কাপালিডাঙ্গা রাজাকার ক্যাম্প দখল
বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চল ছিল রাজাকারদের লুটপাটের গােল্ডেন পয়েন্ট; দেশের আইনকানুন সবই ছিল রাজাকারদের রাইফেলের অধীনে। রাজাকারদের নিয়ন্ত্রণের জন্য কোনই আইন ছিল না বরং সব আইনই রাজাকাররা নিয়ন্ত্রণ করত। রাজাকার কমান্ডার মােকছেদ আলীর নেতৃত্বে ডুমুরিয়ারু রাজাকারবাহিনী অসীম দাপটে এলাকা তােলপাড় করে তােলে; ব্যক্তিগত শক্রতার কারণে রাজাকারবাহিনীর নিকট নালিশ করলে তারা সাথে সাথে বিচার করে রায় কার্যকরী করত। মৃত্যুদন্ড ও জরিমানা আদায় করা ছিল তাদের অতি সাধারণ ব্যাপার। সামান্য কারণে তারা যে কত লােককে হত্যা করেছে তার কোন লেখা-যােখা নেই। এমনিভাবে রাজাকাররা ডুমুরিয়া বাজারে প্রকাশ্য দিনের বেলা এ এলাকার বিশিষ্ট ব্যক্তি জবেদ আলী মাষ্টারকে হত্যা করে, ঘুটুদিয়ে গ্রামের অজিত কবিরাজকে হত্যা করে। অজিত কবিরাজ খুলনা জজকোর্টের একজন অভিজ্ঞতা সম্পন্ন মুহুরী ছিলেন। তারা ডুমুরিয়ার সাজিয়াড়া গ্রামের নেপাল দফাদারের পুত্র পঞ্চানন দফাদারকেও অজ্ঞাত কারণে হত্যা করে। কোমলপুর গ্রামের ইনছার আলী ফফির ও আহম্মদ আলী সরদারকে একই রাজাকারবাহিনী দিনের বেলা হত্যা করে, অন্যান্যদেরকেও হুমকি দিতে থাকে যে, তাদের নির্দেশ মােতাবেক না চললে একই ভাগ্যবরণ করতে হবে। ডুমুরিয়া অঞ্চলের সাধারণ লােকজন রাজাকারদের ভয়ে আতঙ্কিত ও সন্ত্রস্ত হয়ে জীবন যাপন করতে থাকে। ইতিমধ্যে নূরুল ইসলাম মানিকের নেতৃত্বে মুক্তবাহিনীর একটি দল ডুমুরিয়া থানার শােভন্য ইউনিয়ানের সতের চকের বারুইকাটি গ্রামে ঘাঁটি স্থাপন করে। মানিক ডুমুরিয়ায় আসার পূর্বে ভােমরা, কাকাঙ্গা প্রভৃতি যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়। নূরুল ইসলাম মানিক একজন মুজাহিদ ছিলেন।
তবুও তিনি বিহারের চাকুলিয়া থেকে উচ্চতর সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন। মানিক ডুমুরিয়ায় এসে এলাকার খোঁজখবর নেন, পাকবাহিনী ও রাজাকারদের গমনাগমন ও অবস্থান সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে থাকেন। কয়েকদিন পর তার ক্যাম্পে খবর এল ডুমুরিয়ার সাহস ইউনিয়নের কাপালিডাঙ্গা গ্রামে একটি হিন্দু ভদ্রলােকের পরিত্যাক্ত বাড়িতে রাজাকাররা ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করেছে এবং তারা সেখানে এসেই এলাকার লােকজনদের উপর অকথ্য অত্যাচার ও লুটপাট করতে থাকে। গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগী ইত্যাদি ইচ্ছা মতাে ধরে খেতে থাকে। নারী নির্যাতন ছিল ওদের নিত্যকার অপকর্মের একটি রুটিন মাফিক ঘটনা। নূরুল ইসলাম মানিক তখন তার সঙ্গীদের নিয়ে বিষয়টি আলাপ-আলােচনা করে এবং কাপালিডাঙ্গার রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ ও দখল করে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু চূড়ান্ত পরিকল্পনা প্রস্তুতের পূর্বে এলাকা রেকি করা প্রয়ােজন। তাই নূরুল ইসলাম মানিক ১২/১৩জন সশস্ত্র সঙ্গীদের নিয়ে নৌকাযােগে বের হয়ে পড়েন। খাল-বিল পাড়ি দিয়ে তারা প্রায় মধ্য রাতে কাপালিডাঙ্গায় এসে উপস্থিত হন। | অক্টোবর মাস, চারদিকে ধান আর ধান। ঘুমন্ত নীরব নিথর কাপালিডাঙ্গা গ্রামে মুক্তিবাহিনীর পদার্পণ সম্পর্কে রাজাকাররা কিছুই বুঝতে পারেনি। রাত গভীর হওয়ায় লােকজন কোথাও ছিল না। সুতরাং কমান্ডার মানিকের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী চুপি চুপি রাজাকার ক্যাম্পের অতি নিকটে চলে আসে। মানিক দু’জনকে সঙ্গে নিয়ে একেবারে রাজাকারদের ভবনের নিকটে অবস্থান নিয়ে রাজাকারদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন।
দু’তিনজন রাজাকার রাইফেল পাশে রেখে ঘুমাচ্ছিল। বাকীরা সব হৈ চৈ করে তাস-দাবা খেলছিল। রাজাকারদের আনন্দ উৎসব দেখে মনে হচ্ছিল যেন তারা বিয়ের বরযাত্রী এসে অলসভাবে তাস-দাবা খেলে সময় কাটাচ্ছে। তাদের অস্ত্রশস্ত্র সম্ভবত তৈরি ছিল না। রাজাকাররা সম্ভবত আদৌ ধারণা করেনি যে মুক্তিবাহিনী তাদের ক্যাম্পে কখনও হানা দিতে পারে। তাই তারা আনন্দ স্কুর্তিতে ও খেলায় মত্ত ছিল। কমান্ডার মানিক ছিল অসমসাহসী তরুণ, তিনি তার সঙ্গীদের কাছে এসে বললেন, রাজাকাররা যে ভাবে আছে তাতে আমি ওদের উপর ঝটিকা আক্রমণ করার লােভ সামলাতে পারছি না। এখনই ওদের উপর আক্রমণ করে রাজাকার ক্যাম্প দখল করতে চাই। কারণ এ সুবর্ণ সুযােগ হেলায় হাতছাড়া করা উচিত হবে না। সবাই মানিকের প্রস্তাবে একমত হয়। মানিক ষ্টেনগান নিয়ে ৪/৫ জন সশস্ত্রযােদ্ধাসহ ঝটিকা বেগে ওদের ক্যাম্পে প্রবেশ করে ওদের সেন্ট্রিদের নিরস্ত্র করে শত্রুদের সব অস্ত্র দখল করে নেন এবং রাজাকারদের কঠিন ভাষায় আত্মসমর্পণ করার হুকুম দেন। ঘটনার আকস্মিকতায় রাজাকাররা পুরােপুরি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়। শত্রুপক্ষকে অস্ত্রধারণের কোন সুযোেগই দেয়নি মুক্তিবাহিনী। রাজাকাররাও এতই হতবিহ্বল হয়ে পড়ে যে, দু’হাতে তুলে প্রাণভিক্ষা চায়। মানিকের সাথে মাত্র ১২/১৩ জন মুক্তিযােদ্ধা ছিল অথচ তারা ২৮জন রাজাকারকে কৌশলে বন্দি করে ২৮টি রাইফেল দখল করে নেন। কেবলমাত্র জনবল এবং অস্ত্রবলের উপর মুক্তিযােদ্ধারা নির্ভর করেনি বরং রণকৌশল ও দুঃসাহসিকতাই ছিল মুক্তিবাহিনীর অন্যতম হাতিয়ার।
রাজাকারদের একে একে বেঁধে ফেলা হয় এবং রাইফেলের মুখে ভয়ে তারা চুপচাপ থাকে। রাজাকাররা প্রথমে ভেবেছিল মুক্তিবাহিনীর লােকজন অনেক বেশি, কিন্তু যখন তারা দেখল মাত্র ১২/১৩ জন, তখন রাজাকাররা নিজেদের বােকামীর কথা বুঝতে পারল। তখন আর তাদের করার কিছুই ছিল না। কমান্ডার মানিকের সাথে অন্যান্য যারা অংশ নেন তারা হলেন মাহবুবুর রহমান, বিজন বিহারী মিস্ত্রি, রবীন্দ্র নাথ বৈরাগী, অরবিন্দু মন্ডল, নির্মলকান্তি বালা, সুধাংশু, নির্মলকান্তি মন্ডল, মারাচঁাদ মন্ডলসহ মােট ১২/১৩ জন। মানিকের বাহিনী ছিল অত্যন্ত সুশৃঙ্খল, সাহসী ও দেশ প্রেমিক। তাই রেকি করতে এসে কমান্ডারের প্রস্তাবে এ অদ্ভুত অথচ লােভনীয় প্রস্তাবে রাজী হয়ে অভিযান চালায়। আর কমান্ডার নূরুল ইসলাম মানিক ছিলেন একজন অভিজ্ঞ মুজাহিদ। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধেও তিনি অংশ | নিয়েছিলেন। এই অভিজ্ঞতার আলােকে তার সিদ্ধান্ত ছিল নির্ভুল। তাই কাপালিডাঙ্গার রাজাকার ক্যাম্প অপারেশনে মুক্তিবাহিনী আশাতীত সাফল্য লাভ করে। রাজকারদের বােকামী ও বালখিল্যতার কথা চিন্তা করে কমান্ডার মানিক আজও আপনমনে হেসে ওঠেন। (সূত্র : স্বাধীনতার দুর্জয় অভিযান, স, ম, বাবর আলী।)
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত