বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ১৯শে সেপ্টেম্বর, বৃহস্পতিবার, ৩রা আশ্বিন, ১৩৮০
পাকিস্তানে মার্কিন অস্ত্র
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র বলেছেন বর্তমান নিক্সন-ভুট্টো আলোচনাকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের অস্ত্র সরবরাহের যে আংশিক বিধিনিষেধ রয়েছে তা প্রত্যাহার করা হবে না। ভুট্টো সাহেব এ আলোচনাকালে তেমন কোনো প্রস্তাবও যদি উত্থাপন করেন নিক্সন সাহেব তা প্রত্যাখান করবেন। তিনি বলেছেন, এই বৈঠকে অস্ত্র চুক্তি ছাড়া অন্যান্য চুক্তি সম্পাদিত হতে পারে।
মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের উক্ত মুখপাত্রের এই উক্তিগুলো সত্য হবে বলে ধরে নিলেও কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। সে প্রশ্ন গুলো হচ্ছে পাকিস্তানে মার্কিন সমরাস্ত্র প্রেরণ সম্পর্কিতই। বর্তমানে পাকিস্তানে মার্কিন অস্ত্র সরবরাহের ব্যাপারে যে আংশিক বিধিনিষেধ রয়েছে তা কি এতই শক্তিশালী যে, এই বিধি নিষেধের বেড়াজালে পাকিস্থানে কোন মার্কিন সমরাস্ত্র ঢুকতে পারবে না?
যদি প্রশ্ন করা হয় যে, এই বিধি-নিষেধকে এড়িয়ে পাকিস্তানে মার্কিন সমরাস্ত্র প্রবেশ লাভের হাজারো রকমের পথ খোলা আছে, তবে কি মার্কিনী কর্তৃপক্ষ বা পাকিস্তানি কর্তা ব্যক্তিরাই সেটা অস্বীকার করতে পারবেন? বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালেও তো এসব বিধিনিষেধ ছিল, তাই বলে কি পাকিস্তান তখন মার্কিন অস্ত্র পায়নি? আর সেই অস্ত্র দিয়েই কি বাংলাদেশে নারকীয় গণহত্যা ও ভারতের সাথে যুদ্ধ চালায়নি? মার্কিনীরা ও পাকিস্তানিরা এর কোনো সদুত্তর দেবেন না। কেননা সত্য উত্তর দেবার মত কিছুই নেই তাদের কাছে। তবুও এ সাফাই করা হচ্ছে।
পাকিস্তানের আজ মার্কিন অস্ত্রের বড় প্রয়োজন। আর প্রয়োজন বলেই ভুট্টো সাহেব বারবার মার্কিন কর্তাদের দরবারে ধন্না দিচ্ছেন। মাস দুয়েক আগেও গিয়েছিলেন। কিন্তু নিক্সন সাহেব তখন অসুস্থ ছিলেন। তাই দেখা হয়নি। এখন আবার গেছেন । আলাপ হচ্ছে-শলা পরামর্শ হচ্ছে। নিক্সন সাহেব কি ভুট্টো সাহেবকে একেবারে খালি হাতে ফিরিয়ে দেবেন? বা দিতে পারবেন?
ভুট্টো সাহেবের নিজের নিরাপত্তার জন্যই আজ মার্কিন সমরাস্ত্র তার সবচাইতে বড় দরকার। বেলুচিস্তানের বিদ্রোহীদের তথা দেশপ্রেমিক বেলুচ-মেঙ্গলদের দমন করে মার্কিন মারণাস্ত্র তার চাই-ই। সীমান্তের পাঠানদের কব্জীভূর করার ব্যর্থ অপচেষ্টা চালানোর জন্য মার্কিন অস্ত্র আজ তাঁর সবচাইতে বড় দরকার। পাঞ্জাবি প্রভুদের চাপে প্রতিবেশী ভারত ও আফগানিস্তানের সাথে রণোন্মদনায় মেতে থাকার জন্য মার্কিন মারণাস্ত্রই এখন তাঁর জীবন। এমতাবস্থায় নিক্সন সাহেব তাকে ফিরাবেনই কিভাবে? সরাসরি অস্ত্র না দিলেও হয়তো বলবেন ইরানের শাহকে দিচ্ছি -ওর কাছ থেকে যত দরকার নিয়ো। কাজেই পাকিস্তানে মার্কিন অস্ত্রের প্রবেশ লাভ ওই বিধি-নিষেধের ফলে কোন বিঘ্নের সৃষ্টি করতে পারবে না।
প্রবল বর্ষণে আবার বন্যা
সংবাদে প্রকাশ, গত কয়েকদিনের প্রবল বর্ষণের দরুন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বন্যা দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন জেলার উদ্ভূত এই বন্যার দরুন ক্ষয়ক্ষতির খবর আসছে তার মধ্যে রংপুর ও বগুড়ার অবস্থা ভয়াবহ। বগুড়া ও রংপুর জেলা মিলে ৩২ টি থানার প্রায় লক্ষাধিক একর জমি পানিতে ডুবে গেছে। ফলে প্রায় সত্তরভাগ ফসল সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়ে গেছে এবং তিরিশ হাজার বাড়িঘর ধ্বংস হয়ে গেছে। এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় তিরিশ লাখ লোক। আরও জানা গেছে রংপুর জেলার আমন ধান সম্পূর্ণভাবে বিনষ্ট হয়ে গেছে। অন্য একটি সংবাদ প্রকাশ, ঢলের দরুন বঙ্গোপসাগরে ভাঙ্গন ধরেছে। ফলে চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের চারটি ইউনিয়ন নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তার ভাঙ্গনে রংপুরের চিলমারী ও হিরাগাছ বন্দরের প্রায় অর্ধেক মাইল এলাকা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। সন্দীপের চারটি ইউনিয়নের ভাঙ্গনের দরুন এলাকায় প্রায় ১ লক্ষ ২৫ হাজার লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এখনো নাকি বঙ্গোপসাগরে ভাঙ্গন অব্যাহত রয়েছে। সন্দ্বীপ এলাকায় প্রায় তিরিশ একর জমির ফসল বিনষ্ট হয়েছে বলেও জানা গেছে। সংবাদে জানানো হয়েছে, ইতোমধ্যেই কিছু কিছু সাহায্য দ্রব্য ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় প্রেরণ করা হয়েছে। গত পরশুর সর্বশেষ সংবাদে প্রকাশ, ময়মনসিংহ জেলার আটটি থানার বিভিন্ন অঞ্চল বন্যাকবলিত হয়েছে। এই এলাকার প্রচুর পরিমাণ আমন ফসল ডুবে গেছে। বেশ কিছু পুরাতন বাড়িঘর ও ধসে গেছে। বন্যা এহেন রূপ ধারণ করবে তা অকল্পনীয় ছিল। প্রবল বর্ষণের দরুন যমুনা নদীর পানি বেড়েছে তেমনি ক্ষেতে পানি জমে গিয়ে ফসলের ক্ষতি সাধন করছে। বর্ষণের দরুণ উল্লেখিত ঐ সকল এলাকার নদীগুলোর পানিও বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। ফলে বিস্তীর্ণ এলাকা ভেসে গেছে। এবং ফসলের ক্ষতি সাধন করেছে। আমাদের দুর্ভাগ্য, প্রকৃতির এই নির্মম পরিহাস রোধ করার কোন উপায় আপাতত হাতে নেই। সরকার দুঃস্থ মানুষের জন্য যতটুকু সম্ভব সাহায্য দান করেই তার কর্তব্য পালন করবেন। তবে বৃহৎ পরিকল্পনা রয়েছে বন্যা নিয়ন্ত্রণ করার। জাতি সেই স্থায়ী বন্যা নিয়ন্ত্রণের আশায়ই বসে রয়েছে। যতদিন এ দেশের বন্যা নিয়ন্ত্রণ স্থায়ী ভাবে সম্ভব না হয় ততদিন প্রকৃতির নির্মম আঘাত জীবন আর সম্পদের ক্ষতি সাধন করবে। বর্ষণের দরুন জীবনের সৃষ্টি হয়েছে এবং সে কারণে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের প্রয়োজনীয় সাহায্যদানের আহ্বান জানাবো সরকারের প্রতি। আমাদের বিশ্বাস সরকার অবিলম্বে একটি কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
বসন্ত নির্মূল প্রসঙ্গে
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে গুটি বসন্তকে নির্মূল করার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরুরি কর্মসূচি গ্রহণ করেছে বলে জানা গেছে। সংস্থার ডিরেক্টর জেনারেল ডাঃ এইচ টি আহলার মতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিশেষভাবে পরিলক্ষিত এবং এক ভারতেই শতকরা ৮০ ভাগ। এই কর্মসূচিতে তিনি ১৯৭৭ এর মধ্যে এই রোগ নির্মূলের আশা পোষণ করেছেন। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় ভারতের পরেই এই রোগের প্রাদুর্ভাব হলো বার্মা, ইন্দোনেশিয়া, ভুটান, বাংলাদেশ এবং আফগানিস্তানে। এই কয়টি দেশ ছাড়া বিশ্বের অন্য কোন দেশের সম্ভবত এই রোগের অস্তিত্ব নেই বা থাকলেও তা এই সব দেশ থেকে আগমনকারীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ।
বিশ্বের সব উন্নত দেশ এমনকি অধিকাংশ উন্নতশীল দেশেও যেখানে রোগের কোন অস্তিত্ব নেই সেখানে বাংলাদেশ সুদ্ধ এই কটি দেশে আজও এই রোগকে নির্মূল করা সম্ভব হচ্ছে না কেন? ১৯৬৭ থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বহুবার নতুন নতুন কর্মসূচি নেওয়া সত্ত্বেও এইসব দেশে আজও এ রোগের প্রাদুর্ভাব এত বেশি কেন?
আমরা জানি বসন্ত রোগের জীবাণুর মানুষ ছাড়া অন্য কোন ধারক-বাহক নাই এবং এ শুধু মানুষ থেকে মানুষেই সংক্রমিত হয়। তাই যে কোন আক্রান্তকে আলাদা করে রাখলে অর্থাৎ তার থেকে অন্যকে সংক্রমিত হতে না দিলে এই রোগ কোন ক্রমে বিস্তার লাভ করতে পারে না। অন্যদিকে সার্থক টিকা দেওয়া থাকলে কোন লোকেরই এই রোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকেনা।
স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে প্রথম আক্রান্তকে আলাদা করে রাখা সম্ভব হয়না কেন অথবা জনসাধারণের প্রত্যেককে অন্ততঃ প্রাথমিক টিকা দেয়া হয় না কেন?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কর্মসূচির অধীনে বাংলাদেশেও ১৯৬৯-এ বসন্ত নির্মূল অভিযান আরম্ভ করা হয়েছিল। ৪৪টা ল্যান্ডরোভার জীপ, ২৪টা স্পিডবোট, ১৮টা টিকা দেয়ার জেড ইঞ্জেক্টর, প্রায় ২০০ মোটর সাইকেলসুদ্ধ প্রচুর সাহায্য এসেছিল বাংলাদেশের জন্য। সে কর্মসূচির ফলশ্রুতি হিসেবে ১৯৭০ এর আগস্ট মাসে বাংলাদেশ থেকে বসন্তকে নির্মূল করা হয় এবং ১৯৭২ এর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এদেশে কোন বসন্ত রোগের অস্তিত্ব ছিলনা। সরকারি তথ্য অনুসারে ১৯৭২ এর মার্চ মাসে ভারত প্রত্যাগত শরণার্থীদের দ্বারা এদেশে আবার বসন্ত সংক্রমিত হয়।
আমরা মনে করি, স্বাস্থ্য বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের কর্মবিমুখতা প্রশাসনিক দুর্বলতা এবং অনভিজ্ঞ লোকের পরিচালনায় আজ পর্যন্ত এই রোগকে নির্মূল করা সম্ভব হয়নি। বর্তমান বসন্ত নির্মূল অভিযানের প্রশাসনকে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন করা আশু প্রয়োজন। যাতে করে কোনো জায়গায় বসন্ত শুরু হলে প্রথম বা দ্বিতীয় আক্রান্তকে অনতিবিলম্বে খুঁজে বের করে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয় এবং আশপাশের প্রত্যেকটি লোককে কালবিলম্ব না করে টিকা দিয়ে রক্ষিত করা সম্ভব হয়। বর্তমান প্রশাসনিক কর্মবিমুখতা অব্যাহত থাকলে এবং প্রত্যেক থানায় থানায় স্বাস্থ্য কর্মচারীদের কার্যক্রমের উপযুক্ত তত্ত্বাবধানের ব্যবস্থা না থাকলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নতুন কর্মসূচির নিষ্ফল হতে বাধ্য। বারে বারে শুধু কাগুজে কর্মসূচি নেয়ার চেয়ে তাকে বাস্তবে রূপান্তরিত করাই আমাদের কাম্য।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক