You dont have javascript enabled! Please enable it!
অপারেশন লাজাফ পেট্রোল পাম্প
পাকবাহিনীর হৃৎপিন্ডে মুক্তিযােদ্ধারা আঘাত হেনেই চলেছে। মুক্তিরসেনারা পাকবাহিনীর সব স্থানে আঘাত হানছে। বর্বরদের রুখতে হলে চাই তাদের সমস্ত চলার পথে বাধার সৃষ্টি করা। মার্চের পর প্রথম ক’মাস তাদের যে দাপট ছিল এখন তা নেই। তারা তাদের অপকর্ম স্থানীয় দালালদের মাধ্যমে করে যাচ্ছে। শহরে মুক্তিযােদ্ধাদের অসমসাহসী অপারেশন পাকবাহিনীকে ভাবিয়ে তুলছে। মুক্তিযােদ্ধারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে পাকবাহিনীর সবধরনের সরবরাহ বন্ধ করে দেবে।  সেপ্টেম্বর মাস। এফএক প্রশের জিন্নাহ বিশেষ প্রশিক্ষণ নিয়ে আসেন ভারত থেকে অল্প ক’দিনে চট্টগ্রামের পাকবাহিনীর অবস্থান সম্বন্ধে ধারণা অর্জন করেন। তিনি সিদ্ধান্ত নেন পাকবাহিনীর সরবরাহ কেন্দ্রে আঘাত করে তাদের দুর্বল করা যাবে না। এছাড়া ভারত থেকে আসার সময় নির্দেশ ছিল পাকসেনাদের পেট্রোল সরবরাহ কেন্দ্রগুলিকে গুড়িয়ে দিতে হবে। মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ শহরে প্রবেশ করে দেখলেন জামাল খান রােডের উত্তরকোণে খাস্তগীর স্কুলের সামনে লাজাফ পেট্রোল পাম্প পাকবাহিনীকে পেট্রোল সরবরাহ করে থাকে। সিদ্ধান্ত নিলেন এই লাজাফ পেট্রোল পাম্পটিকে তিনি উড়িয়ে দেবেন। এক সপ্তাহ রেকি করে তৈরি করলেন একটি অপারেশন পরিকল্পনা। বের করলেন সুবিধে-অসুবিধে।
সেপ্টেম্বর মাসের শেষ সময়। তিনি গেলেন প্যারেড গ্রাউন্ডের পাশে মুক্তিযোেদ্ধা জাকারিয়ার বাসায়। জিন্নাহ, জাকারিয়া, সলিম উল্লাহ, জন জোসেফ বাড়ই ও ফিরােজসহ অপারেশনের জন্য পূর্ণ পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। দীর্ঘ আলাপ আলােচনার পর সিদ্ধান্ত হল লাজাফ’ পেট্রোল পাম্পকে অপারেশন করে উড়িয়ে দেবেন। সমস্যা একটি তা হল দিনের প্রায় সবসময়ই পাকবাহিনীর একটি না একটি গাড়ি পাম্পে থাকেই। তাই তারা বের করল বিকল্প পথ। ভাের ৬ টা। নির্ধারিত সময়ে জিন্নার নেতৃত্বে জাকারিয়ার বাসা থেকে বেরিয়ে এলেন সবাই। অপারেশরের জন্য তারা ব্যবহার করছে একটি গাড়ি। ড্রাইভিং সিটে বসেছে। সবার হাতে স্টেনগান ও প্রয়ােজনীয় বিস্ফোরক। চলে এল তারা পেট্রোল পাম্পের সামনে এসে দেখেন একটি গাড়ি ঘুরিয়ে চলে গেল জামাল খানের দিকে। কিছু সময় এদিকওদিক ঘুরিয়ে আবার এলেন পেট্রোল পাম্পের সামনে। পেট্রোল পাম্পের সামনে সেই গাড়িটি আর নেই। আর অপেক্ষা না করে মুক্তিযােদ্ধারা গাড়িসহ প্রবেশ করলেন পেট্রোল পাম্পের ভিতরে। পাম্পের কর্মচারীরা ভেবেছিল পেট্রোল নিতে এসেছে গাড়িটি। এগিয়ে এল একজন। চোখের পলকে সবাই গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। পাম্পের কর্মচারীটির বুকে স্টেন ধরে নিয়ে এলেন ভিতরে অফিস কক্ষে। বাকীরা জামাল খান ও আসকার দীঘির রাস্তার দিকে পাহারা বসিয়েছে। দলনেতা জিন্নাহ অফিস কক্ষে ম্যানেজারকে নিয়ে রয়েছে। চাবী চাইলেন রিজার্ভ ট্যাংকের।
কিন্তু বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হল হাতে সময় কম। যে কোন সময় বিপদ হতে পারে। আর দেরি করার সময় নেই। পাম্পের নলদ্বারা পুরাে এলাকাকে ভিজিয়ে দেয়া হল পেট্রোল ছিটিয়ে। তারপর পেট্রোল রিজার্ভ ট্যাংকের মুখে, অফিস কক্ষে, সার্ভিসিং সেন্টারসহ আরাে কিছু স্থানে বিস্ফোরক স্থাপন করা হল। সমস্যা দেখা দিল পাম্পের কর্মচারীদের নিয়ে। বিস্ফোরক বিস্ফোরিত হলে পাম্পের, কর্মচারীদের মৃত্যু অবধারিত। তড়িৎ সিদ্ধান্ত নেয়া হল। পাম্পের কর্মচারীদের এক জায়গায় এনে জড়াে করা হল। তারপর তাদের বলা হল আসকার দীঘির পাড়ের দিকে দৌড় দিতে। উপায় নেই- কর্মচারীরা তাই করল। সবাই একই সাথে ছুটতে শুরু করল আসকার দীঘির পাড়ের দিকে। প্রাতঃভ্রমণের সময় মানুষ যেভাবে দৌড়ে তারাও সেভাবে দৌড়চ্ছে। ইতিমধ্যে মুক্তিযােদ্ধা জাকারিয়া সেফটি ফিউজে আগুন দিয়ে দ্রুত ওঠে পড়ল গাড়িতে। একে একে সবাই গাড়িতে উঠতেই গাড়ি ছুটতে শুরু করল। সবাই তখন মাঠের উত্তরে জাকারিয়াদের বাসায়। অপারেশন সফল না ব্যর্থ তা মুক্তিযােদ্ধারা জানতে পারেনি। অত্যাধিক উত্তেজনা ও নিরাপত্তার কথা ভেবে গাড়ি নিয়ে সবাই ছুটে চলে এসেছে। পরে অপারেশনের সংবাদ সংগ্রহের জন্য লােক পাঠান হল। লােকটি অপারেশন। স্থলের আশে পাশে এসে সংবাদ পেল পেট্রোল পাম্প সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত। মুক্তিযােদ্ধারা মানসিক উত্তেজনার কারণে বিস্ফোরণের আওয়াজ শুনতে পায়নি। লাজাফ পেট্রোল পাম্পটি চালু করা যায়নি। পাম্পের মালিক মুক্তিযােদ্ধাদের ভয়ে পাম্পটি আর চালু করার চেষ্টাও করেনি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও এ পাম্পটি বিধ্বস্ত অস্তিত্ব নিয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছিল। (সূত্র : রণাঙ্গনে সূর্য সৈনিক, সাখাওয়াত হােসেন মজনু )

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!