You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.03.21 | কুষ্টিয়া-যশােরের সশস্ত্র প্রতিরােধ - সংগ্রামের নোটবুক
কুষ্টিয়া-যশােরের সশস্ত্র প্রতিরােধ
সাক্ষাৎকার ও মােহাম্মদ তৌফিক ই-এলাহী চৌধুরী ২১-২২-২৩শে মার্চ আমরা নিম্মলিখিত কয়েকজন অফিসার তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যালােচনার জন্য তদানীন্তন এসডিপিও জনাব মাহাবুবউদ্দীন আহমদের বাসায় (ঝিনাইদহে) একত্রিত হই। আর ছিলেন, ১। তৌফিক এলাহী, এসডিও, মেহেরপুর, ২। কামালউদ্দীন সিদ্দিকী, এসডিও, নড়াইল, ৩। ওয়ালিউল ইসলাম, এসডিও, মাগুরা, ৪। শাহ মােহাম্মদ ফরিদ, এসডিও, গােয়ালন্দ। আলােচনায় আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে, একটা সামরিক সংঘর্ষ অবধারিত। এই বৈঠকে নিজ নিজ এলাকায় প্রতিরােধ গড়ে তােলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। আমি আমার এলাকায় সমস্ত থানার পুলিশদের প্রস্তুত রাখি। ২০শে মার্চ রাতে নূরুল হক এমপি আমাকে টেলিফোনে জানালেন যে, ঢাকায় পাকসেনাবাহিনী শহরে বের হয়ে পড়েছে এবং জনগণের উপর আক্রমণ চালিয়েছে। আমি তাকে আমার বাসায় আসতে অনুরােধ করি। অনুসন্ধান করে জানতে পারলাম যে, ঢাকা  টেলিফোন এক্সচেঞ্জ কুষ্টিয়া থেকে ঢাকায় সেনাবাহিনীর আক্রমণের খবর জানিয়েছে এবং কুষ্টিয়া এক্সচেঞ্জ মেহেরপুরে এই খবর জানিয়েছে। প্রথমে কুষ্টিয়ার সাথে টেলিফোনে যােগাযােগ করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু যােগাযােগ তার আগেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তারপর আমি পুলিশ অয়ারলেস থেকে ঢাকাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের সাথে যােগাযােগ করি। একজন অজ্ঞাতনামা অপারেটর রাজারবাগ থেকে উত্তর দেয়, যা বলার বলেছি তাে, আর বিরক্ত করবেন না। আবার অনুরােধ করায় আর কোন উত্তর পাওয়া গেল না।
২৫শে মার্চ রাত বারােটার মাইকে কুষ্টিয়া শহরের জনগণকে ঢাকাতে পাকবাহিনীর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কথা জানিয়ে দেয়া হল। সেই মুহূর্ত থেকে আমি আর পাকিস্তানী সরকারী কর্মচারী রইলাম না। এবং জনগণের আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘােষণা করলাম। মেহেরপুরের আনসার কমাণ্ডারকে আমি আদেশ দিই ২৬শে মার্চের মধ্যে মেহেরপুর মহকুমার সমস্ত আনসার ও মুজাহিদকে একত্র করার জন্য। ২৬শে মার্চ সকাল বেলা। আমার ধারণা হয়েছিল মেহেরপুরকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। আমার কাছে মনে হল সমস্ত জনতার মধ্যে এক অভাবনীয় পরিবর্তন এসেছে এবং প্রত্যেকে তার একক সত্ত্বাকে বিসর্জন দিয়ে এক সম্মিলিত সত্বায় রূপান্তরিত হয়েছে। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেরণা এবং এর অবশ্যম্ভাবী বিজয়ের শক্তি এই জনতার নব রূপান্তরিত সত্ত্বার মধ্যে নিহিত ছিল। প্রত্যেকটা লােক এবং প্রত্যেকটা ছেলে আমার কাছে নতুন ভাবে ধরা দিয়েছিল। গায়ের বধূরা পর্যন্ত এই স্বতঃস্ফূর্ত গণজাগরণে অঙ্গাঙ্গীভাবে একাত্মতা অনুভব করেছিল। সেই মুহূর্তে আমি যেন দিব্যচক্ষে পৃথিবীর বড় বড় বিপ্লবকে চাক্ষুষ দেখতে পেলাম। সমগ্র পরিস্থিতিতে আমার ব্যক্তিগত মূল্যায়নে আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে, আমাদের যে কোন জায়গা থেকে অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করতে হবে। এবং শুধুমাত্র ভারতই আমাদের এই সাহায্য করতে পারে। দ্বিতীয়তঃ, ভারত-পাকিস্তানের ঐতিহাসিক বিরােধের পটভূমিকারয় এটা সুস্পষ্ট ছিল যে, বাংলাদেশের যে কোন সামরিক বা গণঅভ্যুত্থান ভারতের সমর্থন পাবেই। তাই ২৬শে মার্চ সকালে আমি দু’রকম চিঠি ভারতে পাঠাই। একটা চিঠি পাঠান হয়েছিল নদীয়া জেলা প্রশাকের কাছে, যার একটা অনুলিপি পাঠাই লেফটেন্যান্ট কর্নেল চক্রবর্তী ‘সিও, ৭৬ বিএসএফ যা মেহেপুর সীমান্তের ভারতে মােতায়েন ছিল-এর কাছে। দ্বিতীয় চিঠি আমি ভারতবর্ষের জনগণকে উদ্দেশ্য করে পাঠাই।
দু’টো চিঠিতেই আমি আমার দস্তখত এবং সরকারী সিলমােহর ব্যবহার করি। দ্বিতীয় চিঠিটা অমৃত বাজার’ এবং যুগান্তর; পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ২৭/২৮/২৯/৩০ মার্চ-এর সংখ্যাগুলােতে। ডেস্টিনেশন মুজিবনগর’ নামক বইটিতে একটা চিঠির ফটোস্টেট কপি মুদ্রিত হয়েছে। প্রথম চিঠিটা নদীয়ার জেলা প্রশাসক মিঃ মুখার্জীর কাছে লেখা হয়েছিল। কর্নেল চক্রবর্তী আমাকে বলেছিলেন যে, এই চিঠিটা দিল্লীতে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে অনতিবিলম্বে প্রেরণ করা হয়েছিল এবং তারই ফলস্বরূপ ২৯শে মার্চ বেতাই (ভারতে) বিওপিতে আমাকে দেখা করার জন্য খবর পাঠান হয়। | ২৯শে মার্চ আমি বেতাই বিওপিতে যাই। নদীয়া জেলা প্রশাসক এবং কর্নেল চক্রবর্তী আমাকে সাদরে গ্রহণ করেন এবং স্থানীয় বিএসএফ-এর একটি ছােট দল গার্ড অব অনার প্রদর্শন করে। আমি এবং কর্নেল চক্রবর্তী গার্ড অব অনার পরিদর্শন করি। নদীয়া জেলা প্রশাসক আমাকে বাংলাদেশের আনঅফিসিয়াল দূত হিসেবে মর্যাদা দেন।
গাড়িতে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড্ডীয়মান ছিল। রাস্তার দু’পাশে জনতা মুহুর্মুহু জয় বাংলা শ্লোগান দিয়ে আমাদেরকে সম্বর্ধনা জানাচ্ছিল। এই দুটো জীপ গাড়ি যেন তাদের কাছে স্বাধীনতার শক্তিশালী প্রতীক হিসেবে প্রতীয়মান হচ্ছিল। এরা অনেকেই আমাদেরকে চিনত। গ্রামবাসীরা বুঝতে পেরেছিল যে, আমরা কোন গােপন মহৎ সামারিক উদ্দেশ্যে সীমান্তে ঘােরাফেরা করছি। পথে পথে দেখতে পেলাম স্বতঃস্ফূর্ত জনতা প্রতিরােধ গড়ে তুলছিল, অস্ত্র বলতে ছিল হয়ত একটা দুটো শর্টগান। তখনই এদের মধ্যে জন্ম নিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের নিউক্লিয়াস, এবং আমরা পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম যে ভবিষ্যত প্রস্তুতি, সামরিক প্রতিরােধ এবং সংঘর্ষে শক্তি এবং প্রেরণা এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অথচ দলবদ্ধ জনতাই জোগাবে। | সন্ধ্যার পরে পরে আমরা চেংখালী চেকপােস্টে পৌছিলাম। বড় বড় শিরিষ গাছের সারি দু’পাশে থেকে রাস্তায় উপরে একটা লম্বা ছাতার মতাে আবরণ সৃষ্টি করেছিল। কোন লােকালয় দৃষ্টিগােচর হচ্ছিল না, চারদিক খাঁ খাঁ করছিল এবং অপসৃয়মান গােধূলীর আলােয় সমস্ত এলাকায় থমথমে অলৌকিক, অশরীরী পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। শুক্লপক্ষের স্নান চাদের আলাে পরিবেশকে আরাে গভীরতর করে তুলেছিল। পেছনে গাড়ি দুটো রেখে আমি এবং মাহবুব ধীরে সতর্কতার সাথে অপরিচিত গন্তব্যস্থানের দিকে আন্দাজের উপর ভর করে এগুচ্ছিলাম। বার বার আমাদের গায়ের লোেম শিউরে উঠছিল। প্রায় আধ মাইল চলার পর সামনে একটা পাকা ঘরের ধ্বংসাবশেষ দেখতে পেলাম, আমরা বুঝতে পারছিলাম না আমরা কোথায় যাচ্ছি।
হঠাৎ সেই ভূতুড়ে ধ্বংসস্তুপ থেকে যেন এক অশরীরী আত্মার আওয়াজ শুনতে পেলাম-হলুট’। যদিও আমরা একটু ভড়কে গিয়েছিলাম তবুও অনতিবিলম্বে ঝােপের আড়াল থেকে একটা মানুষের ছায়া বের হয়ে এল। এবং সেটা ছিল ভারতীয় বিএসএফ-এর একজন সিপাহী, আমাদের পরিচয় দেবার পর সে আমাদেরকে তাদের বিওপিতে নিয়ে চলল। আরাে আধা মাইল চলার পর আমরা বিওপিতে পৌঁছলাম এবং আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানালেন উচ্চপদস্থ কর্মচারী জনাব গােলক মজুমদার এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল চক্রবর্তী। আনুষাঙ্গিক আলােচনার পর দুটো সিদ্ধান্ত নেয়া হল ঃ ১। আমাদেরকে আগামীকাল থেকে সামরিক অস্ত্রশস্ত্র দেয়া হবে এবং ২। ভারতীয় সামরিক কর্তৃপক্ষের সাথে আওয়ামী লীগের রাজনীতিবিদদের যােগাযােগ করিয়ে দিতে হবে এবং যথাসম্ভব প্রচেষ্টা চালাতে হবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সাথে যােগাযােগ করার। তখনও তারা জানতেন না যে, আমাদের সাথে জনাব তাজউদ্দীন এবং ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম রয়েছেন। আমি এবং মাহাবুব নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলােচনা করে ঠিক করলাম যে, আমাদের সাথে যে তাজউদ্দীন রয়েছেন তা গােলক মজুমদারকে জানাব এবং গােলক মজুমদারকে জানালাম। গােলক মজুমদার আনন্দে উচ্ছসিত হয়ে তাড়াতাড়ি তাজউদ্দীন সাহেবকে তাঁর কাছে নিয়ে আসতে বললেন। আমরা তাজউদ্দীনকে তাঁর কাছে নিয়ে এলাম। তারা একে অপরকে আন্তরিকভাবে করমর্দন এবং আলিঙ্গন করলেন। গােলক মজুমদার আমাদেরকে বলেছিলেন যে, কলকাতার দমদম বিমান বন্দরে একটি সামরিক জেট বিমান অপেক্ষা করছে। যদি কোন রাজনীতিবীদ আসে তবে তাকে যেন তক্ষুনি দিল্লীতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। হয়ত ঐ প্লেনেই জনাব তাজউদ্দীন এবং ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম দিল্লীতে গিয়েছিলেন। রাতে আমরা এক সাথে খাবার খাই। গােলক মজুমদার তাজউদ্দীন এবং ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামকে নিয়ে যান। এবং আমরা চুয়াডাঙ্গা অভিমুখে যাত্রা করি।
এই সাক্ষাৎকারের পর ভারত থেকে আমরা কম-বেশি অস্ত্রশস্ত্র, গােলারারুদ এবং জ্বালানি পেতে থাকি। আমি নিজে প্রায় এক পক্ষকাল ধরে একা সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র ভারত থেকে নিয়ে আসতাম। এই সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র চেংখালী চেকপােস্টের বিপরীত দিকে ভারতীয় বিওপি থেকে নিয়ে আসতাম। আমি প্রায় প্রত্যেক সন্ধ্যায় ভারত সীমান্ত অভিমুখে চুয়াডাঙ্গা থেকে যাত্রা করতাম। সাথে থাকত ইপিআর-এর দুটো এসকর্ট পেট্রল, কয়েকটা ট্রাক এবং কোন কোন সময় দর্শনা চিনিকলের ট্রাক্টর এবং তার সাথে লাগানাে ট্ৰলী। এই অস্ত্রশস্ত্র গ্রহণ করার সময় আমি ভারতীয় কাগজপত্রে দস্তখত করে নিতাম এবং মেহেরপুরের এসডিও-র সরকারী সীলমােহর ব্যবহার করতাম।
মধ্যরাতের দিকে আমরা ভারতীয় বিওপিতে পৌঁছতাম এবং চুয়াডাঙ্গার ফেরত আসতে আসতে অধিকাংশ সময়েই ভাের হয়ে যেত। এই সময় এক নাগাড়ে আমি দশ দিনের মতাে বিছানায় গা লাগাতে পারিনি। অস্ত্রশস্ত্র দেবার সময় অনেক সময় কর্নেল চক্রবর্তী থাকতেন এবং সব সময় ক্যাপ্টেন মহাপাত্র থাকতেন। এপ্রিল মাসের ১০তারিখ থেকে আমরা অস্ত্রশস্ত্র বেতাই বিওপি (যা মেহেরপুর মহকুমার সংলগ্ন ছিল) থেকে সংগ্রহ করতাম। ২৫শে মার্চ রাতে মেহেরপুর চুয়াডাঙ্গা এবং কুষ্টিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়। কুষ্টিয়া এবং চুয়াডাঙ্গার খবরাখবর আমরা নিতে থাকি। আমরা খবর পাই যে, চুয়াডাঙ্গায় অবস্থিত ইপিআর বাহিনী বিদ্রোহ ঘােষণা করেছে এবং মেজর ওসমান চুয়াডাঙ্গায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আমি জানতে পেরেছিলাম যে, চুয়াডাঙ্গার সাধারণ ইপিআর-এর জোয়ানরা সম্মিলিতভাবে বিদ্রোহ ঘােষণা করেছে এবং বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেছে। চুয়াডাঙ্গার এই সিদ্ধান্তে ইপিআর-এর সাধারণ সৈনিকদের মুখ্য ভূমিকা এবং ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের এই সাহসিকতা এবং দেশপ্রেম বাংলাদেশের এই এলাকার মুক্তিদ্ধের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখা উচিত। চুয়াডাঙ্গায় অবস্থিত ইপিআর-এর ক্যাপ্টেন আজম চৌধুরীর ভূমিকা এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। মেজর ওসমান কুষ্টিয়া থেকে ২৭/২৮শে মার্চ চুয়াডাঙ্গা আসেন এবং তিনিও এই সিদ্ধান্তের প্রতি দৃঢ় সমর্থন জানান। দু’জন সামরিক অফিসারের নেতৃত্বে খাকি পােশাক পরিহিত এবং সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এই ইপিআর বাহিনী কুষ্টিয়া জেলা, পাবনা জেলার বহুলাংশে, যশােরের কিয়দংশ, এমন কি ফরিদপুরের গােয়ালন্দ ঘাট পর্যন্ত বাংলার সাধারণ জনগণের চোখে স্বাধীনতার সূর্য সৈনিক হিসেবে প্রতীয়মান ছিল। আজ শহীদ হাবিলদার মেজর মুজিবর রহমান, সুবেদার মুজাফর, সুবেদার মুকিত এবং আরাে অনেক চেনা মুখের কথা বার বার মনে পড়ছে। সেই দুর্যোগপূর্ণ মুহূর্তে এরা আমার জন্যও আশার প্রতীক হিসেবে প্রােজ্জ্বল ছিলেন।
দু’এক দিনের মধ্যেই চুয়াডাঙ্গার সাথে মেহেরপুরের যােগাযােগ স্থাপিত হয় এবং আমি মেজর ওসমানের সাথে চুয়াডাঙ্গায় সাক্ষাৎ করি। ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সাথে আলাপআলােচনার বিষয়বস্তু তাঁকে অবহিত করি। মেজর ওসমান আমাকে প্রয়ােজনীয় সামরিক অস্ত্রসম্ভার সম্বন্ধে ধারণা দেন। | এখানে উল্লেখযােগ্য যে, গােয়ালন্দের তৎকালীন এসডিও জনাব শাহ মােহাম্মদ ফরিদ সস্ত্রীক মেহেরপুরে বেড়াতে এসে আটকা পড়ে যান। তাঁকে মার্চের ২৭/২৮ তারিখ .গােয়ালন্দে ফেরত যাবার বন্দোবস্ত করি। জনাব ফরিদ তার স্বীয় মহকুমার এই স্বাধীনতা সংগ্রামকে জোরদার করার জন্য অত্যাধিক উৎসাহ দেখান এবং এই দুর্যোগের সময় গােয়ালন্দে ফেরত যান। তিনি পরে পাকিস্তানসেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন এবং অমানুষিক ভাবে নির্যাতিত হন। তিনি ১৯৭১-এর ডিসেম্বর মাসে মুক্তি পান।
চুয়াডাঙ্গাতে ইতিমধ্যে কিছু সিদ্ধান্ত এবং কর্মসূচী নেয়া হয়েছিল : ১। ইপিআর উইং হেডকোয়ার্টার চুয়াডাঙ্গা এবং তার অধীনস্থ বিওপিতে সমস্ত অবাঙালি ইপিআরকে নিরস্ত্র করা, ২। কুষ্টিয়া জেলায় পাকিস্তানসেনাবহিনীর মােতায়েন সম্বন্ধে বিশদ খবরাখবর সংগ্রহ করা, ৩। কুষ্টিয়ার উপর একটা আক্রমণ পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন করা। এই মিশনের জনশক্তি যােগাবে একদিকে ইপিআর, অন্যদিকে আনসার, মুজাহিদ এবং সাধারণ ছাত্র-জনতা। আক্রমণ এবং অবরােধ মােটামুটি ত্রিমুখী হবে। এক দিকে জনাব মাহাবুবউদ্দীন আহম্মদ ঝিনাইদহ কুষ্টিয়া রাস্তা অবরােধ করবেন এবং ইপিআর, আনসার, মুজাহিদদের একটি দল কুষ্টিয়া অভিমুখে অগ্রসর হবে। অন্যদিকে মেহেরপুর থেকে ইপিআর, মুজাহিদ, আনসারের একটি দল কুষ্টিয়া অভিমুখে যাবে। অপরদিকে প্রাগপুরভেড়ামারা-কুষ্টিয়া থেকে ইপিআর বাহিনী কুষ্টিয়া অভিমুখে অগ্রসর হবে। এই সম্মিলিত বাহিনীর নেতৃত্ব দেবেন ক্যাপ্টেন আজম চৌধুরী।  প্রথমে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল যে, এই আক্রমণ ২৯শে মার্চ ভাের পাঁচটার সময় শুরু করা হবে। পরে এই সিদ্ধান্ত ২৪ ঘণ্টা পিছিয়ে দেয়া হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২২ ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের অনধিক দুই কোম্পানী সৈন্য কুষ্টিয়ার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলাে পাহারা দিচ্ছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখযােগ্য যে, ২২ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেকি এবং সাপাের্ট ব্যাটালিয়নে একটা অংশ ছিল। এদের ফায়ার পাওয়ার, মােবিলিটি এবং কমিউনিকেশন পাকিস্তানের অন্যান্য সাধারণ পদাতিক ব্যাটালিয়নের চেয়ে অনেক বেশি ছিল। শহরের উপকণ্ঠে, অনেকটা অবরােধের মতে, প্রথমে মুক্তিবাহিনীকে—যার মধ্যে ইপিআররা ছিলেন মূলশক্তি—মােতায়েন করা হয়। অস্ত্রশস্ত্রের মধ্যে ছিল পুরনাে ৩০৩ রাইফেল এবং কিছু পুরনাে এসএমজি। ইপিআর ছাড়া আনসার এবং মুজাহিদদের কাছে ১০ রাউণ্ড বা অনুর্ধ ২০ রাউণ্ডের মতাে গুলি ছিল। 
৩০শে মার্চ সকালে অবরােধ স্থানগুলাে থেকে যুগপভাবে পাকিস্তানসেনাবাহিনীর বিভিন্ন অবস্থানের উপর অতর্কিতে গুলিবর্ষণ শুরু করা হয় এবং সাথে সাথে আমাদের প্রত্যেকটি অবস্থানের পেছনে সমবেত হাজার হাজার লােক গগন বিদারী আওয়াজে জয় বাংলা’ ধ্বনি তােলে এবং শ্লোগান দিতে দিতে মুক্তিযােদ্ধারা অগ্রসর হতে থাকে। পাকিস্তানসেনাবাহিনী এই অতর্কিত আক্রমণে, জনতার এই আকাশফাটা চিৎকারে এবং রাইফেল ছাড়াও কিছু স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের আওয়াজে দিশেহারা এবং ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। এটা তাদের কল্পনাতীত ছিল যে, বাঙালি ইপিআর-এর জোয়ানরা ঐ অল্প সময়ের মধ্যে তাদের নিজেদেরকে সংগঠিত করে সুসজ্জিত পাকিস্তানসেনাবাহিনীর অবস্থানের উপর আক্রমণ করার দুঃসাহস করবে। পাকিস্তানসেনাবাহিনীর বিক্ষিপ্ত দলগুলাে এই আক্রমণের মুখে তাদের কুষ্টিয়া সেনাবাহিনী সদর দফতরের দিকে পিছিয়ে পড়তে থাকে। তাদের এই পশ্চাদপসরণে আমাদের মুক্তিযােদ্ধাদের সাহস ও মনােবল দ্বিগুণ বৃদ্ধি পায়। পাকিস্তানসেনাবাহিনীর জন্য এই আক্রমণ ছিল সম্পূর্ণ বিভ্রান্তিজনক। কারণ, তারা বুঝতে পারেনি কারা কোথা থেকে তাদের উপর এই আক্রমণ চালাচ্ছে এবং কেন? এই পশ্চাদপসরণ তাদের জন্য কাল হল। কারণ প্রত্যেকটা ঘটনার সাথে সাথে তাদের মনােবল ভেঙে যাচ্ছিল এবং আমাদের মনােবল উত্তরােত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এভাবে যুদ্ধ সারাদিন চলতে থাকে। সন্ধ্যার দিকে তারা তাদের অবস্থান থেকে পুল আউট করে কুষ্টিয়া জেলাস্কুল এবং সার্কিট হাউসে একত্রিত হতে থাকে।
এবং এটাই তাদের জন্য কাল হয়। আমরাও তাদের দিকে অগ্রসর হতে থাকি। আমাদের অবরােধ তিন দিক থেকে এসে জেলা স্কুল এবং সার্কিট হাউস ঘিরে ফেলে, যদিও তখন পর্যন্ত কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ রাস্তার কয়েক মাইল জনশক্তির অভাবে আমাদের আয়ত্তাধীন ছিল না। পরে অবশ্য আমরা এই দল থেকে বন্দি লেফটেন্যান্ট আতাউল্লার কাছ থেকে জানতে পারি যে, মেজর শশায়েব এবং অন্যান্য অফিসাররা রি-ইনফোর্সমেন্ট-এর জন্য বার বার অনুরােধ জানাচ্ছিলেন যশাের সদর দফতরকে। কিন্তু যশাের সদর দফতর তাদেরকে কোন সাহায্যের আশ্বাস | দিচ্ছিল না। এতে তথাকথিত দুর্ধর্ষ ২২ এফ এফ সেনাবাহিনী একেবারে ইঁদুরের মতাে হয়ে যায়। তারা পালাবার পথ খুঁজতে শুরু করে। ৩১শে মার্চ থেকে তারা পলায়ন করতে শুর করে। মুক্তিবাহিনীর সাথে সংর্ঘষে আনুমানিক ২০ জন পাকিস্তানী সৈন্য হতাহত হয়েছিল। বাকি দুই কোম্পানীর অনধিক সৈন্য সবাই জনতার সাথে সংঘর্ষে নিহত হয়। এখানে উল্লেখযােগ্য যে, কুষ্টিয়া হতে ঝিনাইদহের পথে একটা পুলের উপর মুক্তিবাহিনী একটা বিরাট খাদ খনন করে ক্যামােফ্লেজ করে রেখেছিল। মেজর শােয়েব এবং ২২ এফ. এফ-এর কিছু অফিসার এবং সৈনিক গাড়িতে করে যশােরের দিকে পশ্চাদপসরণ করার সময় এই খাদে পড়ে যায় এবং তারপর যারা বাঁচতে পেরেছিল তারা পার্শ্ববর্তী গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। বাংলার সাধারণ মানুষের এই সময়কার সাহসিকতা পৃথিবীর ইতিহাসেও বিরল। তাদের স্বয়ংক্রিয় মারণাস্ত্রের বিরুদ্ধে অনেক সাধারণ বাঙালি । তবুও ২২ এফ এফ-এর কেউ শহরে ফিরে যেতে পারেনি। কুড়াল, কাস্তে বা কোন সময় একেবারে খালি হাতে কোন সময় বা গাছ থেকে অতর্কিত সাধারণ জনগণ এদের মােকাবেলা করে। আমরা ১লা এপ্রিল থেকে অনবরত এই গ্রামের লােকজনের কাছ থেকে অস্ত্রশস্ত্র পেতে থাকি যা তারা পাকসেনাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল।
আজও একটা কিশােরের কথা মনে পড়ে, যে একটা শটগান নিয়ে তিনজন পাকসেনাকে অসুসরণ করে, যাদের হাতে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ছিল। সে নিজের বুদ্ধিবলে শটগান দিয়ে তিনজন পাকসেনাকে খতম করে এবং ওদের অস্ত্রশস্ত্র আমাদের কাছে জমা দেয়। পরে কুষ্টিয়া মুক্তিবাহিনীর দখলে আসার পর আমাদের দখলীকৃত অস্ত্র সম্ভারের হিসাব নিতে গিয়ে আমরা আশ্চর্য হয়ে যাই। যে অস্ত্রশস্ত্র ফেলে ২২ এফ এফ পশ্চাদপসরণ করে, মনােবল থাকলে ঐ অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে তারা এক পক্ষকাল যুদ্ধ করতে পারত। হয়ত আমাদেরকে পরাজিত করতে পারত। ২২ এফ এফ-এর এই পরাজয় এবং মুক্তিবাহিনীর জয়ে আমাদের মনােবল দ্বিগুণ বেড়ে যায়। আমরা বিশ্বাস করতে থাকি আমাদের বিজয়ের গতি অপ্রতিহত থাকবে এবং অচিরেই পদ্মার পাড় আমরা পুরােপুরি মুক্ত করতে পারব। কিন্তু সামরিক জ্ঞানের অভাবে আমরা বুঝতেও পরিনি যে এক সুসজ্জিত সেনাবাহিনী কিভাবে আবার মরণ কামড় হানতে পারে।  আমার যতদূর মনে পড়ে কুষ্টিয়াতে আমরা ৩৫টি গাড়ি, ৬টি আর আর গানসহ শতাধিক রাইফেল, এলএমজি এবং ভারী মেশিনগান এবং প্রচুর গােলাবারুদ দখল করি, যা দিয়ে আমরা মুক্তিবাহিনীকে সজ্জিত করতে থাকি। এই দখলীকৃত অস্ত্রসম্ভার এবং গাড়ি আমরা চুয়াডাঙ্গায় এনে জনগণকে প্রদর্শন করি, যা অনেক বিদেশী সাংবাদিক এবং টেলিভিশন সংস্থা পর্যবেক্ষণ করে।
এই সময় এপ্রিলে প্রথম সপ্তাহে কোন একদিন একটি ফরাসী-স্পেনিশ টেলিভিশন সংস্থার প্রতিনিধির সাথে সাক্ষাৎকার দেয়ার সময় ৩টি পাকিস্তানী স্যাবর জেট চুয়াডাংগা আক্রমণ করে এবং আধঘন্টা পর্যন্ত কয়েক জায়গায় বােমাবর্ষণ করে। এই টেলিভিশন সংস্থা অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে এই ঘটনার পুরােপুরি আলােকচিত্র গ্রহণ করে, যা সারা বিশ্বে তুমুল আলােড়নের সৃষ্টি করেছিল। এই ছবিগুলাে নিশ্চয়ই বিশ্ববিবেককে জাগ্রত করতে বিশেষ ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিল। | এই সময় মুক্তিবাহিনীর ক্ষুদ্র একটি দলকে কুষ্টিয়ায় রেখে আমরা নতুন সমর পরিকল্পনা গ্রহণ করি। আমরা যশাের থেকে মাত্র কয়েক মাইল উত্তরে বিশাখালীতে আমাদের প্রতিরক্ষাব্যুহ গড়ে তুলি। মাহাবুব এই এলাকার সামরিক নেতৃত্ব গ্রহণ করে। বিশাখালীতে আমাদের দু’কোম্পানীরও কম সৈন্য ছিল। উত্তর পূর্বে আমরা হার্ডিঞ্জ ব্রীজের উভয় পার্শ্বে ঢাকা হতে আক্রমণ প্রতিহত করার প্রতিরক্ষাব্যুহ তৈরি করি। হার্ডিঞ্জ ব্রীজে আমাদের দু’পাটুনেরও কম ইপিআর জোয়ান ছিল। এই সময় আমরা ফরিদপুর, গােয়ালন্দ, পাবনা, নাটোর, এমন কি নওগাঁর সাথেও যােগাযােগ স্থাপনে সক্ষম হই। এই সময়কার টেলিফোন কর্মচারীদের সহায়তা এবং তাদের দেশপ্রেম আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। | উপরােল্লিখিত কয়েকটি জায়গার সাথে আমরা সবসময় যােগাযােগ রক্ষা করেছিলাম। রাজশাহী এবং পাবনায় পাকসেনাদের তৎপরতা এবং মুক্তিযােদ্ধাদের পরিকল্পনা সম্বন্ধে অবহিত ছিলাম। গােয়ালন্দ মহকুমার প্রশাসক শাহ মােহাম্মদ ফরিদের অনুরােধে আমরা একটি ক্ষুদ্র ইপিআর বাহিনীকে গােয়ালন্দে শত্রুকে মােকাবেলা করার জন্য প্রেরণ করি। এমন কি আমরা পাবনা দখলের পর নগরবাড়ী ঘাটে শত্রুর মােকাবেলা করার জন্য ক্ষুদ্র একটি বাহিনী প্রেরণের প্রস্তুতি নিই।
আমাদের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল যশােরে পাকসেনাকে কোণঠাসা করা এবং ঢাকা হতে কোন রকম রিইনফোর্সমেন্ট বা আক্রমণকে প্রতিরােধ করা। সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যে কোন ব্যক্তির কাছে এটা প্রতীয়মান হবে যে, বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়া ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইপিআর বাহিনীর পক্ষে এই সামরিক ভূমিকা পালন করা অসম্ভব ছিল। এবং কোন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেনাবাহিনী এই প্রস্তুতি নিতে কোন দিনই সাহস পেত না। তবুও দেশপ্রেমের উন্মাদনা আমাদেরকে পেয়েছিল, তাই যা করা অসম্ভব তা করারও সাহস এবং প্রস্তুতি আমরা নিয়েছিলাম। | এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে আমরা কুষ্টিয়া, যশাের, (শুধু সেনানিবাসকে বাদ দিয়ে), ফরিদপুর, পাবনা, রাজশাহীকে মুক্তাঞ্চল হিসেবে ঘােষণা করি এবং আমাদের নিজস্ব সীলমােহরও বানাই। শুধু তাই নয়, গােয়ালন্দ থেকে কুষ্টিয়া এবং কুষ্টিয়া থেকে দর্শনা পর্যন্ত ট্রেন চলাচল চালু করতে শুরু করি। আমরা এই সময় ব্যাংকেও নির্দেশ দিই ৫০০ টাকার উপরে কাউকে কোন পেমেন্ট না করতে। এমন কি ভারতের সাথে সার্টিফিকেট মােটমুটি পাসপাের্টের মর্যাদা পাবে। এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত এটা বলবৎ ছিল—অর্থাৎ আমরা একটি স্বাধীন স্বার্বভৌম সরকারের প্রশাসন ব্যবস্থা চালাচ্ছিলাম। আমি এই সময় মেহেরপুরের প্রশাসন ভার মেহেরপুরের সেকেণ্ড অফিসারকে দিই এবং নিজে সামরিক পরিকল্পনা প্রণয়নে সামরিক অফিসারের ভূমিকা গ্রহণ করি। এখানে উল্লেখযােগ্য যে, এই সময় শত শত ভারতীয় এবং বিদেশী সাংবাদিক, টেলিভিশন সংস্থা আমাদের সাক্ষাৎকার নেয় এবং এই মুক্তাঞ্চল পরিদর্শন করে। তাদের সবারই এক প্রশ্ন ছিল যে, তােমাদের সরকার কোথায়? আমরা উত্তরে জানাই যে, অতিশীঘ্রই আমাদের বাংলাদেশের সরকার ঘােষণা করা হবে।
এই সময় আমরা ভারতের টুঙ্গী বিওপি’তে জনাব তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামের সাথে সাক্ষাৎও করি এবং সমগ্র পরিস্থিতির বিশদ পর্যালােচনা করি। তারা আশ্বাস দেন যে অতি শীঘ্রই সরকার ঘােষণা করা হবে। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের শেষদিক থেকে একটি নতুন মােড় নেয়। এই সময় শত্রুসৈন্য যশাের সেনানিবাসে নতুন ভাবে সমর প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। আমার অভিমত যে, পাকিস্তানসেনাবাহিনী কোনদিন কল্পনা করতে পারেনি যে বাঙালিরা তাদের সুশিক্ষিত বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্রের ভাষায় জবাব দিতে পারে। কুষ্টিয়ার পরাজয়ের গ্লানি নিশ্চয়ই তাদের মনােবল ভেঙ্গে দিয়েছিল। তাই প্রচুর রি-ইনফোর্সমেন্ট ঢাকা থেকে যশাের আনা শুরু হয়। আমরাও উধ্বশ্বাসে তাদের নতুন তৎপরতার জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। আমরা এক-একসময় ভাবছিলাম যে জনতার সমুদ্র নিয়ে যশাের সেনানিবাসের উপর ঝাপিয়ে পড়ব। যশাের সেনানিবাস তখন আমাদের কাছে বাস্তিলের কারাগারের মতাে পাকিস্তানসেনাবাহিনীর সামরিক গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটির প্রতীক মনে হচ্ছিল। কিন্তু লক্ষ লক্ষ জনতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার একটা ঝুঁকি ছিল যে হয়ত যশাের আমরা দখল করতে পারব কিন্তু তা হবে হাজার হাজার লােকের প্রাণের বিনিময়ে। এতবড় একটা ঝুঁকি নিতে আমরা প্রস্তুত ছিলাম না।
এই সময় পাকিস্তানসেনাবাহিনীর সাথে আমাদের প্রথম সংঘর্ষ বিশাখালীতে । এইখানে পাকিস্তানসেনাবাহিনী গােলন্দাজ বাহিনীর সহযােগিতায় আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যুহের উপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। এটা ছিল এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহের শেষের দিকে। আমাদের ইপিআর বাহিনী অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে এই আক্রমণ মােকাবেলা করে। হানাদারবাহিনীর শতাধিক সৈন্য হতাহত হয়। প্রায় ২৪ ঘণ্টার এই আক্রমণ প্রতিহত করার পর আমরা বিশাখালী থেকে প্রতিরক্ষাব্যুহ পিছিয়ে আনতে বাধ্য হই। প্রথম ট্যাকটিক্যাল রিট্রিট আমাদের মনোেবলের উপর মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। এই প্রথম আমরা উপলব্ধি করি যে, শত্রুর দুরপাল্লার ভারী কামানের জবাব দেবার মতাে অস্ত্র আমাদের ছিল। অন্যদিকে শত্রু এই কামানের আক্রমণ দ্বারা আমাদেরকে পিনডাউন করে রেখে সেই আর্টিলারী কভারের সাহায্যে আমাদের অবস্থানের উপর তাদের সুবিধা অনুযায়ী আক্রমণ চালাতে থাকে। শুধু তাই নয়, প্রত্যেক আক্রমণে তারা প্রচুর সৈন্য ব্যবহার করছিল। প্রত্যেক আক্রমণের সাথে আমাদের মনােবলও ভেঙ্গে যাচ্ছিল। এবং আমরা ভবিষ্যৎ বিজয়ের কোন সামরিক সমাধান খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তদুপরি আমাদের অগ্রবর্তী ঘটিগুলাের সাথে যােগাযােগ রক্ষাও সম্ভব ছিল না এবং কোন রণাঙ্গনে অগ্রবর্তী অথবা পশ্চাদবর্তী অবস্থানগুলাের সাথে যােগযােগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে তাতে যুদ্ধ দক্ষতা এবং মনােবলের উপর যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে তা যারা যুদ্ধে অভিজ্ঞ তারাই বলতে পারে। এই রকম একটি অগ্রবর্তী অবস্থান থেকে আমি নিজেও অসহায় অবস্থায় পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হই।
তদুপুরি এই সময় বর্ষার অশুভ আগমন শুরু হয়। আমাদের অবস্থাগুলােতে খাদ্যদ্রব্য এবং গােলাবারুদের অভাব দেখা দেয়। বিচ্ছিন্ন। অবস্থানগুলােতেও এই বিরূপ পরিস্থিতিতে সৈন্যদের মনােবল ভেঙ্গে যেতে শুরু করে। আমাদের পশ্চাদপসরণ অব্যাহত থাকে। এ ছাড়া আহত মুক্তিযােদ্ধাদের চিকিৎসারও কোন সুব্যবস্থা ছিল না। ঔষধের অভাবে অনেকেই মারা যায়। এটা সহজেই অনুধাবনযােগ্য যে, গােয়ালন্দের মত জায়াগায় ক্ষুদ্র একটি প্রতিরক্ষা ব্যুহ কিরকম আত্মঘাতী ছিল। এদের পেছনে পাকসৈন্য অবতরণ করে অনায়াসে ঐ ঘটিকে একেবারে উড়িয়ে দেয়। একইভাবে নরবাড়ী ঘাট এবং অবশেষে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ শক্রর আয়ত্তে চলে যায়। আমাদের খবর অনুযায়ী জেনারেল মিঠা খান নিজে পাবনা হার্ডিঞ্জ ব্রিজ এ্যাক্সিস-এর অপারেশন। চালান। চতুর্দিকে শক্রর প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে আমাদের সংগঠনও দুর্বল হয়ে পড়ছিল। প্রত্যেকটি ঘাঁটি থেকে পশ্চাদপসারণে বাধ্য হয়ে আমরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ি। আস্তে আস্তে ঝিনাইদহ আমাদের আয়ত্তের বাইরে চলে যায়। শত্রুসৈন্য কুষ্টিয়াও দখল করে ফেলে এবং চুয়াডাংগার দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। আমরা এই শত্রুর আক্রমণের মুখে পুনর্গঠন এবং পুনর্বিন্যাসের সময় এবং সুযােগ পাচ্ছিলাম না। চতুর্দিকে প্রচুর বিভ্রান্তি দেখা দেয়। সাধারণ জনগণের মনােবলও ভেঙ্গে পড়তে থাকে। চুয়াডাংগা যখন শত্রুর আক্রমণের আওতায় চলে আসে তখন আমরা সদর দফতর চুয়াডাংগা থেকে সরিয়ে পেছনে মেহেরপুরে নিই। | প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্ট যশাের সেনানিবাসে অবস্থান করছিল। লেফটেন্যান্ট কর্নেল জলিল প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার ছিলেন। ২৫শে মার্চের আগেই প্রথম বেঙ্গলকে এক্সারসাইজের জন্য ঝিকরগাছার দিকে পাঠান হয়। আমরা প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাথে যােগাযােগের চেষ্টা করি।
আমি, মাহাবুব এবং মেজর ওসমান চিঠির মাধ্যমে বর্তমান পরিস্থিতি ও ভবিষ্যৎ কর্মসূচী সম্বন্ধে তাকে অবহিত করি স্বতন্ত্রভাবে চিঠির মাধ্যমে। প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টকে আমাদের সঙ্গেযােগ দেয়ার আহ্বান জানাই। দুর্ভাগ্যবশত আমাদের কোন চিঠিরই জবাব পাইনি। এর পরপরই প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্ট যশাের সেনানিবাসে ফিরে গেলে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের নিরস্ত্র করার চেষ্টা করলে তুমুল সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষে একজন বাঙালি লেফটেন্যান্ট আনােয়ার শাহাদাত বরণ করেন। প্রচুর বাঙালি সৈন্য হতাহত হয়। এই সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে ক্যাপ্টেন হাফিজ প্রায় ৩০০ বাঙালি সৈন্যকে নিয়ে চৌগাছা ও ঝিকরগাছার দিকে অগ্রসর হয়। প্রত্যেকে অস্ত্র হাতে নিয়ে বেরিয়ে এসেছিল। ক্যাপ্টেন হাফিজের সাথে আমার প্রথম দেখা হয় চুয়াডাগায়। সে তখন প্রথম বেঙ্গলের বিক্ষিপ্ত, বিচ্ছিন্ন লােকদের নিয়ে চৌগাছা এবং ঝিকরগাছায় একত্রিত করছিল। আমাদের সশস্ত্র যুদ্ধের কিছু খবর পেয়ে সে আমাদের সাথে যােগাযােগ স্থাপন করতে চুয়াডাংগায় এলে আমি জানতে পারি যে, তারাও তখন ভারত সরকারের কাছে অস্ত্রশস্ত্রের জন্য চেষ্টা করছিল। আমরা তখন যৌথভাবে সামরিক পরিকস্পনার প্রস্তুতি নিতে থাকি। | প্রথম বাংলাদেশ সরকার গঠন ঃ এই সময় আমরা জনাব তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামের সাথে যােগাযােগ অব্যাহত রাখি। এবং আমরা আশা করছিলাম যে, অনতিবিলম্বে বাংলাদেশ সরকার গঠন এবং ঘােষণা করা হবে।
এই সময় আমাদের মুক্তাঞ্চলে প্রতিদিন অনেক বিদেশী সাংবাদিক এবং টেলিভিশন দল আমাদের মুক্তাঞ্চল ঘুরেফিরে দেখছিলেন এবং এত প্রতিকূল অবস্থার ভেতরেও আমরা যে শুধু পাকিস্তানসেনাবাহিনীর আক্রমণের বিরুদ্ধে নিজেদেরকে প্রতিরক্ষা করছিলাম তা নয়, আমরা এ রকম একটা সুসজ্জিত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক অভিযান চালিয়ে জয়ী হয়েছিলাম। আমাদের এই সামরিক বিজ, জনগণের উচ্ছাস, উন্মাদনা ও দৃঢ়সংকল্প তাদের সবাইকে বিমােহিত করেছিল। মেহেরপুরের কোন এক স্থানে বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণের প্রস্তাবের কথা আমরা এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের দিকে জানতে পারি। আমরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য গভীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করতে লাগলাম। এই সময় যশােরের কাছে পাকিস্তানসেনাবাহিনী আমাদের প্রতিরক্ষাব্যুহ ভেদ করে এগিয়ে আসছে। এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে শত্রু বাহিনীর প্রচন্ড আক্রমণের মুখে আমরা পশ্চাদপসরণ শুরু করি। ওদের সৈনসংখ্যা আমাদের তুলনায় অনেক বেশি। আমাদের রণকৌশলগত পশ্চাদপসরন ছিল প্রথম পর্যায়ের যুদ্ধে অনিবার্য পরাজয়ের সূচনা মাত্র। | ১২ই এপ্রিল — দিনের পর দিন মরণপণ যুদ্ধের পরও আমরা যখন কোন স্বীকৃতি পাচ্ছি না, তখন আমাদের মনােবল ভাঙ্গতে শুরু করে। একটা পর্যায় পর্যন্ত মানুষের মনােবল অক্ষুন্ন থাকে। যুদ্ধক্ষেত্রে অনেকগুলি ব্যর্থতা আমাদের যােদ্ধাদের মনেও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল। এমন এক সংকটজনক দিনে আমি খবর পেলাম, বাংলাদেশ সরকার ১৬ই কিংবা ১৭ই এপ্রিল শপথ গ্রহণ করবেন। তার আগেই আমি প্রাথমিক ব্যবস্থাদি সম্পন্ন করে ফেলেছিলাম।
তিনটি বিষয়ের ভিত্তিতে আমাদের স্থান নির্ধারণের কাজ করতে হয়েছে—শহর থেকে দূরত্ব বজায় রাখা এবং ভারতীয় এলাকা থেকে বিদেশী সাংবাদিকরা যাতে সহজে আসতে পারেন এবং শত্রুর সম্ভাব্য বিমান আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য ছদ্মাবরণের ব্যবস্থা করা। ১৬ই এপ্রিল মাহাবুব (ঝিনাইদহ মহকুমা পুলিশ অফিসার ছিলেন, পরে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর একজন অফিসার হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন) ও আমি চূড়ান্ত ব্যবস্থা সম্পন্ন করার জন্য নির্দিষ্ট স্থানের দিকে যাত্রা করি। তখন ছিল অত্যন্ত সংকটজনক সময়। আমাদের বাহিনীর পশ্চাদপসরণের খবর পাচ্ছি। অগ্রবর্তী এলাকার সাথে আমাদের যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। আমাদের সেনারা বিচ্ছিন্ন হয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে পরিণত হয়ে বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। মেজর ওসমান তখন আমাদের বাহিনীর প্রধান। তিনি তাঁর সদর ঘাঁটি মেহেরপুরে সরিয়ে এনেছেন। মেজর ওসমান ভীষণ ব্যস্ত এবং চিন্তাম্বিত। পাকিস্তানবাহিনী একের পর এক আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যুহ ভেদ করে এগিয়ে আসছে। আমরা তখন জানতাম না আর কতদিন মাতৃভূমির বুকে আমাদের শেষ ঘাঁটি টিকিয়ে রাখতে পারব। আমরা দুপুর নাগাদ আমাদের গন্তব্যস্থলে পৌছলাম। ৭৬ তম ব্যাটালিয়নের লেঃ কর্নেল চক্রবর্তীর সাথে এই উপলক্ষ্যে যােগাযােগ রক্ষা করে কাজ করছিলাম। ১৭ই এপ্রিল সকালে আমি আর মাহাবুব সেই ঐতিহাসিক স্থানে ছুটলাম। অনাড়ম্বর আয়ােজন সম্পন্ন হয়েছে। সকাল ৯টার দিকে জনাব তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম অন্যদের সাথে নিয়ে সেখানে পৌছলেন। আমি তাদের নিয়ে এলাম বদ্যিনাথতলার মণ্ডপে। ওখানে আশেপাশের গ্রাম থেকে কিছু চেয়ার সংগ্রহ করে আনা হয়েছে। সংগৃহীত চেয়ারের মধ্যে সবগুলি পূর্ণাঙ্গ নয়।
কোনটার একটা হাতল নেই, কোনটার একটা পায়া খােয়া গেছে। মাহাবুব আর আমি দ্রুত একটা অনুষ্ঠানসূচী প্রণয়ন করে ফেললাম। অন্যদেরও তা দেখালাম। আমরা নেতৃবৃন্দকে গার্ড অব অনার দেবার মতাে মাত্র কয়েক প্লাটুন ইপিআর ও মুজাহিদ মােতায়েন করি। মাহবুব তাদের নিয়ে গার্ড অব অনার দেবার মহড়া শুরু করল। আমি তখন কর্নেল ওসমানী ও অন্যদের সাথে কয়েকটি সমস্যা নিয়ে আলােচনা করছিলাম। হাজার দুয়েক লােক জমায়েত হয়েছে অনুষ্ঠানে। তার মধ্যে অন্ততঃ শতাধিক বিদেশী সাংবাদিক, ফটোগ্রাফার ও টিভি ক্যামেরাম্যান। নীরব আয়ােজন। সমবেত গ্রামের মানুষের নিকট অতীতেও এমন কোন অনুষ্ঠান দেখার সুযােগ হয়নি। আমরাও অনুষ্ঠানের কথা গােপন করে রেখেছিলাম। গ্রামের মানুষের শূন্য দৃষ্টির ভাষা আমি বুঝতে পেরেছি। তারা যেন একটা অঘটন ঘটতে দেখছে। – বিস্ময়াবিষ্ট, নিষ্পলক।  বেলা প্রায় ১১টা নাগাদ বহু প্রতীক্ষিপ্ত অনুষ্ঠানের সূচনা হল। আমি জীপে করে জনাব তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, জেনারেল এমএজি ওসমানী ও অন্যান্যা কয়েকজনকে মঞ্চের ৫০ গজের মধ্যে তােরণের কাছে নিয়ে এলাম। মাহবুব গার্ড অব অনারের নেতৃত্ব দিল। সৈয়দ নজরুল ইসলাম অভিবাদন গ্রহণ করলেন। পিছনে দাঁড়িয়ে জেনারেল ওসমানী। সৈয়দ নজরুল ইসলাম যখন পতাকা উত্তোলন করছিলেন তখন সাংবাদিকরা তাদের চতুর্দিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। একটা ছােট দল জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সােনার বাংলা গাইল। একটা জাতির জন্মলগ্ন প্রত্যক্ষ করলাম। এমন জন্মের কাহিনী ইতিহাসে বহুবার পড়েছি। কিন্তু বিশ্বাস হয় না চোখের সম্মুখে একটি জাতি স্পন্দিত হচ্ছে। গার্ড অব অনারের পর ভাবী মন্ত্রিসভার সদস্যরা মঞ্চে উপবেশন করলেন। সৈয়দ নজরুল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার কথা ঘােষণা করলেন। তারপর এক এক করে মন্ত্রিসভার সদস্যদের পরিচয় করিয়ে দিলেন তিনি। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভাষণ দান করলেন।
রাষ্ট্রপতির পর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ সাংবাদিক সম্মেলনে বক্তৃতা করেন। ঘােষণা করা হল লক্ষ লক্ষ মৃতদেহের নিচে পাকিস্তান সমাধিস্থ হয়েছে। আর এই সমাধির উপরে একটি জাতি প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। সেই জাতি হল বাংলাদেশ। মানুষ এই ঘােষণাকে অভিনন্দিত করল। আমাদের মধ্যে কয়েকজন সম্মেলন কেন্দ্র ছেড়ে চলে গেলেন। ক্যাপ্টেন হাফিজ তার সহযােদ্ধাদের কাছে চলে গেলেন, সহযােদ্ধারা প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা করে বসে রয়েছেন। মাহাবুব আর আমি চললাম আমাদের কর্মক্ষেত্রে। পথে আমরা উপলব্ধি করলাম, একটি জাতি আজ জন্ম নিল বটে কিন্তু আজ যে শিশু জন্ম নিল সেই শিশুকে বিশ্বসভায় আসন গ্রহণের জন্য অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আমরা জানি এই পথে পাড়ি দেবার জন্য আরাে রক্তমূল্য দিতে হবে। আমাদের কাহিনী রক্তাক্ষরে লিখতে হবে। এই মুহূর্তে আমাদের চিন্তা হল, সদ্যোজাত জাতি বড় হবে যেদিন, যেদিন বিশ্বাসভায় মর্যাদার আসন পাবে, সেদিন কি আমরা তা আজকের মতাে দেখার জন্য বেঁচে থাকব?  সরকার গঠনের পর আমাদের সাথে প্রথম বেঙ্গলরেজিমেন্টের একত্রীকরণ হয়। মেজর ওসমানের নেতৃত্বাধীনে আমাদের সমস্ত সৈন্য শার্শা-নাভারন এলাকায় মােতায়েন করা হয়। এই সময় উল্লেখযােগ্য যে, ক্যাপ্টেন সালাউদ্দীন এবং ক্যাপ্টেন মুস্তাফিজ যারা ঢাকা সেনানিবাস থেকে পালিয়ে মেহেরপুরে এসেছিলেন তারাও এপ্রিলের আনুমানিক দশ তারিখের দিকে চুয়াডাঙ্গায় আমাদের সাথে যুদ্ধে যােগ দেন। এই সময় আরাে দু’জন সামরিক অফিসার আমাদের সাথে যােগ দেন। তারা হলেন ক্যাপ্টেন হুদা ওহাব যিনি যশাের সেনানিবাস থেকে পালিয়ে আসেন। শার্শা-নাভারনের নতুন প্রতিরক্ষা ব্যুহকে আমরা শক্তিশালী করতে থাকি।
এই সময় আমরা আর একজন নতুন মুক্তিযােদ্ধাকে পাই, যাকে পরে আনুষ্ঠানিকভাবে সামরিক বাহিনীতে নেয়া হয়। তিনি সরাসরিভাবে প্রতিরক্ষাব্যুহতে মােতায়েন ছিলেন। তিনি হচ্ছেন ক্যাপ্টেন শফিকউল্লাহ। তিনি ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের শিক্ষক ছিলেন। এপ্রিল মাসের তৃতীয় সপ্তাহের দিকে এই সময়েই ক্যাপ্টেন হাফিজ নাভারনে শত্রুবাহিনীর ঘাঁটির উপর একটা সাফল্যজনক দুঃসাহসিক রেইড চালান। এই রেইডে প্রথম বেঙ্গলের লােকজন ছিল। এতে করে যদিও শত্রুর কিছু ক্ষয়ক্ষতি হয় তবুও তারা আমাদের অবস্থান সম্বন্ধে সচেতন হয়ে উঠে। এবং তারপর পাকিস্তানসেনাবাহিনী বিরাট আকারে আমাদের অবস্থানের উপর আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে শত্রুবাহিনী গােলন্দাজ বাহিনীর সাহায্য নিয়েছিল, যার প্রত্যুত্তরে আমাদের কিছুই ছিল না। তাই আক্রমণকারী বাহিনীর উপর চাপ সৃষ্টি করে আমরা পিছু হটতে থাকি। এই সময় হাবিলদার মেজর মুজিবুর রহমানসহ আরাে অনেক মুক্তিযােদ্ধা এই যুদ্ধে শহীদ হন। অনেকেই হতাহত হন। আমরা পরে জেনেছিলাম শক্রর ক্ষয়ক্ষতি হতাহত মিলিয়ে প্রায় দুই শতাধিক ছিল। সেই এলাকায় এক মৃত মেজরের নামে পাকিস্তানসেনাবাহিনী এক ছােট মেমােরিয়াল তৈরি করেছিল। | আমাদের পশ্চাদপসরণ বিশৃঙ্খলভাবে হয়েছিল। পশ্চাদপসরণের সময় কিছু মূল্যবান হাতিয়ার খােয়া যায়। বেনাপােল চেক পােস্টে আমাদের সদর দফতর স্থানান্তরিত করা হয়। ঐদিনই জনাব তাজউদ্দীন আহমদ বৃটিশ এমপি টমাসম্যানসহ চেকপােস্টে আসেন এবং ঐখানে তার বিবৃতি দেন। ঐদিনই পরে শত্রুবাহিনী আমাদের হেডকোয়ার্টারের উপরে গুলীবর্ষণ করে। এই অতর্কিত আক্রমণের জন্য আমরা মােটেই তৈরি ছিলাম —শত্রুর আক্রমণে আমরা বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি এবং বাংলাদেশের মাটিতে শেষ ঘাঁটিটুকু ছেড়ে দিয়ে ভারতে পশ্চাদপসরণ করি। (সূত্র : বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, নবম খণ্ড)

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত