You dont have javascript enabled! Please enable it!
বাঁকার যুদ্ধ
১০ই সেপ্টেম্বর ১৯৭১ সাল। প্রতিদিনের মতাে যথাযথভাবে সকালের প্রশিক্ষণ সেরে মুক্তিযােদ্ধারা বিশ্রামরত— ক্যাম্পের নাম বাকা মুক্তিযােদ্ধা ক্যাম্প।’ ১৮ই সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় বাকা মুক্তিযােদ্ধার ক্যাম্প পরিদর্শনে যাই। ১৭ই সেপ্টেম্বর বােয়ালিয়া ওদের বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধের কথা শুনি, ঐ একই দিন আমরা আশাশুনির গােয়ালডাঙ্গায় রাজাকারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি। যুদ্ধে ১০/১২জন রাজাকার মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে প্রাণ দিয়েছে, সেই সাথে আমরা হারিয়েছি মানােরঞ্জনকে। যা হােক, রাতে আমাদের গেরিলা যুদ্ধের পরিকল্পনা। আমাদের চলার পদ্ধতি, বিভিন্ন বিষয়ে উপস্থিত মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে কথা হল। ১৯শে সেপ্টেম্বর সকাল ৮টায় আমি রওনা দেই দক্ষিণ অঞ্চলের অন্যান্য ক্যাম্পগুলাে পরিদর্শনের জন্য।
আমি চলে গেলাম। থেকে গেল বাকা মুক্তিযােদ্ধা ক্যাম্পে’ ক্যাম্প কমান্ডার আবুল কালাম আজাদসহ অন্যরা। ক্যাম্পে খাবার নেই। কমান্ডার কালাম রুটিন মাফিক সকলকে কাজে দেয়। পাহারার ব্যবস্থা করে আইনুদ্দীন। কমান্ডার কালাম, মুকছেদ, হান্নান খাবারের সন্ধানে বাঁকা যায়। তখন সময় বেলা ১০/১১টা। হঠাৎ একটা লঞ্চের আওয়াজ শুনে সবাই ক্যাম্পের দিকে যায় এবং কমান্ডার কালামকে অনুসরণ করে। নদীর ধারে পৌছে ওরা নদীর ধার বরাবর পজিশন নেয়। তীরে ওয়াপদা বাঁধ না থাকায় ওদের অসুবিধায় পড়তে হয়। তবুও রিং বাঁধের আড়ালে তিনটি গ্রুপে ভাগ হয়ে ওরা পজিশন নেয়। তখন একটা গানবােট বােঝাই পাকসেনা ও লঞ্চ বােঝাই রাজাকার এসে উপস্থিত হয়। ভরা জোয়ারে গানবােট ও লঞ্চ থেকে অবিরাম গুলি ছুঁড়তে থাকে। ৭টা ৩০৩ রাইফেল ও ১টা এসএল আর মুক্তিযােদ্ধদের সম্বল। এ নিয়েই দৃঢ় মনােবলে ওরা পাল্টা গুলি চালাতে থাকে, কিন্তু বিপক্ষের ভারী মেশিন গানের গােলাবর্ষণের ফলে বেশিক্ষণ ওরা টিকতে না পেরে পিছু হটতে বাধ্য হয়। পাকসেনা ও রাজাকাররা তীরে নেমে পড়ে। নদীতে পানি ভর্তি থাকায় ওদের সুবিধা হয়। মুক্তিযােদ্ধারা কেউ পার্শ্ববর্তী ধান ক্ষেতে, কেউ পাট ক্ষেতে, কেউ বা কারাে বাড়িতে আশ্রয় নেবার চেষ্টা করে। গুলি চালাতে চালাতে রাজাকার ও পাকসেনারা সামনে এগুতে থাকে। কালাম, আক্রাম, আবুল, সােহরাব, মােজাম্মেল গ্রামের ভেতর বাশ বাগানে আশ্রয় নেয়। ৪/৫ মিনিট যেতে না যেতেই বহু লােকের পদশব্দে ওরা লক্ষ্য করল শত্রুরা ইতিমধ্যেই গ্রামের ভেতর ঢুকে পড়েছে। ওরাও নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিল। কালাম একটা মজা পুকুরে শেওলার মধ্যে নাক জাগিয়ে কোন মতে বেঁচে থাকে। পুকুরের চারদিকে সে শত্রুদের আগমন বুঝতে পারে।
ওর কাছে তখন স্টেনগান ও দুটো ম্যাগাজিন ভরা গুলি ছিল। দেড় ঘন্টা মজা পুকুরে থাকার পর উপরে উঠে স্থানীয়দের কাছে কালাম শুনল কয়েকজন মারা গেছে আর পাকসেনা ও রাজাকাররা গানবােট চলে গেছে। যাওয়ার পূর্বে বাকা মুক্তিযােদ্ধা ক্যাম্প আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়ে গেছে। কালাম দেরি না করে নদীর পাড়ে যায় এবং দেখল সহযােদ্ধা সিদ্দীক মারাত্মক আহত অবস্থায় পড়ে আছে। তার পায়ের হাঁটুতে গুলি লেগেছে। গ্রাম্যলােকজনের সহায়তায় সিদ্দীককে কালাম ডাক্তারের কাছে নেয়। নদীর পাশে মান্নান ঘাটের ইটের পুরােনাে ভাটার পাশে দেখল শংকর অধিকারী ও এনায়েত আলীর মৃতদেহ পড়ে আছে। শংকরের ও এনায়েতের বুকে ও পেটে গুলি লেগে নাড়ীভুড়ি বের হয়ে গেছে। এর একটু দূরে রিং বাধের পাশে কামরুলের মৃতদেহ পড়েছিল। হতভম্বের মতাে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থাকে কালাম, এক সময় উচ্চস্বরে অন্য সঙ্গীদের ডাকতেই রশিদ, বাকু, অশােক, নূর মােহাম্মদ, মােকছেদ, হান্নান একে একে ধান ক্ষেত থেকে বের হয়ে আসে। সবাই ঘটনা শুনল। এরপর কামরুল ও এনায়েতের লাশ তার পরিবারের লােকজনের হাতে তুলে দেয়। দেশে শংকরের সেই সময় কোন অভিভাবক না থাকায় গ্রামবাসীদের মতামত নিয়ে শংকরের মৃতদেহ রশীদ ও হান্নানের সহায়তায় কপােতাক্ষ নদে ভাসিয়ে দেয়। অতঃপর বাকী মুক্তিযােদ্ধাদের খোজ নেওয়া হয়। দুর্ভাগ্য মালেক, আইনুদ্দীন, জামির হােসেন ও আবু তালেবকে আর পায়নি ওরা। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায় তাদের ৪ জনকে পাকসেনারা লঞ্চে তুলে নিয়ে যায়।
মুক্তিযােদ্ধাদের বিন্দুবাহিনী অর্থাৎ ক্ষুদে অথচ সাহসী ছেলেদের নিয়ে গঠিত একটি বাহিনীর অন্যতম সদস্য ছিল এই জামির হােসেন। বাড়ি তার বাগালী ইউনিয়নের ইসলামপুর গ্রামে। এই যুদ্ধে সেও খানসেনাদের হাতে ধরা পড়ে। কিন্তু ক্ষুদে বালকের মতাে সে আচরণ করায় তার উপর খানসেনারা তেমন বেশি অত্যাচার করেনি। জামির ছিল অতীব চালাক ও ধূর্ত। প্রতি মুহূর্তে সে গানবােট থেকে পালানর চেষ্ট করে। অবশেষে খুলনা শহরের কাছাকাছি এসে সে পায়খানায় যাওয়ার নাম করে একটু ফাকায় চলে আসে। যেহেতু জামিরের শারীরিক গড়ন ছােট তাই পাকসেনারা তেমন পাহারা দেয়নি বা বাধা-ধরা করেনি। ফলে সে সুযােগ পেয়েই সবার অজ্ঞাতে রূপসা নদীতে ঝাঁপ দেয় এবং রূপসা নদীর একজন মাঝির সহযােগিতায় ২ দিন পর মুক্তিযােদ্ধা ক্যাম্পে ফিরে এলে সবাই অবাক হয়। কারণ। বাকী তিনজনের মতাে তাকেও খরচের খাতায় ধরা হয়েছে। কথায় বলে—“রাখে আল্লা মারে কে?’ শােনা যায় বাকী তিনজনকে মেরে লাশ খুলনার রূপসা নদীতে ফেলে দেয়া হয়। কপােতাক্ষ তীরে মুক্তিযােদ্ধাদের এই আত্মদান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায়।
এদিকে আহত সিদ্দীকের চিকিৎসার ব্যবস্থা করে কালাম ক্যাম্পে গিয়ে দেখল সারা ক্যাম্প পুড়ে ছাই। উপায় না পেয়ে কালাম মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ে নদীর ঘাটে যায়। সারাদিন কারাে খাওয়া নেই। কিছু চিড়া-মুড়ি জোগাড় করে নৌকোয় ওঠে রাত ৮টায়। আহত সিদ্দীক মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। গ্রামবাসীরা সবাই ভীত সন্ত্রস্ত। কালাম ওদের উদ্দেশ্যে অস্ত্র, সাহস, মনােবল নিয়ে ঐ এলাকায় আবার ফিরে আসার অঙ্গীকার করল। দুদিন পর আহত সিদ্দীককে চিকিৎসার জন্য ভারত পাঠানাে হল। সিদ্দীক আজ সুস্থ কিন্তু সে পঙ্গু। তার পায়ের ভেতর পাইপ ফিট করা, কোন ভারী কাজ করার ক্ষমতা তার নেই।
বাঁকা যুদ্ধে যারা অংশ নেয় ।
(১) আবুল কালাম আজাদ, (২) মাস্টার আফসার আলী, (৩) আঃ রশীদ সানা, (৪) মােঃ মােকছেদ আলী, (৫) আঃ হান্নান, (৬) আঃ আকামত হােসেন, (৭) অশােক কুমার রায়, (৮) নূর মােহাম্মদ, (৯) সােহরাব উদ্দিন, (১০) আবু দাউদ আহমেদ, (১১) আবু বক্কার সিদ্দীকী বাকু, (১২) আবুল হােসেন গাজী, (১৩) আবুল কালাম মােড়ল, (১৪) মােজাম্মেল হক, (১৫) মােঃ জমির আলী, (১৬) আব্দুল মজিদ গােলদার, (১৭) মােঃ হায়দার আলী, (১৮) আব্দুল কুদ্স।
এই যুদ্ধে যারা শহীদ হয় ? ১) কামরুল ইসলাম খােকন, সাং-শ্ৰীকণ্ঠপুর । ২) আইন উদ্দীন গাজী, সাং-শ্রীকণ্ঠপুর। ৩) আব্দুল মালেক মােড়ল, সাং-শ্রীকণ্ঠপুর। ৪) এনায়েত আলী মােড়ল, সাং-বাকা। ৫) আবু তালেব মােড়ল, সাং-বাকা। ৬) শংকর কুমার অধিকারী, সাং-বাঁকা, ভবানীপুর । ( সূত্র ও স্বাধীনতার দুর্জয় অভিযান, স, ম, বাবর আলী ।)

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!