You dont have javascript enabled! Please enable it! গৌরনদীর প্রতিরােধ - সংগ্রামের নোটবুক
গৌরনদীর প্রতিরােধ
২৫শে এপ্রিল। মিলিটারী আসছে, গৌরনদীর সর্বত্র রব উঠল। সকাল থেকে চারখানা হেলিকপ্টার বেশ উঁচু দিয়ে বার বার মাদারীপুর থেকে যে রাস্তা গৌরনদীর বুক চিরে বরিশালের দিকে চলে গেছে তার উপর দিয়ে উড়ছে। ওদিকে বরিশাল শহরের চার মাইল উত্তরে জুনাহারে প্রচণ্ড গােলা বিনিময় হচ্ছে মুক্তিবাহিনীর সাথে । কামানের গর্জন, গানবােটের শেলিং আর মর্টারের শব্দ থেকে থেকে কেঁপে উঠছে। অপর দিকে খবর পাওয়া গেল, মাদারীপুর দু’দিন পূর্বে পাকবাহিনী দখল করে নিয়েছে এবং আজকেই সড়কপথে দস্যুরা গৌরনদী হয়ে বরিশাল যাবে। কি করা যায় ভাবছে কৃষক-শ্রমিক আর রাজনৈতিক কর্মীরা। মুহূর্তের মধ্যে স্থির করে নিল তারা। যে করে হােক হানাদারদের বাধা দিতে হবে। অন্তত বাধা দেয়ার চেষ্টা করতেই হবে। বীরযােদ্ধারা জানত, সম্মুখযুদ্ধে কয়েকটা ৩০৩ রাইফেল আর ৫/৭-দশ রাউণ্ড করে গুলি দিয়ে ভারী অস্ত্রের সামনে কিছুই করা যাবে না। তবুও সাধারণ মানুষ যাতে ভেঙ্গে না পড়ে বা ভুল না বােঝে তার জন্য চেষ্টা চালাতে হবে। তাই তারা সকাল থেকে গৌরনদীর উত্তরে কটকস্থল নামক স্থানে পজিশনে রইল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যাচ্ছে তবুও শত্রুর সাথে দেখা নেই।
সকাল গড়িয়ে দুপুর। রৌদ্রের প্রখরতায় পিপাসাকাতর হয়ে পড়েছে মুক্তিযােদ্ধারা। তাদের গােপন অবস্থান থেকে (সি এণ্ড বি সড়কের পাশে) কয়েক গজের মধ্যেই সাধারণ কৃষক জহরউদ্দীন মােল্লার বাড়ি। তাই কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা পানি খাওয়ার জন্য জহর মােল্লার ঘরে গেলে পানি ঢেলে দেয়। যেখানে বসে মুক্তিকামী ভাইয়েরা বিশ্রাম নিচ্ছিল তার থেকে কয়েক গজ উত্তরে একটা উঁচু পুল রয়েছে। এত উঁচু যে পুলের অপর দিক থেকে কিছুই দেখা যায় না। দুপুর গড়িয়ে বেলা তখন তিনটা। হঠাৎ করে শব্দ না করে একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল ওদের সামনে। পর পর আরও কয়েকটা—একেবারে গুণে গুণে চল্লিশটা। বর্বর সেনারা গুলি চালাল। বসা অবস্থায়ই শহীদ হলেন চারজন মুক্তিযােদ্ধা। শহীদ হল জহরউদ্দীন মােল্লা ও তার ছেলে মােবারেক মােল্লা। মুক্তিবাহিনীর হাতে সেদিন খতম হল দু’জন খানসেনা। * দৈনিক বাংলা, ২৪ মার্চ, ১৯৭২-এ প্রকাশিত শহীদ সেরনিয়াবাত রচিত প্রতিবেদনের অংশ। 
সেদিনের ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়া মুক্তিবাহিনী কয়েক দিনের মধ্যেই আবার একত্রিত হল। এই একত্রিত করার পেছনে যাদের অক্লান্ত প্রচেষ্টা ছিল তারা হলেন এস এম রকিব, অধ্যাপক এনায়েত, সেন্টু ও আরও কয়েকজন। তাদের প্রচেষ্টায় ২৪টা রাইফেল ও তিনশত রাউণ্ড গুলি দিয়ে প্রথম দল গঠন করা হয়। পরে এই দল মিলিত হয় গােপালগঞ্চের হেমায়েতের সঙ্গে।  গৌরনদীর প্রতিরােধ সংগ্রামে আরও যাদের নাম চির অম্লান তাদের কথা কিছু লিখতেই হবে। যে দলটি সরিলে ঘাটি করেছিল সেই দলটি খসরুর পার্টি নামে পরিচিত ছিল। এরা বয়সে তরুণ এবং সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক চেতনায় অনুপ্রাণিত হয়ে একটি শক্তিশালী দল হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলেছিল। এরা সাধারণত হিট এ্যাণ্ড রান করে অনেক অস্ত্র পাকসৈন্য, পুলিশ ও রাজাকারদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল। বহু দালাল এদের হাতে নিহত হয়েছে। এরা নিজ হাতে অস্ত্র তৈয়ারও করত। আজও সরিকলবাসী আলমের কথা ভােলেনি। নিজের তৈরি বােমার আঘাতেই আলম শহীদ হয়েছেন সরিকলের শামসু মিয়ার বাড়িতে। জনতার প্রতিরােধ শক্তিশালী, দুর্জয়। তার প্রমাণ গৌরনদীর বাকাই। বাকাইর বীর জনতা বল্লম দিয়ে মেরেছিল চার চারটে তরতাজা পাঞ্জাবী দস্যুকে। কেড়ে নিয়েছিল চারটে চায়না রাইফেল।
সেদিন ছিল ১৪ই মে। একদল খানসেনা বাকাই গ্রামে ঢুকে পড়েছে। যেভাবে হােক। তাদের রুখতেই হবে। তাই প্রস্তুত হয়ে গেল গ্রামবাসী। হাতে বল্লম ও রাম দা’। কয়েকজন গ্রামবাসী যেখান দিয়ে খানসেনারা আসবে সেই পথের ধারে একটা গর্তের মধ্যে আত্মগােপন করে রইল। কিছুক্ষণের মধ্যেই খানসেনারা কাছে এসে গেল। মুহূর্তের মধ্যে কয়েকটি বল্লম নির্ভুল লক্ষ্যভেদ করল। বল্লম একেবারে হানাদার চারটের বক্ষভেদ করে দিল। তারপর টুকরাে টুকরাে করে ছড়িয়ে দিল সে মৃতদেহ চারটি। খানসেনারা এর পর থেকে আর ঢােকেনি বাকাই গ্রামে।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত