You dont have javascript enabled! Please enable it!
সশস্ত্র প্রতিরােধ ৩য় বেঙ্গল
সাক্ষাৎকার ঃ মেজর মােঃ আনােয়ার হােসেন ১৯৭১ সাল ২৫শে মার্চ আমি সৈয়দপুর সেনানিবাসে ৩য় বেঙ্গলরেজিমেন্টের কোয়ার্টার মাস্টার হিসাবে নিযুক্ত ছিলাম। ১লা মার্চ ইয়াহিয়া খানের জাতীয় পরিষদ অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘােষণার পরিপ্রেক্ষিতে সৈয়দপুরে বাঙালি ও অবাঙালিদের ভিতরে প্রথমে তীব্র অসন্তোষ দেখা দেয় ও পরে অবাঙালিরা বাঙালিদের উপর হত্যাযজ্ঞ চালায়। এই পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাটালিয়নের জোয়ান ও অফিসারদের মধ্যে অস্ত্র ও গােলাবারুদ সব সময়ের জন্য দিয়ে দেওয়া হয়। কারণ, যে কোন সময়ে দেশের আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করতে হবে।  সেই সময় আমাদের কমান্ডিং অফিসার লেঃ কর্নেল ফজল করিম (পাঞ্জাবী), ২য় অধিনায়ক মেজর আক্তার (পাঞ্জাবী) ও ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার আব্দুল্লাহ খান মালিক (পাঞ্জাবী) আক্তার ব্যাটালিয়নকে ছত্রভঙ্গ করার উদ্দেশ্যে বাঙালি অফিসার দ্বারা বিভিন্ন কোম্পানীকে অসহযােগ আন্দোলনের সময় বিভিন্ন জায়গায় দেশের আইন শৃঙ্খলা বজায় রাখবার জন্য পাঠায় ঃ ১। মেজর নিজাম, লেঃ মােখলেস ও ২য় লেঃ রফিকসহ বিওডি কোম্পানীকে রংপুর জেলায় ঘােড়াঘাটে পাঠানাে হয়; ২। ক্যাপ্টেন আশরাফকে সৈয়দপুর ও দিনাজপুর রােডের মধ্যবর্তী মওলপাড়া নামক স্থানে বৈদ্যুতিক সংযােগস্থল পাহাড়ার জন্য ৪০ জন জোয়ান দিয়ে পাঠান হয়; ৩। সুবেদার রহমতুল্লাহ ও অবাঙালি মেজর শাফায়েৎ হােসেনকে সঙ্গে দিয়ে ১ প্লাটুন পার্বতীপুর পাঠান হয়; ৪। মর্টার প্ল্যাটুনের জোয়ানদের মর্টার রেখে দিয়ে শুধু রাইফেল দিয়ে শহরের অনতিদূরে পাওয়ার হাউস পাহরার জন্য পাঠান হয়। ১৭ই মার্চ অয়ারলেস সেট ও ভারী হাতিয়ারগুলি ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টার থেকে ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা হয়।  আমি কোয়ার্টার মাস্টারের দায়িত্বে থাকায় ব্যাটালিয়ন হেড কোয়াটারের কাজে নিয়ােজিত ছিলাম।
সেই সময় দেশের পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ ছিল। ২৪শে মার্চ আমাকে এবং আমাদের ব্যাটালিয়নের সুবেদার মেজর হারিসকে ব্রিগেডিয়ারের অফিসে ডাকা হয়। ব্রিগেডিয়ার আমাকে ও সুবেদার মেজর সাহেবকে বাইরের গুজব না শুনে শৃঙ্খলার সাথে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেন, কিন্তু আমাদের ২য় অধিনায়ক মেজর আক্তারের সাথে রুদ্ধদ্বার কক্ষে বহু সময় আলাপ আলােচনা করেন। এতে আমাদের মনে আরাে সন্দেহের ভাব উদয় হয়। ২৮ শে মার্চ মণ্ডলপাড়া থেকে ক্যাপ্টেন আশরাফ অফিসে আসে এবং আমাকে দেশের বর্তমান পরিস্থিতি সম্বন্ধে জানায়। তখন ২৩ ফিল্ড রেজিমেন্টে ১ জন বাঙালি অফিসার লেঃ সালামকেও ডাকা হল। তিনজন রুদ্ধদ্বার কক্ষে ভবিষ্যতে কি কর্মপন্থা অবলম্বন করতে হবে তা নিয়ে আলােচনা করি। সৈয়দপুর সেনানিবাসে অপর যে দুইটি ব্যাটালিয়ন ছিল ঐ ব্যাটালিয়ান দুইটির ৩১শে মার্চ রাত্রে বগুড়ায় চলে যাওয়ার কথা ছিল। আমরা ঐ সময়ে সৈয়দপুর সেনানিবাস দখল করার সিদ্ধান্ত নিই। সেই অনুযায়ী ক্যাপ্টেন আশরাফকে এক ট্রাক গােলা বারুদ মণ্ডলপাড়া নিয়ে যাওয়ার জন্য দিয়ে দিই।  ৩১শে মার্চ রাত্রি আড়াই ঘটিকার সময় ২৬ এফএফ ব্যাটালিয়ন, ৩/২৩ ফিল্ড রেজিমেন্ট গােলন্দাজবাহিনী আমাদের ব্যারাকের উপর অতর্কিতভাবে আক্রমণ চালায় কিন্তু আমরা সর্তক থাকায় সকাল ১০টা পর্যন্ত উভয় পক্ষে গুলি বিনিময় হয় এবং তারা  রােডে বসানাে হয় ; (২) আমি আমার কোম্পানী নিয়ে ঘােড়াঘাট চরখাই রােডে ডিফেন্স নিই; (৩) লেঃ মােখলেসের কোম্পানীকে ডেপথ কোম্পানী হিসাবে রাখা হয়।
১৩ই এপ্রিল সংবাদ পাওয়া গেল পাকবাহিনী বগুড়া দখল করে নিয়েছে। তাই পাকবাহিনী বগুড়া জয়পুরহাট ও পাঁচবিবি রােড হয়ে হিলি দখল করে নিতে পারে ভেবে ১৪ই এপ্রিল আমি আমার কোম্পানী নিয়ে পাঁচবিবি-হিলি রােডে ডিফেন্স নিই। অপর ২ কোম্পানী চরখাইতেই ডিফেন্স নিয়ে থাকে। ১৯ শে এপ্রিল পাকবাহিনী পাঁচবিবির দিক থেকে হিলি আক্রমণ করে। সেই দিন পাকবাহিনীর সাথে আমাদের চার ঘন্টা যুদ্ধ চলে। এই যুদ্ধে পাকবাহিনীর অনেক সৈন্য নিহত হয় ও আমাদের তীব্র আক্রমণের মুখে তারা পিছন হটতে বাধ্য হয়। সেই দিন চরখাই থেকে ২ কোম্পানীকে হিলিতে চলে আসার নির্দেশ দিই। সেই সময় ক্যাপ্টেন আশরাফ ও লেঃ মােখলেস তাদের জোয়ানদের ফেলে চলে যায়।  ২০শে এপ্রিল সুবেদার হাফিজ, নায়েক সুবেদার করম আলী ও নায়েক সুবেদার শহীদুল্লাহ দুই কোম্পানীসহ হিলিতে আমার নিকট পৌছে। সেই দিন খুব জোরে পাকবাহিনী আমাদের উপর আক্রমন করে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পাকবাহিনীর সাথে আমাদের তীব্র যুদ্ধ চলে। অবশেষে পাকবাহিনী পেছন হটতে বাধ্য হয়। এদিকে পাকবাহিনীর মর্টার ও শেলিং-এ ভারতীয় সীমান্তের কয়েকজন ভারতীয় নাগরিক নিহত হয়। ভারতীয় বিএসএফ কর্নেল মুখার্জী, পশ্চিম দিনাজপুরের ডিএম ও পুলিশ সুপারের অনুরােধে ২০ তারিখ গভীর রাতে আমাদের ডিফেন্স ভেঙ্গে দিয়ে হিলি থেকে ১৩ মাইল দূরে ভারতের কামালপাড়া নামক স্থানে কুরমাইল বেসিক ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে ২৫০ জনের মতাে জেসিও জোয়ান আশ্রয় নিই। এই যুদ্ধে ৬জন জোয়ান শাহদাৎ বরণ করে। সীমান্ত অতিক্রম করার পূর্বে চরখাই ও হিলি সরকারী গুদাম থেকে ৪শত বস্তা চাউল নিয়ে যাই। ২১শে এপ্রিল পাকবাহিনী হিলি দখল করে নেয়। 
ভারতে অবস্থান কালে এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহে কামারপাড়া, সােবরা এবং আঙ্গিনাবাদে তিনটি অপারেশন ক্যাম্প স্থাপন করি। সুবেদার হাফিজকে আঙ্গিনাবাদ ক্যাম্প কমাণ্ডার, সুবেদার আলী নেওয়াজকে কামারপাড়া ক্যাম্প কমাণ্ডার ও জয়পুরহাট চিনি মিলে একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারকে সােবরার ক্যাম্প কমাণ্ডার হিসাবে নিযুক্ত করে আমি উক্ত তিনটি শিবির পরিচালনা করি।
সেই সময় বাংলাদেশের কমাণ্ডার-ইন-চীফ কর্নেল এমএজি ওসমানী বালুরঘাট আসেন। এবং আমাকে হিলি সেক্টর কমাণ্ডার হিসাবে নিযুক্ত করেন। ১৩ই মে পর্যন্ত আমি হিলি সেক্টর কমাণ্ডারের দায়িত্ব পালন করি। আমি কমাণ্ডার থাকাকালে আরাে তিনটি ক্যাম্প স্থাপন করি—মালন ক্যাম্প, তরঙ্গপুর ক্যাম্প ও তপন ক্যাম্প। মেজর নজমুল হক আমার নিকট থেকে দায়িত্ব ভার বুঝে নেন এবং তৎকালীন মেজর বর্তমান কর্নেল শাফায়েৎ জামিল ৩য় বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক নির্বাচিত হন। আমি আঙ্গিনাবাদ ক্যাম্প কমাণ্ডার হিসাবে দায়িত্বভার গ্রহণ করি। এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে মে মাসের ২য় সপ্তাহ পর্যন্ত গেরিলা পদ্ধতি গ্রহণ করা হয় ও পাকবাহিনীর চলাচলের পথে এ্যাম্বুশ করে পাকবাহিনীকে নাজেহাল ও তাদের ক্ষতি সাধন করা হয়। তার মধ্যে উল্লেখযােগ্য, জয়পুরহাট রেলওয়ে স্টেশন অপারেশন করে পাকবাহিনীকে সেখান থেকে প্রতিহত করে ২ ট্রাক ঔষধ, ৬০ বস্তা চিনি ও কিছু কাপড় নিয়ে আসা হয়।
২৯শে মে গােপন সূত্রে খবর পেয়ে এক কোম্পানী বেঙ্গলরেজিমেন্ট ও ইপিআর-এর জোয়ান নিয়ে হরতাকিডাঙ্গা নামক স্থানে পাকবাহিনীর গতিপথের উপর এ্যাম্বুশ করি। সেই সময় পাকবাহিনীর এক কনভয় উক্ত পথ দিয়ে যাচ্ছিল আমাদের অতর্কিত আক্রমণে পাকবাহিনীর একজন অফিসারসহ আনুমানিক ৩০ জন নিহত হয় ও একখানা জীপ ধ্বংস হয়। আমাদের পক্ষে ইপিআর-এর জলিল শাহাদৎ বরণ করে। সেখানে একটি পিআরসি১০ আয়ারলেস সেট ও একটি এসএমজি উদ্ধার করি। ২৮শে মে দিনাজপুর ফুলবাড়ি রােডে মােহনপুর ব্রীজ এক্সপ্লোসিভ দ্বারা উড়িয়ে দেওয়া হয় এবং সেখানেই এ্যাম্বুশ বসান হয়। ২৯শে মে ১০-১০ মিনিটে পাকবাহিনীর এক কোম্পানী ঐ পথে অগ্রসর হওয়ার সময় আমরা অতর্কিত আক্রমণ করি। সেখানে পাকবাহিনীর সাথে আমাদের চার ঘণ্টা গুলি বিনিময় হয়। এখানে পাকবাহিনীর ১১জন নিহত হয় ও ২০ জন আহত হয়। আমাদের পক্ষে ২জন শহীদ হয় ও একজন আহত হয়। তাছাড়া জুন মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত রামগতি, ফুলবাড়ী, চরখাই, রামনগর, জলপাইতলী, বাজাই, আমবাড়ী, গৌরীপুর, মন্মথপুর রেলওয়ে স্টেশনের রেইড, কমাণ্ডো ও এ্যাম্বুশ করে পাকবাহিনীর বহু ক্ষতি সাধন করি। (সূত্রঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, নবম খণ্ড ।)

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!