বরিশাল রণাঙ্গণে
পাকসৈন্যরা এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি মাদারীপুর শহর দখল করে নিয়েছিল। এপ্রিল মাসের শেষের দিকে ওরা মিলেটারী ভ্যান নিয়ে বরিশাল জেলার সীমানায় এসে প্রবেশ করল। খবর পেয়ে তাদের প্রতিরােধ করার জন্য মুক্তিবাহিনী গৌরনদী থেকে মার্চ করে এগিয়ে চলল। এদের মধ্যে যুদ্ধ-বিদ্যায় অভিজ্ঞ কেউ ছিল না—সকলেই কাঁচা, সকলেই অনভিজ্ঞ। মাস খানেকের রাইফেল ট্রেনিং আর নির্ভীক দেশপ্রেম, এইটুকুকেই সম্বল করে তারা এই দুর্ধর্ষ শত্রুদের মােকাবিলা করতে চলেছে। বরিশাল আর ফরিদপুর জেলার সীমান্তরেখায় ভুরপাটা গ্রাম। পাকসৈন্যবাহিনী বেলা এগারােটার সময় এই ভুরপাটার সেতু পেরিয়ে ইল্লা গ্রামের দিকে চলে এসেছে। দু’পাশের গ্রামবাসীদের মনেও আতঙ্কের সঞ্চার করে ভ্যানগুলি গর্জন করে ছুটে আসছে। রাইফেল, মেশিনগান, মর্টার সবকিছুই আছে তাদের সঙ্গে। কুড়ি-পঁচিশটা রাইফেল আর বন্দুক নিয়ে যুদ্ধ-বিদ্যায় অশিক্ষিত একদল তরুণ তাদের প্রতিরােধ করতে চলেছে। মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দুটি তরুণ এই সীমান্ত এলাকার গ্রামে গ্রামে ঘুরে সংগঠনের কাজ করে চলেছিলেন। দু’জনেই কলেজের অধ্যাপক। মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য অধ্যাপনার কাজ ছেড়ে দিয়ে তারা মুক্তিযুদ্ধের পথে এগিয়ে এসেছেন। আজ সকল কর্তব্যের বড় কর্তব্য মুক্তিযুদ্ধে সামিল হওয়া। শত্রুসৈন্যরা যে বরিশাল জেলার মাটির * প্রতিরােধ সংগ্রামে বাংলাদেশ’ গ্রন্থ থেকে সংকলিত।
উপর এসে গেছে, এ খবরটা তখনও তারা জানতে পারেননি। আক্রমণ আসন্ন, ভুরপাটা গ্রামের সেতুটাকে এখনই ভেঙ্গে ফেলা দরকার। সেতুটাকে ভাল করে পরীক্ষা করে দেখবার জন্য তারা দু’জন রিকশাযােগে ভুরপাটা গ্রামের দিকে চলেছিলেন। ইল্লা গ্রামে এসে পৌছতেই মিলিটারী ভ্যানের গর্জন শুনে চমকে উঠলেন তাঁরা। সরে পড়ার সময় ছিল না, কয়েক মুহূর্তের মধ্যে দ্রুতবেগে ছুটে আসা ভ্যানগুলি তাদের দৃষ্টিগােচরে এসে গেল। আর ঠিক সেই সময় একটা বুলেট তাঁদের দুজনের মাঝখান দিয়ে রিকশার গা ভেদ করে বেরিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে দু’জন রিকশা থেকে পথের দু’পাশে ছিটকে পড়লেন। বরিশাল জেলার বুকে শত্রুপক্ষের এই প্রথম গুলিবর্ষণ।। তারা দু’জন হামাগুড়ি দিয়ে উঁচু সড়ক থেকে নিচে নেমে এলেন। তাদের ভাগ্য ভাল, তারা শত্রুদের নজরে পড়ে যাননি। তারা গুণে গুণে দেখলেন। ১০টা ভ্যান, তার পেছনে একটা এ্যাম্বুলেন্স গাড়ি। ভ্যানগুলি সম্ভবত গৌরনদীকে লক্ষ্য করে ছুটে চলে গেল। এঁরা দু’জন গ্রামের পথ ধরে পেছন পেছন ছুটলেন। বার্থী গ্রামের সামনে গিয়ে ভ্যানগুলি দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর একদল সৈন্য ভ্যান থেকে নেমে গ্রামের ভেতর ঘুরে ঘুরে এলােপাথাড়ি গুলি ছুঁড়ে চলল। যাকে সামনে পেল তাকেই মারল। তখন কালীপূজার সময়। ওরা পূজাবাড়িতে গিয়ে পূজায় রত দু’জন পুরােহিতকে হত্যা করল। এই পবিত্র কর্তব্য সুসম্পন্ন করে ভ্যানগুলি আবার তাদের গন্তব্যস্থলের দিকে যাত্রা করল।
বার্থ থেকে মাইল দুই দূরে কটকস্থল নামে একটি গ্রাম। মুক্তিবাহিনীর যে যােদ্ধারা শত্রুসৈন্যদের প্রতিরােধ করবার জন্য গৌরনদী থেকে যাত্রা করেছিল, তারা সেই সময় এই কটকস্থল গ্রামে পথের ধারে বসে বিশ্রাম করছিলে। ভ্যানগুলি এগিয়ে আসতেই প্রতিদ্বন্দ্বী দু’পক্ষ পরস্পরকে দেখতে পেল। পাকসৈন্যরা তাদের লক্ষ্য করে প্রথমেই গুলি ছুঁড়ল। প্রতিপক্ষ যে কোন সময় তাদের উপর এসে চড়াও হতে পারে, এমন একটা অবস্থার জন্য মুক্তিবাহিনীর যােদ্ধারা প্রস্তুত ছিল না। সেজন্য তাদের মূল্যও দিতে হয়েছিল। কিন্তু একটু বাদেই তারা তাদের পজিশন নিয়ে নিল। তারপর পরস্পর অজস্র ধারায় গুলি বিনিময় চলল। প্রায় আধ ঘন্টা ধরে এই যুদ্ধ চলেছিল। কিন্তু পাকসৈন্যরা যখন ভারী মেশিনগান ব্যবহার করতে শুরু করল, তখন রাইফেল সর্বস্ব মুক্তিযােদ্ধারা তাদের সামনে আর বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। দাঁড়িয়ে থাকাটা সমীচীনও ছিল না। তারা পাঁচজন মুক্তিযােদ্ধার মৃতদেহ পেছনে ফেলে রেখে গ্রামের অন্তরালে অদৃশ্য হয়ে গেল। কটকস্থল গ্রামের যুদ্ধের দিন কয়েক পরে গৌরনদী পাকসৈন্যদের দখলে এসে গেছে। এখানকার ঘাঁটি সুদৃঢ় করে নিয়ে এবার তারা বরিশাল শহর দখলের অভিযানের জন্য তৈরি হচ্ছে। অপর দিকে বরিশাল শহরে মুক্তিবাহিনীও চুপ করে বসে নেই। হামলাকারী শত্রুদের প্রতিরােধ করবার জন্য তারা তাদের পরিকল্পনা অনুসারে কাজ করে চলছিল। | বরিশাল শহরের মুক্তিবাহিনী গৌরনদীর মুক্তিবাহিনীর তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী। শুধু মুক্তিযােদ্ধাদের সংখ্যা ও অস্ত্রবলের দিক দিয়েই নয়, তাদের মধ্যে যুদ্ধবিদ্যায় শিক্ষিত এবং অভিজ্ঞ লােকও ছিল। ছাত্র ছাড়াও বেঙ্গলরেজিমেন্ট ও ইপি. আর. বাহিনীর জওয়ান, পুলিশ, আনসার ইত্যাদি নিয়ে এই বাহিনী গড়ে উঠেছিল।
মুক্তিবাহিনীর নেতারা প্রতিরােধ-প্রস্তুতির শেষ পর্যায়ে এসে এক নতুন রণকৌশল উদ্ভাবন করেছিলেন। এই কৃতিত্বের জন্য অবশ্যই তাদের প্রশংসা করতে হবে। সি এণ্ড বি রােড বরিশাল শহরকে ফরিদপুর জেলার সঙ্গে যুক্ত করেছে। শত্রুরা এই পথ দিয়েই বরিশাল শহর আক্রমণ করতে আসবে। তাদের গতিপথকে রুদ্ধ করে দেবার জন্য এবং তাদের অচল করে ফেলবার জন্য ইতিপূর্বে এই সড়কের বিভিন্ন স্থানে নানাভাবে ব্যারিকেড সৃষ্টি করা হয়েছিল। মুক্তিবাহিনীর নির্দেশে সেই সমস্ত গ্রামের লােকেরা উদ্যোগী হয়ে সেই কাজে হাত দিয়েছিল। কিন্তু মুক্তিবাহিনী শেষ মুহূর্তে হঠাৎ তাদের এই পরিকল্পনা বাতিল করে দিয়ে এক নতুন রণকৌশল নিয়ে শত্রুপক্ষের জন্য এক মায়ার ফাঁদ পেতে বসল। দেখতে দেখতে সমস্ত ব্যারিকেডগুলিকে সরিয়ে নিয়ে এই রাস্তাকে যানবাহন চলবার পক্ষে সুগম করে দেওয়া হােল। শত্রুরা যাতে বিনা বাধায় এবং নিশ্চিন্ত মনে এগিয়ে আসতে পারে, সেজন্যই এই ব্যবস্থা করা হয়েছিল। বরিশাল শহরে আসতে হলে পর পর দুটো নদী পেরিয়ে আসতে হয়। প্রথমটা শিকারপুরের নদী, দ্বিতীয়টা দোহারিকা নদী। এই দু’য়ের মাঝখানে দশ মাইর স্থলপথ। এইখানে মায়ার ফাঁদ পেতে রাখা হয়েছে। পথে কোথাও কোন বাধা পাওয়া যাবে না, কোন ব্যারিকেড সরিয়ে আসতে হবে না, কোন ভেঙ্গে ফেলা পুল সারাই করে নিতে হবে এমন কথা পাকসৈন্যরা ভাবতেও পারেনি। এমন সহজ সুগম পথ পেয়ে তারা মহা খুশি। তাদের সৈন্যবাহী গাড়িগুলি স্বচ্ছন্দে শিকারপুরের নদীর পাড় পর্যন্ত চলে এল।
ফেরী বােটে করে এই নদী পাড়ি দিয়ে ওপারে যেতে হবে। ওরা উল্লসিত হয়ে দেখল ফেরীবােটের মাথায় পাকিস্তানের পতাকা উড়ছে। ফেরীবােটের লােকেরা ওদের আসতে দেখে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বলে জয়ধ্বনি তুলল। তখনকার মতাে দুর্দিনে এমন সাদর সংবর্ধনা পাবে, এটা ওরা কল্পনাও করতে পারেনি। আনন্দে ডগমগ হয়ে ওরা ফেরীবােটের সাহায্যে নদী পার হতে লাগল। মুহূর্তের জন্য তাদের মনে এই সন্দেহ জাগেনি যে, এই ফেরী বােট যারা চালিয়ে যাচ্ছে, তারা সবাই মুক্তিবাহিনীর লােক; মুহূর্তের জন্যও তারা ভাবতে পারেনি যে তারা ইতিমধ্যেই প্রতিপক্ষের রচিত মায়ার ফাঁদে পা দিয়ে বসেছে। এমনি করে ক্রমে ক্রমে নব্বই জন সৈন্য আর চালকসহ গাড়ি পাড়ি দিয়ে ওপারে গিয়ে উঠল। এখানেও কোন বাঁধা নেই, ওরা স্বচ্ছন্দে এগিয়ে চলল। একটু দূরে গিয়েই ওরা থামল। তাদের গােয়েন্দারা চারদিকটা ভাল করে পরীক্ষা করে দেখে নিল—না, কোথাও কোন বিপদের আশঙ্কা নেই। সবাই গ্রামে ঢুকে পড়ল, নিঃশঙ্কচিত্তে গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল। পেছনে পড়ে রইল ন’খানা মিলিটারী ভ্যান ও তাদের চালকরা। সৈন্যদের মধ্যে কেউ কেউ গৃহস্থদের দিয়ে ডাব-নারিকেল, কলা এবং নানারকম খাদ্য আনাতে লাগল, তারপর সেইখানেই তাই দিয়ে ভােজের উৎসবে মেতে গেল। কেউ কেউ গৃহস্থদের ভয় দেখিয়ে হাস-মুরগী, খাসি ইত্যাদি এনে জড়াে করতে লাগল। আবার আর একদল গৃহস্থ-বধুদের কাছে সােনা-দানা, গয়না যা পেল সবকিছু লুটে-পুটে আনতে লাগল।
এই শান্ত, ঠান্ডা আর ভেড়ার মতাে নিরীহ মানুষগুলি এর প্রতিবাদে একটি কথাও বলল না। ওরা তখনকার মতাে যুদ্ধবিগ্রহের কথা ভুলে গিয়ে ভােজের উৎসবে মেতে গেছে, সৈনিকের শৃঙ্খলাবােধ হারিয়ে ফেলেছে। খেয়ে-দেয়ে পরিতৃপ্ত হয়ে আরামে এলিয়ে দিয়েছে দেহ। এমন সময় হঠাৎ একই সঙ্গে বহু রাইফেলের আওয়াজ শান্ত প্রকৃতির নিস্তব্ধতাকে ভেঙ্গে চুরমার করে দিল। সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠল সৈন্যরা। তাদের উপর বৃষ্টিধারার মতাে গুলিবর্ষণ চলছে। শুধু রাইফেলের আওয়াজ নয়, তারই সাথে সাথে শত শত দৃপ্তকণ্ঠের ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি আকাশ বাতাস মুখরিত করে চলেছে। অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত হতে হতে ওদের অনেক সময় কেটে গেল। অস্ত্র চালাতে গিয়েও প্রতিপক্ষের দেখা গ্রামাঞ্চলে আসার পর থেকে পাকসৈন্যরা এ পর্যন্ত কোন দিক থেকেই কোন বাধা পায়নি। গ্রামে ঢুকেই ওরা প্রথমে সিদ্ধেশ্বর সরকারের বাড়িতে গিয়ে হামলা করল। সিদ্ধেশ্বর সরকার বাড়ি ছিলেন না, তিনি তখন এদের উপযুক্ত অভ্যর্থনার জন্য উদ্যোগ আয়ােজনে অন্যত্র ব্যস্ত। সরকার বাড়িতে যা কিছু মূল্যবান জিনিস পেল তা লুটপাট করে নিয়ে ওরা খালের ওপারে নবগ্রাম গ্রামের বিশ্বাস বাড়িতে লুটপাট করতে গেল। বিশ্বাস বাড়ির চিলেকোঠাটা ছিল এখানকার ছাত্রদের বিস্ফোরক দ্রব্য তৈরি করবার ল্যাবরেটরী। দুটি ছেলে সেখানে বসে তাদের সংগৃহীত যৎসামান্য রাসায়নিক মাল-মশলা দিয়ে হাতবােমা তৈরি করত। তাদের মধ্যে একজন ছিল পাশ করা ডাক্তার। সৈন্যরা বিশ্বাস বাড়ি আক্রমণ করতে আসছে এ-সংবাদ পেয়ে তারা তাদের তৈরি কতকগুলি হাতবােমা নিয়ে বিশ্বাস বাড়ির কাছে একটা ঘন গাছপালায় ঢাকা ঝােপের আড়ালে গিয়ে দাঁড়াল। সৈন্যরা তাদের নাগালের মধ্যে আসতেই তারা তাদের লক্ষ্য করে পর পর কয়েকটা হাতবােমা ছুঁড়ল। বিস্ফোরণের শব্দে গ্রামের শান্ত আবহাওয়া কেঁপে উঠল। ভয়ে কেঁপে উঠল পাকিস্তানী সৈন্যরা।
ওরা প্রাণের ভয়ে উধ্বশ্বাসে ছুটল। কিন্তু ইতিমধ্যে উত্তর, পশ্চিম ও দক্ষিণ দিক থেকে পূর্ব নবগ্রামে মুক্তিযােদ্ধারা আকাশ-ফাটানাে গর্জনধ্বনি করতে করতে ছুটে আসছে। | এইভাবে আক্রান্ত আক্রমণকারী সৈন্যরা অবিরল ধারায় গুলিবর্ষণ রতে করতে পেছনে হটে যেতে লাগল। যে-কোন ভাবেই হােক, ওদের মেদাকুরের ঘাঁটিতে ফিরে যেতে হবে। কিন্তু মুক্তিযােদ্ধারা ওদের গুলিবর্ষণকে অগ্রাহ্য করে ক্রমেই কাছে, আরও কাছে এগিয়ে আসছে। অর্ধচন্দ্রাকারে ঘেরাও করে এসেছে। সৈন্যরা কোন দিকে লক্ষ্য রাখবে ঠিক করে উঠতে পারছে না। তাছাড়া তাদের ঘন ঘন জয় বাংলা’ ধ্বনিতে ওরা মাথা ঠিক রাখতে পারছিল না। ইতিমধ্যে মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে কয়েকজন দুঃসাহসী মৃত্যুভয়কে তুচ্ছ করে একেবারে সামনে এসে পড়েছে। তাদের মধ্যে একজন মাত্র হাত দশেক দূর থেকে একজন সৈন্যকে তাক করে তার হাতের সড়কি ছুঁড়ল। অব্যর্থ লক্ষ্য। সঙ্গে সঙ্গে দানবের মতাে বিরাট দেহ সেই পাঞ্জাবী সৈন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল।
যে দুঃসাহসী যুবক সড়কিটা ছুঁড়েছিল, তার নাম অমূল্য মল্লিক। ইতিমধ্যে আর একজন সৈন্য এগিয়ে এসে অমূল্যকে লক্ষ্য করে তার হাতের রাইফেলটা তুলেছে। অমূল্যকে রক্ষা করার জন্য মধ্যবয়সী দেবেন সরকার দু’লাফে সামনে এগিয়ে এল। এসেই পেছন থেকে জাপটে ধরল সেই সৈন্যটিকে, কিন্তু ততক্ষণে সেই রাইফেলের গুলি তার লক্ষ্যস্থলে গিয়ে পৌছেছে। গুলিবিদ্ধ অমূল্য মল্লিক চিরতরে চোখ বুজল, তার মাতৃভূমির বুকে শিশুর মতাে ঘুমিয়ে পড়ল। ইতিমধ্যে প্রফুল্ল সরকার সেই সৈন্যর হাত থেকে সেই মৃত্যুবর্ষী রাইফেলটাকে ছিনিয়ে নিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গেই লেজার ঘায়ে সেই সৈন্যটির ভবলীলা সাঙ্গ হল। | চারজন সৈন্যের মধ্যে বাকি রইল দু’জন। ওরা পেছন দিকে ছুটতে ছুটতে সামনে একটা খালের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল। খালের পাড়টা খাড়া, তার মধ্যে নেমে পড়া সহজ কিন্তু সেখান থেকে ওঠাটা সহজ নয়। তাছাড়া একগলা জলে দাঁড়িয়ে ওরা ওদের রাইফেল চালাতে পারছিল না। এই মরণের ফাদ থেকে ওরা উঠতে পারল না, মুক্তিযােদ্ধাদের সড়কির ঘায়ে সেইখানেই তাদের সলিল সমাধি ঘটল।
বরিশাল আর ফরিদপুর জেলার যে কর্মীরা সম্মিলিতভাবে মুক্তিবাহিনী গড়ে তুলবার চেষ্টা করেছিল, পূর্ব নবগ্রামের এই প্রতিরােধ সংগ্রামের সঙ্গে তাদের প্রথম থেকেই যােগাযােগ ছিল। পাকসৈন্যদের নিধনপর্বের মধ্য দিয়ে তাদের উৎসাহ আরও বেড়ে গেল। ইতিমধ্যেই পূর্বোক্ত তিনটি থানার কর্মীদের নিয়ে মুক্তিফ্রন্ট সংগঠন গড়ে তােলা হয়েছে। এই তিনটি থানা থেকে পঞ্চাশ জনের মতাে তরুণ মুক্তিযােদ্ধা হিসেবে নাম লিখিয়েছে। এদের মধ্যে মুসলমান, হিন্দু, খৃস্টান সকল সম্প্রদায়ের লােক আছে। ছাত্রও আছে, কৃষকরাও আছে। আরও অনেক লােক দলে আসবার জন্য উন্মুখ।
কিন্তু এ বড় কঠিন জিনিস, অনেক দেখে শুনে, অনেক ভেবে-চিন্তে লােক বাছাই করতে হয়। ফ্রন্টও গঠিত হয়েছে, মুক্তিযােদ্ধারাও সামনে এগিয়ে এসেছে, কিন্তু না আছে অস্ত্র, না আছে ট্রেনিং। পূর্ব নবগ্রামে যা-ই হােক না কেন, ওদের বিরুদ্ধে সত্য সত্যই তাে আর সড়কি আর লেজা নিয়ে লড়াই করা চলবে না। চাই রাইফেল, নিদেনপক্ষে বন্দুক। যে করেই হােক তা সংগ্রহ করতেই হবে। মুক্তিফ্রন্টের সেক্রেটারী জনৈক তরুণ অধ্যাপক। এক বিরাট দায়িত্ব তার মাথার উপর এসে পড়েছে।
| চারজন পাকসৈন্য এভাবে খতম করতে পারার ফলে পূর্ব নবগ্রাম ও নিকটবর্তী গ্রামগুলিতে উৎসাহ ও আনন্দের ঢেউ বয়ে যায়। কিন্তু তা একটুকু সময়ের জন্যই; পরমুহূর্তেই সকলের মনে পড়ল যে সামরিক কর্তৃপক্ষ ব্যাপারটাকে কিছুতেই এত সহজে হজম করে নেবে না। মাত্র দেড় মাইল দূরে ওদের ঘাটি, ওরা এক্ষুণি সদলবলে এসে হানা দেবে এবং কঠিন হাতে এর প্রতিশােধ নেবে। ওদের প্রতিহিংসার আগুনে পূর্ব নবগ্রাম আর নবগ্রাম এই দুটি গ্রাম পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। এরপর এখানে একটি জনপ্রাণীকেও ওরা বেঁচে থাকতে দেবে না। এ অবস্থায় প্রাণে বাঁচতে হলে এক্ষুণি, এই মুহূর্তে কোন নিরাপদ জায়গায় চলে যেতে হবে। একটা জায়গা আছে বটে, সেটা হচ্ছে এখানকার বিল-অঞ্চল। সেই বিস্তীর্ণ জলরাশির মধ্যে ডাঙা থেকে বহুদূরে বিক্ষিপ্তভাবেই ছড়িয়ে আছে বিল এলাকার ছােট ছােট গ্রামগুলি। সেখানে গিয়ে আশ্রয় নিলে ঝড়ের এই প্রথম ঝাপটাটা হয়ত সামলে নেওয়া যাবে। পাকিস্তানী সৈন্যরা টের পেলেও ওখানে যেতে সাহস করবে । বেশি চিন্তা করবার সময় নেই, যা করবার এই মুহূর্তেই করতে হবে। দেখতে দেখতে সমস্ত এলাকা জনমানবশূন্য হয়ে গেল।
ওরা যা ভেবেছিল তাই ঘটল, খবর পাবার সঙ্গে সঙ্গেই হিংস্র পাকসৈন্যরা শস্যের ক্ষেতে পঙ্গপালের মতাে এসে ছেয়ে ফেলল, গ্রামের পর গ্রামে হানা দিয়ে চলল। পাশাপাশি ক’টা গ্রাম ওরা একেবারে উচ্ছন্ন করে দিল। এত বড় ঘা খেয়েও মুক্তিফ্রন্টের লােকদের মনােবল কিন্তু ভাঙ্গেনি। একটা জিনিসের দিকে তাদের বিশেষ লক্ষ্য ছিল, যে চারজন পাকিস্তানী সৈন্য এখানে নিহত হয়েছে তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে রাইফেলু ছিল। সেই চারটা রাইফেলের মধ্যে একটা ছিল চীনা স্বয়ংক্রিয় রাইফেল। এই অস্ত্রটি দুর্লভ। এই অস্ত্রটিকে হাত করতে পারলে শুধু সেটা দিয়েই বহু কাজ হাসিল করতে পারা যাবে। আপাতত তাদের হাতে রাইফেল বা বন্দুক জাতীয় একটিও অস্ত্র নেই। ওই চারটি রাইফেল এই গ্রামেই আছে, ওইগুলিকে খুঁজে বের করে হস্তগত করতে পারলে মুক্তিবাহিনীর যােদ্ধাদের হাতে খড়ির কাজ শুরু হতে পারবে।
সবাই যখন জান-প্রাণ নিয়ে পালাতে ব্যস্ত, মুক্তিবাহিনীর সেক্রেটারি তখন সেই রাইফেলগুলির সন্ধানে উঠে-পড়ে লেগে গেলেন। হাতে সময় নেই, শত্রু সৈন্যরা যেকোন সময় এসে পড়তে পারে, তার আগেই এই অস্ত্রগুলিকে খুঁজে বের করতে হবে। অস্ত্রগুলির সম্পর্কে প্রথমে কেউ কোন কথা বলতে চায় না। বহু মিনতি আর রাগারাগির পর অবশেষে একটি একটি করে সব ক’টির সন্ধান পাওয়া গেল। সবচেয়ে আনন্দের কথা, সেই চীনা স্বয়ংক্রিয় রাইফেলটিকেও পাওয়া গেছে। মুক্তিফ্রন্টের সেক্রেটারি উত্তেজনা আর উল্লাসে অধীর। আর চিন্তা নেই, এবার এই ক’টিকে পুঁজি করেই তারা কাজ শুরু করে দেবেন।
আরও আনন্দের কথা এই যে, রাইফেলগুলির সাথে এক পেটি ভর্তি বুলেটও পাওয়া গেছে, যার অভাবে রাইলেগুলি অচল হয়ে থাকত। অস্ত্রগুলি যাদের হাতে এল, তাদের কিন্তু রাইফেল চালনা সম্পর্কে কোন ধারণাই নেই। কারও কাছ থেকে এ বিষয়ে সাহায্য নেবে, এমন লােকও হাতের কাছে নেই কিন্তু তাতেও তারা ঘাবড়াল না। তাদের উৎসাহ অদম্য। সারারাত জেগে রাইফেলগুলিকে নিয়ে নানাভাবে নাড়াচাড়া করতে করতে রাইফেল থেকে গুলি ছুঁড়বার কৌশলটা বেরিয়ে এল। এ তাদের কাছে এক মহাআবিষ্কার । সাফল্যের পর সাফল্য। ভাগ্যলক্ষ্মী তাদের উপর সুপ্রসন্ন হয়ে তার ভাণ্ডারের বন্ধ দরজাটা এবার তাদের সামনে খুলে ধরেছেন। ইতিপূর্বে মার্চ মাসে গৌরনদী থানা এলাকায় যে মুক্তিবাহিনী গড়ে উঠেছিল তাদের হাতে বেশকিছু রাইফেল আর বন্দুক ছিল। সেই মুক্তিবাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়ার পর মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে অধিকাংশ কে কোথায় চলে গেছে তার কোন পাত্তা নেই। তাদের মধ্যে অনেকেই হয়ত বর্ডারের ওপারে নিরাপদ আশ্রয়ে আছে। কিন্তু তাদের অস্ত্রগুলিকে কোথায় রেখে গেছে তারা? শােনা যায়, এই অঞ্চলেই কোথায় নাকি লুকিয়ে রেখে গিয়েছিল। নবগঠিত মুক্তিফ্রন্ট তার জন্মের পর থেকেই এই নিরুদ্দেশ অস্ত্রগুলির অনুসন্ধান করে চলেছিল। অবশেষে সেই পুরনাে দলের একটি ছেলের সাহায্য নিয়ে সেই মহামূল্য গুপ্ত সম্পদগুলিকে আবিষ্কার করা গেল। সহজ ব্যাপার নয়, রাইফেল আর বন্দুকে মিলিয়ে সতেরখানা।
নিহত পাকসৈন্যদের কাছ থেকে পাওয়া চারটি রাইফেল আর এই সতেরখানা, মােট একুশখানা। মুক্তিবাহিনী এখন একুশটি অস্ত্রের অধিকারী। অস্ত্রের সাথে সাথে বেশকিছু বুলেটও পাওয়া গেছে। তাই দিয়ে অনেকদিন কাজ চলবে। একটা নিরালা জায়গায় ট্রেনিং ক্যাম্প স্থাপন করে এক মাসের ট্রেনিং দেওয়ার ব্যবস্থা করা হতে লাগল। বহু খোঁজাখুঁজির পর ট্রেনিং দেওয়ার জন্য একজন প্রাক্তন সৈনিকের সন্ধান পাওয়া গেল। অনেক সাধ্য-সাধনা করে রাজী করান গেল তাকে। আপাতত প্রথম রাউণ্ডে তাকে দিয়েই কাজ চালিয়ে নিতে হবে। পাশাপাশি ক’টা গ্রাম একেবারে জনমানবশূন্য। ট্রেনিং-এর জন্য গােপন ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করবার মতাে নিরালা জায়গাও মিলল। কিন্তু সমস্যা দাঁড়াল এই যে, পঞ্চাশটি তরুণ এক মাস কাল ধরে ট্রেনিং নেবে, তারা খাবে কি? এই দুঃসময়ে যারা তাদের অর্থ দিয়ে, খাদ্য দিয়ে সাহায্য করতে পারত, তাদের মধ্যে অনেকেই গ্রাম থেকে পালিয়ে বিল অঞ্চলে আশ্রয় নিয়েছে। অর্থ ও খাদ্য সংগ্রহের জন্য মুক্তিফ্রন্ট অর্থ সাব-কমিটি ও খাদ্য সাব-কমিটি গঠন করেছিল। তাদের চেষ্টার ত্রুটি ছিল না বটে কিন্তু এই কঠিন সময়ে যথাশক্তি চেষ্টা করেও তারা তাদের এই দায়িত্ব পূর্ণ করে উঠতে পারছিল না। তা সত্ত্বেও একমাস ধরে এই ট্রেনিং চলল। প্রতিটি স্বেচ্ছাসেবকের ঐকান্তিক নিষ্ঠা ও দৃঢ়সংকল্প এই অসাধ্য সাধন করতে সক্ষম হয়েছিলে। সত্য কথা বলতে কি, তারা অধিকাংশ সময়ে আধপেটা খেয়ে এবং সময় সময় না খেয়েও এই সামরিক ট্রেনিং নিয়ে চলছিল। প্রাথমিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করে মুক্তিবাহিনী এবার কাজে নামল।
তারা প্রথমে সমাজবিরােধী শত্রুদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভিযানে নামল। তারা এই সমস্ত দালাল ও দুবৃত্তদের নামের একটা কাল তালিকা তৈরি করে নিয়েছিল। পর পর কয়েকটি ঘটনা ঘটে গেল। ১২ই জুন তারিখে মুক্তিবাহিনী গইলা অঞ্চলের দু’জন কুখ্যাত দালালের বাড়িতে হামলা করল। এদের হাতে প্রথম বাড়িতে আরজান ও তার দু’ছেলে এবং দ্বিতীয় বাড়িতে গইলার প্রতাপশালী চেয়ারম্যান আফতাবুদ্দিন মুন্সী নিহত হল। এইভাবে বিভিন্ন স্থানে দালাল হত্যার পর সারা অঞ্চলে সাড়া পড়ে গেল। লােকে বুঝল, সামরিক সরকার মুক্তিবাহিনীর হাত থেকে তাদের দালালদের রক্ষা করতে অসমর্থ। অবস্থা দেখে অন্যান্য দালালরাও ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। তাদের অনেকের কাছ থেকে মুক্তিফ্রন্টের নেতাদের নামে চিঠি আসতে লাগল। কালাে তালিকার কথাটা সকলের কাছেই প্রকাশ হয়ে গিয়েছিল। আতঙ্কগ্রস্ত দালালরা তাদের সেই সমস্ত চিঠিতে এই মিনতি জানাত যে, তাদের নাম যেন ওই কালাে তালিকা থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। মুক্তিফ্রন্ট যদি তাদের রেহাই দেন, তাহলে তারা মুক্তিফ্রন্টকে অনেক টাকা-পয়সা দিয়ে সাহায্য করবে। | এইভাবে দালালদের দমন করে মুক্তিবাহিনী এবার তাদের আসল কাজে নামল। ইতিমধ্যে একটা অনুকূল যােগাযােগের ফলে মুক্তিবাহিনীর শক্তি আশাতীতরূপে বেড়ে গিয়েছিল। আপনা থেকে একটা বিরাট সুযােগ তাদের হাতে এসে গেল। মুক্তিফ্রন্ট তাদের সংগ্রাম শুরু করবার কিছুটা আগে আর একটি ছােট দল অনুরূপ আদর্শ নিয়ে কার্যক্ষেত্রে নেমে গিয়েছিল। দলটি ছােট হলেও গুণের দিক দিয়ে উন্নত পর্যায়ের। দলের নেতার নাম হেমায়েতউদ্দীন। হেমায়েতউদ্দীন প্রাক্তন সৈনিক। ২৫-এ মার্চ ঢাকায় যখন প্রথম আক্রমণ শুরু হল, সেই সময় হেমায়েতউদ্দীন ঢাকাতেই ছিলেন।
তার কিছু আগেই তিনি কি করে একটা মেশিনগান ও একটা সাব-মেশিনগান যােগাড় করে নিয়েছিলেন, একমাত্র তিনিই তা জানেন। এছাড়া কয়েকটা রাইফেলও তার হাতে এসে গিয়েছিল। ঢাকার হামলার পর এই দুটি ভারী অস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে হেমায়েতউদ্দীন চলে এলেন ফরিদপুর সেই প্রাথমিক অবস্থায়। অস্ত্রবলের দিক থেকে এরা ছিল খুবই শক্তিশালী। তাছাড়া এই দলের ছিল যুদ্ধবিদ্যায় সুশিক্ষিত ৪জন সৈন্য। কিন্তু তাদের সবচেয়ে বড় শক্তি দলের নেতা হেমায়েতউদ্দীন। পরিচালনা শক্তি, বুদ্ধি ও সাহসের দিক দিয়ে তার তুলনা কমই মেলে। মুক্তিফ্রন্টের বহু ভাগ্য, এক বন্ধুর মধ্যবর্তিতায় তাদের সঙ্গে হেমায়েতউদ্দীনের যােগাযােগ ঘটল এবং কিছুদিনের মধ্যেই এই দু’দল পরস্পরের সঙ্গে ওতপ্রােতভাবে মিশে গেল। মুক্তিফ্রন্ট হেমায়েতউদ্দীনকে মুক্তিবাহিনীর কমাণ্ডার বা সেনাপতির পদে নির্বাচিত করল। অস্ত্রশক্তির দিক দিয়ে এবং সামিরক শিক্ষাব্যবস্থার দিক দিয়ে মুক্তিবাহিনী এবার যথেষ্ট সমৃদ্ধ হয়ে উঠল।
মুক্তিফ্রন্টের এই বাহিনীতে যােগ দেবার আগে হেমায়েতউদ্দীন তার এই ছােট্ট দলটিকে নিয়ে নিজের বুদ্ধি অনুসারে কাজ করে চলেছিলেন। কোন রাজনৈতিক দলের লােক নন তিনি। তাহলেও সারা প্রদেশব্যাপী স্বাধীনতা আন্দোলন তাদের মুক্তিসংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করে তুলেছিল। তারপর বর্বর পাকসৈন্যদের নৃশংস অত্যাচার তাঁকে ক্ষিপ্ত করে তুলেছিল। যে করেই হােক এদের হাত থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করতেই হবে—এই প্রতিজ্ঞা তার ধ্যান, জ্ঞান আর জপমন্ত্র হয়ে দাঁড়াল। এইভাবে মুক্তিমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে হেমায়েতউদ্দীনের এই ছােট্ট দলটি একান্তভাবে নিজেদের শক্তির উপর নির্ভর করেই কাজে নামল। ৯ই মে তারিখে তারা ফরিদপুরের কোটালীপাড়া থানা আক্রমণ করেছিলেন। থানায় সশস্ত্র পুলিশরা ছিল, দু’চারজন পুলিশ আর রাজাকারদের মধ্যে শৃঙ্খলা বলতে কোন কিছু ছিল না। তারা সবাই যে যার প্রাণ বাঁচাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। অপর দিকে মুক্তিবাহিনীর মেশিনগান আর রাইফেলগুলি ওদের উপর অত্যান্তভাবে মরণ-আঘাত হেনে চলেছে। এই প্রবল আক্রমণের মুখে ওরা সংখ্যায় বেশি হলেও বেশিক্ষণ লড়াই চালিয়ে যেতে পারল না। ওরা প্রাণ বাঁচাবার জন্য নৌকা থেকে খালের জলে ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগল। সৈন্য, পুলিশ আর রাজাকার সবাই এই একই পন্থা অনুসরণ করল। এইভাবেই হরিণাহাটি যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটল, মুক্তিবাহিনীর জয়ধ্বনিতে হরিণহাটির নৈশ আকাশ ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে চলল।
যুদ্ধের ফলাফল দেখে মুক্তিযােদ্ধারা নিজেরাই বিস্মিত হয়ে গিয়েছিল । এত বড় সাফল্যের কথা তারা কল্পনাও করতে পারেনি। পরদিন সকালবেলা নৌকার মধ্যে ও জলের উপর শত্রুপক্ষের ৫০টি মৃতদেহ পাওয়া গেল। ১৮জন তাদের হাতে বন্দি হয়েছে। বাকি সবাই প্রাণ নিয়ে পালিয়েছে। মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে মাত্র একজন মারা গেছে। তাব নাম ইব্রাহিম। মুক্তিবাহিনী ওদের নৌকার ভেতর থেকে ৫টি রাইফেল ও বেশ কিছু বুলেট উদ্ধার করল। এ সম্বন্ধে কারও মনে কোন সন্দেহ ছিল না যে, শত্রুরা পর পর দু’বার ঘা খেয়ে ক্ষান্ত থাকবে না, তাদের আক্রমণ আসন্ন। সেজন্য অবশ্যই প্রস্তুত থাকতে হবে। পরদিন ১৬ই জুন তারিখে মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটি খালের পূর্বদিকে কোদালধােয়া গ্রামে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হল । কিন্তু এই সংবাদটা শক্রদের অগােচর রইল না। খবর পাওয়া গেল তারা সেদিনই তাদের বর্তমান ঘাঁটির দিকে লক্ষ্য করে এগিয়ে আসছে। ওদের লঞ্চ সেখান থেকে এক মাইল দূরে পয়সারহাট বাজারে এসে ভিড়েছে। শত্রুদের লঞ্চ এই খালের উপর দিয়ে আসবে। মুক্তিযােদ্ধারা খালের দু’পাশে স্থানে স্থানে পজিশন নিয়ে তৈরি হয়ে তাদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। এইভাবে ঘন্টাখানেক সময় কেটে গেল, কিন্তু সেই লঞ্চটির আর দেখা নেই। শেষে খবর পাওয়া গেল যে, ওরা পয়সারহাট বাজারে খানাপিনার উৎসবে মেতে গেছে। এই বাজারে যে সমস্ত খাদ্যদ্রব্য মেলে ওরা তা জবরদস্তি করে লুটে পুটে নিচ্ছে।
কমাণ্ডার হেমায়েতউদ্দীন স্থির করলেন, মুক্তিবাহিনীর একটা দল এখানেই মােতায়েন থাকবে। অবশিষ্ট মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ে তিনি দু’মাইল পথ এগিয়ে যাবেন এবং সেখানে গিয়ে লঞ্চসহ শত্রুদের ঘেরাও করে ফেলবেন। এই পরিকল্পনা নিয়ে তার দল সবেমাত্র কিছুদূর এগিয়ে গিয়েছে, এমন সময় শত্রুসৈন্যবাহী লঞ্চটা তাঁদের কাছাকাছি এসে পৌছল। জায়গাটা এমন যে, সেখানে দাড়িয়ে পজিশন নেওয়ার খুবই অসুবিধা। কিন্তু উপায়ান্তর না থাকায় সেখানেই তাদের পজিশন নিতে হল। শত্রুরা তাদের দেখতে পেয়েছে এবং দেখার সঙ্গে সঙ্গে গুলি ছুঁড়তে শুরু করে দিয়েছে। মুক্তিসেনাদের মেশিনগান ও রাইফেলের গুলিও তার প্রত্যুত্তর দিয়ে চলল। তাদের প্রবল গুলিবর্ষণের ফলে লঞ্চটা জায়গায় জায়গায় ভেঙ্গেচুরে যাচ্ছিল। শেষপর্যন্ত অবস্থা বেগতিক দেখে শত্রুরা তাদের লঞ্চ নিয়ে পৃষ্ঠভঙ্গ দেবার চেষ্টা করছিল। কমাণ্ডার হেমায়েতউদ্দীন পলায়মান লঞ্চের পেছনে পেছনে ধাওয়া করলেন, কিন্তু শেষপর্যন্ত সেই লঞ্চ তাঁদের আক্রমণের নাগালের বাইরে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। ঘন্টা দেড়েক এই যুদ্ধ চলেছিল। তাতে হানাদারদের মধ্যে ছয়জন সৈন্য নিহত ও অনেক সৈন্য আহত হয়।
সেইদিনই বিকালবেলা দু’দল পাকসৈন্য দু’দিক থেকে সাঁড়াশি আক্রমণের পরিকল্পনা নিয়ে মুক্তিফ্রন্টের ঘাটি কোদালধােয়া গ্রামটিকে লক্ষ্য করে এগিয়ে আসতে থাকে। একটি দল মাদারীপুর থেকে স্পীডবােট বােঝাই করে আসছিল। তারা অনেক দূর পর্যন্ত চলে এসেছিল বটে, কিন্তু তাদের দালালদের মুখে মুক্তিবাহিনীর মেশিনগানের পরিচয় পেয়ে তারা আর বেশিদূর এগুতে ভরসা করল না। শেষপর্যন্ত তাদের মনের ক্ষোভ মেটাবার জন্য তারা পীড়ারবাড়ি গ্রামে হামলা করে, সেখানকার ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিয়ে স্বস্থানে ফিরে যায়। অপরদিকে গৌরনদী, উজিরপুর, কোটালীপাড়া ও গােপালগঞ্জ থেকে চারটি স্পীডবােট বােঝাই করে বহু পাকসৈন্য আর একদিক দিয়ে কোদালধােয়া গ্রামের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। মুক্তিফৌজ সামনে এগিয়ে গিয়ে এই হানাদার শত্রুদের প্রতিরােধ করে দাঁড়াল। দু’পক্ষে প্রবল সংঘর্ষ হয় এবং শেষপর্যন্ত মুক্তিবাহিনী শত্রুদের পয়সারহাট থেকে আট মাইল দূরে তাড়িয়ে দিয়ে জয়-গৌরবে ফিরে আসে। এই যুদ্ধে নয়জন পাকসৈন্য মারা যায়।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত