You dont have javascript enabled! Please enable it!
অপারেশন জাম্বুরী মাঠ পাওয়ার ষ্টেশন
 
আমাদের মা, বােনদের নিবাপত্তা নেই। হায়নার দল নখর মেলে বসে আছে। কখন হিংস্র ছােবল হানে বলা যায় না। তাদের নিকট নারীর ইজ্জত ভূলুণ্ঠিত। মা, বােনের সম্মান তাদের কাছে নেই। প্রতিদিন বিভিন্ন অঞ্চলে হানা দিচ্ছে তারা। বেইজ্জত করছে আমাদের। মা, বােনদের তুলে নিয়ে যাচ্ছে ক্যাম্পে। পাকহানাদার গােষ্ঠী প্রায় প্রতি এলাকায় গড়ে তুলেছে নির্যাতন কেন্দ্র। পাপ তাদের এমন ভাবে পেয়ে বসেছে যে সামান্য লজ্জা-ভয় তাদের কাছে নেই। সব কিছুই নির্বাসনে চলে গেছে। বিবেক তাদের পােপ পেয়েছে। বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ বেহায়া পাকহানাদার গােষ্ঠী। তাদের শিক্ষা দিতে নেমেছে বীর বাঙ্গালী। টেক্সী থামল। নেমে এলেন দু’মহিলা। বােরখায় ঢাকা পুরাে শরীর। এগিয়ে এলেন একজন তরুণ। নামিয়ে নিলেন একটি লেদার সুটকেস ও দুটি মিষ্টির প্যাকেট। বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলেন তারা। এসেছেন বেড়াতে। সঙ্গে এনেছেন প্রয়ােজনীয় কাপড়। সুটকেস ও একটি মিষ্টির প্যাকেট সুকৌশলে বাড়ির গােপন কক্ষে রেখে দেয়া হল। কেউ বুঝতে পারেনি এতে কি রয়েছে। মহিলাদের একজন হাজেরা খাতুন। বয়স পঞ্চাশ পেরিয়েছে। অন্য জন হাফিজা খাতুন। বয়স ত্রিশের কোঠায়। এ দু’জন মহিলা মিষ্টির প্যাকেট ও সুটকেসটি পাকসেনাদের সামনে দিয়ে নিয়ে এসেছেন। কেউ সন্দেহ করতে পারেনি।  রমজান শুরু হয়নি। আর মাত্র দু’দিন বাকী। মানুষের মাঝে চলছে পূর্ব প্রস্তুতি। বিল্লাপাড়ার বাড়ি থেকে বের হয়ে এলেন এক তরুণ। পরনে খাঁটি মুসলমানী পােষাক। এলেন তকতার মসজিদের সামনে কবরস্থানে। উদ্দেশ্য পীর কামেল হযরত জিন্নাহ আলী শাহের মাজার জিয়ারত করা। জিয়ারত সম্পন্ন করে অলস ভঙ্গীতে হাঁটছেন। আর দেখছেন পাশের বড় ড্রেনটিকে। ড্রেনটি বেশ চওড়া।
বর্তমান সিএন্ডবি কলােনীর (স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কলােনী ছিল না) ট্রান্সফরমার ও সাব ষ্টেশনের পাশে। সেই সাব স্টেশনে প্রবেশ পথ সামনের নেই। বারােজন পাকসৈনিক নিয়মিত পাহারা দেয়। মুক্তিযােদ্ধারা তিনদিন নিয়মিত রেকি করেন কিন্তু ভিতরে প্রবেশের ছিদ্র খুঁজে পেলেন না। অনেক ভেবে চিন্তে ঠিক হল ড্রেনের ভিতর দিয়েই ঢুকতে হবে সাব ষ্টেশনের ভিতরে। তবে ভীষণ কষ্ট হবে। রেকি করতে এসে পরিচয় হল ইউনুছ মিয়ার সাথে । ইউনুছ মিয়া একজন পান দোকানদার। বয়স পঞ্চাশের মতাে হবে। দীর্ঘ দিন থেকে এ সাব ষ্টেশনের সামনে পান বিক্রি করেন। তার পান তৈরির বিশেষত্ব হল যে একবার খেয়েছে তাকে দ্বিতীয়বার খেতেই হবে। বিভিন্ন ধরনের মসল্লা দিয়ে তিনি পান তৈরি করেন। পাকসৈনিকরা প্রতিদিন পালাবদলের সময় ইউনুছ মিয়ার দোকানে আসে পান খেতে। যাওয়ার সময় রাতে খাওয়ার জন্য অনেকগুলাে বানিয়ে নিয়ে যায়। মুক্তির ক’জন সৈনিকের সাথে ইউনুছ মিয়ার সখ্যতা হল। সাব ষ্টেশনটি ধ্বংস করার জন্য তাঁর সাহায্য চাওয়া হল । খুশিতে নেচে উঠলেন তিনি। পঞ্চাশ বছরের ইউনুছ মিয়া একজন তরুণের মতাে টগবগিয়ে উঠলেন। তাঁর মুখাবয়ব জুড়ে কঠোরতার ছাপ ফুটে উঠল। তিনি অভয় দিলেন যােদ্ধাদের।
কৃষ্ণপক্ষের রাত। চারদিকে ঝি ঝি পােকার আওয়াজ। ড্রেনের পানি ভীষণ নােংরা । সেদিকে কারাে খেয়াল নেই। মিষ্টির প্যাকেট ও সুটকেসের ভিতর থেকে বের করে আনা হল দুটি ষ্টেনগান। একটি বহন করেন ফয়েজুর রহমান, অন্যটি জাহিদ হােসেন। ফয়েজ ষ্টেন নিয়ে গরীবউল্লার পেছনে রয়েছে। ড্রেনে কোমর পানি। বিশ্রী অবস্থা। ক’জন পাহারায় বসেছে ড্রেনের মুখে। পৌছে গেল ট্রান্সফরমারের নিকট ড্রেনের প্রবেশ পথে। আস্তে আস্তে লােহার রডগুলাে কাটা হল। প্রবেশ করলেন দু’জন ভিতরে। রাত তিনটা। পাকসৈনিকদের প্রায় সবাই ঘুমিয়ে। কেউ টেবিলের ওপর মাথা দিয়ে, কেউ বেঞ্চের ওপর সটান ঘুমিয়ে। একজন দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে ঝিমুচ্ছে। বুঝতে পারল মূল ব্যাপার। পালা বদলের সময় ওরা ইউনুস মিয়ার পান খেয়েছে। আজ অপারেশনের সংবাদ ইউনুছ মিয়া জানতেন। তাই তিনি সংগ্রহ করেছিলেন ঘুমের ঔষধ। পানের সাথে তা মিশিয়ে দিয়েছেন। ঘুমের ঔষধের একশন শুরু হয়েছে। তাই সবাই ঘুমােচ্ছে। ফয়েজ অন্ধকার থেকে ষ্টেন তাক করে রয়েছে। পাকসৈনিকদের লক্ষ্য করে গরীব উল্লাহ বসাচ্ছে বিস্ফোরক। অল্প সময়ের মধ্যে বিস্ফোরক স্থাপন করা হল ট্রান্সফরমাগুলােতে। ৪টি ট্রান্সফরমার রয়েছে এ সাব ষ্টেশনে। প্রত্যেকটিতে বিস্ফোরক বসান হয়েছে। বিস্ফোরক বসিয়ে তার টেনে নিয়ে এল অনেক দূর ড্রেনের মুখে। সবাইকে নিরাপদ দূরত্বে পাঠিয়ে দেয়া হল। মাত্র কয়েক মিনিট পর প্রচন্ড বিস্ফোরণ।
পুরাে এলাকা অন্ধকার হয়ে গেল। দূর থেকে গুলির আওয়াজ ভেসে আসছে। পুরাে আগ্রাবাদবাসী জেগে গেছে। মুক্তিযােদ্ধারা নিরাপদে চলে এসেছে পূর্বের বাড়িতে। তারা সবাই পড়ে রয়েছে ঘুমের ভান করে। আওয়াজের প্রচন্ডতার বাড়ির সকলের ঘুম ভেঙ্গে গেল। মানুষজন জড়াে হল বাড়ির আঙ্গিনায়। মুক্তির সৈনিকরাও চোখ কচলাতে কচলাতে আঙ্গিনায় এল। মনে হল তারা কিছুই জানেন না। জাম্বুরী মাঠের রাস্তা ধরে পাকসৈনিকদের গাড়িগুলাে এগিয়ে এল। ট্রান্সফরমার সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হল। পাকহানাদার বাহিনীর ক্যাম্প উড়ে গেল। মৃতের সংখ্যা ৮ জন। আহত বাকী সবাই। এ অপারেশনের পেছনে রয়েছে অন্যতম একটি কারণ। পাকবর্বরদের একটি ঘাঁটি ছিল এখানে। তারা প্রায় সময় মানুষকে অত্যাচার করত। তাদের অত্যাচারের ভয়ে কেউ ঘরে থেকে বের হতে সাহসী হত না। একদিন দুপুরে ফরেস্ট কলােনী থেকে একজন বুয়াকে ধরে নিয়ে আসে পাওয়ার ষ্টেশনে। উপযুপরি ধর্ষণ করে। এ ঘটনার পর এলাকা থেকে সব মহিলারা চলে যান। পুরুষরা কোন রকমে ভয়ে ছিল। এ অপারেশন জুম্মন খান ও আবেদ খান দেয়াল পড়ে মারা যায়। তাদের মৃত্যুতে এলাকাবাসী ভীষণ খুশি হয়েছে। পাকবাহিনী তাদের ক্যাম্প স্থায়ী ভাবে এখানে থেকে তুলে নিয়ে যায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এ ট্রান্সফরমারগুলাে আর ঠিক করা হয়নি। সেদিনের অপারেশনের পর আর ইউনুছ মিয়াকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। দু’মহিলার একজন হাজেরা খাতুন মুক্তিযােদ্ধা গরীবউল্লাহর মা। অন্যজন হাফিজা খাতুন তার ভাবী। জাতি এ দু’জন বিদূষিনীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল। ( সূত্র ঃ রণাঙ্গনে সূর্য সৈনিক, সাখাওয়াত হােসেন মজনু)

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!