সল্টগােলা অপারেশন
চট্টগ্রামের বৰ্হিনােঙ্গর অপারেশনের শিক্ষা নৌকমান্ডােরা ভুলতে পারেনি। এ অপারেশনে গিয়ে তারা হারিয়েছেন বীর ক’জন কমান্ডােকে। সে আঘাত নিয়ে তারা প্রতিজ্ঞা করেছে জলপথে পাকহানাদারদের দিশেহারা করে রাখবে। | খবর এল পাকিস্তানী জাহাজ সফিনা- ই- রহমত চট্টগ্রাম বন্দরের ১৩ নম্বর জেটিতে এসেছে। এ সংবাদ পেয়ে নৌকমান্ডােরা চঞ্চল হয়ে ওঠেন। কারণ এ জাহাজটি ঘায়েল করতে গিয়ে তাদের ক’জন কমান্ডাে শহীদ হয়েছে। সফিনা-ই-রহমতের আগমন সংবাদ পেয়ে নৌ কমান্ডাে ফারুখ-ই-আজম রেকি করেন। বন্দরের অবস্থান ও জাহাজের দূরত্বসহ সার্বিক বিষয়ের ওপর রেকি শেষ করে তিনি ভাবছিলেন কাদের দিয়ে অপারেশন সম্পন্ন করবেন। সবাই অপারেশনে যেতে চায়। বিগত ক’টি অপারেশনের শিক্ষা থেকে তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দু’জন করে কমান্ডােকে দিয়ে অপারেশনের সম্পন্ন করবেন। অপারেশনে যাবেই। অনেক আলাপ আলােচনার পর ঠিক হল আবু মুছা চৌধুরী ও মনােজ এ অপারেশন সম্পন্ন করবে। কারণ অপারেশন আউটার এংকরের ব্যর্থতার পর আবু মুছা চৌধুরী মরণপণ প্রতিজ্ঞা করেছেন। যে কোন কিছুর বিনিময় হােক এ অপারেশন সফল করতেই হবে। এ অপারেশন সফল করতে হলে মৃত্যু বরণ করতেও আপত্তি নেই। আবু মুছা চৌধুরী পরবর্তীতে ঢাকার কাচপুরের অপারেশন কালাগাছিয়ায় তুরাগ জাহাজ অপারেশন সম্পন্ন করেন। অসীম সাহসী এ বীর কাঁচপুর মিনি লায়ন, মিনি লেডী গমবাহী পাকজাহাজকে ধ্বংস করতে কমান্ডাে আক্রমণ চালিয়েছিলেন। এভলােজ ও মানা জাহাজ আপারেশন এর উদ্দেশ্যে আবু মুছা চৌধুরী ও মনােজ আসেন রিয়াজ উদ্দিন বাজারের সফিনা হােটেল হয়ে আগ্রাবাদে কর্ণফুলী মার্কেটে। দলীয় অধিনায়ক ফারুখ-ই-আজমও রয়েছেন। রাত তখন ৮টা। স্থানীয় একজন মুক্তিযোেদ্ধা নুরুল হক (বর্তমানে যমুনার অফিসার) তাদের নিয়ে উত্তর পতেঙ্গা বাজারের পশ্চিমে মুসলিমাবাদ গ্রামে আসেন। সেখানে অপেক্ষায় ছিলেন নূর মােহাম্মদ, মাহবুবুল আলম মাহবুব।
সেখান থেকে তাঁরা আসেন নূরুদ্দিন সাহেবের বাসায়। পূর্বে নূরুল হক, লােকমান গণি জাহাজ আপারেশনের প্রয়ােজনীয় অস্ত্র একটি অষ্টিন গাড়িতে করে এনে রাখেন নৌ বাহিনীর সেইলার্স কলােনীর পূর্বপাশে নূরুল ইসলাম নামক একজনের বাড়িতে। সেখানে থেকে পরে চাল ও তরকারীর বস্তায় করে আনা হয় নুরুদ্দিন সাহেবের বাসায়। এ মালামাল পরিবহনে সহযােগিতা দিয়েছিলেন সেকান্দর ও আবুল কালাম। নুরুল হক এ অপারেশন ও নৌকমান্ডােদের গাইডার। সবাই মিলে গােপন শেল্টারে খেলেন। রাত ১১টা। রাত ১১.৩০ মিনিটে পাহারা বদল হবে। গুপ্তখালের চারদিকে পাকবাহিনীর পাহারা থাকে। নৌকমান্ডােরা সিদ্ধান্ত নিল পাহারা বদলের সময় পানিতে নেমে যেতে হবে। কারণ এ সংক্ষিপ্ত সময়ে কোন দল পাহারায় থাকে না। দূর থেকে নৌকমান্ডােরা দেখছে পাহারা বদল হচ্ছে। দেরি না করে প্রয়ােজনীয় সামগ্রী ও মাইন বুকে বেঁধে আবু মুছা চৌধুরী ও মননাজ কুমার দত্ত নুরুদ্দিন সাহেবের বাসা থেকে বেরিয়ে গুপ্তখালের জলে নেমে পড়েন। তারা বহন করছে ৪টি লিমপেট দুট, ছুরি। এছাড়া পলিথিনে করে একটি সার্ট, একটি লুঙ্গি ও ৩০০টাকা দেহে বেঁধে নিয়েছে। যেন আপারেশন শেষে সাধারণ বেশ ধরতে পারে। আবু মুছা চৌধুরী ও মনােজ যখন গুপ্তখালের জলে নামছেন তখন একজন লােক। তাদের দেখে ফেলে। পাশেই ছিল ফারুখ-ই-আজম ও নুরুল হক তারা দ্রুত লােকটিকে অস্ত্রের মুখে বেঁধে ফেলে। তাকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে গিয়ে ভাল করে হাত মুখ বেঁধে দূরে ফেলে রাখে।
গুপ্তখালের জলে নিঃশব্দে দু’কমান্ডাে চলছে গন্তব্যে। সামনে এগুতেই দেখে দু’জন পাকসৈন্য পুলের গােড়ায় পাহারায়। নৌকমান্ডাে দু’জন ভয় পেল। একটি কাঁচা পায়খানার আড়ালে লুকিয়ে রইলেন। কতক্ষণপর পুলের ওপর পাহারারত পাকবাহিনী দু’জন সরে গেল। দেরি না হয়ে সাহসী নৌকমান্ডাে দু’জন ত্বরিৎগতিতে গিয়ে পড়েন কর্ণফুলীর জলে। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে কাক্ষিত লক্ষ্যবস্তু। আবু মুছা চৌধুরী চলছে এভলােজ জাহাজের দিকে আর মনােজ মানা। জাহাজের ওপর পাকসৈন্যদের চলাচল। কখনাে সার্চ লাইটের আলাে এসে পড়ছে। দুরু দুরু বক্ষ নিয়ে এগুচ্ছেন দু’বীর। একটু অসচেতন হলে মৃত্যু অবধারিত। কতক্ষণ সাঁতার কাটার পর দু’জন এলেন কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য বস্তুর নিকট। আবু মুছা চৌধুরী বুক থেকে খুলে নিলেন দুটি লিমপেট মাইন। অপর দিকে মনােজও মানা জাহাজে দুটি মাইন লাগালেন ! তারপর পূর্বের মতাে তারা দু’জন কর্ণফুলী সেদিন ২রা অক্টোবর। পূর্বের তুলনায় বন্দরের অবস্থা বিপদসংকুল। নিরাপত্তা বেষ্টনী কড়া। বন্দরের জলে-স্থলে একই অবস্থা। পাকবাহিনীর পাহারা ডিঙ্গিয়ে অপারেশন সম্পন্ন করা সে এক ভীতিকর ব্যাপার। সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে অপারেশনের অধিনায়ক ফারুখ-ই-আজম সিদ্ধান্ত নিলেন বন্দরে অবস্থানরত পাকবাহিনীর চোখে ধূলাে দিয়ে তারা কাক্ষি সফলতা অর্জন করবেন। যথা সময়ে দু’জন কমান্ডােকে বাছাই করা হল। তারা হলেন আবু তাহের ও মনু। গাইডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন নূর মােহাম্মদ (বাসদ নেতা), আহমদ শরীফ (স্থানীয় যােদ্ধা), আবদুর রহমান (মুক্তিযােদ্ধা কমান্ডার), নূরুল হক (যমুনার অফিসার), লােকমান গণি (মুক্তিযােদ্ধা কমান্ডার) প্রমুখ।
গাইডার দল ঠিক সময়ে মাইনসহ যাবতীয় গােলাবারুদ, অস্ত্র নিয়ে আসেন। ঈশান মিস্ত্রীর হাটের কোরবান শাহ-এর মাজারের সংলগ্ন কালু সওদাগরের বাড়িতে। সন্ধার পূর্বেই ফারুখ- ই- আজম অপারেশনের জন্য মনােনীত কমান্ডাে আবু তাহের ও মনুকে সঙ্গে নিয়ে কালু সওদাগরের বাড়িতে চলে আসেন। রাতে সবাই কালু সওদাগরের বাড়িতে খেলেন। আবু তাহের ও মনু অপারেশনের জন্য প্রয়ােজনীয় সংক্ষিপ্ত পােষাক পরেন। বুকে গামছা দিয়ে মাইন | বেঁধে নিলেন। পায়ে লাগালেন সাঁতার কাটার ফিন্স। তারপর সতীর্থদের সাথে কোলাকুলি করে অন্ধকারে নেমে গেলেন সল্টগােলা খালে। দু’জন নৌকমান্ডাে চলেছেন দেশমাতার স্বাধীনতার জন্য মৃত্যুর পথে। বাঁচলে তাঁরা গাজী, মরলে শহীদ। নিঃশব্দ গতিতে খালের পানি দিয়ে তাঁরা এগুচ্ছে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যের দিকে। এক সময় তারা পাকসেনাদের চোখকে ফঁকি দিয়ে অতিক্রম করেন সল্টগােলা ব্রীজ। ব্রীজের ওপর ছিল পাহারারত পাকসৈনিকের দল। রাত তখন ১০.৩০ মিনিট। মুক্তির দুই বীর নৌকমান্ডাে কর্ণফুলীর জলের সাথে মিশে যান। দূর থেকে দেখে কাঙ্খিত জাহাজটি ১৩ নম্বর জেটির জলে ভাসছে। উত্তেজনা তাদের প্রতিটি রক্ত কণিকায়। আল্লাহকে স্মরণ করে সাতরাতে শুরু করেন। জাহাজ ডেকে পাকবাহিনীর চলাচল দেখা যাচ্ছে। অল্প কতক্ষণ সাঁতরিয়ে তারা এলেন জাহাজের নিকট। কোমর থেকে ছুরি বের করে তারা জাহাজের শ্যাওলা পরিস্কার করে দু’জনে নিজেদের বুকের সাথে বেঁধে রাখা মইনগুলাে জাহাজে স্থাপন করে দিলেন। কর্ণফুলীর স্রোতের টানে আবারাে নিঃশব্দে নৌকমান্ডাে দু’জন সাঁতরিয়ে চলেছেন নিরাপদ স্থানের উদ্দেশ্যে। | সময় গড়িয়ে গেল। মুক্তির দু’জন নৌকমান্ডাে পানিতে সাঁতরিয়ে চলেছেন। এক সময় একেঅপরের থেকে ঢেউয়ের ধাক্কায় ছিটকে গেলেন। প্রায় ৪০ মিনিট পর প্রচন্ড বিস্ফোরণ হল। বিস্ফোরণের শব্দে নদীর জলও কেঁপে উঠল। চারদিক থেকে ভেসে আসছে পাকবাহিনীর গােলাগুলির শব্দ। তারা অনবরত পানিতে গুলি ছুড়েই চলেছে। শহরের বিভিন্ন অবস্থান থেকে পাকবাহিনী গুলি ছুড়ছে অনবরত। দীর্ঘক্ষণ ধরে এলােপাথাড়ি গুলি ছুড়তে ছুড়তে হয়ত তারাও ক্লান্ত হয়েছে। ততক্ষণে পাকিস্তানের জাহাজ সফিনা- ই- রহমত চট্টগ্রাম বন্দরের ১৩ নম্বর জেটিতে মালামাল ও অস্ত্রসহ ডুবে গেল। মুক্তির সাহসী সৈনিক আবু তাহের ও মনু নদীতে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেও আল্লাহর বিশেষ রহমতে নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁরা পরদিন সতীর্থদের সাথে পুনরায় মিলিত হন। ( সূত্র ঃ রণাঙ্গনে সূর্য সৈনিক, সাখাওয়াত হােসেন মজনু)
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত