এদের ‘গলাবাজি’র দরকার ছিল
কণা সেন
যােলই এপ্রিল সংখ্যার দর্পণে শ্রীস্বদেশ রঞ্জন সিংহের ‘এরা কোন লজ্জায় গলাবাজি করছে’ শীর্ষক চিঠিখানি একটি বাংলা প্রবাদকে মনে পড়িয়ে দিল।
শ্ৰীসিংহ কংগ্রেস, সি পি আই, বাংলা কংগ্রেস নেতা এবং অমৃতবাজার, যুগান্তর, আনন্দবাজার প্রভৃতি পত্রিকাগুলাের উপর খুব একচোট ঝাল ঝেড়েছেন বাংলাদেশের সাম্প্রতিক মুক্তিযুদ্ধ উপলক্ষে তাদের ‘গদগদ ভাব আর কান্না দেখে! তার একতরফা সমালােচনা প্রসঙ্গে আমার বক্তব্য, বাংলাদেশে যে স্বাধীনতা সংগ্রাম চলেছে তা ইতিহাসের এক অতুলনীয় অধ্যায়। তার মধ্যে কোনাে নােংরা রাজনীতি নেই। অন্তত এখন পর্যন্ত নেই। তাকে যারা সমর্থন করছে, বিশেষ করে ভারতের এবং পশ্চিমবঙ্গের তরফ থেকে, করছে প্রধানত দুই কারণে।
(ক) এমন ব্যাপক গণঅভ্যুত্থান, দেশের জন্য সমগ্র জাতির ঐক্যবদ্ধ মরণপণ সংগ্রাম বাঙালির জাতীয় জীবনে আগে কখনাে দেখা যায় নি। যে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব এবং কলুষতাহীন স্বজাতি ও দেশপ্রীতির অভাবে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি আজ ভয়াবহ বিচ্ছিন্নতাবােধে আক্রান্ত, ওপার বাংলায় তার সার্থক রূপায়ণের প্রতিচ্ছবি বাঙালি মাত্রেরই চিত্তকে উদ্বেলিত না করে পারেনি। ওপার বাংলার সংগ্রামী মানুষেরা আমাদের সহানুভূতি এবং শ্রদ্ধা জয় করে নিয়েছেন আপন গৌরবে।
(দুই) বাংলাদেশে ইয়াহিয়া খানের ব্যাপক গণহত্যার নীতি একদিন এবং অচিরেই ভারতকেও নানা সমস্যায় জর্জরিত করে তুলবে যদি সর্বরকম প্রচেষ্টার দ্বারা এ রক্তস্রোত বন্ধ না করা যায়।
বাংলাদেশের সগ্রামী মানুষের আজ পশ্চিমবঙ্গ ও ভারতের সহানুভূতি, স্বীকৃতি এবং সাহায্য পাওয়া সবচেয়ে জরুরি দরকার। আর তা যে তারা কিছু পরিমাণে পাচ্ছেনও তা প্রধানত এসব বুর্জোয়া পত্রিকাগুলাের আপ্রাণ প্রচারের ফলেই, তাই নয় কি? এঁরা যদি গলাবাজি’ করে বিশ্বকে, ভারতকে, পশ্চিমবঙ্গকে ও বাংলার পুঙ্খানুপুঙ্খ সংগ্রামের ইতিহাস না শশানাতেন, ছবিতে লেখায় সে দেশের প্রতিদিনকার ঘটনার বিবরণ না তুলে ধরতেন, তবে পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারত এমন উত্তাল হয়ে উঠত কি? রেডিওতে সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে আর কতটুকু খবর বলা যায়? তার চেয়ে ঢের ঢের বেশি ঘটনা ঘটে চলেছে এবং সেগুলাে প্রচার করে, সম্পাদকীয়তে তীব্র, তীক্ষ মন্তব্য করে যুগান্তর, আনন্দবাজার, অমৃতবাজার, দেশ, অমৃত লক্ষ লক্ষ মানুষকে বিচলিত, উন্মথিত করে তুলেছে। এরা স্বদেশীয় রাজনীতি কিংবা কূটনৈতিক ব্যাপারে একেবারে ধােয়া তুলসিপাতা তা কেউ বলবে না। কিংবা কংগ্রেস অথবা সি পি আই কিংবা শ্রীঅজয় মুখােপাধ্যায় সম্পর্কেও আমার বিন্দুমাত্র পক্ষপাতিত্ব নেই। কিন্তু পশ্চিমবাংলার ভুল রাজনীতির একটার পর একটা ভুল তারা করে ফাদে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে গিয়ে চলেছেন বলে, কখনাে ন্যায়ের পক্ষ সমর্থন করে একটা ভালাে কাজ করলে কিংবা একটা ভালাে কথা বললেও, তাকেও অবিশ্বাস আর সন্দেহের চোখে দেখব, সমালােচনায় ব্যতিব্যস্ত করে তুলবে- মানুষের শুভবুদ্ধির উপর এতােখানি আস্থা হারিয়ে ফেলবার কোনাে যুক্তি আমি দেখতে পাইনে।
কটু সমালােচনা একটু কম হলে হয়তাে দেখা যাবে ওপার বাংলার নিষ্কলঙ্ক জাতীয়তাবাবােধ তহাসের নিয়মে এপার বাংলার মানুষের মধ্যেও সঞ্চার হচ্ছে এবং আত্মকলহে, পারস্পরিক নিন্দায় ও কুৎসায় বাঙালিরাও ঐক্যবদ্ধ হতে, ভালােবাসতে শিখছে। আর এটা যে আমাদের এখন কত দরকার তা কি আপনারা বােঝেন না?
সূত্র: দর্পণ
৩০.০৪.১৯৭১