৯ম বেঙ্গল রেজিমেন্টের কুমিল্লা শহর দখল
মনতলি (আগরতলা) ক্যাম্প থেকে দুকোম্পানী সৈন্য নিয়ে আমি সােনামুড়া (ভারত) গেলাম। ২৩শে নভেম্বর সােনামুড়াতে যে ভারতীয় সৈন্য ডিফেন্স নিয়েছি। তাদের কাছ থেকে আমি দায়িত্ব বুঝে নিয়ে বাংলাদেশের দিকে অগ্রসর হই। বাংলাদেশের ভেতরে আরও দুটি কোম্পানী পূর্ব থেকেই অবস্থান করছিল। আমাকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে নির্ভয়পুর (ভারতে) যেতে এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কুমিল্লা দখল করার জন্য বলা হল। আমি ১লা ডিসেম্বর নির্ভয়পুর গেলাম। সেখানে যাওয়ার পর ব্রিগেডিয়ার টম পাণ্ডে মিল্লা ও চট্রগ্রাম রাস্তার মাঝে চিওড়াতে ডিফেন্স নিতে বললেন। আমাকে ভারী অস্ত্র দযে সাহায্য করা হল। আমি ব্রিগেডিয়ারের নির্দেশ মতাে ৩ তারিখ রাতে চিওড়া গেলাম। আমরা পৌছলে চিওড়া বাজারে ভারতীয় যে এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য ডিফেন্স নয়েছিল (পূর্ব থেকেই) তারা তখন অন্যত্র চলে গেল। পাকসৈন্যবাহিনী চিওড়া বাজারের উত্তর দিকে একটি বাজারে ডিফেন্স নিয়েছিল। চিওড়া পৌছার পর পরই পাকবাহিনী কোন রকম প্রতিরােধ না করেই পিছনের দিকে চলে গেল। ৫ই ডিসেম্বর সকালে বালুতুফা (কুমিল্লা শহরের পূর্ব পাশে) গিয়ে আমি আমার বাহিনী নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকি। আমি যখন বালুতুফা পৌঁছই তখন সেখানে যে পাকসেনারা বাঙ্কারে ডিফেন্স নিয়েছিল তার দূরত্ব ছিল মাত্র আট মাইল। আমি ভাবলাম যে, পাকসেনারা যে পাকা বাঙ্কারে ডিফেন্স নিয়ে আছে তাদের সাথে সরাসরি যুদ্ধ করা অল্প সংখ্যক সেনা নিয়ে সম্ভবপর নয়। তাই পাকসেনাদের পিছনের দিক দিয়ে কুমিল্লা শহরে ৬ই ডিসেম্বর প্রবেশ করি। এর ফলে বালুতুপারে পাকাসেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং তারপরই আমি আমার বাহিনী নিয়ে কুমিল্লা শহরে প্রবেশ করি।
কুমিল্লা শহরের পূর্ব দিক থেকে ঢুকে আমার কনভয় নিয়ে কুমিল্লা শহরের পশ্চিম দিকে ৭ই ডিসেম্বর দুপুর ১২ টার দিকে পৌছলাম। দুপুর বারােটার দিকে আমার সঙ্গে ভারতীয় শিখ জাটের ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডার টমসনের সঙ্গে ব্রীজের কাছে দেখা হয়। শিখ জাট ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডারের কাজ ছিল কুমিল্লা বিমান বন্দর আক্রমণ করা। শিখ জাট ব্যাটলিয়ন কমাণ্ডার বিমানবন্দর আক্রমণ করেছিলেন ৬ই ডিসেম্বর রাতে। এই আক্রমণে শিখ জাট সেনাদের কয়েকজন আহত ও নিহত হয়। পাকসেনারা বিমানবন্দর ছেড়ে চলে যায়। আমার কনভয় যখন কুমিল্লা শহরের পশ্চিমদিকে এগুচ্ছিল তখন শহরের হাজার হাজার জনতা আমাদেরকে স্বাগত জানাতে অগ্রসর হচ্ছিল। আমি ভাবলাম এ সময় যদি পাকবাহিনী হঠাৎ করে আক্রমণ করে তবে আমার বাহিনীর পক্ষে ভিড়ের ভেতর সুষ্ঠভাবে কাজ করা দুরুহ হয়ে পড়বে। এই কথা চিন্তা করে আমি কনভয়ের সামনে এসে জনতাকে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না করতে এবং সামনে না আসতে অনুরােধ করলাম। আমি আরও বললাম যে, আমরা প্রথমে শহর সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত করি। কিন্তু জনতা একথা প্রথমে শুনতে নারাজ হওয়াতে বাধ্য হয়েই আমাকে তাদের উপর বলপ্রয়ােগ করতে হল। জনতা শেষ পর্যন্ত ফিরে গেল। তবে জনতা আমাদের উপর একটু মনঃক্ষুন্ন হল।
৭ই ডিসেম্বর বিকাল পাঁচটায় জেনারেল অরােরা হেলিকপ্টারযােগে কুমিল্লা বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। ঐ সময় কুমিল্লা শহরের শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত সকল স্তরের পুরুষ ও মহিলা ফুলের মালা হাতে করে রাস্তায় নেমে গেছে ভারতীয় ও বাংলাদেশ সেনাদের মালা দেয়ার জন্য। | আমি এ সময় সাধারণ পােশাক পরে বিমানবন্দরে গেটে এ দৃশ্য দেখছিলাম। এমন সময় জেনারেল অরােরা আমাকে ডেকে পাঠান। জেনারেল অরােরা আমাকে কুমিল্লা শহরের সম্পূর্ণ শান্তি-শৃঙ্খলা আয়ত্তে আনার দায়িত্ব দিয়ে তিনি হেলিকপ্টারে পুনরায় চলে গেলেন। এর পরই জনতা আমাকে চিনতে পারল। জনতা আমার গলায় মালা দেয়ার জন্য ভিড় জমাল। আমি ভিড় ঠেলে বের হয়ে আসলাম। ঐ দিন ৭ই ডিসেম্বর আমি শহরে এসেই সমস্ত সােনার দোকান সীল করে দিলাম। যতদিন পর্যন্ত না বাংলাদেশ সরকার থেকে কোন রকম আদেশ না আসে ততদিন পর্যন্ত পাকআমলের এসপিডি সিকে কাজ চালিয়ে যাবার নির্দেশ দিলাম। এ সময় কুমিল্লায় তেমন কোন পুলিশ ছিল না।
এসপি’কে সাহায্য করার জন্য বাংলাদেশ সেনারা সব সময় এগিয়ে আসত। তখনও পাকসেনারা আত্মসমর্পণ করেনি।। পাকসেনারা যে কোন সময় আক্রমণ করতে পারে, সেজন্য সতর্ক থাকার জন্য নাগরিকদেরকে আমি মাইকযােগে জানিয়ে দিলাম। বিমান আক্রমণ বা অনুরূপ ধরনের আক্রমণ হলে সবার বাড়িতে পরিখা খনন করার জন্য নির্দেশ দিলাম। ৭ তারিখ থেকে আমার বাহিনীর নিয়ে কুমিল্লা সেনানিবাসের দক্ষিণ দিক থেকে আক্রমণ করার জন্য ডিফেন্স নিয়েছিলাম এবং আক্রমণের প্রস্ততিও নিচ্ছিলাম। কিন্তু ১৩ই ডিসেম্বর ভারতীয় হাই কমাণ্ড থেকে জানান হল যে, কুমিল্লা সেনানিবাসে আক্রমণ করতে হবে না। জেনারেল অরােরা প্রচারপত্র বিলি করছেন এবং রেডিওতে ঘােষণা করছেন যাতে পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করে। এই নির্দেশের পর আমি পাকসেনানিবাস আক্রমণ করার পরিকল্পনা বন্ধ করি। ১৬ তারিখে যখন পাকসেনারা আত্মসমর্পণ করে তখন আমি কুমিল্লা সেনানিবাসে উপস্থিত ছিলাম। (সূত্র : বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র অষ্টম খণ্ড।)
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত