অপারেশন চন্দনপুরা রাজাকার ক্যাম্প
রাজাকারবাহিনী বাংলার কলঙ্ক। তাদের প্রতিটি সদস্য বেঈমানের ছোঁয়া সমৃদ্ধ। তারা এ মাটিতে জন্মেছে,এ মাটির আলাে বাতাসে বেড়ে উঠেছে। অবশেষে তারাই বেঈমানী করেছে বাংলার শ্যামল মাটির সাথে। ইতিহাস এবং আগামী প্রজন্ম তাদের মূল্যায়ন করবে ঘৃণার সাথে। তখন ১৯৭১-এর অক্টোবর মাস। মুক্তিযােদ্ধাদের মােকাবিলা করতে পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের নাভিশ্বাস উঠে গেছে। মুক্তিযােদ্ধাদের গেরিলা কৌশলের নিকট তারা বার বার পরাস্ত হচ্ছে। মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণে রুখে দিতে পাকবাহিনী চট্টগ্রাম শহরের আনাচে-কানাচে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছে। রাজাকার, আল বদর, আল শামস দলের সদস্যদের শহরের বিভিন্ন ক্যাম্পে স্থাপন করিছে। তেমনি একটি রাজাকার ক্যাম্পে স্থাপিত হয়েছে চন্দনপুরায়। এ ক্যাম্পটি স্থাপিত হয়েছে চন্দনপুরা প্রধান সড়কের উপর। অনেকগুলাে দোকানের পাশে। এখানে রাজাকার বাহিনী রাস্তা পারাপারের সময় প্রতিটি গাড়ি তার চেক করত। সমস্যায় পড়লেন মুক্তিযােদ্ধারা। এ রােড দিয়ে পটিয়া থেকে অস্ত্র আসার কথা কিন্তু রাজাকার বাহিনী তাদের চন্দনপুরা ক্যাম্পে থেকে এখানে চেক পােষ্ট বসিয়েছে। পটিয়া থেকে আসা বেশ কিছু অস্ত্র মাঝপথে আটক রয়েছে। এ অস্ত্র শহরে প্রবেশ করাতে না পারলে অনেকগুলাে অপারেশন সম্পন্ন করা যাবে না। ভাবনায় পড়লেন সবাই। অবশেষে এ সমস্যা সমাধানের জন্য সার্বিক দায়িত্ব দেয়া হল সাহসী যােদ্ধা এনামুল হক দানুকে। তিনি ভাবলেন ক’দিন। মনে মনে পরিকল্পনা ঠিক করে বসলেন বৈঠকে। চকবাজারের আত্মত্যাগী পুরুষ শান্তনু চক্রবর্তীর বাসায় বসে এনামুল হক দানু মনােনীত করলেন দু’জন গেরীলা যােদ্ধাকে। তাঁরা হলেন নাসিরউদ্দীন চৌধুরী (বর্তমানে পূর্বকোণের সাংবাদিক) ও মাহবুবুর রহমানকে। যথাসময়ে তারা এলেন চকবাজার শান্তনু চক্রবর্তীর বাসায়। মাথায় টুপি পরে দু’জন বের হলেন গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। একটি ট্যাক্সী তাদের বহন করেছে।
সাথে রয়েছে দু’জনের দুটো ষ্টেনগান। পরিকল্পনা হল রাজাকার ক্যাম্পে পৌঁছে মাহবুব ফায়ার করবে আর নাসিরুদ্দীন তাকে কাভারিং দেবে। টেক্সী এগিয়ে চলল। সামনে মানুষজন পথ চলছে। রাজাকার বাহিনী তখন তাদের ক্যাম্পে গল্পগুজব করছিল । মুক্তিযােদ্ধা দু’জন গায়ে চাদর দিয়ে আস্তে আস্তে এসে দাঁড়ালেন রাস্তার অপর পাড়ে। টেক্সী অপেক্ষা করছে। তারা দেখছেন রাজাকারদের অবস্থান। রাজাকার দল সম্পূর্ণভাবে অপ্রস্তুত। অপেক্ষা করার সময় নেই। দ্রুত ক্যাম্পের সামনে এলেন তারা। কিন্তু সামনে ছিল কাঠের উঁচু পাটাতন। হুমড়ি খেয়ে পরলেন। মাহবুবের পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ হল। রাজাকার বাহিনী প্রায় বুঝে গেছে। তাই আর অপেক্ষা না করে নাসিরুদ্দীন চৌধুরী নিজেই রাজাকারদের লক্ষ্যে ব্রাশ ফায়ার করলেন। রাজাকার প্রতি উত্তর দিতে পারল না। ঘটনাস্থলে মারা গেল ৮ জন। আহতের সংখ্যা প্রায় ১০ জন, ক’জন পালিয়ে বেচেছে। নাসিরুদ্দীন চৌধুরী পরবর্তী সময় চলে যান দক্ষিণ চট্টগ্রামে। সেখানে তিনি লড়েছেন শত্রুর বিরুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি আত্মত্যাগের মানসিকতা নিয়ে দেশ সেবায় রত ছিলেন। চন্দনপুরা রাজাকার ক্যাম্পে আক্রমণ করে তিনি রাজাকার বাহিনীর মধ্যে ভীতির সঞ্চার করতে সক্ষম হয়ে ছিলেন। পরবর্তী কালে চন্দনপুরা রাজাকার ক্যাম্প সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যায়। অনেক রাজাকার স্বপক্ষ ত্যাগ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। এ অপারেশন শহরে বেশ আলােড়ন সৃষ্টি করেছিল। স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতারকেন্দ্র এ অপারেশনের বর্ণনা চমৎকারভাবে প্রচার করেছিল। ( সূত্র ঃ রণাঙ্গনে সূর্য সৈনিক, সাখাওয়াত হােসেন মজনু)
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত