নম্বর সেক্টর। মেজর সি আর দত্ত (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল) সেক্টর কমান্ডার হিসেবে নিয়ােজিত ছিলেন। জেনারেল দত্ত পাকিস্তানসেনাবাহিনীর এফএফ (ফ্রন্টিয়ার ফোর্স) রেজিমেন্টের একজন সিনিয়র মেজর পদে চাকরি করছিলেন। ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে তিনমাসের ছুটিতে পশ্চিমপাকিস্তান থেকে হাজিগঞ্জে অবস্থান করছিলেন। পঁচিশে মার্চের কালােরাতের পর অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল রব (এমসিএ) ও মানিক চৌধুরী (এমসিএ) প্রমুখ আনসার, মুজাহিদ, পুলিশ, ছাত্র, কৃষক-শ্রমিক জনতাকে একত্রিত করে সিলেট শহরকে মুক্ত করার পরিকল্পনা করে মেজর দত্তকে যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হল। মেজর চিত্তরঞ্জন দত্তের নেতৃত্বে আনসার, মুজাহিদ, পুলিশ, ছাত্র ও জনতা সিলেট শহর হানাদারমুক্ত করার জন্য অগ্রসর হল। সীমান্ত চৌকিগুলােতে ইপিআর (বর্তমানে বিডিআর) বাহিনীকে যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য খবর পাঠানাে হল। বিভিন্ন উইং থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ইপিআর সৈনিসেরা মেজর দত্তের বাহিনীতে যােগ দিল।
১লা এপ্রিল মেজর দত্ত রশীদপুর থেকে রিয়ার হেড কোয়ার্টার মৌলভীবাজারে স্থানান্তর করেন। পথিমধ্যে নয়নপুরে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুখােমুখি সংঘর্ষ হয়। পাকবাহিনীর হাতে উন্নতমানের অস্ত্রশস্ত্র থাকা সত্ত্বেও হাজার হাজার মুক্তিযােদ্ধাদের জয় বাংলা’ ধ্বনিতে পাকবাহিনী মুক্তিবাহিনীর সংখ্যাগরিষ্ঠতার কথা ভেবে ভীত হয়ে পিছু হটে যায়। মৌলভীবাজার থেকে সিলেট আক্রমণ করা রণকৌশলগত দিক দিয়ে সুবিধাজনক ছিল। মৌলভীবাজারের অবস্থান এমন স্থানে ছিল যে সেখানে থেকে দু’টো প্রধান সড়ক সিলেট থেকে একটি কুলাউড়া হয়ে এবং অপরটি শেরপুর-শাদিপুর হয়ে মৌলভীবাজারে মিলেছে। যদি শত্রুরা কুমিল্লা অথবা ব্রাহ্মণবাড়িয়া যেতে চায় তাহলে মৌলভীবাজারে অনিবার্যভাবেই আসতে হবে। ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের দুটি প্লাটুন শেরপুরে এবং এক প্লাটুন সৈন্য শাদিপুরে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেয়। সিলেট আক্রমণের জন্য শেরপুর ও শাদিপুর ছিল অত্যন্ত গরুত্বপূর্ণ স্থান। পাকবাহিনীর কাছে স্বয়ংক্রিয় মেশিনগান, তিন ইঞ্চি মর্টার ও চাইনিজ রাইফেল ছিল। শেরপুর-শাদিপুর পারাপারের ফেরী নৌকাগুলাে পাকবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ছিল।
৪ঠা এপ্রিল রাত দশটায় মুক্তিবাহিনী তিনভাগে বিভক্ত হয়ে নৌকায় পার হয়ে শেরপুর অভিমুখে যাত্রা শুরু করে। ৫ই এপ্রিল ভাের পাঁচটার সময় পাকবাহিনীর উপর আক্রমণ শুরু হয়। দুপুর ১২টা পর্যন্ত এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলতে থাকে। পাকসেনাদের মর্টারের গােলার আঘাতে অনেক ঘরবাড়ি ধ্বংস হয় এবং অনেক গ্রামবাসী প্রাণ হারায়। এই যুদ্ধে অধিকাংশ পাকসেনা নিহত হয়। তিনজন মুক্তিযােদ্ধা শহীদ হন এবং অনেক আহত হন। শাদিপুর মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে। এই সময়ে দত্তের অনুরােধে শফিউল্লাহ (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল ও যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের হাই কমিশনার হিসেবে কর্তব্যরত) ক্যাপ্টেন আজিজের নেতৃত্বে কুলাউড়া, শেওলা, সুতারকান্দি, গােপালগঞ্জ হয়ে সিলেটের সুরমা নদীর দক্ষিণ তীরে প্রতিরােধ গড়ে তােলে। সিলেট শহর থেকে প্রায় তিন মাইল দূরে কদমতলীতে পাকসেনাদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় এবং পাকসেনারা সিলেট শহরে চলে যায়। ক্যাপ্টেন আজিজ সুরমা নদীর দক্ষিণ তীরে প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা করেন। অন্যদিকে মেজর দত্ত শাদিপুর হয়ে সিলেটের পথে অগ্রসর হতে থাকেন। মুক্তিবাহিনী বিশ্বনাথপুরে পাকবাহিনীর অবস্থানের উপরে আক্রমণ চালায়। পাকসেনারা মুক্তিবাহিনীর প্রচন্ড আক্রমণের মুখে হতদ্যম হয়ে পিছু হটে সিলেট শহরে পালিয়ে যায়। ৭ই এপ্রিল শুধুমাত্র সিলেট বিমান বন্দর এবং লাকাতুরা চা বাগানের কিছু অংশ ছাড়া সমস্ত সিলেট জেলা মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে।
৮ই এপ্রিল চিত্তরঞ্জন দত্ত ভারতের শিলচর থেকে ফিরে আসার আগেই পাকসেনারা শালুটিকর বিমান বন্দর ও লাকাতুরা এলাকা থেকে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালায়। এর আগে পাকবাহিনী বিমানযােগে ঢাকা থেকে ব্যাপকভাবে সৈন্য ও অস্ত্র নিয়ে আসে। ১০ই এপ্রিল বিকাল পাঁচটায় পাকসেনারা খাদিমনগরে অবস্থানরত মুক্তিবাহিনীর উপরে স্থল ও বিমান হামলা চালায়। মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে ভারী অস্ত্রশস্ত্র না থাকায় তারা পেছনে সরে এসে হরিপুরে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেয়। এই সময় শালুটিকর বিমান বন্দরের রানওয়ে ধ্বংস করে দেয়ার জন্য ১৯শে এপ্রিল আক্রমণ চালান হয় এবং সারারাত অবিরাম গােলাবর্ষণ করে রানওয়ের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করা হয়। পাকবাহিনীর অব্যাহত আক্রমণের মুখে ক্যাপ্টেন আজিজের কোম্পানি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। পরে অবস্থানরত মুক্তিবাহিনী সিলেটের দিকে অগ্রসর হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু আকস্মিকভাবে ২০শে এপ্রিল ভােরে তিনদিক থেকে গােলন্দাজ, মর্টার, মেশিনগান দিয়ে পাকসেনারা আক্রমণ চালায়। মুক্তিযােদ্ধারা স্বাভাবিকভাবেই এই সর্বাত্মক আক্রমণের মুখে টিকে থাকতে না পেরে বিচ্ছিন্নভাবে নানা দিকে ছড়িয়ে পড়ে। মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে মুক্তিযােদ্ধারা ভারতের সখাপুঞ্জী নামক স্থানে আশ্রয় নেয় এবং পুনর্গঠিত হওয়ার জন্য সচেষ্ট হয়।
তবু পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর সংঘর্ষ অব্যাহত থাকে। সুতারকান্দিতে পাকসেনাদের সঙ্গে বড় ধরনের যুদ্ধ হয় ২৪শে মে। পাকবাহিনী সি-১৩০ বিমানযােগে সৈন্যবৃদ্ধি করতে থাকে। অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাবারুদের অভাবে মুক্তিবাহিনী টিকে থাকতে পারেনি। গােপালগঞ্জ প্রতিরক্ষা অবস্থান ছেড়ে বড়গ্রাম বিওপি এলাকাতে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেয়। শেওলাঘাট থেকে কুশিয়ারা নদী অতিক্রম করে পাকবাহিনীকে বাধা দেয়ার জন্য মুক্তিবাহিনীর এক কোম্পানি সৈন্য শেওলাঘাটে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেয় মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে। বড়গ্রাম থেকে ক্যাপ্টেন রবের নেতৃত্বে মাঝে মাঝে পাকসেনাদের ওপরে। আক্রমণ চলতে থাকে।
ক্যাপ্টেন রব (বর্তমানে কর্নেল) ১৯শে জুন লাঠিটিলায় অবস্থিত পাকঘাঁটি আক্রমণ করেন। একটি ছােট টিলার ওপর পাকসেনারা অবস্থান করছিল। ভারতীয় গােলন্দাজ বাহিনী এই আক্রমণে গােলা নিক্ষেপ করে মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করে। ক্যাপ্টেন রবের নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধারা পাকসেনাদের সম্মুখভাগে চার্জ করে। এই যুদ্ধে ২২ বেলুচ রেজিমেন্টের একজন হাবিলদার ও একজন সিপাই জীবিত আত্মসমর্পণ করে। ৪ জন মুক্তিযােদ্ধা আহত হন। একই সময়ে ক্যাপ্টেন শরিফুল হক ডালিম কুকিতল সাব সেক্টরে। দিখলখুশ ও জুরি এলাকায় পাকবাহিনীকে প্রচণ্ডভাবে আক্রমণ করেন। এই যুদ্ধে ক্যাপ্টেন শরিফুল হক ডালিম গুরুতরভাবে আহত হন।
১০ই আগস্ট ক্যাপ্টেন রব শাহবাজপুরে (লাতু) রেলওয়ে স্টেশন আক্রমণ করেন। ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের একটি কোম্পানি ও কিছু রাজাকার এখানে অবস্থান করছিল। ক্যাপ্টেন রবের নেতৃত্বে পাঁচটি মুক্তিবাহিনী কোম্পানি একযােগে আক্রমণ করে। একটি কোম্পানি বিয়ানী বাজার থেকে সাহায্যের সকল পথ রুদ্ধ করে দেয়। মাত্র পনেরাে মিনিটের মধ্যে শাহবাজপুর রেলওয়ে স্টেশন মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। পরে অবশ্য পাকবাহিনীর পাল্টা আক্রমণে মুক্তিবাহিনী পেছনে সরে আসতে বাধ্য হয়। এই যুদ্ধে ৬জন মুক্তিযােদ্ধা শহীদ হন।
২০-২১শে নভেম্বর রাতে জাকিগঞ্জ ও আটগ্রাম মুক্ত হয়। এই যুদ্ধে ভারতীয় ৯১ মাউন্ট ব্যাটালিয়ন ও ১ম ইস্টবেঙ্গলের বীর সৈনিকরা অংশগ্রহণ করে। ২১শে নভেম্বর ক্যাপ্টেন রব সালামটিলা দখল করেন এবং ২২শে নভেম্বর লেঃ জহির রাজটিলা শত্রুমুক্ত করেন। জেড ফোর্স অধিনায়ক লেঃ কর্নেল জিয়া (প্রয়াত রাষ্ট্রপতি) ক্যাপ্টেন রবকে কানাইঘাট আক্রমণের নির্দেশ দেন। সুরমা নদীর পাড়ে কানাইর ঘাটে পাকঅবস্থানের জন্য সামনে অগ্রসর হওয়া যাচ্ছিল না। ১ম ইস্টবেঙ্গল জামালপুর-চরখাই-সিলেট অক্ষে অগ্রসর হচ্ছিল। ২৬শে নভেম্বর চারগ্রাম শত্রুমুক্ত হয় এবং ২৮শে নভেম্বর চারখাই এলাকায় শত্রুর মুখােমুখি হতে হয়। রেকি করে জানা গেল পাকবাহিনীর একটি ব্যাটালিয়ন সুদৃঢ় প্রতিরক্ষা অবস্থান নিয়েছে। ১ম ইস্টবেঙ্গলকে কানাইঘাট দখল করে সিলেট অভিমুখে যেতে নির্দেশ দেয়া হয়। এ কোম্পানিকে যথাক্রমে চরখাই ও আটগ্রামে নিয়ােজিত রাখা হয়। ২৯শে নভেম্বর কানাইঘাটে শত্রুর অবস্থান রেকি করা  ‘বি’ কোম্পানি এলাকায় মেশিনগানে গুলিবর্ষণের শব্দ শােনা যায়। লেঃ ওয়াকার হাসান (বর্তমান অবসরপ্রাপ্ত মেজর ও স্বাধীনতা যুদ্ধে বীর প্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত) প্রতিরক্ষা অবস্থানে প্রস্তুত হয়েই ছিলেন। ভাের পাঁচটায় পাকসেনাদের কামানের গােলা নিক্ষেপ শুরু হল। প্রায় আধঘণ্টা ধরে এই গােলা নিক্ষেপ চলে। তারপর পাকসেনারা আক্রমণ করে। অগ্রবর্তী দুই প্লাটুনের ফাক দিয়ে শত্রু সৈন্য ঢুকে পড়ে। লেঃ ওয়াকার মেশিনগান দলকে গুলিবর্ষণ অব্যাহত রাখতে নির্দেশ দিয়ে ২০০ গজ সামনে ডানদিকে প্ল্যাটুনের দিকে দৌড়ে যান। প্রচন্ড গুলিবর্ষণের মধ্যে ওয়াকার হাসান ও তার সহযােগী যােদ্ধাদের সঙ্গে পাকসেনাদের হাতাহাতি যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। প্রায় ৪৫ মিনিট প্রচণ্ড যুদ্ধের পরে কানাইঘাট পুনর্দখল হয়। ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের মেজর সরােয়ার ও ২৫জন পাকসেনা আত্মসমর্পণ করে। ৮৭জন পাকসেনার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। পাকসেনাদের অনেকেই নদীতে ঝাপ দিয়ে মৃত্যুবরণ করে। এই যুদ্ধে লেঃ গিয়াসের নেতৃত্বে এক কোম্পানি সৈন্য দরবশত কানাইঘাট সড়কে এবং লেঃ জহিরের নেতৃত্বে এক কোম্পানি সৈন্য কানাইঘাট চরখাই সড়কে কাট অফ পার্টি হিসেবে নিয়ােজিত রাখা হয়।
পাকসেনারা দরবশতে প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা করল। মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে ৭ই ডিসেম্বর দরবশত ছেড়ে হরিপুরে প্রতিরক্ষা অবস্থান নিল। ১২ই ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী হরিপুর আক্রমণ করে এবং ১৩ই ডিসেম্বর সম্পূর্ণ মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে।
খাদিমনগরে অবস্থিত ছিল পাকসেনাদের শেষ অগ্রবর্তী ঘাঁটি। ১৫ ডিসেম্বর মিত্র বাহিনী ও মুক্তিবাহিনী যৌথভাবে আক্রমণ করে এবং খাদিমনগর দখল করে নেয়। পাকসেনারা আত্মসমর্পণ করে ১৭ই ডিসেম্বর। সিলেট তখন মুক্তশহর, রাজপথে লক্ষ মানুষের বিজয় মিছিল। টেংরাটিলা যুদ্ধ ৩০শে নভেম্বর রাধানগর শত্রুমুক্ত হওয়ার পরে পাকিস্তানীদের হতাহতের সংখ্যা ব্যাপক বলে জানা যায়। সেই তারিখে সম্মিলিত মুক্তিবাহিনী গােয়াইনঘাটের দিকে অগ্রসর হয় এবং গােয়াইনঘাট নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। শেলা সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন হেলালও তার সেবা-সেক্টরে ব্যাপক তৎপরতা অব্যাহত রেখেছিলেন। নভেম্বরের মধ্যে পাকিস্তানীদের যােগাযােগের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সড়ক (সুনামগঞ্জ-সিলেট সড়ক) বিচ্ছিন্ন করার জন্যে সেক্টর কমান্ডার মেজর শওকত, লেঃ মাহবুবুর রহমান এবং লেঃ রউফকে নির্দেশ দেন। লেঃ মাহবুব অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে তাঁর বাহিনী নিয়ে পাগলা সেতু ধ্বংস করলেন। এখানে প্রহরারত পাকসেনাদের বেশ কয়েকজন হতাহত হয়। লেঃ রউফ তার বাহিনী নিয়ে অত্যন্ত প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে দিয়েও জাওয়া রেল এবং সড়কসেতু ধ্বংস করতে সমর্থ হন। | টেংরাটিলাতে ছিল পাকিস্তানীদের একটা বড় ঘাঁটি। টেংরাটিলা আক্রমণের পূর্বে সেক্টর কমান্ডার মেজর শওকত তার বাশতলা সেক্টর হেড কোয়ার্টারে ২০শে নভেম্বর এক কনফারেন্স আহ্বান করলেন। সভাতে টেংরাটিলা আক্রমণের বিষয় নিয়ে মেজর শওকত বিস্তারিত আলােচনা করলেন। ঐ সভায় অন্যান্যদের মধ্যে যারা উপস্থিত ছিলেন তারা হলেন-ক্যাপ্টেন মহসিন, ক্যাপ্টেন আকবর, ক্যাপ্টেন হেলাল, লেঃ মাহবুবুর রহমান এবং কিছু সংখ্যক এফএফ লীডার।
সিদ্ধান্ত অনুসারে ২৭/২৮শে নভেম্বর টেংরাটিলা রেকি করা হল। ২৯শে নভেম্বর মুক্তিবাহিনীর ৪টি কোম্পানি টেংরাটিলার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে ৩০শে নভেম্বর নির্দিষ্টস্থানে পৌছে নিজ নিজ প্ররিতক্ষা ব্যুহ রচনা করে। পরিকল্পনা অনুসারে ৩য় বেঙ্গলের ক্যাপ্টেন মহসিন তার কোম্পানি নিয়ে ডান দিকে এবং ৩য় বেঙ্গলের কোম্পানি ক্যাপ্টেন নিয়ে বাঁদিকে ফ্লাঙ্কগার্ড হিসাবে রইলেন। লেঃ রউফ রইলেন ডানদিকের ফ্লাংগার্ডে। এই অপারেশন পরিচালনার ভার নিলেন সেক্টর কমাণ্ডার নিজে। ৩০শে নভেম্বর ৭টায় মুক্তিবাহিনী প্রথম আক্রমণ করল। পাকিস্তানীরা সঙ্গে সঙ্গে পাল্টা গুলি চালায়। উভয়পক্ষের মধ্যে গুলি বিনিময় ক্রমশ তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। মুক্তিবাহিনীর ধারণা ছিল চারিদিক থেকে ঘেরাও করে আক্রমণ অব্যাহত রাখলে নিশ্চয়ই পাকসেনারা আত্মসমর্পনে বাধ্য হবে। কিন্তু পাকিস্তানীদের প্রতিরক্ষা ব্যুহ এমন দৃঢ় ছিল যে, মুক্তিবাহিনী কিছুতেই সামনে অগ্রসর হতে পারছিল না। অবশ্য পাকসেনারা তাদের সঙ্গীণ অবস্থার কথা অনুমান করতে পেরেছিল। আর তাই কয়েকবার তারা পালাবার চেষ্টাও করে। কিন্তু মুক্তিবাহিনী সে চেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়। অবশেষে প্রচন্ড গােলাগুলির মধ্যে রাতের আঁধারে তারা একটি পায়ে চলা পথে জলের ভিতর দিয়ে তাদের যাবতীয় রেশন,গােলাগুলি ফেলে পালিয়ে যেতে সমর্থ হয়। ৫ই ডিসেম্বর রাত পর্যন্ত মুক্তিবাহিনী তাদেরকে ঘেরাও করে রেখেছিল।
সাতক্ষীরা ট্রেজারী থেকে অস্ত্র সংগ্রহ ও বন্দি এস ডি ও
চারদিকে যুদ্ধের দামামা বেজে গেছে। অনিবার্য যুদ্ধকে সামনে রেখে বীর বাঙালি এগিয়ে যায় ধাপে ধাপে। পাইকগাছা, কয়রা, আশাশুনি এলাকা থেকে নির্বাচিত এমএনএ গফুর সাহেব সাতক্ষীরা আসায় সাতক্ষীরার ছাত্র-যুব কর্মীরা প্রাণ ফিরে পায় এবং তাদের আশা উদ্দীপনা বৃদ্ধি পায়। গফুর ভাই বিপ্লবী চিন্তাধারার রাজনীতিক এবং বামপন্থি রাজনীতির উপর তার লেখাপড়া বেশ। সর্বত্রই সগ্রাম পরিষদ, আওয়ামী সেচ্ছাসেবক বাহিনী ও স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মাধ্যমে প্রতিরােধ সৃষ্টির লক্ষ্যে ব্যাপক কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছেন। জেলা শহর খুলনা যখন খানসেনারা দখল করেছে, তখন মহকুমা শহর সাতক্ষীরায় শীঘ্রই পাকসেনা আসবে নিশ্চিত, এটা কেবলমাত্র সময়ের ব্যাপার। সুতরাং এই হায়েনার দলকে রুখে দাড়ানাের জন্য চাই অস্ত্র । কিন্তু অস্ত্র কোথায় পাওয়া যাবে? সাতক্ষীরা ট্রেজারীতে অস্ত্র আছে। অতএব পুলিশের সাথে যােগাযােগ করে অস্ত্র নেয়া যায় কিনা চিন্তাভাবনা হল। মােটেই দেরি না করে গফুর ভাই, সুবেদার আয়ুব, পুলিশের এসডিপি ওর সাথে আলাপ করলেন। খুলনা জেলার পুলিশ সুপার এআ খন্দকার বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধারক ও বাহক ছিলেন। তিনি পূর্বেই আওয়ামী লীগ নেতৃত্বে। গঠিত সংগ্রাম পরিষদের সাথে যােগাযােগ রেখে তাদের কথা মতাে কাজ করার জন্য তাঁর অধীনস্ত পুলিশ বাহিনীকে গােপন নির্দেশ দেন। সুতরাং এসডিপিও (মহকুমা পুলিশ অফিসার) অস্ত্র দিয়ে দিতে রাজী হলেন। সাতক্ষীরা ট্রেজারী থেকে ৩৫০ টা ৩০৩ রাইফেল ও ৩০/৪০ বাক্স গুলি পাওয়া গেল। মুস্তাফিজ, কামরুল ইসলাম খান, মাসুদ, এনামুল, হাবলু প্রমুখ অস্ত্র ও গােলাবারুদ গ্রহণ করে। এই সময় পুলিশের ভূমিকা ছিল প্রশংসার যােগ্য। স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে এসব অস্ত্র লাভ মুক্তিযুদ্ধের গতিপ্রকৃতিতে নতুন মাত্রা যােগ করে এবং ছাত্র-যুব-তরুণদের মনে প্রচন্ড আশার সঞ্চার করে।
তারা আরাে আত্মপ্রত্যয় নিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।  ছাত্র-যুবকদের এই সময় সশস্ত্র যুদ্ধ সম্পর্কে যেমন কোন ধারণা ছিল না তেমনি ওদের ছিল না অস্ত্রের কোন প্রশিক্ষণ। কিন্তু দেশকে হানাদার মুক্ত করার জন্য এসব তরুণ ছাত্র যুবক বুকের তাজা রক্ত অকাতরে ঢেলে দিতে সদা প্রস্তুত। সাহস আর প্রাণপ্রাচুর্য্যে এদের কোন তুলনা হয় না। কাজল নামক একটা ছেলে আসে, সে ছিল পিএন দশম শ্রেণীর ছাত্র। তার আব্বা আশরাফ উদ্দিন খান ভােমরায় এসে স্বীয় পুত্র, কাজলকে বাড়ি নিয়ে যেতে চান। কাজলের বাড়ি ছিল সাতক্ষীরার পলাশপােলে। কাজলে আব্বার আগমনের খবর পেয়ে অনেক ছাত্র যুবকই তাকে ঘিরে ধরে এবং সাতক্ষীরার মােস্তাফিজ কাজলের আব্বাকে বলে, “চাচা কাজল আপনার ছেলে একথা ঠিক, কিন্তু আমরা কি আপনার কেউ নই?’ তখন কাজলের আব্বা জবাব দেন যে, কাজলের মা ছেলের জন্য খুবই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আর চারদিকে যে অবস্থা তাতে কাজলের মা খুবই কান্নাকাটি করছে। তখন অন্যান্য ছেলেরা বলে, চাচা আমাদের বাড়িতে আমাদের মা-বাবাও তাে কান্নাকাটি করছে। তখন কাজলের আব্বা সবাইকে দোয়া করে, কাজল শহীদ হয়। কাজল ছিল হৃষ্টপুষ্ট চমৎকার চেহারার সুন্দর প্রাণবন্ত একটা ছেলে।  সাতক্ষীরা মহকুমায় ঐ সময় এসডিও ছিলেন পাঞ্জাবী, নাম তার খালেদ মাহমুদ, একজন সিএসপি অফিসার। এই পাঞ্জাবী এসডিও নিশ্চিতভাবে ভবিষ্যতে পাকিস্তানীদের পক্ষে এবং বাঙালিদের বিরুদ্ধে কাজ করবে। তাই তাকে ধরে ফেলার সিদ্ধান্ত হয়। এমএনএগফুর সুবেদার আয়ুবসহ ছাত্রনেতৃবৃন্দ এসডিও খালেদ মাহমুদকে গ্রেফতার করে মুসলীম লীগের গফুর সাহেবের বাড়িতে তার জিম্মায় রাখেন। সাতক্ষীরায় এই সময় দু’জন গফুর ছিলেন। একজন মুসলীম লীগের গফুর যিনি পরবর্তীতে সংগ্রাম পরিষদের কোষাধ্যক্ষ হন। কিন্তু পরে পাকিস্তানীদের সেবাদাস বনে যান এবং অন্যজন সংগ্রামী বীর এমএনএ গফুর, যিনি নবম সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক।
২৯শে মার্চ, এসডিও খালেদ মাহমুদকে ভােমরায় আনার জন্য গফুর ভাই সহ কয়েকজন ছাত্রনেতা গফুর সাহেবের বাড়িতে যান। কিন্তু তিনি এসডিও কে হস্তান্তর করতে অস্বীকার করেন। সাথে সাথে ভােমরায় খবর পাঠানাে হয় সুবেদার আয়ূবকে। তিনি খবর পেয়েই এক গাড়ি ইপিআর সহ অতি দ্রুত মুসলীম লীগের গফুর সাহেবের বাড়িতে উপস্থিত হন। কিন্তু গফুর সাহেব এসডিওকে হস্তান্তর করতে একদম নারাজ। বহু কথা কাটাকাটি হয়, কিন্তু কাজ হল না। অতএব তাকে বন্দি করে গাড়িতে তােলা হল। তার বন্দুক নিয়ে নেয়া হল। এমন সময় গফুর সাহেবের পুত্রবধু (সিরাজের স্ত্রী) গফুর সাহেবের প্রাণের বিনিময়ে তাদের বাড়ির এক বাথরুমের ভিতর থেকে এস. ডি. ওকে ভােমরায় আনা হল। ভােমরা কাষ্টম অফিস তখন মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প। সাতক্ষীরার এসডিও কে বন্দি করে আনা হয়েছে, তাকে দেখতে বহু লােকজন জমা হয়ে গেছে। গফুর ভাই ও সুবেদার আয়ুবের এ ধরনের কাজ ও সাহসিকতার প্রশংসা করছে সবাই। এবং জিম্মাদার মুসলীম লীগের গফুর সাহেবের নিন্দা করছে। বিদ্যুৎ বেগে এ খবর রটে গেল চারদিকে, লােকমুখে এ খবর জেনে ছুটে এলেন এমএনএ কামালবখত সাকী। তিনি গফুর ভাইয়ের উপর প্রচন্ডভাবে রেগে গিয়ে তাকে ধমকাতে লাগলেন, কেন এসডিও কে এভাবে আনা হল? সাকী সাহেবের কথায় সাতক্ষীরার ছাত্র-যুবকরা দারুণভাবে আহত হল। পাঞ্জাবী এসডিওর প্রতি তার এই দরদের অর্থ ঠিক বুঝা গেল না।
সালাম, মুস্তাফিজ, কামরুল গফুর ভাইয়ের পক্ষ নিয়ে সাকী সাহেবের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন। সাকী সাহেব মনের আগুনে জ্বলতে জ্বলতে স্থান ত্যাগ করতে বাধ্য হলেন। পরে এসডিও খালেদ মাহমুদকে বন্দি হিসেবে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের নিকট হস্তান্তর করা হয়। সাতক্ষীরা ট্রেজারী থেকে অস্ত্র গ্রহণ এবং পাঞ্জাবী এসডিও খালেদ মাহমুদকে বন্দি করে আনার ঘটনা ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এর প্রতিক্রিয়াও ছিল ব্যাপক এবং সুদূর প্রসারী। একদিকে পাকবাহিনী ক্ষিপ্ত হয়ে যায়, পক্ষান্তরে মুক্তিবাহিনীর ছাত্র-যুবকের মধ্যে অভিনব রােমান্টিকতার সৃষ্টি করে।  (সূত্র : স্বাধীনতার দুর্জয় অভিযান, স, ম, বাবর আলী )

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত