বােয়ালিয়ার রােমাঞ্চকর যুদ্ধ
মেঘাচ্ছন্ন সকাল। প্রাত্যাহিক কাজ সেরে মুক্তিযােদ্ধারা প্রস্তুত তাদের কাজের জন্য। তারিখটা ছিল ১৭ই সেপ্টেম্বর। বাকা মুক্তিযােদ্ধা ক্যাম্প কমান্ডার আবুল কালাম আজাদ মুক্তিযােদ্ধাদের ৩টি গ্রুপে ভাগ করে দিলেন। এদের মধ্য থেকে ৬/৭জনের একটা দলকে কাটাখালী নদীর ত্রি-মােহনায় পাহারায় যেতে বললেন যার নেতৃত্বে ছিলেন। আইনুদ্দীন গাজী। অন্য ৭/৮ জনের একটা দলকে ক্যাম্পের দায়িত্ব দিয়ে কমান্ডার নিজে ৭জনের একটা গ্রুপের নেতৃত্ব নিয়ে বিশ্বস্তসূত্রে একটা লঞ্চযােগে রাজাকারদের অগ্রসরের গােপন সংবাদ পাওয়ায় বােয়ালিয়া খেয়াঘাটে যান। নদী কিনারে ওয়াপদা বাঁধের ভেতরে সবাইকে পজিশন নিতে বলেন। মুক্তিযােদ্ধা কামরুলকে নিয়ে কমান্ডার আবুল কালাম আজাদ খেয়াঘাটের নিকটবর্তী নদীর চরে নৌকার আড়ালে একটা খুপরি ঘরে শত্রুর অপেক্ষা করতে লাগলেন। আনুমানিক বেলা ৯/১০ টায় কপিলমুনির দিক থেকে লঞ্চআসতে দেখা গেল কমান্ডার কালাম জোর গলায় লঞ্চ তীরে ভিড়াতে বলেন। ডাক দেয়ার পর লঞ্চ ভিড়ছে না দেখে কমান্ডার কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি করার জন্য সঙ্গীদের নির্দেশ দেন। ৪/৫ রাউন্ড গুলি হবার পর পাল্টা লঞ্চ থেকে রাইফেলের গুলি আসে। মুক্তিযােদ্ধার তখন নিশ্চিত হল যে, এই লঞ্চ কপিলমুনি থেকে রাজাকাররা নিয়ে এসেছে। প্রতি সন্তর্পণে মুক্তিযােদ্ধারা ওয়াপদা বাঁধের ধার থেকে অবিরাম গুলিবর্ষণ করতে থাকে এবং এক পর্যায়ে লঞ্চ তীরে ভেড়াতে সক্ষম হয়। তখন রাজাকাররা উপায়পেয়ে বােয়ালিয়া খেয়াঘাটের কিছুটা উত্তর দিকে একটা বাগানের পাশে লঞ্চ থামায় এবং সেখানকার স্তুপীকৃত ইটের ফাঁকা পজিশন নিয়ে গুলি করতে থাকে। প্রায় ২ ঘন্টা ব্যাপী নদীর এপার-ওপার বসে যুদ্ধ হয়।
মুক্তিযােদ্ধারা যখন বুঝল রাজাকাররা পিছু হটছে তখন কমান্ডার কালাম ৩/৪ জন সঙ্গী নিয়ে নৌকাযােগে নদী পার হতে থাকে। রাড়ুলীর ওপার তখন বাকী মুক্তিযােদ্ধারা কভারিং এর দায়িত্ব পালন করে। ওপারে গিয়ে কমান্ডার কালাম দেখল খালি লঞ্চের ছাদে সারিবদ্ধ বালির বস্তা কেটে-ছিড়ে গেছে, লঞ্চের ছাদের উপর চাপ চাপ তাজা রক্ত জমে রয়েছে এবং লঞ্চ স্টাফরা লঞ্চের পাটাতনের নিচে লুকিয়ে ছিল। ওদের কাছ থেকে জানা গেল ৩/৪ জন রাজাকার মারা যাওয়ায় বাকীরা তাদের লাশ নিয়ে কপিলমুনির দিকে চলে গেছে। এদিকে বেলা ১১টার সময় অবিরাম গুলিবর্ষণের শব্দে কাটাখালীর ধারে পাহারারত যােদ্ধারা আইনুদ্দীনের নেতৃত্বে বােয়ালিয়ার যুদ্ধে যােগ দেয়। বােয়ালিয়ার যুদ্ধের বৈশিষ্ট্য ছিল যে, এ যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী অতি সতর্ক থাকায় সুবিধা মতাে সময়ে রাজাকাদের লঞ্চের উপর আক্রমণ চালাতে সক্ষম হয়। মুক্তিযােদ্ধারা রাড়ুলী গ্রামের পরে ডাঙ্গায় অবস্থানে থাকায় তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল না। শুধু বালির বস্তার আড়ালে তারা লুকাতে পারত। কিন্তু আক্রান্ত হলে রাজাকারদের পক্ষে পাল্টা তেমন কোন আক্রমণ করার অবস্থা ছিল না। তাই মুক্তিবাহিনীর আকস্মিক আক্রমণে তারা অনেকটা দিশেহারা হয়ে পড়ে।| বােয়ালিয়ার যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী মুক্তিযােদ্ধা ঃ ১। আবুল কালাম আজাদ (কমান্ডার), ২। মাস্টার আফসার আলী, ৩। মােঃ মােকছেদ আলী, ৪। আঃ রশীদ খাঁ, ৫। কামরুল ইসলাম খােকন, ৬। আব্দুল হান্নান, ৭। অশােক রায়, ৮। নূর মােহাম্মদ, ৯। বাকু, ১০। আইনুদ্দীন, ১১। গৌরপদ, ১২। আকামত হােসেন, ১৩। মজিদ গােলাদার, ১৪। কালাম মােড়ল। (সূত্র : স্বাধীনতার দুর্জয় অভিযান, স, ম, বাবর আলী ।)
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু‘শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত