You dont have javascript enabled! Please enable it!
সশস্ত্র প্রতিরােধে রংপুর ঠাকুরগাঁ দিনাজপুর
২৫শে মার্চের বিকালে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ঘােষণা, পিলখানা হতে প্রেরিত বেতার সংকেত কিছুই আমাদের কানে পৌছেনি। হঠাৎ মাঝরাতে কি এক জরুরি ডাকে আমাদের নবম শাখার ছােটকর্তা ক্যাপ্টেন নাবিদ আলম এক প্লাটুন লােক নিয়ে দিনাজপুর গেলেন। সেক্টর কমাণ্ডার লেঃ কর্নেল তারেক রসুল কোরেশীর সঙ্গ নিয়ে দিনাজপুর গেলেন। সেক্টর কমাণ্ডার লেঃ কর্নেল তারেক রসুল কোরেশীর সঙ্গে কি যেন আলােচনা হল। ভাের রাতে সদলবলে তিনি ফিরে এলেন। ২৬শে মার্চের ভাের। ক্যাপ্টেন ঠাকুরগাঁ হেডকোয়ার্টারে উপস্থিত তামাম জুনিয়ার কমান্ডারদের অফিসে ডেকে পাঠালেন। জরুরি সভা করে সরকারের আদেশ সবাইকে জানিয়ে হাজির রির্জাভ কোম্পানীসহ বাকী সবাইকে অতি অল্প সময়ের মধ্যে পূর্ণ সামরিক সাজে সজ্জিত হতে আদেশ দিলেন। উপস্থিত সকলেই বহুত আচ্ছা সাব’ বলে যে যার কাজে লেগে যায়। এদিকে উইং অধিনায়ক মেজর মােহামদ হুসেন সীমান্ত পরিদর্শনে পঞ্চগড়ের দিকে বাইরে ছিলেন। তাকে বিশেষ করে ডেকে পাঠান হল। সকলেই রণ সাজে সজ্জিত হয়ে গভীর আগ্রহে বসে আছে। ঠাকুরগাঁ টাউন ততক্ষণে ফেটে পড়ছে। জনতার বান ডেকেছে, রাস্তাঘাটে ব্যারিকেড তৈরি করা হচ্ছে ইট পাথর ও অন্যান্য জিনিস দিয়ে, শত শত গাছ কেটে । উইং হেডকোয়ার্টারে আত্মরক্ষামূলক সামরিক ব্যুহ রচনা করে পাহারার বন্দোবস্ত করা হল। এমন সময় প্রায় ৯টার দিকে মেজর এলেন, আবার জরুরি সভা বসল। খামাখাই ছুতা-নাতায় নেহাৎ ভাল মানুষ বলে সুপরিচিত মেজর বিষম রাগত হয়ে উঠলেন সবার প্রতি, আর রিজার্ভ কোম্পানীর অধিনায়ক সুবেদার হাফিজকে তাে একেবারে হাজতে দেবেন বলে শাসালেন। তার অপরাধ কোম্পানী রণপ্রস্তুতি নিতে একটু দেরি করে ফেলেছে। মওকা বুঝে ক্যাপ্টেনও এক ধাপ আগে বাড়লেন। বললেন, ‘ও দিন ভুল যাও—আওয়ামী লীগ-মীগ নেহী হােতা।
ডাক-তার না থাকলেও বাতাস যেন কানে কানে চুপে চুপে সব খবর দিয়ে যেতে লাগল। এমনিভাবে সমুদয় বাঙালি সৈনিকের মন পুরাদস্তুর বারুদের ঘর হয়ে উঠল। অপেক্ষা একটু মাত্র ঈঙ্গিতের। কিন্তু আমি লােকদিগকে সান্ত্বনা দিতে লাগলাম। এদিকে বড় কর্তার আদেশ টাউনে পেট্রল পাঠানাে হল, আর কারফিউ জারী থাকল দিন-রাত। কিন্তু হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ জনতা সকল আদেশ অমান্য করে শশাভাযাত্রা বের করে এবং নানা জায়গায় বেরিকেড স্থাপন করে চলল। মেজর ও ক্যাপ্টেন আমাকে সঙ্গে নিয়ে শহরে যান এবং পরিস্থিতি আয়ত্তে আনার চেষ্টা নেন। সেদিন বেলা দশ ঘটিকার সময় মিছিলের উপর গুলি চালানাে হয়। ফলে রিকশাওয়ালা মােহাম্মদ আলী ঘটনাস্থলেই নিহত হয়। আমাদের লােক আরও খাপ্পা হল। আমি তাদেরকে সান্ত্বনা দিয়ে আমার কয়েকজন সহকর্মীসহ পরিস্থিতি সম্পর্কে পরামর্শ করলাম এবং সকল আলােচনা গােপন রাখা হল। আবার সেই দিনই (২৬শে মার্চ) দিবাগত রাতে বাঙালি ক্যাপ্টেন নজির আহমদ ও সুবেদার আতাউল হকসহ ৩০ জনের একটি প্লাটুন সেক্টর সদর দিনাজপুর হতে আমাদের সাহায্যার্থে ঠাকুরগা এসে হাজির হলেন। এই দলে পশ্চিমারা ছিল প্রায় ডজন খানেক। আমাদের হেডকোয়ার্টার সংরক্ষণ ও টাউন পেট্রল ডিউটি সমানে চলতে লাগল। প্রায় এক কোম্পানী লােক এতে নিয়ােজিত রইল। ২৭তারিখ আবার ঠাকুরগাঁ টাউন রক্তে রঞ্জিত হল আমাদের নির্মম গুলির আঘাতে। এইদিন একটি নিস্পাপ শিশু নিহত হল। আমাদের ডিউটি চলতে লাগল। ইতিমধ্যে জনসাধারণের মনােবল ভেঙ্গে পড়ছে, তারা ততক্ষণে টাউন ছেড়ে পালাতে শুরু করেছে। আমি সেই দিনই সুবেদার হাফিজ, সুবেদার আতাউল হক, নায়েক সুবেদার মতিউর রহমান, হাবিলদার আবু তালেব ও নায়েক আব্দুল হাকিমকে নিয়ে এক গােপন আলােচনা সভায় সিদ্ধান্ত নিলাম পরদিন ভাের ৬টায় পশ্চিমাদের উপর আমাদের তরফ হতে আক্রমণ চালান হবে।
কিন্তু হায়, পরিকল্পনা অনুসারে সুবেদার হাফিজ যখন পশ্চিমানিধনে উদ্যত হলেন তখন জনৈক বাঙালি হাবিলদারের অসহযােগিতার দরুন তা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে সেই দিনকার মতাে আক্রমণ স্থগিত রইল। আমরা বিশেষ চিন্তিত হলাম কারণ, একে ত শুরুতেই বাধা এল, দ্বিতীয়ত : যদি আমাদের উদ্দেশ্য ফাঁস হয়ে যায় তবে আর রক্ষা থাকবে না। | খােদার উপর ভরসা করে চুপ থাকলাম। কিন্তু সহকর্মীদেরকে নির্দেশ দিলাম সকলেই যেন জরুরি, নির্দেশের অপেক্ষায় সব সময় সজাগ থাকে। এইসময় স্থানীয় আওয়ামী লীগ আমাদের কর্মসূচী জানবার জন্য বার বার আমাদের সঙ্গে যােগাযােগ করে, কিন্তু তাদেরকে বলি যে সুযােগ এলেই তা করা হবে এবং আপনারা সজাগ থেকে আমাদের সঙ্গে যােগাযােগ রাখবেন। ২৮শে মার্চ ভােরেও বিশেষ কারণে পরিকল্পনা মাফিক আমাদের পশ্চিমাদের উপর আক্রমণ চালান সম্ভব হল না। মনটা একেবারে বিগড়াইয়া গেল। খােদা না করুন আমাদের পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে গেলে এর পরিণাম কি হবে। আবার ঐদিকে আমাদের পাঞ্জাবী মেজর ও ক্যাপ্টেনসহ পশ্চিমাদের তৎপরতা বেশ বেড়ে উঠল। আমরা সরকারী কাজের মধ্য দিয়ে খুব সতর্ক থাকলাম। সেই দিন রিজার্ভ কোম্পানী কমাণ্ডার সুবেদার হাফিজ টাউন ডিউটি শেষ করে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে নিজ বিছানায় শুয়ে নানা চিন্তায় মগ্ন। প্রােগ্রাম মাফিক তার পরবর্তী ডিউটি ছিল পরদিন অর্থাৎ ২৯শে মার্চ সকাল পৌনে সাতটায়, কিন্তু সেই দিন হঠাৎ করে বিকাল পৌনে চারটায় তাকে জরুরি পেট্রলে পাঠান হয় ঠাকুরগাঁও-দিনাজপুর হাই রােড পর্যবেক্ষণ ও পরিষ্কার করার উদ্দেশ্যে। মেজর হুসেন নিজে তাকে পেট্রল সম্বন্ধে বিস্তারিত বুঝিয়ে দিয়েছিলেন।
সুবেদার হাফিজ ইশারায় বলতে গেলে আদেশ বহির্ভূত কাজ করে অনেক দূর পথ অগ্রসর হলেন। পথিমধ্যে দিনাজপুর হতে পলায়নপর বাঙালি ইপিআর জোয়ানদের নিকট জানতে পারেন সেই দিন দুপুরেই দিনাজপুর সেক্টর হেডকোয়ার্টার কুটিবাড়ীতে বাঙালি ইপিআর লােকদের সঙ্গে আর্মি ও ইপিআরের পশ্চিমাদের তুমুল সংঘর্ষ শুরু হয়েছে। এক নিমেষে মনে মনে তিনি নিজ কর্তব্য স্থির করে তাড়াতাড়ি উইং সদরে ফিরে আসেন। তখন সন্ধ্যা সমাগত প্রায়। এসেই তিনি মাগরেবের নামাজের জন্য আমাকে মসজিদে উপস্থিত পান এবং উপরােক্ত বিষয় অবহিত করেন। অপরদিকে কিছুক্ষণের মধ্যেই বিশ্বস্তসূত্রে জানতে পারলাম রাত পৌনে ১১টায় উইং-এর শেষ পেট্রল লাইনে ফিরে আসার পরই বাঙালিদের উপর হামলা শুরু করার নির্দেশ এবং আমাকে গ্রেফতার করার আদেশ সৈয়দপুর আর্মি হেডকোয়ার্টার দিয়ে দিয়েছে। অতএব আমার বাসায় সুবেদার হাফিজ, ৭ উইং-এর সুবেদার আতাউল হক, নায়েক সুবেদার মতিয়ুর রহমান ও আরও জন তিনেক জোয়ান একত্রিত হয়ে মিনিট কয়েকের মধ্যেই সিদ্ধান্ত নিলাম বিপ্লব ঘটাবার এবং সেই রাতেই। এমন সময় উইং কমাণ্ডার হতে আদেশ এল সব হাতিয়ার ম্যাগাজিনে জমা দিতে হবে। মুহূর্তে খানদের চক্রান্ত সম্বন্ধে আমার দ্বিধা দূর হল। আমি আরও শক্ত হয়ে বাঙালি সহকর্মীদিগকে অস্ত্র জমা না দেবার নির্দেশ দিলাম। পরম পরিতােষের বিষয় সকলেই একবাক্যে আমার আদেশ মান্য করল এবং হাতিয়ার জমা দেওয়া হল না একটিও। বিপ্লব করতেই হবে, অথচ এদিকে অসুবিধা ছিল ঢের। গােটা এক প্লাটুন গেছে পেট্রলে, বাকী সব লােক উইং সদরের চতুর্দিকস্থ পরিখা-বিবর ঘাটিতে ডিউটিতে লাইনে হাজির। লােক খুব কম, আবার ওদের সঙ্গে উঠা-বসা-শােয়ার ব্যবস্থা। তথাপি কমাণ্ডারগণ নির্দেশ মাফিক আপন-আপন গ্রুপের লােকজনদের ইশারায় সব বুঝিয়ে দিলেন।
অতি সতর্কতার সাথে প্রস্তুতি চলল। প্রচুর উৎসাহ-উদ্দীপনা থাকা সত্ত্বেও অনেককেই এই সময় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়তে দেখা গেল। তবে মঙ্গলময়ের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে সুবেদার হাফিজ খুবই সক্রিয় ছিলেন। তিনি উইং-এর পুরা রক্ষা ব্যুহ ঘুরে প্রতিটি মরিচায় যেয়ে প্রতিটি বাঙালির কাছে পৌছে দিলেন অপারেশনের নির্দেশ এবং বাইরে পেট্রল পার্টির সাথে যােগাযােগ রাখা হল । খােদাকে ধন্যবাদ কেউ সেই দিন না বলেনি, যদিও মনে মনে ঘাবড়ে গিয়েছিল অনেকেই। রাত ১০টা ১৮ মিনিটি। চারিদিকে অন্ধকার, থমথমে ভাব। সুবেদার হাফিজের হস্তগত ছােট্ট স্টেনগানটা হঠাৎ গর্জে ওঠল। মেজর আর ক্যাপ্টেন দেহরক্ষীদলের অধিনায়ক হাবিলদার মােহাম্মদ জামান বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে পরকালের যাত্রী হলেন তারই গার্ড রুমের বিছানায়। পর মুহূর্তে আরও অনেক ক্ষুধার্ত হাতিয়ার গর্জে উঠল একসঙ্গে। বেশ কজন পশ্চিমা পরপারের যাত্রী হল। আমাদের লােক জয় বাংলা’ ধ্বনি দিয়ে বিজয়বার্তা ঘােষণা করল। সারা রাত ধরে ফায়ার চলল, যদিও আমার মতে আদেশও দরকার ছিল না। ঐদিকে গােলাগুলির ফাঁকে এক সময়ে বর্ডার কোম্পানীগুলিকে নির্দেশ দেওয়া হল সব পশ্চিমা খতম করে সামান্যসংখ্যক লােক পেছনে রেখে অধিকাংশকে ঠাকুরগা পাঠিয়ে দিতে। রাতের অন্ধকারে তেতলা দালান, বাসাবাড়ি ইত্যাদি বিভিন্ন স্থানে। চতুর্দিক লােক ছড়িয়ে ছিল, তাই একেবারে পশ্চিমা নিধন পর্ব শেষ হল না। অধিকন্তু নানা সুযােগে, নানা জায়গায় কিছু সংখ্যক পশ্চিমা হাতে অস্ত্র তুলে নেয়। তাই আরও কিছুটা সময় লাগে আমাদের। এই এলােপাথাড়ি পাতলা ফায়ারের ভেতর দিয়া।
আমাদের বাঙালি পরিবারগুলিকে শহরে স্থানান্তরিত করে দিলাম। শহরবাসীরা প্রথমে গােলাগুলির শব্দে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়লেও অনতিবিলম্বে আমাদের বিজয় সংবাদ শ্রবণে হাজার হাজার মুক্তিপাগল মানুষ সমবেত কণ্ঠে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিসহ বিভিন্ন শ্লোগানে আকাশ-বাতাস মুখরিত করে তুলল এবং তারা বিভিন্ন প্রকারে আমাদের সাহায্য করতে লাগল। সেই দিন ভাের রাতে বাঙালি ক্যাপ্টেন নজীর আহমদ অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে ক্যাপ্টেন নাবিদ আলম ও তার স্ত্রীকে নিয়ে ছদ্মবেশে পলায়ন করতে থাকেন সম্ভবত সৈয়দপুর যাওয়ার উদ্দেশ্য। কিন্তু পহ্রজে সামান্য কিছু দূর যাওয়ার পর ক্ষীপ্ত জনসাধারণে হাতে ধরা পড়ে নিহত হন এবং ক্যাপ্টেন নাবিদ সস্ত্রীক আমাদের লােকজনের হাতে মারা পড়েন। ওদিকে সেদিন ভাের রাতেই ৮-উইং হতে আসা সুবেদার আতাউল হক শহীদ হন। এই বিপ্লবে তার ভূমিকা অতি প্রশংসনীয়। তারই যােগসূত্র ক্রমে সেই রাতেই হাজার হাজার লােক টাউনে বের হয়ে পড়ে এবং তারা আমাদের সহযােগিতা পেয়ে আবার শতগুণ উৎসাহে মেতে ওঠে এবং আমাদের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসে।  ২৯শে মার্চ সকালবেলা সামান্য গােলাগুলি লাগল। অবশিষ্ট খানরা দালানকোঠায় থেকে ফায়ার করাতে তাদেরকে কাবু করা গেল না। আমরা ছাত্র, জনসাধারণ ও স্থানীয় বিভিন্ন বিভাগের নিম্নপদস্থ কর্মচারী বিশেষ করে ওয়াপদা বিভাগের লোেকদের সহায়তায় ছাউনি হতে আমাদের প্রয়ােজনীয় সব হাতিয়ার গােলাগুলি ও অন্যান্য বহু জিনিসপত্র অন্যত্র সরিয়ে নিলাম।
২৯শে পার হয়ে ৩০শে মার্চের সকালে আমি নায়েক সুবেদার মতিউর রহমানকে এক প্লাটুন লােকসহ ঠাকুরগাঁ হেডকোয়ারকে শত্রুমুক্ত করার জন্য নির্দেশ দিলাম। তিনি সঙ্গে সঙ্গে তাঁর দলবল নিয়ে অগ্রসর হলেন কিন্তু অনকেক্ষণ চেষ্টার পর খানদের ব্যুহ ভেদ করতে না পেরে ফেরত চলে এলেন। তখন সুবেদার হাফিজ তার কোম্পানীর এক প্লাটুন লােক নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং বিকাল প্রায় তিনটা নাগাদ তেতলা দালানের শেষ দুশমনটি পর্যন্ত খতম করে তা পরিষ্কার করেন। তারই আদেশে প্লাটুন কমাণ্ডার বজল আহমদ চৌধুরী একদল লােক নিয়ে উইং অধিনায়কের বাসভবন মুক্ত করেন। মেজর হােসেন এই সময়ই নিজ বাসভবনে নিহত হন। একই সময় যুগপৎ আক্রমণ করে নায়েক সুবেদার মতিউর রহমান পাকআর্মির গেরিলা সুবেদার ও তার সঙ্গীদের খতম করে জেসিও মেস পরিষ্কার করেন। পাবলিকের সহায়তায় অল্প সময়ের মধ্যে সমস্ত মৃতদেহ অন্যত্র সরিয়ে দাফন করে ফেলা হয়। আর এদিকে দ্রুতগতিতে লাইনের ভেতরকার সবকিছু যথাসম্ভব সেরে নিয়ে হেডকোয়ার্টারের চতুর্দিকে দৃঢ় প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা করা হল। সুবেদার হাফিজের নেতৃত্বের তাঁর নিজস্ব ‘ডি’ কোম্পানী ব্যতীত আরও কিছু আনসারমুজাহিদ এই প্রতিরক্ষা ঘাঁটিতে মােতায়েন রইল।
ওদিকে স্থানীয় এমসিএ জনাব ফজলুল করিমের নেতৃত্বে ঠাকুরগাঁ শহরে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করা হল। আমাদের দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ স্বেচ্ছায়ই তারা গ্রহণ করলেন। তাদের কর্তব্য ছিল শহরের শান্তি, শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বজায় রাখা এবং প্রয়ােজনমতাে যুদ্ধরত লােকদের নানা কাজে সাহায্য করা। ছাত্র-জনতা আমাদের পাশে থেকে যে সাহায্য করেছে তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। স্থানীয় নারী সমাজ পর্যন্ত এই সংগ্রামে প্রচুর সাহায্য ও সমর্থন দিয়েছে। ঐ দিন (৩০শে মার্চ) সন্ধ্যা পর্যন্ত সীমান্তস্থ কোম্পানীসমূহের লােকজন ঠাকুরগায় এসে সমবেত হয়। আমাদের জোয়ানরা ও স্থানীয় জনসাধারণ আমাকে মেজর পদে বরিত করে যুদ্ধের পূর্ণ দায়িত্ব আমাকেই বহন করতে বললেন। বৃদ্ধ বয়সে ঘাের দুর্যোগের সময় এত বড় দায়িত্ব আমাকেই বহন করতে হল। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালার নাম স্মরণ করে জনসাধারণের শুভাশীষ নিয়ে আমি আমার ব্যাটালিয়ানকে পুনর্গঠন করে আগামী দিনের জন্য সকলকে তৈরি করতে লাগলাম এবং সামান্য ভাষণের মাধ্যমে আমরা সমবেতভাবে শপথ নিলাম।
এই দিন বিকালেই সুবেদার আবদুল খালেকের নেতৃত্বে আমাদের দুই কোম্পানী এবং এক কোম্পানী মুজাহিদকে সাধ্যানুযায়ী সুসজ্জিত করে ঠাকুরগার ২৩ মাইল আগে ভাতগাঁও পুল প্রতিরক্ষার্থে পাঠান হয়। নায়েক সুবেদার বদিউজামানের অধীনে আমাদের ‘সি’ কোম্পানীকে এক কোম্পানী মুজাহিদসহ দেবীগঞ্জে পাঠান হল। হাবিলদার নূর মােহাম্মদের অধীনে এক প্লাটুন ইপিআর এবং এক প্লাটুন মুজাহিদ শিবগঞ্জ বিমান বন্দর প্রতিরক্ষার জন্য পাঠান গেল। বাকী সদর কার্যালয়ের সঙ্গে এক কোম্পানী অতিরিক্ত হিসাবে রাখা হল। সে রাতেই আনসার মুজাহিদ ভাইয়েরাও অধিক মাত্রায় এসে একত্রিত হতে লাগল। সহকারী আনসার এ্যাডজুটেন্ট (মহকুমা) জনাব কবির তাদেরকে পুনর্গঠন করে আমার পাশে থেকে অনেক সাহায্য করতে লাগলেন। আমরা সীমান্ত এলাকাকে দুটি সাব সেক্টরে ভাগ করে সুবেদার আবুল হাশেম ও নায়েক সুবেদার হাজী মুরাদ আলীকে যথাক্রমে পঞ্চগড় সাবসেক্টর ও রুহিয়া সাবসেক্টরের দায়িত্ব ভার অর্পণ করি এবং নিমােক্ত বিষয়গুলি তাদের দায়িত্বের অন্তর্গত করে দিই ঃ (১) সীমান্ত রক্ষণাবেক্ষণ করা আঞ্চলিক আনসার মুজাহিদের সহযােগিতায়; (২) এলাকার জনসাধারণের এবং সরকারী বেসরকারী সম্পত্তির নিরাপত্তা বিধান করা; (৩) আনসার মুজাহিদদের পুনর্গঠন, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী এবং ছাত্রদের সামরিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা; (৪) বন্ধুরাষ্ট্রের সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা করা এবং প্রয়ােজনীয় বিষয়াদির ব্যবস্থা করা; (৫) বন্ধুরাষ্ট্রের যে কোন সাহায্যের জিনিসপত্র সমিতির মাধ্যমে সুষ্ঠুভাবে বণ্টনের তদারক করা; (৬) রণাঙ্গনের খবর কতিপয় নির্দিষ্ট লােককে জ্ঞাত করান। এমনিভাবে সবরকম আদেশ উপদেশ দিয়ে তাদেরকে নিজ নিজ জিম্মাদারী এলাকায় মােতায়েন করা হল।
ইতিমধ্যে হেডকোয়ার্টার এবং বর্ডারের বিভিন্ন স্থানে সংগঠিত বিপ্লব অপারেশনের বিস্তারিত খবর আমাদের নিকট পৌছল। হিসাবে দেখা গেল, এই অপারেশনে বর্ডারে আমাদের একজন মাত্র লােক আহত হয়েছে। সে হাবিলদার আব্দুল আজিজ। হেডকোয়ার্টারে চারজন ঘােরতর জখম ও দু’জন শহীদ। জখমী ঃ (১) হাবিলদার দীন মােহাম্মদ (২) সিপাহী ওলিউল্লাহ ভূঞা (৩) সিপাহী আবু তাহের (৪) একজন মুজাহিদ কমাণ্ডার এবং শহীদ ঃ (১) সুবেদার আতাউল হক (২) ল্যান্স নায়েক জয়নাল আবেদীন। এই সামান্য ক্ষতির বিনিময়ে আমরা এক মেজর ও এক ক্যাপ্টেনসহ প্রায় ১১৫ জন খান সেনাকে খতম করি—যাদের অধিকাংশই ছিল কমিশন্ড, জুনিয়র কমিশনড় ও নন। কমিশনড় অফিসার এবং বয়সে প্রবীণ, অভিজ্ঞতায় পরিপক্ক ও সামরিক প্রশিক্ষণে নিপুণ আর সর্বোপরি এই এলাকার রাস্তাঘাট ও অবস্থান এবং আমাদের বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে ছিল বিশেষ ওয়াকিফহাল। তাই সার্বিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এটি আমাদের পক্ষে ছিল এক বিরাট সাফল্য। পশ্চিমা হতাহতদের মধ্যে ছিল ইপিআর-এর-১০৪, আর্মির ৮ এবং বিমান বাহিনীর ৩ জন। | ৩০শে মার্চ হতেই সকল গ্রামে-গঞ্জে, স্কুল-কলেজে যুবকদের সামরিক শিক্ষা চলতে লাগিল। আমার ব্যাটালিয়ন ছাড়া একদিনের মধ্যেই এক ব্যাটালিয়ন আনসার ও এক ব্যাটালিয়ন মুজাহিদ পুনর্গঠিত হল। এক ব্রিগ্রেডের মতাে শক্তি নিয়ে (অবশ্য শুধু সংখ্যানুপাতিক) আমরা বিখ্যাত সৈয়দপুর শত্রু ছাউনি আক্রমণ করবার পরিকল্পনা গ্রহণ করলাম। এই দিকে দিনাজপুর হতেও সাহায্য পাবার আশ্বাস পেলাম। পরিকল্পনা অনুসারে ইপিআর আনসার ও মুজাহিদদের মিলিত বাহিনীকে প্রয়ােজনাভিত্তিক প্লাটুন ও কোম্পানী পর্যায়ে বিভিন্ন স্থানে মােতায়েন করা হল—বিশেষ করে সৈয়দপুর-ঠাকুরগাঁর মধ্যে যােগাযোেগকারী বিভিন্ন রাস্তার উপর অবস্থিত গরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহে। এইভাবে ক্রমে ক্রমে ডাইনে বীরগঞ্জ, শালবাগান, ভাতগাঁ এবং বায়ে খানসামা, দেবীগঞ্জ, জয়গঞ্জ, ঝারবাড়ি প্রভৃতি স্থানে অনেকগুলি রক্ষাব্যুহ তৈরি করে আরও অগ্রসর হবার প্রয়াস পেলাম। অবশ্য স্থানগুলি ছিল একে অন্য হতে বহু দূরে এবং যােগাযােগের দিক দিয়ে একেবারেই বিচ্ছিন্ন। না ছিল কোন বেতারযন্ত্র, না ছিল কোন টেলিফোন। লােক মারফতেই ছিল যােগাযোেগর একমাত্র মাধ্যমে। অধিকাংশ সময় এক পজিশন অন্য পজিশনের বদলী বা অবস্থান-প্রস্থানের কিছুই জানত না। অথচ আধুনিক সমরে এ রীতি সম্পূর্ণ অচ। খাদ্য এবং অন্যান্য সামরিক সরবরাহের ব্যাপারও ছিল সম্পূর্ণভাবে জনসাধারণের উপর নির্ভরশীল। কাজেই অনাহার-অর্ধাহার ছিল নিত্যসঙ্গী।
ইতিমধ্যে সৈয়দপুরে ৩নং বেঙ্গলরেজিমেন্টের লােকদের সঙ্গে যােগাযােগ করলাম। তবে মাত্র তাদের ‘সি’ কোম্পানীর লােকজন সেখানে ছিল। তাঁরাও ততক্ষণে খানদের দ্বারা একবার আক্রান্ত হয়ে বিধ্বস্ত অবস্থায় সেখান হতে বের হয়ে এসেছে। তাদের কোম্পানীর লােকজন পুরাে ছিল না এবং নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন ক্যাপ্টেন আশরাফ। যাই হােক, তাদের সহযােগিতায় সৈয়দপুরের দিকে অগ্রাভিযানের প্রস্তুতি চলতে লাগল। পেছনের দিকে পূর্বে কথিত হাবিলদার নূর মােহাম্মদের নেতৃত্বাধীন প্লাটুনদ্বয় ঠাকুরগা বিমানবন্দরের হেফাজত করতে লাগল এবং ম্যানেজার আতাউর রহমান ও স্থানীয় জনগণের সহায়তায় বিমানবন্দরকে নানা উপায়ে শত্রুর ব্যবহারের অনুপযুক্ত করে তােলা হল। ৩১শে মার্চ। বন্ধুরাষ্ট্রের ৭৫ নং বিএসএফ ব্যাটালিয়নের কমাণ্ডার কর্নেল ব্যানার্জী সাহেবের সঙ্গে যােগাযােগ করলাম। তিনি সব রকম সাহায্য দানের প্রতিশ্রুতি দিলেন। পহেলা রাতে কর্নেল ব্যানাজী সাহেবকে আমাদের অগ্রবর্তী ঘাঁটিগুলি পরিদর্শন করালাম তিনি আমাদের কাজের বিশেষ প্রশংসা করতেন। আমরা তাঁর উপদেশ মতাে নিজ বাহিনীকে সৈয়দপুরের আরও কাছাকাছি নিয়ে যাবার পরিকল্পনা নিলাম। ২রা এপ্রিল হঠাৎ পুরানাে কমাণ্ডিং অফিসার পাকআর্মির অবসরপ্রাপ্ত মেজর এম টি হুসেন আমার সাথে দেখা করে আলাপচারী হলেন। তাঁর প্রাথমিক আলাপের অবিকল উদ্ধৃতি নিম্নে দেয়া হল : ‘সুবেদার মেজর সাহেব, আপনি আপনার লােকজনসহ দেশের মুক্তি আন্দোলনে ঝাঁপ দিয়েছেন তা সত্যি অদ্ভুত। আপনার উদ্দেশ্য সকল হউক, কাজে সফলতা আসুক এই কামনা করি। আর আমি আজই ঢাকা হতে এসেছি। আপনি আমাকে আপনার সঙ্গে কাজ করার সুযােগ দেবেন কি।’ আমি আনন্দের সঙ্গে তাকে গ্রহণ করলাম ও আমাদের কমাণ্ডিং হিসাবে নিযুক্ত করলাম।
এক্ষণে আমরা আরও নতুন উদ্যম নিয়ে কাজ করতে লাগলাম। পরদিন ৩রা এপ্রিল আমরা দিনাজপুর গেলাম এবং সেখানকার সরকারী ও বেসরকারী নেতা ও কর্মচারীবৃন্দকে নিয়ে একটি সভা করে আগামী দিনের পরিকল্পনা নিয়া আলােচনা করলাম। পরিকল্পনা মাফিক ঐদিন ৩রা এপ্রিল ঠাকুরগাঁর রক্ষাব্যুহ উঠিয়ে ফেলা হয় আর সুবেদার হাফিজকে তাহার ‘ডি’ কোম্পানীসহ সবার আগে দশ মাইল তে-রাস্তার মােড়ের প্রায় দেড় মাইল পূর্বে দিনাজপুর-সৈয়দপুর প্রধান সড়কের উপর মােতায়েন করা হল। সেখানে গিয়ে তারা ক্যাপ্টেন আশরাফের ৩ বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘সি’ কোম্পানীর সাথে মিলিত হন। তারা মিলিতভাবে সৈয়দপুরগামী সড়ককে অক্ষরেখা ধরে ঘাঁটি নির্মাণ করে। আবার ঐ দিন দিনাজপুর ও ঠাকুরগাঁ ইপিআর, আর্মি, আনসার ও মুজাহিদ বাহিনী নিয়ে একটা যৌথ কমাণ্ড গঠিত হয়। আর ভাতগাঁও পুলের নিকট একটি জরুরি সভা ডেকে তাতে যৌথ কমাণ্ডের অধীনে সৈয়দপুর আক্রমণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হল।
৫ই এপ্রিল ৮ উইং দিনাজপুরের সুবেদার আবদুল মজিদের নেতৃত্বে এক কোম্পানী ইপিআর ৯ উইং-এর একটি ইপিআর প্ল্যাটুনসহ সৈয়দপুর-নীলফামারী সদর রাস্তায় সৈয়দপুরের অদূরে দারােয়ানির নিকট প্রতিরক্ষা ঘাঁটি নির্মাণ করে। উক্ত তারিখে ভূষির বন্দরে আমাদের সঙ্গে শত্রুদের সংঘর্ষ হয় এবং তারা পালিয়ে যায়। সেদিনই আমাদের বাহিনী এক নাগাড়ে প্রায় ১০ মাইল এগিয়ে চম্পাতলী নামক স্থানে গিয়ে পৌছে। তখন রাত ১১ টা। একে তাে অপরচিতি স্থান, তদুপরি গাঢ় অন্ধকার ও মূলষলধারে বৃষ্টি। যাই হােক, ভাের পর্যন্ত প্রতিরক্ষার অনেকটা ব্যবস্থা হয়ে গেল। কিন্তু ৬ই এপ্রিলে সূর্য উঠতে উঠতেই দুশমনরা গােলন্দাজ বাহিনীর সাহায্যে আমাদের উপর তীব্র আক্রমণ চালায়। তারপর এক পর্যায়ে তারা আমাদেরকে ঘটি হতে তাড়িয়ে দিতে এগিয়ে আসে। তাদের ইয়া আলী’ হুঙ্কারের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ইপিআর ও রেজিমেন্টের জোয়ানরা মিলিতভাবে পাল্টা ইয়া আলী’ বলে সিংহনাদে দুশমনের উপর ঝাপিয়ে পড়ে! বঙ্গ সার্কুলের থাবায় নয়জন খানসেনা প্রাণ হারায়, বাকী ক্ষত-বিক্ষত অবস্থায় প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যায়। খানিক পরে ক্যাপ্টেন আশরাফ পরামর্শ সভা ডাকলেন, জানা গেল তার কাছে গােলাবারুদ একেবারেই কম, কোনমতে সেদিনকার মতাে চলতে পারে। তিনি সেদিনই সন্ধ্যা পর্যন্ত পশ্চাদপসরণ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু ততক্ষণ আর অপেক্ষা করতে হল না। দুশমনের সৈয়দপুর ছাউনির দূরত্ব মাত্র মাইল তিনেক। ঘড়ির কাটা প্রায় আড়াইটার ঘরে। হঠাৎ করে শুরু হল শত্রুর গােলন্দাজ বাহিনীর অজস্র শেলিং, পিছনে এল কয়েকটি ট্যাঙ্ক, সঙ্গে ৮১ মিলিমিটার মর্টার । অনেকক্ষণ সংঘর্ষ চলল। উভয় পক্ষেই হতাহত হল এবং সন্ধ্যা প্রায় ৬টা নাগাদ আমাদের বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হল এবং ছত্রভঙ্গ হয়ে অনেক লােক দলত্যাগী হবার সুযােগ পেল। আমরা ভূষির বন্দর প্রতিরক্ষা ঘাঁটিতে পজিশন নিলাম। পরদিন সেখানে তুমুল যুদ্ধ হল। আমাদের নিকট ভারী এবং প্রতিরােধক অস্ত্র না থাকায় আবার পশ্চাতে আসতে বাধ্য হলাম।
১০ই এপ্রিল সকাল ৯ ঘটিকায় শক্ররা ট্যাঙ্ক ও গােলন্দাজ বহর নিয়ে আমাদের উপর ভীষণ আক্রমণ চালাল। প্রথম বার আমরা তাদের আক্রমণ প্রতিহত করলাম। দ্বিতীয় বার বেলা দু’টোর সময় আক্রমণ চালায়। শত্রুপক্ষের গােলার আঘাতে আমাদের দুটি ছয় পাউডার গান-ই নষ্ট হয়ে যায়। তুমুল যুদ্ধের পর এখানে আমাদের চারজন লােক শহীদ হয় এবং কিছু লােক আহত হয়। ফলে আমাদের লােক দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে দিনাজপুরের লােক দিনাজপুরের দিকে ঘাঁটি পরিবর্তন করে ও ঠাকুরগাঁয়ের লােক ভাতগাঁও পুলের নিকট দৃঢ় অবস্থান নেয়। দশ মাইল স্ট্যাণ্ডের যুদ্ধে আমাদের ভীষণ ক্ষতি হল, কেননা অনেক গােলাবারুদ আমরা এখানে এনে জমা করেছিলাম এবং আমাদের কাছে থাকা কয়েকশত রাইফেল বন্দুকও সেখানে রাখা ছিল। সকলেরই ধারণা ছিল আমাদের এই স্থান ছাড়তে হবে না কিন্তু ট্যাঙ্ক বহরের আক্রমণের চাপে ঐ স্থানও ছাড়তে হল। লােকের মনােবল যথেষ্ট ছিল। তবে ভারী অস্ত্র না থাকায় আবার সরে আসতে হল।
আমরা আবার ভাতগাঁয়ের পুলের নিকট শক্তিশালী ঘাঁটি স্থাপন করলাম। মেজর এম টি হােসেনসহ কর্নেল ব্যানার্জীর সাথে যােগাযােগ করলাম। তিনি আমাদেরকে কিছু বারুদ দিলেন কিন্তু পরিমাণে অতি অল্প বিধায় কোন কাজে এল না। আমি ব্যানার্জী সাহেবকে বলেছিলাম যে, ভাতগাঁয়ের পতন হলে আমাদের লােকজনের মনােবল নষ্ট হবে এবং ঠাকুরগাঁ শহরকে রক্ষা করা সম্ভব হবে না। তাই যে ভাবেই হােক ভাতগাঁওকে রক্ষা করতে হবে। আমরা দুজনে ভারী অস্ত্র সংগ্রহ করবার জন্য অনেক চেষ্টা নিলাম কিন্তু কিছুই হল না। বিহারের প্রধানমন্ত্রী কপূরী ঠাকুর আমাদেরকে যে কোন সাহায্য দিতে আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু তা পেতে অনেক দেরি হয়ে গেল। ১৩ই এপ্রিল ভাতগাঁয়ে সম্মুখ সমরে না এসে খান সেনার রাস্তা ধরে পিছন দিক হতে আক্রমণ করবার পরিকল্পনা নিল। শত্রুদের পরিকল্পনা আমরা অনেকটা বুঝতে পারলাম। খানসামায় তখন আমাদের কোন লােক ছিল না। তাই আমরা তাড়াহুড়া করে গােপনে সুবেদার হাফিজের নেতৃত্বে এক কোম্পানী সেখানে পাঠালাম। ১৩ তারিখ সন্ধ্যায় তার কোম্পানী যখন নদী পার হচ্ছিল তখন তারা সুযােগ বুঝে তাদের উপর অতর্কিতে আক্রমণ চালিয়ে তাদের ৮ বালুচ ডি কোম্পানীকে সম্পূর্ণরূপে পর্যুদস্ত করে দেয়। প্রচুর হতাহত করা ছাড়াও তারা দুমশনের নিকট হতে ১০ গাড়ি মালামাল হস্তগত করি যার মধ্যে অনেক গােলাবারুদ, ৭৫টি বিছানা, প্রচুর রেশন, পাকের সরঞ্জাম, একটি ওয়ারলেস সেট, একটি মােটর সাইকেল ও আরও বিবিধ দ্রব্যাদি ছিল। সুবেদার হাফিজের বলিষ্ঠ নেতৃত্বই ছিল এই কোম্পানীর সাফল্যের কারণ। শত্রুর এই আক্রমণ প্রতিহত করতে পাল্টা তাদের যে ক্ষতি সাধন করা হয়েছিল তাতে শত্রুর মনােবল যথেষ্ট ক্ষুন্ন হয়ে যায়, ফলে তিনদিন পর্যন্ত শক্রর তরফ হতে আর কোন সাড়াশব্দ ছিল না এবং পশ্চাৎ আক্রমণ হতেও আমাদের ঘাঁটি মুক্ত ছিল।
১৭ই এপ্রিল আমি বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের তিন সদস্যের একটি দলকে নিয়ে ভাের পাঁচটায় রওয়ানা হই সীমান্তের দিকে তাদেরকে গন্তব্যস্থানে পৌছে দিতে। মেজর এম টি হােসেন সাহেব থাকলেন রণাঙ্গনের দায়িত্ব নিয়ে। আমি প্রায় দুপুর তিনটায় রুহিয়া পৌছে ঠাকুরগাঁও কমাণ্ডো পােস্টের সঙ্গে টেলিফোনে যােগাযােগ করি। একমাত্র কমপাউণ্ডার মনসুরই ছিল আমাদের প্রধান অবলম্বন এবং তার সঙ্গে কয়েকজন নার্স ছিল। কম্পাউন্ডার মনসুর বিপদের সময় যে কাজ করেছেন, যেভাবে রােগিদের সেবাযত্ন নিয়াছেন তা সত্যিই প্রশংসনীয়।
পরের দিন ১৯শে পরে এপ্রিলের দুপুর। আমার সহকর্মী কমান্ডারদের নিয়ে নতুন পরিকল্পনা সম্বন্ধে আলােচনাৰ্থে সবেমাত্র ডাক বাংলায় বসেছি এমন সময় হঠাৎ কয়েকটি গােলার শব্দ শােনা গেল। আমরা আলােচনা স্থগিত রেগে বের হয়ে পড়লাম। অবস্থা আঁচ করতে না করতেই আরও কয়েকটা শেল আমাদের ডাইনে-বায়ে পেছনে এসে পড়ল। বুঝতে বাকি রইল না দুশমনের প্রত্যক্ষ আক্রমণ অত্যাসন্ন। কমান্ডাররা যে যার স্থানে চলে গেলেন। ইতিমধ্যে দুশমনের একটি গােলা আমাদের একটি গাড়ির উপর আঘাত করল এবং তাতে আগুন ধরে গেল। গাড়িটিতে খানসামায় দুশমনদের নিকট হতে আটককৃত গােলাবারুদ রক্ষিত ছিল, পাশেই আমার জীপগাড়িটিও ছিল, কোনমতে তা সরিয়ে নিতে সক্ষম হলাম। আমরা শত্রুর আক্রমণের জবাব দিতে লাগলাম। চার পাঁচ ঘন্টা ধরে সংঘর্ষ চলল, সুবেদার আবুল হাশেমসহ কয়েকজন আহত হন। এদেরকে পরে হাসপাতালে পাঠান হয়। অবশেষে ট্যাঙ্কসহ শত্রুবাহিনী আমাদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে এবং আমরা পশ্চদপসরণ করতে বাধ্য হই। এইবার আরও হাতিয়ার গেল, গােলাবারুদ গেল, বাহিনীর বহুলােক পালিয়ে গেল। নায়েক সুবেদার খালেক ও সুবেদার হাফেজ সাহসে ভর করে ঐদিন সন্ধ্যায়ই কিছু লােকজনসহ ভজনপুর গিয়ে পৌছলেন। এপ্রিলের ২০ তারিখের ভাের হতে না হতেই তারা ভজনপুরে ঘাঁটি নির্মাণের কাজ শুরু করে দিলেন। আমি তাদেরকে যথারীতি উপদেশ দিয়ে নানা জরুরি কাজে ও বিচ্ছিন্ন লােকদেরকে জড় করার উদ্দেশ্যে পিছনে গেলাম। এদিকে দুশমনরাও অতি তাড়াতড়ি জগদল এবং ওমরখানায় তাদের শক্ত ঘাঁটি গড়ে। ওমরখানা পর্যন্তই শত্রুদের শেষ ঘাঁটি ছিল। দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত এই অবস্থা বিদ্যমান ছিল।
তারপর ঐ মাসের অর্থাৎ এপ্রিল মাসের এক শুভক্ষণে জানতে পারলাম যে, স্বাধীন বাংলার সরকার গঠিত হয়েছে। এমতাবস্থায় মে মাসের ৮ তারিখ আমাদের মুক্তিবাহিনী প্রধান তদানীন্তন কর্নেল এম এ জি ওসমানী আমদেরকে ভারতের কদমতলায় ডেকে পাঠান। সেখানে এক জরুরি সভা হল। তাতে যােগ দিলেন ক্যাপ্টেন নজরুল হক, ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ এবং কয়েকজন ভারতীয় অফিসার। মুক্তিবাহিনী প্রধান বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ হতে যুদ্ধের পরিকল্পনা ব্যাখ্যা করলেন। এরপর তিনি তার পরিকল্পনা অনুসারে আমাদেরকে নির্দেশ দান করলেন। আমরাও আমাদের অভাব অভিযােগ জ্ঞাপন করলাম, তিনি যথাসাধ্য পূরণ করবার আশ্বাস দিলেন। উক্ত সভায় তিনি ক্যাপ্টেন নজরুল হক সাহেবকে আমার ব্যাটালিয়নের দায়িত্ব ভার অর্পণ করলেন। তারপর ঐদিনই সন্ধ্যায় তিনি আমাদের ভজনপুর ঘাটিতে আগমন করলেন। তার দর্শন লাভে উৎসাহ ও উদ্দীপনায় আমরা আরাে সতেজ হলাম, তার উপদেশের মাধ্যমে পথের দিশা পেলাম।
অধিকন্তু তিনি ক্যাপ্টেন নজরুল সাহেবকে আমাদের অধিনায়ক রূপে নিয়ােগ করায় আমরা আরাে উৎসাহিত হলাম। এর কিছুদিন পর প্রধান সেনাপতি আবার ভজনপুর এলেন, সঙ্গে বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ। এতে জোয়ানরা খুব খুশি হল, তাদের মনােবল দৃঢ়তর হল । ততক্ষণে ভারত হতে অপ্রচুর হলেও বিভিন্ন রকম সাহায্য আসতে আরম্ভ করেছে। অতএব মুক্তি সংগ্রামীদের মনােবল ঊর্ধমুখী হয়া উঠল। ৯ই মে ক্যাপ্টেন নজরুল আমার ব্যাটালিয়নের দায়িত্বভার গ্রহণ করলেন এবং আমি তার সহকারী হিসাবে কাজ করতে লাগলাম। এ সময় দুশমনরা ওমরখানার জগদল এলাকায় দৃঢ় প্রতিরক্ষা ঘাঁটি নির্মাণ করে ফেলেছে। তাই আারা আমাদের মূল ঘাঁটি ভজনপুরের ৩/৪ মাইল আগে মামারী ও ময়নাগুড়ি নামক স্থানে দুটি পােস্ট খুলে দুটি
ক্ষুদ্র সৈন্যদল পাঠানর ব্যবস্থা করলাম। ২৬শে এপ্রিল হাবিলদার দেওয়ানের নেতৃত্বে ১০ জনের একটি ছােট দল প্রথম ওমরখানার কাছে মাগুরমারীতে পাঠান হয়েছিল। তারা দুশমনের গতিবিধি নিরীক্ষণ করত এবং পিছনে আমাদেরকে খবর দিত। ৩০শে এপ্রিল শত্রুদের হঠাৎ আক্রমণে এই ছােট্ট দলের ২ জন শহীদ এবং অন্য ২ জন গুরতরভাবে আহত হয়ে হাসপাতালে নিহত হয়। যাই হােক, মাগুরমারীতে ক্রমান্বয়ে লােকসংখ্যা বাড়িয়ে শেষ পর্যন্ত দেড় কোম্পানীর মতাে করা হয়। এর এক কোম্পানী নতুন ‘সি’ কোম্পানী নাম নিয়ে নায়েক সুবেদার হাজী মুরাদ আলীর নেতৃত্বে দুশমনদের ওমরখানা ঘাঁটির সন্নিকটে প্রতিরক্ষা ঘাঁটি নির্মাণ করে। ২রা মে হতে জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহ নাগাদ তাহারা সেখানে অবস্থান করে এবং দুশমনদের শতাধিক সৈন্য ও চার পাঁচখানা গাড়ি ধ্বংস করাসহ অশেষ ক্ষতি সাধন করে তাদেরকে নির্বাক নির্জীব করে রাখে। আমার হিসাব মতে সিপাহী আবুল হােসেন একাই সত্তর জনের মতাে শত্রুসেনা খতম করেছে।  তবে এই দলকে বহু কষ্টের মধ্যে দীর্ঘ দুই মাস কাটাতে হয়েছে, কেননা উন্মুক্ত আর নিচু জায়গায় পজিশন থাকা বিধায় দিনের বেলা এরা সামান্য নড়াচড়া পর্যন্ত করতে পারত—শুধু রাতেই এদের খাওয়ার সুযােগ ঘটত। আমি মাঝে মাঝে এই কোম্পানীর সাথে সাক্ষাৎ করতে যেতাম। কোন কোন সময় আমি দেখছি বৃষ্টির মতাে গােলাগুলির মধ্যেও হাজী মুরাদ আলী তার লােকজনের তদারকি করে ফিরছেন। আমার মতে হাজী মুরাদ আলীর বলিষ্ঠ নেতৃত্বেই এই ক্ষুদ্র দলটি নির্ভীক সৈনিকের ভূমিকা পালন করতে অনুপ্রাণিত হয়েছিল। সূত্র : বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধঃ দলিলপত্র, অষ্টম খন্ড, সুবেদার মেজর কাজিম উদ্দিন-এর সাক্ষাৎকার।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত

 
error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!