You dont have javascript enabled! Please enable it! 1974.09.10 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | উন্নয়নের চাবিকাঠি সাক্ষরতা | খাদ্যোৎপাদন বৃদ্ধি: বীজধান প্রয়োজন | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা: ১০ই সেপ্টেম্বর, মঙ্গলবার, ২৪শে ভাদ্র, ১৩৮১

উন্নয়নের চাবিকাঠি সাক্ষরতা

জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থার (ইউনেস্কো) আহবানে সারা বিশ্বে গত পরশু ৮ ই সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস উদযাপিত হয়। এই উপলক্ষে কুমিল্লা পল্লী উন্নয়ন একাডেমী প্রাঙ্গণের সাক্ষরতা দিবস উদযাপনের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি জনাব মুহাম্মাদল্লাহ নিরক্ষরতা ও কুসংস্কার অভিশাপ সম্বন্ধে তার মূল্যবান বক্তব্য পেশ করেন। অতীত পটভূমির জের টেনে তিনি বলেন যে, অতীতে বাংলাদেশের জনসমষ্টি শিক্ষার অভাবেই উৎপাদনশীল জনশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ পায়নি। যার ফলে অজ্ঞানতা জনিত সার্বিক অসুবিধা সহ জনসংখ্যার প্রবল চাপ আজ বাংলাদেশের পক্ষে গুরুতর সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। তাই জাতীয় জীবন তো বটেই ব্যক্তির ব্যবহারিক জীবনের সাফল্যের জন্য সাক্ষরতার প্রয়োজন সর্বাধিক। আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসের অনুষ্ঠানে জনাব রাষ্ট্রপতি বয়স্ক শিক্ষার উপর জোর দেন এবং নিরক্ষরতা ও কুসংস্কারের অভিযোগ করে তিনি দেশ পুনর্গঠন এর জন্য সম্মিলিত প্রয়াসের আহ্বান জানান।
একাডেমি প্রাঙ্গণে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস উদযাপন অনুষ্ঠানে সভাপতির ভাষণে বাণিজ্য মন্ত্রী জনাব মোস্তাক আহমদও মসি আরা লাঙ্গলের একত্রীকরণের মাধ্যমে নিরক্ষর ও অবহেলিত কৃষক সমাজের ভাগ্যোন্নয়নের চেষ্টা করার প্রতি আহ্বান জানান। তিনি আরো বলেন যে, নিরক্ষরতা দূরীকরণ সম্ভব না হলে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জন অত্যন্ত কষ্টকর হয়ে পড়বে।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, ১৯৬৯ সালের আদমশুমারিতে বাংলাদেশের শিক্ষিতের হার ছিল ২১.৫ ভাগ। ১৯৭৪ সালে এই হিসাবের বিশেষ একটা রদবদল হয়নি। এ দেশে এখন পর্যন্ত ষষ্ঠ শ্রেণির লেখাপড়া জানা লোকের সংখ্যা শতকরা ৪.৫। এই হিসেবে প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপতি উল্লেখ করেছেন যে, পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা নিরপেক্ষ দেশগুলির অন্যতম হলো বাংলাদেশ।
“স্মরণ করা যেতে পারে যে, দেশে পরিকল্পিত উপায়ে নিরক্ষরতা দূরীকরণের অভিযান শুরু হয়েছিল ১৯৬৩ সালে। এই উদ্দেশ্যে কুমিল্লায় পল্লী উন্নয়ন একাডেমী দেশী বিদেশী সংস্থার অর্থানুকূল্যে এবং কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সহযোগিতায় এক ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল। বয়স্ক শিক্ষা ও নিরক্ষরতা দূরীকরণের কর্মসূচির জন্য প্রথম যোজনায় একাডেমির বেশ সাফল্য অর্জনও করেছিল। হাতের কাজ সহ, কৃষি ও যৌথ খামার, হাঁস-মুরগী পালন, প্রাথমিক স্বাস্থ্য বিধি ও ফার্স্ট এইড ইত্যাদি বিষয়ে একাডেমি শর্ট কোর্স প্রশিক্ষণ দেয়। প্রয়োজনের তুলনায় একাডেমীর এই প্রয়াস পর্যাপ্ত না হলেও আবশ্যব্যঞ্জক ছিল।
একথা সর্বজন বিদিত যে, আলোর শত্রু আধার আর জ্ঞানের শত্রু অজ্ঞতা। আধার যেমন সমস্ত আলোর প্রয়োজনকে ম্লান করে দিতে পারে-অজ্ঞতা তেমনি ব্যক্তির জীবন তো বটেই, জাতীয় জীবনের সমস্ত সম্ভাবনাকে ডুবিয়ে দিতে পারে অন্ধকারের পাতালে। তখন আবার জ্ঞানের মাধ্যমে সেই অজ্ঞতার থেকে মানুষ মুক্তি পেতে পারে।
আমরা জানি অশিক্ষা জনিত কুসংস্কার হীনতা, স্বার্থপরতা, নীতিহীনতা ও সর্বপ্রকার দুর্নীতি এবং নৈরাজ্য আজ আমাদের গ্রাস করে রেখেছে। কৃষি ও শিল্পকর্মের উন্নয়ন চিন্তাও অজ্ঞানতার দ্বারা আবৃত। সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি, সুন্দর জীবন বোধ ও ভবিষ্যতে পরিচ্ছন্ন চিন্তা রয়েছে রুদ্ধ। বিশ্বব্যাপী আজ বৈজ্ঞানিক চিন্তার বিপ্লবী হাওয়া বইছে কৃষি ও শিল্পে কোন সাধনায় প্রগতি ও সমৃদ্ধির ক্ষেত্রের অনুশীলনই আনছে সন্ত্রাসনাকে ডেকে। সেখানে আমরাই বা পিছিয়ে থাকব কেন? এ ব্যাপারে ছাত্র-শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবী সমাজেরও যথেষ্ট দায়িত্ব আছে বলে আমরা মনে করি।
সে দিকে ইঙ্গিত রেখে রাষ্ট্রপতি বয়স্ক শিক্ষা ও নিরক্ষরতা দূরীকরণের কর্মসূচির প্রথম যোজনায় ৪০ কোটি টাকা স্কীম অনুমোদনের কথা উল্লেখ করেন এবং ছাত্র শিক্ষক বুদ্ধিজীবী সমাজকর্মীদের দায়িত্বের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেই তিনি সাক্ষরতা অভিযান এর সম্ভাব্য সাফল্যের আশা প্রকাশ করেন। আর জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষা এবং বর্তমান প্রতিযোগিতার বিশ্বের নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব ও মৌলিকত্ব প্রতিষ্ঠিত হতে আজ আমাদেরকে সাক্ষরতার হার যে বাড়াতেই হবে এতে কোন দ্বিমতের অবকাশ নেই। অতএব শুধু কথা নয়-কাজের মহড়া চলুক পুরোদমে।

খাদ্যোৎপাদন বৃদ্ধি: বীজধান প্রয়োজন

বন্যায় খাদ্যশস্যের ক্ষয়ক্ষতির কথা বর্ণনা করতে গিয়ে ত্রাণ ও খাদ্যমন্ত্রী কদিন আগে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছিলেন, এবারের বন্যায় অতিরিক্ত খাদ্য ঘাটতি দেখা দেবে ১৩ লক্ষ টন। এমনিতেই তো এবছরের খাদ্য ঘাটতির পরিমাণ অনুমান করা হয়েছিল ১৭ লক্ষ টন। সব মিলিয়ে তাই এবার বাংলাদেশকে সর্বকালের রেকর্ড ত্রিশ লক্ষ টন খাদ্যশস্য ঘাটতির মোকাবেলা করতে হবে।
সীমিত সাধ্য অনুসারে বাইরে থেকে যতটুকু খাদ্যশস্য আমদানি করা সম্ভব তা করতে সরকার কসুর করবেন বলে আমরা মনে করি না। তবে এটাও সত্যি যে শুধু আমদানি করে কোন অবস্থাতেই এই বিরাট খাদ্য ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব নয়। তাই পাশাপাশি পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে অতিরিক্ত খাদ্যশস্য উৎপাদনের।
অতিরিক্ত এই উৎপাদন এমনকি স্বাভাবিক মৌসুমী উৎপাদন করতে গিয়ে বন্যা উপদ্রুত এলাকার কৃষকের কাছে এখন যে সমস্যাটি সবচাইতে প্রকট হয়ে উঠেছে তা হলো কৃষি বীজ সমস্যা। চাষাবাদের উপকরণের অভাব তো রয়েছেই তার উপরে ধানবীজের এই সমস্যা তাদের সম্পর্কে তীব্রতর করেছে। বন্যায় প্রাণহানি এবং অন্যান্য সম্পদ বিনষ্ট হয়েছে, ভেসে গেছে কৃষকের ঘরে সংরক্ষিত বীজ। যতটুকু অবশিষ্ট ছিল তাও ক্ষুধার তাড়নায় নিঃশেষ হয়েছে। কিছু সংখ্যক ভাগ্যবান যাদের গোলায় ধান মওজুদ ছিল তারা এই সুযোগে কৃষকের কাছে ধান বীজের জন্য অস্বাভাবিক উচ্চমূল্য হাঁকছে।
বন্যা দুর্গত এলাকায় ব্যাপক সফরকালে জাতিসংঘ দুর্যোগ ও ত্রাণ সংস্থার সিনিয়র সমন্বয় সাধনকারী মিঃ পি সি, স্টেনিসিসের দৃষ্টি স্বাভাবিকভাবেই এই সমস্যা এড়িয়ে যায়নি। তাই তিনি যথার্থই বলেছে, জনসাধারণের এখন সর্বাধিক প্রয়োজন জীবন রক্ষার জন্য খাদ্য এবং ফসল বোনার জন্য বীজ। আগামী কয়েক মাস যদি নুন্যতম জীবনধারণের জন্য খাদ্য সংস্থান করা যায় এবং কৃষকদের মধ্যে বীজ বিতরণ করা সম্ভব হয় প্রয়োজন যত গভীরই হোক না কেন তা কাটিয়ে উঠা কঠিন হবে না। কদিন আগে জাতিসংঘ ৮৬টি দেশের সরকারের কাছে বাংলাদেশকে সাহায্য দানের জন্য আবেদন করেছিল তাতেও এমনই অভিমত ব্যক্ত করা হয়েছে।
আমরা তাদের অভিমত এর সাথে একমত। প্রয়োজনীয় বীজ পাওয়া গেলে উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে কৃষকরা সরকারের ওপর থেকে আমদানি চাপও হ্রাস করতে সক্ষম হবে। কিন্তু একটি ব্যাপারে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের সতর্ক দৃষ্টি রাখার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। ইতিমধ্যে কোন কোন স্থান থেকে বীজ সরবরাহ নিয়ে কারচুপির অভিযোগ উঠেছে। এ ব্যাপারে পূর্বাহ্নেই সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। কৃষকদের কাছে সরবরাহ সহজ পন্থা অনুসরণ করা দরকার।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন