৮ জন তরুণের মুক্তিযুদ্ধে যােগদান
প্রশিক্ষণ ও যুদ্ধে অংশগ্রহণ ১৯৪৭ সালের পতাকা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার সান্ত্বনা পুরস্কার পেয়েও বাংলার মানুষকে ‘৫২, ‘৬২, ‘৬৭, ‘৬৯, ‘৭০ পর্যন্ত অনেক রক্ত দিতে হয়েছে। দিতে হয়েছে কৃষক, শ্রমিকের ঘামে অর্জিত বিদেশী মুদ্রার সিংহভাগ। যে মুহূর্তের শত অপচেষ্টা সত্ত্বেও বাঙালিরা নির্বাচনে নিজেদের শাসকের ভূমিকায় ফিরিয়ে আনল, ঠিক সেই মুহূর্তে স্বরূপে ফিরে এল পশ্চিমা শাসকগােষ্ঠী। বিচ্ছিন্নতাবাদীর অভিযােগ এনে অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় তারা ১৯৭১-এর ২৫ মার্চের কালাে রাত্রে ঝাঁপিয়ে পড়ল নিরস্ত্র মানুষের ওপর। মুক্তিযুদ্ধ অপরিহার্য হল প্রতিটি বিবেকমান কৃষক, শ্রমিক, মজুর, কামার, কুমাের, ছাত্র, পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী, যুবক, কিশােরদের কাছে। সবাই বুঝল, ধর্মের ছদ্মাবরণে এদেশকে বেশিদিন করায়ত্ব করে রাখা যাবে না। দেশ একদিন স্বাধীন হবেই। ১৯৭৫ সালে যে আম্রকাননে স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল, ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল অনুরূপ এক আম্রকাননে অস্থায়ী সরকারের শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে সেই সূর্য আবার উদিত হল।
দেশকে স্বাধীন করার জন্যে উদ্দীপ্ত হল সকল শ্রেণীর মানুষ। মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেবার লক্ষ্যে ভারতে গেলেন লক্ষ লক্ষ দেশপ্রেমী তরুণ। কিন্তু প্রথমাবস্থায় তাদেরকে সংগঠিত করা যায়নি। কেউ ছিলেন কলকাতায়, আবার কেউ হয়ত ভারতের নদীয়া, কৃষ্ণনগরেই অবস্থান করছিলেন। চুয়াডাঙ্গার দামাল ছেলেরাও এঁদের মধ্যেই ছিলেন। কিন্তু তাঁদের কে কোথায় ছিলেন, কবে ভারতে গিয়েছিলেন, তা আজ নির্ণয় করা কঠিন। তবে হাসান, তারিক, থােকন, কাশেম, রবিউল, রওশন, কিয়ামুদ্দিন ও আফাজউদ্দিন সম্পর্কে যতদূর জানা যায়, প্রথমােক্ত ৭ জন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেবার জন্যে ভারতে যান। আফাজউদ্দিন যােগ দেন আরাে পরে। ১৯৭১-এর ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলা (বর্তমানে মুজিবনগর) আম্রকাননে অস্থায়ী সরকারের শপথ অনুষ্ঠান শেষ হবার পর ঠিক হল সীমান্তবর্তী ভারতীয় এলাকায় যুব অভ্যর্থনা ক্যাম্প গড়ে তােলা হবে। সেসব ক্যাম্পগুলিতে দেশপ্রেমী ও মুক্তিযুদ্ধে যােগদানে ইচ্ছুক যুবকদেরকে একত্রিত করে তালিকাভুক্ত করা হবে। তারপর তাদেরকে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে পাঠান হবে। এই লক্ষ্যে ১৯ এপ্রিল ‘৭১-এ মুজিবনগর আম্রকাননের অদূরে ভারতীয় হৃদয়পুর বিএসএফ ক্যাম্পের পাশে বিরাট বটগাছ ও খামার বাড়ি এলাকায় যুব অভ্যর্থনা ক্যাম্প চালু করা হয়। এর আগে ডাঃ আসহাবুল হক ও এ্যাডঃ ইউনুছ আলী, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক দিলীপ চক্রবর্তী, বাংলা কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক সুশীল ধারা এবং নদীয়া জেলার কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের সাথে আলােচনা করেন।
তাঁরা প্রয়ােজনীয় আর্থিক ও অন্যান্যভাবে সহযােগিতার আশ্বাস দেন। মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিন পর্যন্ত ক্যাম্পটি চালু ছিল। হৃদয়পুর যুব অভ্যর্থনা ক্যাম্প চালু হলে সর্বপ্রথম চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর জেলার ৯৫ জনসহ সর্বমােট ১শ’ ৩৬ জন যুবক যােগ দেন। এদের মধ্যে হাসান, খােকন, কাশেম, রওশন, রবিউল ও কিয়ামুদ্দিন ছিলেন। প্রথম দিকে জনাব সােলাইমান হক জোয়াদ্দার সেলুন ও মতিয়ার রহমান মন্টু (মরহুম) মুক্তিযােদ্ধাদের নেতৃত্ব দিতেন। ক্যাম্পটি চালু হবার ১৬দিন পর ৪ ঠা মে রাতে ক্যাপ্টেন আজম চৌধুরী বেতাই ক্যাম্প থেকে বাছাইকৃত মুক্তিযযাদ্ধাদেরকে তৎক্ষণাৎ বাসে করে বেতাই ক্যাম্পে চলে আসতে বলেন। সেই রাতেই ১৭ জন তরুণ বেতাই ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে রওনা হন। জনাব সােলাইমান হক জোয়ার্দার সেলুনের নেতৃত্বে সেই ১৭ জনের মধ্যে হাসান, রবিউল, রওশন, কাশেম, খােকন ছিলেন। বেতাই ক্যাম্পে পৌঁছে তাঁদের সাথে তারিক যােগ দেয়। তারিক মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেবার জন্যে ভারতে গিয়ে আগেই বেতাই ক্যাম্পে যােগ দিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে জানা গেল, তাদেরকে অস্ত্র দিয়ে দেশের অভ্যন্তরে পাঠানাে হবে। তাদের উদ্দেশ্য থাকবে গেরিলা কায়দায় আচমকা হামলা চালিয়ে পাকবাহিনীকে তটস্থ রাখা। তখন কারাে কোন প্রশিক্ষণ ছিল না। কিন্তু পরদিন ৫ই মে ক্যাপ্টেন আজ, চৌধুরী তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন। অস্থায়ী সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ম্যাসেজ পেয়ে তিনি তাদেরকে দেশের ভেতর প্রেরণের পরিবর্তে ঐ দিনই কৃষ্ণনগরের শালবাগানে পৌছে দেন।
সারাদিনের মধ্যে সেখানে আরাে কয়েক শত বিভিন্ন বয়সী যুবক জমায়েত হন। সন্ধ্যার দিকে তাদেরকে সেখানে চা ও লুচি খেতে দেয়া হয়। তারপর ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রতিটি ট্রাকে ২২ জন যুবককে তুলে দেয়া হল, প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হবে। | সন্ধ্যার কিছু পরে ট্রাকগুলাে প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে রওনা হল। সারারাত একটানা চলার পরেও পথের শেষ নেই। ই মে ভােরে বােঝা গেল, ট্রাকের চালকেরাও জানে না কোথায় গিয়ে থামতে হবে। পথের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সেনাবাহিনীর ট্রাফিক যেদিকে নির্দেশ করছে, ট্রাকগুলাে সেদিকেই যাচ্ছে। এমনিভাবে চলতে চলতে সকাল ৯টার দিকে ট্রাকগুলাে বিহারের চাকুলিয়ায় পৌছল। এরপর শুরু হল প্রশিক্ষণ পর্ব। প্রথম ব্যাচে চাকুলিয়ার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে বৃহত্তর কৃষ্টিয়ার ছাত্র যুবকের সংখ্যা সবচে বেশি ছিল। প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন একটি বিধ্বস্ত ক্যাম্প। প্রথম ব্যাচের অস্ত্র ও বিস্ফোরক দ্রব্য প্রশিক্ষণের জন্য এখানে ৬টি উইং খােলা হয়। প্রতিটি উইং-এ ১শ’ ২৫ হতে ১শ ৫০ জন পর্যন্ত ছাত্র-যুবক ছিলেন। হাসান, তারিক, থােকন, কাশেম, রওশন ও রবিউল ৩নং উইং-এ ছিলেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষকগণ এখানে প্রশিক্ষণ দিতেন। চাকুলিয়া ক্যাম্পে সাপের উপদ্রব ছিল। সাপের কামড়ে ক’জন মুক্তিযােদ্ধা মারাও গিয়েছিলেন। পরে অবশ্য তাঁবুর চারপাশে গর্ত করে সেখানে এক প্রকার গুঁড়া ঔষধ ছিটিয়ে দেয়া হত। তথাপি মুক্তিযােদ্ধারা পর্যায়ক্রমে তাবুর পাশে হারিকেন হাতে করে পাহারা দিতেন। প্রথমদিকে কঠোর নিয়মানুবর্তিতা মেনে চলতে সকলেরই কষ্ট হত। তবু তারা সবকিছু হাসিমুখে বরণ করে নিতেন।
সেই সময় চাকুলিয়া ক্যাম্পে খাদ্য ও পানি স্বল্পতা ছিল। একদিন আলাউল ইসলাম খােকন ও আবুল কাশেম ক্যাম্পের সামান্য কিছু দূরে একটি কূপের সন্ধান পান। কিন্তু জংলী প্রকৃতির একদল মানুষ সেই পানি গ্রহণে বাঁধা দেয়। মুক্তিযােদ্ধাদের তাই ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসতে হয়। পানির অভাবে সকালে চা দিয়ে। কুলি করে নাস্তা খেতে হত। তৃষ্ণা মেটাতেও চা পান করতে হত। বড় ১ মগ চা ও ২ টা পুরি ছিল সকালের নাস্তা। দুপুরে দেয়া হত ১ চামচ ভাত অথবা ২ টি আটার রুটি। রাতেও দুপুরের মতাে সামান্য খাবার দেয়া হত। কঠোর পরিশ্রমের পর সামান্য খাবার অনেকের জন্যেই কষ্টকর ছিল। এভাবে ৪২ দিনে প্রথম ব্যাচের প্রশিক্ষণ শেষ হয়। ১৭ই জুন ৭১-এর চাকুলিয়া হতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযােদ্ধাদের বাংলাদেশ সীমান্তে বিভিন্ন ক্যাম্পে এনে রাখা হয়। একমাত্র প্রথম ব্যাচেই দীর্ঘ ৪২ দিনের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল। এর পরের প্রতিটি ব্যাচকে ২৫ দিনের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।
প্রথম ব্যাচে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হাসান, তারিক, রওশন, রবিউল, কাশেম ও খােকন চাকুলিয়া থেকে প্রশিক্ষণ শেষে শিকারপুর ক্যাম্পে আসেন। পরে তাঁরা কৃষ্ণনগরের হার্টিকালচার আমবাগানে চলে যান। আরাে পরে হাটখােলা ক্যাম্প চালু হলে এরা সেখানে আসেন। সেখানে থেকে তাঁরা বিভিন্ন যুদ্ধে অংশ নেন। প্রথম অবস্থায় হৃদয়পুর ক্যাম্পে অবস্থানরত কিয়ামুদ্দিনও পরবর্তীতে চাকুলিয়ায় প্রশিক্ষণ নিয়ে এসে অন্যান্যদের সাথে মিলিত হন। আরাে অনেক পরে মুক্তিযােদ্ধারা যখন বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকে বিভিন্ন অপারেশন চালাতেন, তখনই কোন এক সময় আফাজউদ্দিনের সাথে অন্যান্যদের পরিচয় ঘটে। আফাজউদ্দিনের কোন প্রশিক্ষণ ছিল । সহযােদ্ধাদের কাছ থেকে তিনি শুধু থ্রী নট থ্রী রাইফেল চালান শিখেছিলেন। তবে তিনি মূলত বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ ও মুক্তিযােদ্ধাদেরকে পথ চিনতে সাহায্য করতেন। (সূত্র : সম্মুখ সমরে, গেলাে নাছির আহমেদ রাজিব।)
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত