সাত নম্বর সেক্টরে মুক্তি যুদ্ধ
লেঃ কর্নেল কাজী নূরুজ্জামান ছিলেন সাত নম্বর সেক্টরের কমণ্ডার। এই সেক্টরটিকে কয়েকটি সাব-সেক্টরে ভাগ করা হয় ?
এক ঃ লালগােলা সাব-সেক্টর–ক্যাপ্টেন গিয়াসউদ্দিন চৌধুরী এই সাব-সেক্টরের কমাণ্ডার ছিলেন।
দুই ঃ মেহেদীপুর সাব-সেক্টর। ক্যাপ্টেন গিয়াসউদ্দিন চৌধুরী এই সাব-সেক্টর কামাণ্ডার।
তিন ঃ হামজাপুর সাব-সেক্টর। ক্যাপ্টেন ইদ্রিস সাব-সেক্টর কমাণ্ডার ছিলেন। চার ঃ শেকপাড়া সাব-সেক্টর। ক্যাপ্টেন রশিদ সাব-সেক্টর কমাণ্ডার নিযুক্ত হন।
পাচ ঃ ভােলাহাট সাব-সেক্টর। লেঃ রফিকুল ইসলাম এই সাব-সেক্টরের কমাণ্ডার ছিলেন।
ছয় ঃ মালন সাব-সেক্টর। প্রথম দিকে ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সাব-সেক্টর কমাণ্ডার ছিলেন। পরে একজন সুবেদার এই সাব-সেক্টর কমাণ্ড করেছেন।
সাত ঃ তপন সাব-সেক্টর। মেজর নজমুল হক প্রথম দিকে কমাণ্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। পরে একজন সুবেদার সাব-সেক্টর কমাণ্ডার ছিলেন। আট ও ঠোকরাবাড়ি সাব-সেক্টর। সুবেদার মােয়জ্জেম সাব-সেক্টর কমাণ্ডার ছিলেন।
নয় ও আঙ্গিনাবাদ সাব-সেক্টর। গণবাহিনীর জনৈক সদস্য মিত্রবাহিনীর তত্ত্বাবধানে কমাণ্ড করেছেন। সেক্টরের প্রতিটি সাব-সেক্টর এলাকায় প্রচণ্ড যুদ্ধ চলে। অতর্কিত আক্রমণ, এ্যামবুশ ও সেতু ধ্বংস করে মুক্তিবাহিনী এক অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করে। মে মাসে খঞ্জনপুর, পত্মীতলা, ধামহাট, গােদাগাড়ী, চারঘাট, সারদা পুলিশ একাডেমী, পুটিয়া দুর্গাপুর ও কাঁটাখালী বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বার বার আক্রমণ করা হয়। পাকবাহিনীর মনােবল দারুণভাবে ভেঙ্গে পড়ে।
দিনাজপুরের ঠনঠনিয়া পাড়ায় একটি বড় রকমের যুদ্ধ হয় ১৮ই জুন। মেজর নজমুল হক নিজে এই যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন। ঠনঠনিয়া পাড়া মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে এবং ১৪ জন পাকসেনা নিহত হয়। একজন মুক্তিযােদ্ধা শহীদ হন ও ২জন আহত হন। জুলাই মাসের ৪ তারিখে মেজর নাজমুল হক কাঞ্চন সেতুর উপরে পাকঘাঁটি আক্রমণ করে। এই আক্রমণ যদিও সফল হয়নি তবু পাকসেনাদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল।
১০ই আগস্ট কলাবড়িতে এক বিরাট সংঘর্ষ হয়। আগের দিন পাকসেনারা স্থানটি দখল করে নেয়। সুবেদার মেজর রবের নেতৃত্বে ভাের পাঁচটার সময় মুক্তিযােদ্ধারা অতর্কিতভাবে হামলা করে। প্রায় ২ ঘন্টা প্রবল যুদ্ধের পর পাকসেনারা কলাবাড়ি ছেড়ে কানসাটে পলায়ন করে।
ক্যাপ্টেন ইদ্রিস ও সুবেদার মেজর মজিদ ২৩শে আগস্ট কানসাট আক্রমণ করেন। এই ভয়াবহ যুদ্ধ চার ঘণ্টা স্থায়ী হয়। প্রচুর পাকসেনা হতাহত হয়। চাঁপাই নওয়াবগঞ্জ থেকে অনেক পাকসেনা সাহায্যে এগিয়ে আসে। কানসাটে ২৬শে আগস্ট শুরু হয় আবার যুদ্ধ। নদী পার হয়ে ক্যাপ্টেন ইদ্রিস ও সুবেদার মেজর মজিদের দল কানসাট আক্রমণ করে। পাকসেনারা কানসাট ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। কিন্তু অল্প সময় পরেই পাকসেনারা পাল্টা আক্রমণ করে। মুক্তিবাহিনী এই আক্রমণের মুখে পিছনে সরে আসে।
৩রা আগস্ট তাহেরপুর পাকঘাঁটি আক্রমণ করেন ক্যাপ্টেন রশিদ। সীমান্ত থেকে ২৫ মাইল ভেতরে পুঠিয়া থানার ঝলমলিয়া ব্রীজে হবিলদার শফিকুর রহমানের দলের সাথে সংঘর্ষ বাধে। অক্ষত অবস্থায় মুক্তিবাহিনী ফিরে আসে। ৪ঠা আগস্ট পাকিস্তানী দল নদীপথে তাহেরপুরের দিকে আসছিল। হাবিলদার শফিক পাকসেনাদের এ্যামবুশ করেন। এতে ১৮জন পাকসেনা নিহত হয়।
দুর্গাপুরে ২৬শে আগস্ট হাবিলদার শফিক অতর্কিতভাবে পাকসেনা কর্তৃক আক্রান্ত হন। মুক্তিযােদ্ধারা মর্টার ও হালকা মেশিনগানের গােলা নিক্ষেপ করে নিরাপদে ফিরে আসে। সারদা পুলিশ একাডেমীতে অবস্থানরত পাকিস্তানী কোম্পানীর উপরে অতর্কিত আক্রমণ করা হয় ১৭ই আগস্ট। এই দুঃসাহসিক অভিযানে ১জন ছাড়া সকলেই শহীদ হয়। মীরগঞ্জে ২২শে আগস্ট সুবেদার মেবােসসারুল ইসলাম চারঘাট থানার মীরগঞ্জ বিওবি আক্রমণ করেন। দ্রিামগ্ন পাকসেনারা সকলেই নিহত হন।
১৪ই অক্টোবর মুক্তিবাহিনী মেখপাড়া সাব-সেক্টর কমাণ্ডারের নির্দেশে দুর্গাপুর থানার গলহরি যান। পাকসেনারা জানতে পেরে আক্রমণ করে। বাঁশের সেতুর উপর দিয়ে যখন পাকসেনা আসা শুরু করে তখন মুক্তিবাহিনী গুলিবর্ষণ শুরু করে। এখানে ৭৩জন পাকসেনা ও ২জন অফিসার নিহত হয়। লালগােলা সাব-সেক্টর মেজর গিয়াসের নেতৃত্বে অমিতবিক্রমে যুদ্ধ চলে । রাধাকান্তপুরের যুদ্ধ ও ইসলামপুরে অবস্থিত পাকঘাঁটি আক্রমণ সবিশেষ উল্লেখযােগ্য। পাকসেনাকে নবাবগঞ্জে পশ্চাৎপসরণ করতে বাধ্য হয়। হামজাপুর সাব-সেক্টরে ১৩/১৪ই নভেম্বর ঘনেপুর বিওপি আক্রমণ করে ৩০জন পাকসেনাকে হত্যা করে। সাতাশে নভেম্বর মেজর গিয়াস পাচঁ কোম্পানী মুক্তিযােদ্ধা নিয়ে পােড়াগ্রাম আক্রমণ করেন। এই ভয়াবহ যুদ্ধে ৩০জন পাকসেনা ও ৫০জন রাজাকার নিহত হয়। ভােলাহাট সাব-সেক্টরে বহমপুর আলীনগরস্থ পাকঘাঁটিতে লেঃ রফিকের নেতৃত্বে অতর্কিত হামলা করা হয় ৭ই নভেম্বরে। পাঁচজন পাকসেনা নিহত হয় এবং মহানন্দা নদী পার হয়ে পাকসেনারা পালিয়ে যায়। ভােলাহাট থেকে রহমপুর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ১০০ বর্গমাইল এলাকা ছিল সম্পূর্ণ মুক্ত। সাব-সেক্টর হেডকোয়ার ছিল পদলিতে। মহানন্দা নদীর দু’পাশে আলীনগর থেকে শাহপুর গড় পর্যন্ত দীর্ঘ ৭ মাইল মুক্তিবাহিনীর ডিফেন্স ছিল।
ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহঙ্গীরের সার্বিক তত্ত্বাবধানে আলমপুর আম্রকাননে অবস্থিত পাকঘাঁটি আক্রমণ করা হয়েছিল ১৮ই নভেম্বর। এই যুদ্ধে লেঃ রফিক ও লেঃ কাইউম ২ কোম্পানী সৈন্য নিয়ে সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। প্রচণ্ড যুদ্ধের পর আলমপুর দখল হয়েছিল কিন্তু আকস্মিকভাবে পিছন দিক থেকে শক্রর গুলি আসতে থাকে। পেছনের বাঙ্কারে শক্র জীবিত অবস্থায় লুকিয়ে ছিল, অগ্রসরমান মুক্তিযােদ্ধারা কেউই তা খেয়াল করেনি। মুক্তিযােদ্ধারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে এবং পাকসেনারা আলমপুর পুনর্দখল করে।
নভেম্বরের শেষের দিকে সংঘটিত হয় শাহপুর গড়ের যুদ্ধ। পাকসেনার একটি ব্যাটালিয়ন শাহপুর গড় আক্রমণ করে। সারাদিন যুদ্ধ চলে। রাত দেড়টার সময়। মুক্তিবাহিনী আক্রমণ করে। এই আক্রমণে রণাঙ্গনে উপস্থিত থেকে নেতৃত্ব দেন স্বয়ং সেক্টর কমাণ্ডার লেঃ কর্নেল কাজী নূরুজ্জামান। বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর কলাবাড়ি, ছােবরা, কানসাট ও বারঘরিয়ার যুদ্ধে বীর নায়ক হয়ে আছেন। একটি মানুষ যে কত সাহসী ও তেজস্বী হতে পারে জাহাঙ্গীর ছিলেন তার দৃষ্টান্ত। প্রতিটি যুদ্ধে সবার আগে থেকে তিনি নেতৃত্ব দিতেন। এ ছাড়া ক্যাপ্টেন ইদ্রিসের বীরত্ব ও সাহসের বর্ণনা করা একটি অসম্ভব ব্যাপার। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে তিনি যে শৌর্যবীর্যের পরিচয় দিয়েছেন তা সমগ্র বাঙালি জাতির জন্য গর্ব ও অহংকারের ব্যাপার। বিরলের যুদ্ধ এখন ঐ অঞ্চলের মানুষের মুখে শােনা যায়। এই যুদ্ধে ক্যাপ্টেন ইদ্রিস আহত হন। তিনদিন পর লেঃ সাইফুল্লাহ গুলিবিদ্ধ হন। লেঃ কায়সার ও আমিন এই যুদ্ধে বিশেষ বীরত্বের পরিচয় দেন। (সূত্র : বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, অষ্টম খণ্ড।)
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত