You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলা বাণী
ঢাকাঃ ৮ই আগস্ট, বৃহস্পতিবার, ২২শে শ্রাবণ, ১৩৮১

জল বাড়ছে, বাড়ছে চাল ডাল তেলের দাম

রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশব্যাপী নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই মূল্য বৃদ্ধি ঘটেছে গত দুই সপ্তাহ ধরে, যখন থেকে বন্যার পানিও মারণাঘাত শুরু করেছে বাংলার কোটি কোটি মানুষের উপর। কিন্তু দ্রব্যমূল্যের এই বল্গাহীন গতি আপাততঃ রোধ করার কোন সক্রিয় প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। গতকাল ঢাকা থেকে প্রকাশিত দুটি সংবাদপত্রের ঢাকার নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের বাজারদর প্রকাশিত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে চালের সর্বোচ্চ মূল্য মণ প্রতি দুই শত চল্লিশ টাকা এবং সর্বনিম্ন একশত চল্লিশ টাকা। কাঁচামরিচ প্রতিসের ১২ টাকা। আলু ৩ টাকা। শুকনো মরিচ ২৫ থেকে ২৮ টাকা। সরষের তেল ২৫ টাকা। ডিম প্রতিহালি দুই টাকা। খাসির মাংস ১২টাকা। মাছের আমদানি অপর্যাপ্ত এবং মূল্য অস্বাভাবিক। খোলাবাজারে আটা পাওয়া দুষ্কর এবং কোনোক্রমে পাওয়া গেলেও প্রতিসের তিন টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
দুই সপ্তাহ আগে চালের বর্তমান সর্বনিম্ন মূল্যই ছিল সর্বোচ্চ মূল্য। খবরের কাগজের রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, রাজধানীতে চালের সর্বোচ্চ মূল্য একশত আশি টাকায় সীমাবদ্ধ রাখার জন্য আরৎদারদের প্রতি সরকারের তরফ থেকে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারিত হওয়ার পর বাজার থেকে ভালো চাল উধাও হয়ে গেছে। অর্থাৎ প্রতি মণ একশত আশি টাকা রাখার জন্য তারা চালে প্রচুর ধুলোবালি আর পাথরকুচি মেশাচ্ছে। চালের মূল্য বৃদ্ধি সম্পর্কে চাল দোকানদারদের বক্তব্য হলঃ দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে বন্যার দরুন চাল সরবরাহ হ্রাস পেয়েছে এবং একশ্রেণীর ক্রেতা প্রয়োজনের অতিরিক্ত চাল মজুদ করেছে বলে চালের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের বক্তব্য হলো চাল দোকানদারদের এই মূল্যবৃদ্ধির অজুহাত সর্বাংশে সত্য নয়। বন্যা পরিস্থিতির দরুন যোগাযোগ ব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে চলতে পারছে না বলে এইভাবে চালের মূল্য বৃদ্ধির কোনো কারণ ঘটতে পারে না। কারণ আমরা অতীতেও দেখেছি জাতীয় দুর্যোগ এর সুযোগে একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী রাতারাতি সব জিনিস মজুত রেখে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে জিনিসপত্র মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি করে। উপরন্তু এই ভাবে তারা ক্রেতাদের উপর দোষ চাপিয়ে থাকেন। বানের পানি যখন হ্রাস পাবে সেই অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে আমরা বলতে পারি, চালের বর্তমান মূল্য হয়তো খানিকটা নেমে গেলেও বন্যার পূর্ববর্তী পর্যায়ে ফিরে যাবে না। আমরা দেখেছি যখনই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বিরুদ্ধে কোনো সাফল্যজনক অভিযান চলে, তখনই মূল্য রাস পায় এবং কঠোরতার লাগাম একটু হালকা করলে দ্রব্যমূল্য লম্ফ দিয়ে চলে।
সরকারি প্রশাসন যন্ত্রকে পুরোপুরিভাবে সক্রিয় রাখা হয়েছে বন্যা দুর্গত এলাকায়। কতৃপক্ষের কাছে আমাদের বক্তব্যঃ দুর্গত এলাকায় প্রশাসনিক তৎপরতার পাশাপাশি দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে অবিলম্বে উপযুক্ত ও স্থায়ী কার্যকরী ব্যবস্থা সমগ্র দেশব্যাপী গ্রহণ করা হোক।

সাম্প্রদায়িকতার আর এক শিকার

পাকিস্তানের যে আমলা-সামরিক চক্র দীর্ঘদিন নিজেদের স্বার্থে দেশের সাম্প্রদায়িক মনোভাব জিইয়ে রেখেছিলেন এখন সেই সাম্প্রদায়িকতার ঘৃণ্য শিকারে পরিণত হয়েছে তারা নিজেরাই। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর যে অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা পাকিস্তানকে মোকাবেলা করতে হয় তার ধকল কাটিয়ে ওঠার আগেই সেখানে শুরু হয়েছে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ। এবার কিন্তু হিন্দু আর মুসলমানের মধ্যে নয়, দাঙ্গা বাঁধায় কাদিয়ানী আর সুন্নিদের মধ্যে। পঞ্চাশের দশকে তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানী এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘটিত দাঙ্গা থামাতে কেন্দ্রীয় সরকারকে কম কাঠ-খড় পোড়াতে হয়নি। সামরিক শাসন জারি করতে হয়েছিল পাঞ্জাবে। বহু নিরীহ মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছিল সে দাঙ্গায়।
এবারকার সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে তেমন প্রাণহানির খবর না পাওয়া গেলেও পাকিস্তানের রাজনীতিতে এর প্রভাব পড়েছে অনেকখানি। কাদিয়ানী বিরোধীদের মূল দাবি ছিল দু’টি। প্রথমতঃ কাদিয়ানিদের অমুসলিম সংখ্যালঘু হিসেবে গণ্য করা এবং দ্বিতীয়তো প্রশাসন এবং সামরিক বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ পদ সমূহ থেকে তাদের অপসারণ। জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো সরাসরি তাদের দাবির প্রতি সমর্থন না জানালেও সম্প্রতি পাকিস্তান থেকে যে সব খবর এখানে এসে পৌঁছেছে তা থেকে অনুমান করা যায় কাদিয়ানী বিরোধী দল সরকারের উপর তাদের প্রভাব কার্যকরী করতে সক্ষম হয়েছে।
ইতিমধ্যে সামরিক বাহিনী থেকে কাদিয়ানীদের অপসারণের কাজ শুরু হয়ে গেছে। লেঃ জেঃ আব্দুল আলিম মালিক এবং লেঃ জেঃ আব্দুল হামিদকে দীর্ঘ ছুটিতে যেতে বাধ্য করা হয়েছে এছাড়া কাদিয়ানী সম্প্রদায় ভুক্ত পাকিস্তানের নৌবাহিনী প্রধান এইচ, এইচ, আহমেদ এবং পাকিস্তানে বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার মার্শাল জুলফিকার আলী খানকে শিগগিরই তাদের পদ থেকে অপসারণ করা হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে ১৭ জন মেজর জেনারেল ১৮ জন ব্রিগেডিয়ার এবং ৫০ জন কর্নেল পাকিস্তানের বর্তমান শাসকগোষ্ঠী কাদিয়ানী বিরোধী অভিযানের আওতায় পড়বেন বলে মনে করা হচ্ছে।
সামরিক বাহিনীর পর হয়তো প্রশাসনিক ক্ষেত্রে হাত দেওয়া হবে। সংখ্যালঘু কাদিয়ানীরা প্রমাদ গুনছে। আসলে কেউ জানেনা সাম্প্রদায়িকতা পাকিস্তানকে কোন দিকে ঠেলে দেবে। এ সাম্প্রদায়িকতাকে মূলধন করেই একসময় উপমহাদেশে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটেছিল। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর উগ্র সাম্প্রদায়িক মনোভাবই বিক্ষুব্ধ করেছিল তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান এবং বর্তমান বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণকে। এই সাম্প্রদায়িকতাকেই বাংলাদেশের শোষণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। আর সাম্প্রদায়িকতার অস্ত্র দিয়েই একাত্তরে হত্যা করা হয়েছিল ৩০ লাখ স্বাধীনতাপ্রেমী বাঙালিকে। এখন সেই খড়গ উদ্যত হয়েছে কাদিয়ানীদের উপর। একসময় মুসলমান হওয়া সত্বেও বাঙ্গালীদের ‘আধা মুসলিম’ হিসেবে আখ্যায়িত করার যে প্রবণতা তাদের ভিতরে ছিল এখন সেই প্রবণতাই প্রবল হয়ে উঠেছে কাদিয়ানী মুসলমানদের বিরুদ্ধে। মধ্যযুগীয় সাম্প্রদায়িক মনোভাব পাকিস্তানকে যে আর কোনও বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাবে একমাত্র ভবিষ্যতই বলতে পারে।

অবশেষে নিক্সনের দোষ স্বীকার

ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির ঘটনা এখন তুঙ্গে। অবশেষে প্রেসিডেন্ট নিক্সন স্বীকার করেছেন কেলেঙ্কারির ঘটনার সত্যতা সম্পর্কে। প্রেসিডেন্ট নিক্সনের এই স্বীকারোক্তির ঘটনা বেশ নাটকীয়। কৌতুহলী বিশ্ববাসীর সর্বশেষ সুদৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এই স্বীকারোক্তির ঘটনা। গত ৫ তারিখে আকস্মিকভাবে প্রেসিডেন্ট নিক্সন সাংবাদিকদের ডেকে পাঠান এবং ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির অনেক অপরাধের কথাই স্বীকার করেন। আমাকে তো নিজে অভিযুক্ত হতে চলেছেন সেকথাও তিনি স্বীকার করেন। এ ঘটনায় সারা আমেরিকায় একটি বিহ্বলাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। যারা এতদিন পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট নিক্সনের গোঁড়া সমর্থক ছিলেন তারা এবার তাদের মতামত ও সমর্থন পাল্টাতে শুরু করেছে। এদিকে ভাইস-প্রেসিডেন্ট ফোর্ডও নিক্সনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ উত্থাপনের পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন। প্রেসিডেন্ট নিক্সন তার স্বীকারোক্তিতে আরো বলেছেন যে, ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির তদন্ত ধামাচাপা দেওয়ার জন্য তিনি এফ,বি,আই ও সি,আই,এ গোয়েন্দা সংস্থা দুটিকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। রাজনৈতিক সুবিধা লাভের জন্যই তিনি এ ধরনের ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। অবশ্য তিনি জাতীয় নিরাপত্তা কথাও বলেছেন। প্রেসিডেন্ট নিক্সন দোষ স্বীকার করার মাঝেও আশা প্রকাশ করেছেন যে, সিনেটের বিচারে তিনি অপসারিত হবে না।
বস্তুতঃ ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির ঘটনা প্রেসিডেন্ট নিক্সনের এই স্বীকারোক্তির পর এক নতুন নাটকীয় মোড় নিয়েছে। তার গোঁড়া সমর্থক এবং নিজের রিপাবলিকান দলের সমর্থকদের মাঝে এই ঘটনা দারুন উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। সংবাদে প্রকাশ, প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কিছু পার্টির সমর্থকও ইতিমধ্যে বিবৃতি প্রদান করে তাদের সমর্থন তুলে নিয়েছেন এবং অভিযুক্ত করনের পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন। প্রেসিডেন্ট নিক্সন নাকি এই স্বীকারোক্তি ঘোষণার পূর্বে তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের ডেকে আলাপ করেছেন এবং পরে সাংবাদিকদের কাছে তা ব্যক্ত করেছেন। সর্বশেষ খবরে জানা গেছে, প্রেসিডেন্ট নিক্সন আপাততঃ পদত্যাগ করছেন না বরং বিচারের সম্মুখীন হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির ঘটনায় প্রেসিডেন্ট নিক্সনের ব্যক্তিগত ক্ষতি যাই হোক না কেন রিপাবলিকান দলের উপরের যে এর প্রতিফলন পড়বে আগামী নির্বাচনে তারা হয়ত তা কাটিয়ে উঠতে পারবেনা। সাংগঠনিক দিক দিয়ে এর প্রতিক্রয়া মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। এছাড়া প্রেসিডেন্টের মত দায়িত্বশীল ব্যক্তির দ্বারা সংগঠিত এই রাজনৈতিক নোংরামিও গোটা বিশ্বের ইতিহাসে একটি কলঙ্কের উদাহরণ হয়ে থাকবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!