You dont have javascript enabled! Please enable it! লায়ন্স সউলের স্মরণীয় অপারেশন - সংগ্রামের নোটবুক
লায়ন্স সউলের স্মরণীয় অপারেশন
১৪ই ডিসেম্বর বিকেল বেলা। মেজর জয়নুল আবেদীন খান, গাজী রহমত উল্লাহ দাদু, লেঃ আরেফিন, শেখ আব্দুল কাইয়ুম, নূরুল ইসলাম, ইসলাম বন্দ, আখতার বন্দ, দাউদ, অন্তবুনিয়ার রেজাউল করীম প্রমুখ খুলনা লায়ন্স স্কুল ও খুলনা রেডিও স্টেশনের পাকসেনাদের ঘাঁটিতে এক দুঃসাহসিক আক্রমণ চালায়, আমার আর যাওয়া হয়নি। বিকেল ৪টায় আক্রমণ শুরু করার কথা। নদীতে ভাটা ছিল, তাই নির্ধারিত সময়ের আগেই সবাই পজিশনে চলে যায় এবং আক্রমণ শুরু হয়। এ আক্রমণের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল খানসেনাদের ফায়ারিং ক্যাপাসিটি সম্পর্কে ধারণা লাভ করা এবং তাদের অবস্থান সম্পর্কে প্রকৃত তথ্য জানা। বাংলার গ্রামাঞ্চলে ও ভারত সীমান্ত এলাকায় ব্যাপক মার খাওয়ার পর তারা জেলা শহর খুলনায় চলে আসে এবং তারা এক রকম নিশ্চিত ছিল যে, মুক্তিবাহিনী শীঘ্রই শহর ঘেরাও করবে এবং তাদের উপর প্রচন্ড আক্রমণ চালাবে। দীর্ঘ দিনের যুদ্ধে ওদের অভিজ্ঞতা হয়েছিল যে, বৈরীভাবাপন্ন পরিবেশে তারা আর যাই হােক যুদ্ধ জয়ের আশা করতে পারে না। পৈতৃকপ্রাণ নিয়ে কিভাবে চলতে চলতে তারা একটা খালের ধারে আসে। কমান্ডারের নির্দেশ ‘খাল পার হয়ে চল’। অতঃপর সকলে সাঁতরিয়ে খাল পার হয়। কাদা মাটি, ঘাস, ধান, খাল-বিল অতিক্রম করা এক দুর্বিসহ কাজ ছিল। কিন্তু দেশ মুক্তির নেশায় সবাই সবকষ্ট সাময়িকভাবে ভুলে যায়। এই যুদ্ধের নেতৃত্বে ছিলেন মেজর জয়নুল আবেদীন খান ও রহমতুল্লাহ দাদু। ছেলেদের মনােবল ছিল খুব বেশি, তার উপর লেঃ আরেফিনের চৌকশ কথাবার্তায় সবাই শত্রুপক্ষের উপর তীব্র চাপ সৃষ্টি করে চলল। মুক্তিবাহিনী তখন মেজর জয়নুল আবেদিন ও রহমাতুল্লাহর দাদুর নেতৃত্বে এগিয়ে চলেছে।
তারা কেউ ৫০০ গজের মধ্যে, আবার কেউ কেউ ১০০ গজের মধ্যে। তখন শক্রর গােলাবর্ষণ আরাে বৃদ্ধি পেল। মেজর সাহেব এলএমজি নিয়ে শক্রদের উপর আক্রমণ করছেন, লেঃ আরেফিন ২ ইঞ্চি মর্টার চালিয়ে শত্রুর ঘাঁটি ধ্বংসের প্রচেষ্টায় লিপ্ত। ছেলেরা খালের মধ্যে, শত্রুপক্ষের গেলােগুলাে এসে আশেপাশে কাদায় পড়ছে,কিন্তু বিস্ফোরিত হচ্ছে না, যা ছিল আল্লাহর রহমত স্বরূপ। কাইয়ুম, তপন এবং অন্যান্য বিলের মাঝে একটি ইটের স্থূপ পায় এবং এটাকে আশ্রয় করে তারা গল্লামারী ব্রীজ ও রেডিও স্টেশনের উপর আক্রমণ অব্যাহত রাখে। | ইতিমধ্যে বেলা পড়ে আসছে। পশ্চিম দিগন্তে সূর্যটা ডুবু ডুবু। কিন্তু মহা সমস্যা হিসেবে দেখা দিল জোয়ারের পানি। ভাটায় নদীর পানি কম থাকায় মুক্তিবাহিনী সুবিধাজনক অবস্থায় ছিল, জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পাওয়ার তখন শক্ররা তাদের বায়নােকুলরের সাহায্যে দেখে দেখে গুলি ও গােলা নিক্ষেপ করছে। তখন মুক্তিবাহিনীর
আছে উপযুক্ত আড়াল না আছে কোন বাঙ্কার । যত সময় যাচ্ছে ততই পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। কমান্ডারদের চিন্তা এই মুহূর্তে কি এতগুলাে ছেলেকে জীবন দিতে হবে! সন্ধ্যা আগত। সবাইকে ধীরে ধীরে গুলি করতে করতে পিছিয়ে আসার জন্য নির্দেশ দেয়া হল। সবাই প্রাণপণে ফায়ার দিতে দিতে পশ্চাদপসারণের চেষ্টায় কিন্তু জোয়ারের পানি। বৃদ্ধির সাথে পাল্লা দিয়ে ওঠা কঠিন। কোন সময় মেজর সাহেব, রহমতউল্লাহ দাদু কভার দিচ্ছেন, অন্যান্যরা প্রত্যাহার করছে। আর কোন সময় লেঃ আরেফিন, কাইয়ুম কভার দিচ্ছে আরেক গ্রুপ প্রত্যাহার করছে। এমনিভাবে কারাে কোন ক্ষতি ছাড়াই সবাই নিরাপদ জায়গায় চলে এসে একত্রিত হল। কি মারত্মক একটা বিপদই না হচ্ছিল।
১৪ই ডিসেম্বর পাকহানাদার বাহিনী প্রকৃত প্রস্তাবে নৈতিক পরাজয় মেনে নেয় এবং তারা পােড়ামাটির নীতি গ্রহণ করে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মেরুদন্ড ভেঙ্গে দেয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। একদিকে তারা বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে এবং অন্যদিকে তারা ব্রীজ-কালভার্ট ও গুরুত্বপূর্ণ সব যােগাযােগের কেন্দ্রবিন্দু ধ্বংস করতে থাকে। খুলনাস্থ বাংলাদেশ ব্যাংকও তারা লুট করে। বিকেল বেলা হঠাৎ খুলনাবাসী অবাক হয়ে দেখল যে, তাদের ওয়ারলেস টাওয়ারও ডিনামাইট লাগিয়ে ফেলে দেয়া হয়েছে। পাকবাহিনীর নীল নকশায় স্বাধীন বাংলাদেশ যেন কখনাে অর্থনৈতিক দিক থেকে বলীয়ান না হতে পারে সেইজন্য তারা এসব ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নেয়। লায়ন্স স্কুল ও রেডিও স্টেশনের কাছাকাছি পৌঁছানাে সত্ত্বেও কোনটাই দখল করা গেল । এই দুঃখে,তখন ওরা বিলাপ করছে। মেজর জয়নুল আবেদীন বললেন, “আজ বিশ্রাম কর, আরাম কর। এদের দিন ফুরিয়ে এসেছে। সবাই ক্যাম্পে ফিরে খুলনা শহর দখলের হামলার প্রস্তুতি হিসেবে সাময়িক বিশ্রামে গেল।
( সূত্র ও স্বাধীনতার দুর্জয় অভিযান, স, ম, বাবর আলী।)