অপারেশন শাওনঘাটা ট্রান্সফরমার চানগাঁও
মুক্তিযােদ্ধারা আজ সর্বত্রই বিরাজমান। চট্টগ্রামের প্রতিটি অঙ্গে মুক্তিযােদ্ধাদের পরশ লেগেছে। পাকবাহিনীর দাপট আর নেই সেই পূর্বের মতাে। তারা বুঝে নিয়েছে মুক্তিযােদ্ধারা গেরিলা কৌশলের নিকট তারা পরাস্ত। পাকবাহিনীকে কাবু করার জন্যে মুক্তিযােদ্ধাদের সর্বত্রই আঘাত হেনে চলেছেন। ডিসেম্বর ‘৭১। চট্টগ্রামের পাকবাহিনীর দপ্তরগুলােতে চলছে বাঙালি নিধনের ছক। সকাল-সন্ধ্যায় তারা বিভিন্ন অঞ্চলে মানুষ হত্যার পাশাপাশি আমাদের মা, বােনদের নির্যাতন করছে। একদিন মুক্তিযােদ্ধাদের কানে এল একটি খবর। ক’জন স্থানীয় দালালের সহযােগিতায় পাকবাহিনী ৬ই ডিসেম্বর রাতে চানগাঁও শাওনঘাটার পাশে একটি বাড়িতে হানা দেবে। এ সংবাদ স্থানীয় মুক্তিযােদ্ধারা জানতে পারে। মুক্তিযােদ্ধা করিম, মাহবুবুর রহমান ও কামাল উদ্দিন আহমেদসহ ক’জন বৈঠকে বসলেন। তাঁরা বসেছেন কি করে পাকবাহিনীর আক্রমণকে বানচাল করা যায়। দু’দিন রেকি করলেন পুরাে অঞ্চলটি। খুঁজে পেলেন সম্ভাব্য একটি আক্রমণ কেন্দ্র। সেটি হল শাওনঘাটা ট্রান্সফরমার। নদীর পাড়ে এ ট্রান্সফরমারটি। যথসময়ে তিনজন মুক্তিসৈনিক গ্রহণ করলেন প্রস্তুতি। প্রয়ােজনীয় বিস্ফোরকসহ চলে আসেন ট্রান্সফরমারের পাশে। পাকবাহিনীর ক’জন সৈন্য তখন ট্রান্সফরমারের থেকে কিছু দূরে নদীর ঘাটে বসে পাহারা দিচ্ছিল। এ ট্রান্সফরমারটি পুরাে চানগাঁও-এর বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রণ করত।
মুক্তিযােদ্ধারা কৌশলে চলে এল ট্রান্সফরমারের অতি নিকটে। দু’জনে দু’দিক থেকে পাহারা দিচ্ছে। মাহবুবুর রহমান বুদ্ধিমত্তার সাথে বসালেন প্রয়ােজনীয় বিস্ফোরক।রাত তখন প্রায় ১২টা। মুক্তিযােদ্ধারা বিস্ফোরক বসিয়ে চলে এলেন নিরাপদ স্থানে। তখন পাকসেনা ৫জন নদীর পাড়ে বসে গল্পগুজব করছে। ইতিমধ্যে পাকবাহিনীকে পথ দেখিয়ে স্থানীয় রাজাকাররা নিয়ে এসেছে পাড়ায় আঘাত হানার জন্য। প্রায় ৫০ জন পাকসৈনিক বিভিন্ন বাড়িতে ঢুকে পড়েছে। তাদের উদ্দেশ্য নরহত্যা ও নারী নির্যাতন। পাকবাহিনীর আগমনে মানুষজন যে যেদিকে পারছে ছুটছে। মহিলা-পুরুষ সবাই নিরস্ত্র । যারা পারছে তারাই পালাচ্ছে। মহিলা-পুরুষের আর্তচিৎকার ভেসে আসছে। এমনি এক সময়ে নদীর কিনার থেকে ভেসে এল প্রচন্ড বিস্ফোরণের শব্দ। এ শব্দে আনন্দিত হল মুক্তির সৈনিকরা। অপর দিকে পাকবাহিনী ভীত হল। গ্রামের ভিতর যে সব পাকসৈন্য প্রবেশ করেছে তারা ভয়ে দৌড়াতে লাগল। গুলি ছুঁড়ে ছুঁড়ে তারা পালাচ্ছে। ট্রান্সফরমারের বিস্ফোরণে পুরাে অঞ্চল অন্ধকার হয়ে গেছে। এতে পাকবাহিনী আরাে বেশি ভীত হয়। গুলির শব্দে পাকবাহিনী মনে করেছে মুক্তিযােদ্ধাদের পাল্টা আক্রমণ। ফলে তারা অন্ধকার থেকে একে অপরের প্রতি অনবরত গুলি ছুড়তেই ছিল। আসলে এ যুদ্ধ ছিল সেমসাইড যুদ্ধ। পাকবাহিনী অন্ধকারে মুক্তিযােদ্ধা মনে করে নিজেরাই নিজেদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। সকাল হলে দেখা গেল শাওনঘাটার আশে পাশে প্রচুর পাকসেনাদের মৃতদেহ। আসলে মুক্তিযােদ্ধারা শুধু ট্রান্সফরমারটি উড়িয়ে দিয়েছিলেন। প্রচন্ড বিস্ফোরণের শব্দে পাকবাহিনী দিশেহারা হয়ে এ কান্ড ঘটিয়েছিল। পরদিন পাকবাহিনীর অন্যান্য সদস্যরা এসে প্রায় ২৫ জনের মৃতদেহ ট্রাকে তুলে নিয়ে যায়। সেদিন ভারতীয় বিমান চট্টগ্রামের আকাশে এসেছিল। পাকবাহিনী সেই দিক সামলাতেই ছিল ব্যস্ত। তাই তারা এদিকে বিশেষ নজর দিতে পারেনি।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত