You dont have javascript enabled! Please enable it!
অপারেশন পাক ইনটেলিজেন্স অফিসার
পুরাে জাতি বর্বরদের হাতে জিম্মী। তাদের খেয়াল খুশির উপরই সবাইকে নির্ভর করতে হচ্ছে। তাদের যত্রতত্র গমন ভয়ের কারণ। বিশেষ করে নারী নির্যাতনের কারণে সকলে ভীত। যুদ্ধ এবং সৈনিকের ন্যূনতম মূল্যবােধ পাকহানাদারদের মধ্যে নেই। সবই। আজ ভূ-লুণ্ঠিত। তাদের এ জঘন্য কাজে বাধা হল মুক্তিযােদ্ধারা। বর্বরদের বিষদাঁত ভাঙ্গতেই হবে আগ্রাবাদ ছােটপপালের দফাদার বাড়ি। হালিশহর রাস্তার কোল ঘেঁষে এ বাড়িতে মুক্তিযােদ্ধারা মাঝে মাঝে আশ্রয় পায় এ বাড়ির সকলে অত্যন্ত আন্তরিকতা নিয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের আশ্রয় দিতেন। খাওয়াতেন, পরাতেন এমনকি মাঝে মাঝে অস্ত্র হেফাজতে রাখতেন। এ বাড়ির মালিক ছিলেন আলহাজ আব্দুল মালেক। দফাদার হিসেবে তিনি ছিলেন বিশেষ পরিচিত।  একরাতে, সম্ভবত আগষ্টের প্রথম সপ্তাহে মুক্তিযােদ্ধা অমল মিত্র, নূর মােহাম্মদ মিন্টু, আব্দুল বারেক, ফজলুল হক ভূইয়া, আবু সাঈদ সরদার, মুকুল দাশ, ফখরুল হাসান মনি আশ্রয় নেন ছােটপুল ঐ দফাদারের বাড়িতে। রাত তখন গভীর বাড়ির মহিলারা রাত জেগে মুরগী জবেহ করে মুক্তিযােদ্ধাদের খাওয়ালেন। একদিকে বিধ্বস্ত দেশের ওপর দফাদার পরিবার অর্থনৈতিক ভাবে পংগু। তবুও প্রাণের আবেগে মুক্তিযােদ্ধাদের খাওয়ালেন। নিজেরা রাতে পাহারা দিয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করলেন।
সকাল হল। বাড়ির মহিলারা মুক্তিযােদ্ধাদের সকালের নাস্তা তৈরি করতে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। এ ব্যাপারটি মুক্তিযােদ্ধারা টের পেলেন। তাঁরা দফাদারকে ডেকে নাস্তার আয়ােজন বাদ দিতে বলেন। তবুও দফাদার নাস্তার ব্যবস্থা করতে এলেন রাস্তায়। উদ্দেশ্য পরােটা কিনবেন হােটেল থেকে। পরােটা কিনে বাসায় ফিরছিলেন তখনই সাদা পােষাকে একজন লােক তার বুকে রিভালবার চেপে ধরেছে। উচ্চস্বরে সম্পূর্ণ উর্দুতে বলছে, ‘তােমার বাড়িতে মুক্তিদের আশ্রয় দিয়েছ।’ হাতের পরােটাগুলাে ছুঁড়ে ফেলে দিল রাস্তায়। মানুষজন ভয়ে পালাল। লােকটি আব্দুল মালেক দফাদারকে অস্ত্রের মুখে নিয়ে যাচ্ছে। এ সংবাদ তার বাড়িতে পৌছে গেল। সংবাদ পেয়ে মুক্তিযােদ্ধারা মর্মাহত হলেন। যে লােক আমাদের জন্য মৃত্যু মুখে যাচ্ছে, তাকে উদ্ধার করতেই হবে। এ ভেবে মুক্তিযােদ্ধা অমল মিত্র নিজের রিভলবারটিকে সঙ্গী করে ঘর থেকে বের হয়ে এলেন। রাস্তায় এসে দেখেন দফাদারকে অনেক দূর নিয়ে গেছে। কোন কিছু চিন্তা না করেই অমল মিত্র উপরের দিকে রিভলবারের ফাঁকা আওয়াজ করলেন। আওয়াজের শব্দে সাদা পােষাকধারী লােকটি চারদিকে তাকাতে লাগল। আরাে একটি গুলি ছোড়া হল। এবার লােকটি দফাদারকে ছেড়ে দৌড়াতে শুরু করল। অমল মিত্র তার পিছু পিছু দৌড়াতে লাগল। সে দৌড়তে দৌড়তে এসে পড়ল আগ্রাবাদ সিসিএ কলােনীতে একটি ধান ক্ষেতের পেছনে। সেও অমল মিত্রকে পাল্টা গুলি ছুড়েছে। কিন্তু ব্যর্থ এ ঘোড়া। প্রায় এক মাইল এদিক-ওদিক দৌড়ানাের পর লােকটি আশ্রয় নিল সিডি এর একটি বাড়ি পেছনে।
মুক্তিযােদ্ধা অমল মিত্র দুটি বাড়ি ঘুরে লােকটিকে পেছন দিকে থেকে আক্রমণ করে তার রিভলবারটি কেড়ে নেয়। অনেকক্ষণ দু’জনের মধ্যে ধস্তাধস্তি হয়। অবশেষে লােকটি পরাস্ত হয়। ইতিমধ্যে অন্যান্য মুক্তিযােদ্ধারা এসে গেছে। তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ অপারেশনের পর সবাই চলে যায় আবিদরপাড়া সুলতান কন্ট্রাক্টরের বাডিতেমন্ত্রী সুলতান আহমেদ (জলসার মালিক) পাকবাহিনীর সাথে ছিলেন ঠিকই কিন্তু তিনি গােপনে মুক্তিযযাদ্ধাদের সাহায্য দিতেন। তাঁকে গিয়ে পুরাে ঘটনা বলা হল। সেখান থেকে মুক্তিযােদ্ধারা চলে যান মাদারবাড়ি আবু জাফর (কমিশনার) সাহেবের বাড়িতে। সেখানে বিশ্রাম নেন সবাই। বিকেলে আগ্রাবাদ সিডিএ কলােনীতে এল অনেক পাকসৈন্য। নিহতকে পাকিস্তানী পতাকা ঢেকে সামরিক মর্যাদায় নিয়ে গেল। সন্ধ্যার সাথে সাথে। পাকবাহিনী পুরাে এলাকা ঘেরাও করে ২৫০ জনকে ধরে নিয়ে যায়। অবশ্য মন্ত্রী সুলতান আহমদ বন্দি সবাইকে পরে মুক্ত করে আনেন।
নিহত লােকটি ছিল পাকসামরিক বাহিনীর ইনটেলিজেন্স অফিসার। মেজর মর্যাদা সম্পন্ন এ লােক অনেক অপকর্ম করেছে হালিশহর অঞ্চলে। তার হাতে শহীদ হয়েছে অনেক বাংলার সন্তান। হালীশহর অঞ্চলের অনেক মা, বােন তার রসনার শিকার হয়েছে। তাকে সাহায্য দিত হালীশহর কলােনীর কিছু বিহারী দালাল। সে দিনে ঘরে ঘরে মুক্তিযােদ্ধাদের আশ্রয় কেন্দ্র ও কোন অঞ্চলে কোন ঘরে সুন্দরী মা, বােন আছে তা খুঁজে বের করত। রাতে সে টার্গেটগুলােতে ঘেরাও করে নির্যাতন চালাত। ঐ দিনও সে এসেছিল এ রকম একটি তথ্য সংগ্রহে। তাকে সহযােগিতা দিয়েছিল স্থানীয় একজন দালাল। দালালের সহযােগিতায় সে আব্দুল মালেক দফাদারকে চিনতে পেরেছিল। সুখের বিষয় ছিল যে, এ স্থানীয় দালালকে পরবর্তীতে রাজাকারবাহিনী মেরে ধানের জমিতে ফেলে রেখেছিল। ঐ স্থানীয় দালালের নাম আব্দুল করিম। ইসলামী ছাত্র সংঘের কর্মী, রেলওয়ের চাকুরে। তার অত্যাচারে ছিল সকলে অতিষ্ঠ।
(সূত্র : রণাঙ্গনে সূর্য সৈনিক, সাখাওয়াত হােসেন মজনু)
 
 

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত

 
error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!