You dont have javascript enabled! Please enable it! খুলনার প্রতিরােধ যুদ্ধ - সংগ্রামের নোটবুক
খুলনার প্রতিরােধ যুদ্ধ
২৫শে মার্চ। পরিস্থিতি গুরুতর, সেটা সবাই বুঝতে পারছে। আবহাওয়া ক্রমেই যেন ভারী হয়ে আসছে। খুলনার রাজনৈতিক নেতারা অবস্থাটা বুঝবার জন্য ঢাকার সঙ্গে টেলিফোনে যােগাযােগ করছিলেন। কিন্তু রাত্রি আটটার সময় পােলের যােগাযােগ একেবারেই বন্ধ হয়ে গেল। তখনি তাদের মনে সন্দেহ জাগল ঢাকার অবস্থা ভাল নয়, একটা কিছু অঘটন ঘটতে চলেছে। কর্মীদের চোখে ঘুম নেই। রাত্রি ১২টার সময় একটা ঘােষণার শব্দ শুনে তারা চমকে উঠল। শুধু তারাই নয়, সারা শহরের ঘুমন্ত মানুষ শয্যা ছেড়ে উঠে বসেছে। সরকারী ঘােষণাকারীরা সারা শহরে ঘুরে ঘুরে মাইক-যােগে প্রচার করে ফিরছে যে, আগামী কাল ২৬শে মার্চ সকাল পাঁচটা থেকে সারা শহরে ৭২ (বাহাত্তর) ঘণ্টা পর্যন্ত কারফিউ জারী করা হচ্ছে। এই সময়ের মধ্যে যদি কেউ ঘর ছেড়ে পথে বেরােয় তবে তাকে সঙ্গে সঙ্গে গুলি করা হবে। অনেকেই অনুমান করল, ঢাকা শহরে অথবা আর কোথাও অবশ্যই একটা কিছু শুরু হয়ে গেছে এবং তার জের সারা দেশেময় ছড়িয়ে পড়বে। কিন্তু প্রথম আক্রমণ করেছে। কারা—পাকিস্তানের জঙ্গীবাহিনী না মুক্তিকামী জনগণ? * প্রতিরােধ সংগ্রামে বাংলাদেশ থেকে সংকলিত।
ইতিমধ্যে সবার অগােচরে আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে গেছে। সেটা ঘটেছে কারফিউ জারী করার বেশ কিছু আগেই। এটা একটা আশাতীত সুখবর । আজই রাত্রিতে ইপিআর বাহিনীর জনৈক পাঞ্জাবী অফিসার তার কয়েকটি প্রিয়পাত্রকে এই বলে হুঁশিয়ারী দিয়েছিলেন যে, ইপিআর-এর লােকদের সামনে এক ভীষণ বিপদ ঘনিয়ে এসেছে, যদি প্রাণে বাঁচতে চাও আর দেরি না করে এখনই পালিয়ে যাও। স্থানীয় ইপিআর বাহিনীতে প্রায় তিন শত জন লােক। খবরটা তাদের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল। দেখতে দেখতে ইপিআর লাইন খালি হয়ে গেল। তারা রাতের অন্ধকারে সেই স্থান ত্যাগ করে সুশৃঙ্খল ভাবে দূরবর্তী গ্রামাঞ্চলে আশ্রয় নিল। অপর দিকে কারফিউ জারী হবার পর অবস্থা সঙ্গীন বুঝতে পেরে শহরের পুলিশরাও তাদের ব্যারাক ছেড়ে পালিয়েছে।
গভীর উত্তেজনার মধ্য দিয়ে সেই রাতটা কেটে গেল। পরদিন সকালে কি ঘটনা ঘটে দেখবার জন্য সবাই উদ্বিগ্ন, কারাে চোখে ঘুম নেই। স্বাধীনতার সংগ্রাম কি তবে সত্য সত্যই শুরু হয়ে গেছে? বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মীরা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন। কে কোথায় আছে তাও ভালভাবে জানে না, অথচ অবিলম্বে উদ্যোগ নিয়ে কিছু একটা করতে হবে। সাধারণ মানুষ তাে তাদের মুখের দিকেই তাকিয়ে আছে। কারফিউ শুরু হবে কাল সকাল পাঁচটায়। অথচ মিলিটালীর লােকেরা ইতিমধ্যে সারা শহরের পথে পথে টহল দিয়ে ফিরছে। ওরা নিশ্চয়ই সব কিছু চোখে চোখে রাখছে। এখন বাইরে চলাচল করতে হলে সর্তক ভাবে ওদের দৃষ্টি এড়িয়ে চলতে হবে।
বেশ কিছু খোঁজাখুঁজির পর তিনজন এক জায়গায় মিলিত হলেন। একজন আওয়ামী লীগের, একজন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির ও একজন ছাত্র লীগের নেতা। ইতিমধ্যে একটা খবর তাঁদের কাছে এসে পৌঁছেছে যে, ইপিআর বাহিনীর সমস্ত লােক ইতিপূর্বে তাদের জায়গা ছেড়ে দৌলতপুরের দিকে পালিয়েছে। সংবাদটা সুসংবাদ। তারা তিন জনে বসে ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা সম্পর্কে একটা পরিকল্পনা গ্রহণ করলেন। নিজ নিজ দলের মতামত নেওয়ার মতাে সময় ছিল না। এখন এমন একটা সময়, যখন ভুল হােক বা শুদ্ধ হােক, যা করবার নিজেদের দায়িত্বেই করতে হবে। এই পরিকল্পনা নিয়ে এই তিন জন অতি সঙ্গোপনে শহর ছেড়ে দৌলতপুরের দিকে চলে গেলেন।
ইপিআর বাহিনীর পলাতক লােকেরা দৌলতপুর থেকে চার মাইল দূরে রংপুর, শাহপুর, লতা প্রভৃতি গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। গ্রামবাসীদের ঘরের দরজা তাদের জন্য অবারিত, তারা নিতান্ত আপন জনের মতাে তাদের নিজেদের ঘরে আশ্রয় দিয়েছে। এতে যে বিপদের আশঙ্কা আছে, এ কথাটা কি তাদের জানা ছিল না? ছিল বৈকি। কিন্তু স্বাধীনতার সংগ্রাম করতে হলে দুঃখ আর বিপদ আর মৃত্যুর সম্মুখীন তাে হতেই হবে। এই পলাতকের দল প্রাণ বাঁচানাের জন্য পালিয়ে এসেছিল একথা সত্য, কিন্তু সেটাই তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। তার চেয়েও বড় কথা, তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য পশ্চিমা শাসকদের জঙ্গী বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করবে। যদি প্রাণ দিতে হয়, প্রাণ দেবে। সারা বাংলাদেশের মানুষ যে অনেক আশা করে তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তাই পালিয়ে আসার সময় তারা যত বেশি সম্ভব রাইফেল, কার্তুজ আর গােটা কয়েক লাইট মেশিনগান সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে। | যে তিনজন স্থানীয় নেতা এদের সন্ধানে শহর থেকে চলে এসেছিলেন তারা এদের সঙ্গে গিয়ে দেখা করলেন। পরামর্শ করলেন এবং তারপর সিদ্ধান্ত নিলেন যে, এই বাহিনী অবিলম্বে দ্রুত মার্চ করে খুলনা শহর দখল করে নেবে।
আধুনিক সমরােপকরণে সজ্জিত এক বিরাট সৈন্যবাহিনী রওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা বিনা বাধায় আসতে পারেনি। পথের মাঝখানে দেশপ্রেমিক জনতা তাদের রুখে দাঁড়িয়েছিল। তারা প্রথম বাধা পায় যশাের জেলার অন্তর্গত নওয়াপাড়া গ্রামে। এখানে ইপিআর-এর কোন সশস্ত্র লােক ছিল না। তবু দুঃসাহসী পুলিশ, ছাত্র ও সাধারণ মানুষ তাদের প্রতিরােধ করতে এগিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তাদের এই দুর্বল ও ভঙ্গুর বাধাকে চূর্ণবিচূর্ণ করে হামলাকারীর দল তাদের লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলল। তারা দ্বিতীয়বার বাধা পেলে খুলনা জেলার ফুলতলা অঞ্চলে। মুক্তিবাহিনী এদের অগ্রগতিকে প্রতিরােধ করবার জন্য তাদের বাহিনীর একটি অংশকে পাঠিয়েছিল। ফুলতলা অঞ্চলে দু’পক্ষের সংঘর্ষ ঘটল। সেখানে ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত যুদ্ধ চলেছিল। এদের এই প্রবল আক্রমণের ফলে যশাের থেকে আগত পাক-সৈন্যবাহিনী যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি ভােগ করার পর মধ্যপথে বিচ্ছিন্ন হয়ে দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেল। একটা অংশ তাদের হতাহত সৈন্যদের সঙ্গে নিয়ে যশােরের দিকে ফিরে চলে গেল। কিন্তু বৃহত্তর অংশটি খুলনা শহরে রণক্ষেত্রের দিকে এগিয়ে চলল। এদের সঙ্গে ছিল পঁয়ত্রিশটি গাড়ি বােঝাই সৈন্য, আর ষােলটি কামান সজ্জিত জীপ। ফুলতলা থেকে খুলনা শহর মােল মাইল দূরে, পথের মাঝখানে সংগ্রামী জনতা বহু বাধা ও ব্যারিকেডের সৃষ্টি করে তুলেছিল, যার ফলে এই ষােল মাইল পথ অতিক্রম করতে এদের আঠারাে ঘণ্টা সময় লেগেছিল।
যশােরে সৈন্যদল এসে পৌছবার পর পাকসৈন্যবাহিনীর শক্তিবহু পরিমাণে বেড়ে গেল। শুধু সৈন্য সংখ্যার দিক দিয়েই নয়, এরা যােলটা মর্টার নিয়ে এসেছে। অথচ এ দিকে খুলনা শহরের শ্রমিক ভাইয়েরা দলে দলে মুক্তিবাহিনীতে যােগ দিয়ে চলেছে। এরা মৃত্যুভয় ভুলে গিয়ে উম্মত্তের মতাে যুদ্ধের আগুনে ঝাঁপ দিয়ে পড়ছে। ‘ যখন দু’পক্ষে প্রবল হানাহানি চলছে, তখন হঠাৎ দেখা গেল পাসৈন্যবাহিনী একটু পেছনে চলে গিয়ে শ্বেত পতাকা তুলে ধরেছে। তার মানে এরা আত্মসমর্পণ করতে চাইছে। থেমে গেল যুদ্ধ। মুক্তিবাহিনীর লােকেরা জয়ােল্লাসে মেতে উঠল। তারা নিশ্চিন্ত মনে পাক-সৈন্যদের বন্দি করবার জন্য এগিয়ে গেল। কিন্তু এটা যে ওদের ছলনা মাত্র, একটু বাদেই তা বুঝতে পারা গেল। ওরা অপ্রস্তুত অবস্থায় কাছে এগিয়ে আসতেই জঙ্গীবাহিনীর মেশিনগানগুলি তাদের লক্ষ্য করে একসঙ্গে গর্জে উঠল। ফলে মুক্তিবাহিনীর হাতে হাতিয়ার ছিল না। সেই অগ্নিবর্ষণের ফলে তারা পতঙ্গের মত পুড়ে ছাই হতে লাগল। এরপর তাদের যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার আর উপায় রইল না। তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যে যেদিকে পারল পালিয়ে গেল। একটানা ছত্রিশ ঘণ্টা যুদ্ধ চলার পর খুলনা শহরের মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্বের পরিসমাপ্তি ঘটল। এই যুদ্ধে বহু পাকসৈন্য হতাহত হয়। তাদের মধ্যে একজন মেজর মারা যান এবং খুলনা সেক্টরের সেক্টর কমাণ্ডার কর্নেল শামস্ গুরুতরভাবে আহত হন। 

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত