পদ্ম-পলাশ ও বীর শ্রেষ্ঠ
রুহুল আমিনের অভিযান ডিসেম্বর মাস। বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধারা বীরবিক্রমে যুদ্ধ ময়দানে পাকহানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকারদের বিরুদ্ধে একটার পর একটা বিজয় অর্জন করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অবিশ্বাস্য রকমের সাফল্য অর্জন করে চলেছে। ১১টা সেক্টরে তখন সেক্টর কমাণ্ডারবৃন্দ নিরলসভাবে অপারেশনের পর অপারেশন হেনে খানসেনাদের উপর চূড়ান্ত আঘাত করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। যুদ্ধ ময়দানে পাকসেনারা তীব্র লড়াইয়ের মুখে বহু স্থান ত্যাগ করে ক্যান্টনমেন্টের দিকে ধাবিত হচ্ছে। নয় নম্বর সেক্টরেও তখন প্রচণ্ড যুদ্ধের প্রস্তুতি চলছে। শ্যামনগর, কালিগঞ্জ, দেবহাটা, সাতক্ষীরা মুক্ত করে ঝটিকাবেগে মুক্তিযােদ্ধারা খুলনা শহর অভিমুখে এগিয়ে চলছে এবং ঝিকরগাছা, যশাের, নােয়াপাড়া হয়ে মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী উল্কাগতিতে খুলনা শহরের দিকে এগিয়ে আসছে। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর নৌকমাণ্ড ও নৌগেরিলারা তখন দেশকে শত্রুমুক্ত করার চূড়ান্ত সংগ্রামে অংশ নেয়। ইতিমধ্যে নবম সেক্টরের মােংলা দাকোপ, মুন্সিগঞ্জ, হরিনগর প্রভৃতি এলাকায় কয়েকটি জাহাজ ডুবিয়ে দিয়ে এবং পাকগানবােটের উপর দুর্ধর্ষ আক্রমণ চালিয়ে বাংলাদেশ নৌ-কমাণ্ডোবৃন্দ ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। পদ্মা’ ও ‘পলাশ’ নামক দুটো রণতরী নিয়ে বাংলার দামাল ছেলেরা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে। উল্লেখ করা আবশ্যক যে, মিত্রবাহিনীর উপহার দেয়া দুটো টাগবােটকে সংস্কার করে রণতরী বা গানবােটে রূপান্তরিত করা হয় এবং এদেরই নতুন নামকরণ করা হয় ‘পদ্মা’ ও ‘পলাশ। ভারতীয় মিত্রবাহিনীর রণতরী পানভেল’ও ‘পদ্মা’ ও ‘পলাশ’র বাংলাদেশের ভেতরে প্রবেশ করে।
সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে তিন তিনখানা রণতরী নদীর বুক চিরে হিরণ পয়েন্টে চলে আসে, হিরণ পয়েন্ট তখন ফাঁকা। পাকনৌবাহিনী মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে পর্যুদস্ত হয়ে খালিশপুরে ‘টি এন এস তীতুমীরে’ এসে আশ্রয় নিয়েছে। পদ্মা’, ‘পলাশ’ ও ‘পানভেল পুনঃ রওনা হয় এবং সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে মােংলা বন্দরে এসে উপস্থিত হয়। তারিখটা ছিল ১০ই ডিসেম্বর। না, পাকনৌবাহিনীর কোন জাহাজ বা গানবােট তাদের কোথাও কোন বাধা দেয়নি, এমন কি হিরণ পয়েন্ট থেকে মােংলা বন্দর পর্যন্ত দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় তারা শত্রুপক্ষের একটা গুলির শব্দও শােনেনি। সম্ভবত তারা তখন জীবন নিয়ে পলায়নরত। এ সময় পাকবিমান বহরও ধ্বংসপ্রাপ্ত। কারণ মিত্রবাহিনীর তীব্র বিমান আক্রমণের মুখে পাক বিশাল বাহিনী তেমন কোন প্রতিরােধই সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়। স্থলবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী একে অপরের পরিপূরক। কিন্তু পাকবিমানবাহিনী প্রায় অকেজো হয়ে যাওয়ায় স্থলপথে ও নৌপথে পাকবাহিনী চরম মার খেতে থাকে। বিশ্বের প্রথম শ্রেণীর নৌবাহিনীর অবস্থা তখন শােচনীয়। বাংলাদেশের অন্যতম বন্দর মােংলা থেকে তখন মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর নৌবহর যৌথভাবে খুলনার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। নৌকমাণ্ডোবৃন্দ ও নাবিকরা সকলেরই লক্ষ্য তখন কিভাবে খুলনার খালিশপুরের পি এন এস তীতুমীর’ দখল করা যায়। মিত্রবাহিনীর গানবোেট ‘পানভেল’ সর্বাগ্রে ছুটে চলেছে। তার পেছনে রণতরী ‘পলাশ’ এবং সবার পিছনে ‘পদ্মা’ পশুর নদীর পানি দু’ভাগ করে বিরাট তরঙ্গ সৃষ্টি করে দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে খুলনা শহরাভিমুখে।
এক সময় রণতরীগুলাে বটিয়াঘাটা পেছনে ফেলে খুলনা শহরের শীপইয়ার্ডের কাছাকাছি চলে আসে। দুপুরবেলা, এমন সময় প্রচণ্ড শব্দ করে কয়েকখানা জঙ্গী বিমান রণতরীগুলােকে টার্গেট করে মাথার উপর ঘুরপাক খেতে থাকে। গানবােট পানভেলের কমাণ্ডার নিকট ‘পদ্মা’ ও ‘পলাশে’র কমাণ্ডারগণ জঙ্গী বিমানগুলােকে গুলি করার নির্দেশ চায়। পানভেল’ই তখন এ দু’টো গানবােটকে নিয়ন্ত্রণ করছিল। কিন্তু মিত্রবাহিনীর নৌকমাণ্ডার স্থির সিদ্ধান্তে এলেন যে, পাকবিমানবাহিনী পুরাপুরি শেষ হয়ে গেছে এবং তাদের আর আকাশে ওড়ার মতাে কোন জঙ্গী বিমানই অবশিষ্ট নেই। সুতরাং আকাশে যে জঙ্গী বিমান উড়ছে তা ভারতীয় মিত্রবাহিনী বিমান হবে। অতএব গুলি করার কোন দরকার নেই। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে পাকবিমান বহরের কয়েকটা বিমান তখনও অবশিষ্ট ছিল বিমান থেকে শুরু হয় প্রচণ্ড গােলাবর্ষণ। তাদের প্রথম আক্রমণ ছিল রণতরী ‘পদ্মা’র উপর, দেখতে দেখতে ‘পদ্মা’য় আগুন ধরে যায়, তারপর শুরু হয় পলাশের উপর প্রচণ্ড আক্রমণ। এই রণতরীর মূল কমাণ্ডার ছিলেন একজন ভারতীয়। তিনি কেমন যেন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন এবং সকলকে জাহাজ ত্যাগ করে নদীতে ঝাঁপিয়ে জীবন রক্ষার জন্য নির্দেশ দিলেন। অনেকেই তখন লাফিয়ে নদীতে ঝাপিয়ে পড়েছেন।
কিন্তু বীর মুক্তিযােদ্ধা মােঃ রুহুল আমিন ভারতীয় কমাণ্ডারের আদেশ না শুনে তিনি সকলকে জাহাজে থেকে শত্রুকে মােকাবিলা করার পাল্টা নির্দেশ দিয়ে নিজেই শত্রুর বিমানের প্রতি গুলিবর্ষণ শুরু করলেন। তাঁর কথা ছিল শত্রুকে শেষ পর্যন্ত বীরের মতাে মােকাবিলা করতে হবে, বিনা চ্যালেঞ্জে ওদের ফিরে যেতে দেয়া হবে না। পাকবিমান বহরের উদ্দেশ্যে রুহুল আমিন গুলি শুরু করলেন। এদিকে তীব্র গােলাবর্ষণ আর বিমান থেকেও রণতরীর উপর চলছে মরণ আক্রমণ। পলাশে’র ইঞ্জিন তখন পুরােপুরি সচল, বাংলার বীর নাবিকরা রুহুল আমিনের নির্দেশে স্বস্তি ফিরে পেয়ে শত্রুর দিকে গােলাবর্ষণ শুরু করেন। কিন্তু তখন বিলম্ব হয়ে গেছে। বীর যােদ্ধা রুহুল আমিনের একই শপথ বীরের মতাে লড়াই করে মরতে চাই। তিনি বীরবিক্রমে যুদ্ধ চালিয়ে যান, কিন্তু এক পর্যায়ে এই বীরযােদ্ধা গুরুতর রূপে আহত হন; বার বার পাক বিমান বহর এসে ‘পলাশের উপর তীব্র আক্রমণ চালায়, ইঞ্জিন ধ্বংস হয়ে আগুন জ্বলে ওঠে, গােলাবারুদেও আগুন লেগে এক ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়। রুহুল আমিনের রক্তস্রোতে পলাশের ডেক ভেসে যাচ্ছে তবুও তিনি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আপ্রাণ লড়াই করেছেন শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করতে। অবশেষে গুরুতর আহত অবস্থায় তিনি নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং অন্যান্য সকলকেও নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ার সঙ্কেত দিলেন। সাঁতরাতে সাঁতরাতে অনেকেই বহু কষ্টে কূলে এসে ওঠেন। গানবােটের সাথে পাকবিমানবাহিনীর এ যুদ্ধ রূপসা নদীর দুই তীরের হাজার হাজার লােক প্রত্যক্ষ করে। কিন্তু এ বীরযােদ্ধার ভাগ্য খারাপ, তিনি এসে ওঠেন রাজাকারদের কাছে। তারা রুহুল আমিনকে ধরে ফেলে এবং তার উপর চরম দৈহিক নির্যাতন চালায়। ফলে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
বাঙালির গর্ব এই বীর মুক্তিযােদ্ধাকে তাঁর সততা ও অকুতােভয় ভূমিকার জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে বীর শ্রেষ্ঠ উপাধি দেন। তাঁর বাড়ি নােয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ থানার বাঘচাপটা গ্রামে। এই যুদ্ধে আরাে যারা অংশ নেন তাঁরা হলেন, মােহাম্মদ মমতাজউদ্দীন, শহিদুল্লাহ, এম ডি এইচ, মােল্লা, এবিএমএম রহমান, এম হক, রফিকুল ইসলাম, ফরিদউদ্দীন আহমেদ, এম এ তাহের, এ আর ভূইয়া, এম এ মােত্তালিব, এম এ মজুমদার, বশীর আহমেদ, এম জালালউদ্দীন প্রমুখ। রাজাকাররা বেশ কয়েকজনকে ধরে নিয়ে চরম অত্যাচার করে এবং কয়েকজনকে হত্যা করে এবং বাকীদেরকে জেলখানায় পাঠিয়ে দেয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ সময়ে কেবলমাত্র ভুল বুঝাবুঝির জন্যই মুক্তিবাহিনীর এ চরম বিপর্যয় ঘটে এবং কয়েকটি মূল্যবান জীবন অকালে ঝরে যায়। মিত্রবাহিনীর সামান্য ভুলের কারণে ‘পদ্মা’ ও ‘পলাশ’ ধ্বংস হয় এবং মুক্তিবাহিনীর অগ্রযাত্রা সাময়িকভাবে ব্যহত হয়। রূপসার পানি মুক্তিযােদ্ধাদের রক্তে লালে লাল হয়ে গিয়েছিল। মুক্তিযােদ্ধারা। জীবনপণ যুদ্ধ করে মাতৃভূমির মর্যাদা রক্ষায় আত্মােৎসর্গ করেছিল কিন্তু তারা মাথা নত করেনি। তাই আজও বাঙালি জাতি শ্রদ্ধাভরে বীর শ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন ও তার সহযােদ্ধাদের কথা স্মরণ করে আর ঘৃণা করে স্বাধীনতা বিরােধী বিশ্বাসঘাতক বাঙালি নামে কথিত পাকবাহিনীর সহযােগী রাজাকার, আল-বদর বাহিনীর সেদিনের জঘন্য তৎপরতা। ‘পদ্মা’ ‘পলাশ’ আর বীর রুহুল আমিনের কীর্তিগাথা আজও খুলনার মানুষের মুখে মুখে।
(সূত্র : স্বাধীনতার দুর্জয় অভিযান, স, ম, বাবর আলী।)
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত