You dont have javascript enabled! Please enable it! বড়ঘাটদিয়া অপারেশন - সংগ্রামের নোটবুক
বড়ঘাটদিয়া অপারেশন
মুকসুদপুর থানা সফর শেষ করে দু’দিন বাড়িতে অবস্থান করলাম। তৃতীয় দিন সন্ধ্যার পর বড়ঘাটদিয়া অপারেশনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। ঐ এলাকার আওয়ামী লীগ কর্মীদের সহিত যােগাযােগ না থাকায় ওখানটায় আমাদের কে কোথায় আছে বা কার কোন রকম কার্যকলাপ কিছুই জানা ছিল না। তাই সরাসরি ঐ এলাকায় না গিয়ে বােয়ালমারী থানায় রূপাপার কালী নগরের বাবু সাহার বাড়ি গিয়ে উপস্থিত হলাম। বিরাট অট্টালিকাময় বাড়ি। ঐ বাড়ির উঠোনে গিয়ে ডাকাডাকি শুরু করলাম। প্রথমে তারা ডাকে সাড়া দিল কিন্তু ঐ বাড়িতে অবস্থানরত এক পরিচিত লােক আমার নাম শুনে চিনতে পেরে দরজা খুলে বের হয়ে আসল। বাবু সাহা বাড়িতে ছিল না। তার ছােট ভাই বিমল চন্দ্র সাহা বাড়িতে ছিল। সে ভেতর বাড়ির একটি ঘরে গােপনে থাকার ব্যবস্থা করে দিল। পরের দিন আমরা এমন ভাবে ওখানে আত্মগােপন করে থাকলাম যে ঐ এলাকার কেউ জানতে পারল না। বিকালে আমি স্থানীয় কয়েকজন আওয়ামী লীগ কর্মীকে গােপনে ডেকে এনে আমাদের উদ্দেশ্য তাদের নিকট ব্যক্ত করলাম। কিন্তু রাতে যখন আমরা বড়ঘাটদিয়া অপারেশন করার জন্য রওয়ানা হব, তখন কেউ ভয়ে সঙ্গে যেতে রাজী হল না। ফলে ঐ রাতে আমাদের অপারেশন প্রােগ্রাম স্থগিত রাখা হল। ঐ বাড়িতে রাতে না থেকে যদুনন্দী চলে আসলাম। ঐ গ্রামের ইদ্রিস নামে এক আওয়ামী লীগ কর্মী আমাদের গােপীনাথপুর হেমায়েত মিয়ার বাড়ি নিয়ে তাদের দালানের ভেতর গােপনে থাকার ব্যবস্থা করে দেয়। পরের দিন বড় ঘাটদিয়ার সাহেবের সহিত দেখা হলে তাকে ঐ গ্রামের মান্নান খাঁ ও চুন্ন মীরকে খবর দিয়ে আনার জন্য পাঠাই। তারা দু’জন বিকালে এসে আমাদের সঙ্গে দেখা করে। তাদেরকে বললাম রাতে আমাদের সাথে যেতে হবে।

আমাদের সঙ্গে যাওয়ার জন্য তারা রাজী হল। রাত প্রায় বারােটার সময় আমরা বড়ঘাটদিয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। দুই দলে বিভক্ত হয়ে একদল আলতাফ ও জাফরের কমান্ডে চান্দকাজীর বাড়ি অপারেশন করতে যায়। অন্যদল আজিজ মােল্লার কমান্ডে মওলানা মােহম্মদ আলীর বাড়ি যায়। আজিজ মােল্লার নির্দেশ ছিল আমি যখন মাওলানা সাহেবের বাড়ি গিয়ে প্রথম ফায়ার খুলব, তখন তােমরা ফায়ারের আওয়াজ শুনে আক্রমণ চালাবে। পূর্ব পরিকল্পনা মতাে আজিজ মােল্লা মাওলানা মােহম্মদ আলীর বাড়ি গিয়ে ঠিক মতাে পজিশন নিয়ে প্রথম ফায়ার করার সঙ্গে সঙ্গে অন্য দল চান্দকাজীর বাড়ি একই সময় আক্রমণ করল। বেশ কিছুক্ষণ ফায়ার করার পর যখন ইসরাইল মিয়ার ঘরের নিকট সবাই উপস্থিত এমন সময় লক্ষ্য করে দেখলাম রাত শেষ হয়ে আসছে। আমি তখন আজিজ মােল্লাকে বললাম, এখন আর ঘরে প্রবেশ  রশিদের সহিত পরামর্শ করে আবার নৌকো ছাড়লাম। তালমা হাট হতে কয়েকখান বাড়ি দূরে এক ঝােপের আড়ালে নৌকা রেখে আবার আক্রমণ পরিকল্পনার সম্বন্ধে পরামর্শ করা হল।

 আলতাফ, জাফর ও রশিদকে এক দলের পরিচালনার ও অন্য দলের দায়িত্ব দেওয়া হল হানিফ ও শাহজাহানকে। বেলা তখন প্রায় ডুবু ডুবু। সবাইকে বললাম, মাগরিবের নামাজের সময় শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের আক্রমণ করতে হবে। আমাদের নৌকা হাটের দুই দিকে ভিড়ান হল। কেউ আমাদের উপস্থিতি জানতে পারল না।
নৌকো হাটে ভিড়লে পূর্বে প্রেরিত ছেলেরা এসে পাকসেনা সহযােগীদের অবস্থান সম্মন্ধে খবর। দিল। তথাপি জাফর হাটের উপর নেমে ভালরূপে দেখে নৌকোয় ফিরল। নির্দেশ ছিল, আলতাফের দল আক্রমণ করবে বাদশা সিকান্দার যে ঘরে পাকসেনা সহযােগীদের নিয়ে। আলাপ আলােচনা করছিল সেখানে। আলতাফ ও রশিদ যথাক্রমে এমএমজি ও স্টেননা মেশিন গান দিয়ে ফায়ার শুরু করবে। অন্যদল ভিন্ন দিক হতে নেমে আক্রমণ করল। হঠাৎ আক্রমণ হওয়ায় হাটের লােকজন ভয়ে দৌড় শুরু করল। আমি এমনভাবে ছিলাম। যাতে দেখেই হঠাৎ কেউ চিনতে না পারে। পূর্ব নির্দেশ মতাে ৫ থেকে ১০ মিনিটের মধ্যে অপারেশন শেষ করে সবাই নৌকোয় ওঠে, নৌকা ছাড়ালাম। ওখানে বেশিক্ষণ দেরি করা নিরাপদ ছিল না। কারণ অল্পদূরেই খানসেনাদের যাতায়াতের জন্য সি এন্ড বি রােড ছিল। এই অপারেশনে ৮ জন দালাল মারা যায়। কিন্তু বাদশা শিকদার পালিয়ে গিয়েছিল, তাকে জাফর ধরে ফায়ার করলে মিস ফায়ার হয়। ফলে ছুটে পালিয়ে যায়, তখন আর জাফর তাকে দৌড়ে ধরতে যায়নি। অবশ্য জাফর তাকে বাদশা সিকদার বলে চিনত না। চিনলে নিশ্চয় যেতে দিত না। আলতাফ ও রশিদ যখন স্টেনাে মেশিনগান দিয়ে ব্রাশ করছিল, তখন পাকসেনা সহযােগীরা এমনভাবে ছটফট করতে করতে মরছিল, যেমন শিকারী পাখির ঝাকের উপর ফায়ার করলে পাখি ছটফট করতে করতে মরে। রাতে টিপ টিপ করে বৃষ্টি হচ্ছিল। সারা রাত বহু কষ্ট করে ভােরে এসে চান্দহাট পৌছলাম। (সূত্র ও মুক্তিযুদ্ধে বৃহত্তর ফরিদপুর, মােঃ সােলায়মান আলী।)

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত