You dont have javascript enabled! Please enable it!
অপারেশন ফয়েজ লেইক
ফয়েজ লেইক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক বিস্ময়। চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক রূপ পর্যটকদের আকর্ষণ করে। বিশেষ করে পাহাড়ী অঞ্চলের সৌন্দৰ্য্যই আলাদা। ফয়েজ লেইক-এর সেই প্রাকৃতিক পরিবেশ আজ আর নেই। বর্বর পাকবাহিনী এ অঞ্চলটিকে বধ্যভূমিতে পরিণত করেছে। হায়নার হিংস্র ছােবলে ফয়েজ লেইকের রূপ হয়েছে রক্তাক্ত। প্রকৃতি নীরব নিথর হয়ে পড়ে রয়েছে মলিন মুখে। পাকিস্তানী বর্বরের দল বাংলার মানুষকে হত্যা করছে। চট্টগ্রামের অন্যতম বধ্যভূমি ফয়েজ লেইক। চট্টগ্রামের বিভিন্নি অঞ্চল থেকে পাকবাহিনী তাদের সহযােগিদের মাধ্যমে মুক্তিপাগল বাঙালিদের ধরে এনে ফয়েজ লেইকে হত্যা করছে। অসংখ্য আদম সন্তানের রক্তাক্ত দেহ শিয়াল কুকুরে খাচ্ছে। ফয়েজ লেইকের নীল জল রক্তাক্ত। এ জলের রক্তাভ রূপ দেখে হিংস্র শকুনীও ভীত হয়ে পালিয়ে গেছে। প্রতিদিন রাতে হাত, চোখ বেঁধে আদম সন্তানদের আনা হয়। তারপর পাঠিয়ে দেয় পরপারে। ফয়েজ লেইকের দু’পাহাড়ের মাঝে একটি ছােট খালের মতাে স্থান। ওখানে পাকবাহিনী তৈরি করেছে একটি বধ্যভূমি। একটি মাঝারি সাইজের পাথর বসিয়েছে সুন্দর করে। তার পাশেই আরাে একটি ছােট পাথর। মাঝারি সাইজের পাথরের পাশে রয়েছে ছােট বড় অনেকগুলাে ধারাল ছুরি। পাথরের দু’পাশে দুটি শক্ত গাছ মাটিতে পুঁতে রেখেছে। গাছগুলাের সাথে হুক বাঁধা কয়টি রশি। প্রতিটি রশির হুক মাটির হুকের সাথে লাগিয়ে রাখা হয়। বাঙালিদের ধরে এনে মাঝারী পাথরের ওপর চিৎ করে শুইয়ে দেয়া হত। হুকওয়ালা রশিগুলাে দিয়ে দেহের বিভিন্ন অংশ বেঁধে দিত।
তারপর জল্লাদের দল সামনে এসে হাতে তুলে নিতাে বড় মাঝারি সাইজের ধারালাে ছুরি। ছােট ছুরি দিয়ে বাঙালি বন্দিদের পেট চিরে ফেলত আর বড় ছুরি দিয়ে তাদের জবাই করা হত। এভাবে অসহায় বাঙালিদের ফয়েজ লেইক বধ্যভূমিতে এনে হত্যা করা হয়। বাঙালিদের হত্যার করুণ কাহিনী শুনে মুক্তিযােদ্ধারা ভীষণ আহত হন। তাঁরা প্রতিজ্ঞা করেন বর্বর পাকবাহিনীকে শিক্ষা দেবেন। ফয়েজ লেইকের পাহাড়ে রয়েছে একটি বিরাট আকার ট্রান্সফরমার। পাকবাহিনী এ ট্রান্সফরমার থেকেই প্রতিনিয়ত একটি আলাে পেয়ে থাকে। সিদ্ধান্ত হল এ ট্রান্সফরমার ধ্বংস করতেই হবে। এ প্রতিজ্ঞা নিয়ে ডাঃ মাহফুজুর রহমান একদল মুক্তিযােদ্ধাকে বেছে নেন। দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে তিনি আব্দুল্লাহ আল হারুণ, ডাঃ জাহাঙ্গীর কবির, ডাঃ আলাউদ্দিন, ফয়েজুর রহমান, আব্দুল আজিজ খান, মনছুর ও মফিজসহ মােট ২৫/৩০ জন মুক্তিযােদ্ধাকে নিয়ে রওয়ানা হন ফয়েজ লেইক ট্রান্সফরমারের দিকে। উল্লেখিত মুক্তিযােদ্ধাদের অনেকের আশ্রয়কেন্দ্র ছিল পাঞ্জাবী লেনে (বর্তমান শহীদ লেন)। পাকবাহিনীর অবস্থান ছিল আকবর শাহ-এর মাজারের পাশে পাহাড়ের উপর। তাদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে এলেন সবাই টার্গেটে । রাত তখন প্রায় ১টা। ডাঃ মাহফুজুর রহমান, ডাঃ জাহাঙ্গীর কবির রয়েছেন মূল ট্রান্সফরমারে বিস্ফোরক লাগানাের কাজে। ডাঃ আলাউদ্দিন, আবদুল্লাহ আল হারুণ, ফয়েজুর রহমানসহ অন্যান্যরা অস্ত্র হাতে পাহারায়।
এ অপারেশনে আসার পূর্বে মুক্তিযােদ্ধারা পরীক্ষা করে দেখেছে একটি পূর্ণাঙ্গ মশার কয়েল জ্বলে শেষ হতে কতক্ষণ সময় লাগে। মুক্তিযােদ্ধারা ট্রান্সফরমারে প্রয়ােজনীয় বিস্ফোরক স্থাপন করেন। তারপর ডেটনেটরে ইগনিশন করার জন্য কর্ডের সাথে মশার কয়েল লাগিয়ে দেন। চার ঘন্টায় কয়েল কতটুকু জ্বলবে কয়েলের ঠিক সেই স্থানে কর্ড লাগিয়ে দেয়া হয়।  বিস্ফোরক স্থাপন করতে মুক্তিযােদ্ধাদের আধা ঘন্টা লেগেছে। তারপর কয়েল জ্বালিয়ে দিয়ে সবাই চলে আসেন। রাত তখন প্রায় ১.৩০ মিনিট। কাজ শেষ করে মুক্তিযোেদ্ধারা পাকিবাহিনীর চোখকে ফাঁকি দিয়ে আবার ফিরে আসেন শহীদ লেনের গােপন আশ্রয়ে। আসার সময় মুক্তিযােদ্ধাদের ক’জনকে স্থানীয় লােকজন দেখে ফেলে। তারা চোর মনে করে দৌড়ে আসে। কাছে এসেই দেখে সবাই পরিচিত মুক্তিযােদ্ধা। এলাকাবাসী প্রায় মুক্তিযােদ্ধাদের চিনত। তারা সহযােগিতা করত মুক্তিযােদ্ধাদের। রাত তখন শেষ প্রহর। মুক্তিযােদ্ধারা আপন আশ্রয়ে এসে গভীর উৎকণ্ঠায় সময় কাটাচ্ছে। দেখছে ঘড়ির কাঁটা। ঘড়ির কাঁটা ঠিক ৪.৩০ মিনিট, কানে এল প্রচন্ড বিস্ফোরণের আওয়াজ। অপারেশন সফল হয়েছে। স্থানীয় পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের অবস্থা তখন কাহিল। অপারেশন ফয়েজ লেইক মুক্তিযােদ্ধাদের বুদ্ধিমত্তার ফসল। এ অপারেশন মশার কয়েল দিয়ে সম্পন্ন করা হয়েছে।
(সূত্র : রণাঙ্গনে সূর্য সৈনিক, সাখাওয়াত হােসেন মজনু )

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!