You dont have javascript enabled! Please enable it! অপারেশন পাঠানটুলী কাবুলীদের আস্তানা - সংগ্রামের নোটবুক
অপারেশন পাঠানটুলী কাবুলীদের আস্তানা
ওরা মানুষ হত্যা করছে—আসুন আমরা পশু হত্যা করি। ঐ পশ্চিমা পশুর দল লুটে লুটে খাচ্ছে আমাদের সাধের দেশকে। গ্রামবাংলার পথ-ঘাট, প্রান্তরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে মানুষের লাশ। বিনা কারণে বাংলার আদম সন্তানগুলােকে হত্যা করা হচ্ছে

নির্বিচারে। ওদের একমাত্র অপরাধ ওরা বাঙালি। হৃদয় ওদের নিবেদিত স্বাধীনতায়। বাংলার পথে-ঘাটে বর্বরের দাপট। সহযােগী উর্দুভাষী প্রায় সকলে। বাংলা ভাষাকে টুটি চিপে শেষ করে দেয়াই তাদের কামনা বাসনা। চট্টগ্রাম শহরে আনাচে-কানাচে মুক্তিযােদ্ধারা এসে গেছে। আবাস গড়েছে গােপনে। স্বাধীনতা প্রত্যাশীদের সহযােগিতায়। আজ তারা গােপনে শিবির গড়েছে শহরের বিভিন্ন অংশে। দেখলে কেউ বুঝতেই পারবে ওরা মুক্তিযােদ্ধা। একজন যােদ্ধার বেশ ভূষা তেমন নেই। কেউ তরকারী বহন করছে, কেউ পথ চলছে মৌলভীর বেশে বা পাগলের উজ্জ্বলতায় রাস্তায় পড়ে রয়েছে। কেউ ড্রাইভার, মসজিদের হুজুর বিভিন্ন বেশভূষায়। তারা মুক্তিযােদ্ধের কাজ করেই চলছে। অনেক সময় দেখা যাচ্ছে হােটেলের বয় চোখের ইশারায় কাজ সেরে ফেলেছে। পাকবাহিনী কত জনকে খুন করবেক’জনকে ধরে নেবে? প্রত্যেকেই আজ মুক্তিযােদ্ধা। অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ। মুক্তিযােদ্ধাদের তৎপরতা চোখে পরার মতাে। মুক্তিযােদ্ধাদের। আক্রমণের মুখে পাকহানাদার বাহিনী দিশেহারা। তাদের সার্বিক সাহায্য ও সহযােগিতা প্রদানে সংঘবদ্ধ হল স্থানীয় দালাল ও অবাঙালিরা।
পাকবাহিনীও তাদের দোসরদের সহযােগিতায় বিভিন্ন পাড়ায় যােগাযােগে কেন্দ্র স্থাপনে সচেষ্ট হল। তেমনি একটি কেন্দ্র স্থাপন করল পাঠানটুলীতে। পাঠানটুলী খান সাহেব উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের পূর্বপাশে সংযুক্ত দোতলা দালানটিতে (ডঃ বাতেনের চেম্বার ভবনটি) থাকত এক দল কাবুলী। তারা মেছ করে থাকত। রান্না-বান্না করে খেত সবাই মিলে। দীর্ঘ দিন থেকে কাবুলীদের দলটি এ এলাকায় থাকছে। তাদের সাথে স্থানীয়দের সম্পর্ক মন্দ নয়। কিন্তু মার্চের শেষ দিকে তাদের রূপের পরিবর্তন ঘটে। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের ঘােষণার পর থেকে তারা সম্পূর্ণ রূপে বদলে যায়। এ এলাকায় দীর্ঘ দিন অবস্থানে কোন লােক কোন দলের সমর্থক এবং কোন বাড়িতে মুক্তিযােদ্ধাদের আশ্রয় দিচ্ছে তা তারা বুঝতে পারে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সমর্থিত পরিবারগুলাে সম্বন্ধে তাদের ধারণা স্বচ্ছ।
 প্রতিদিন পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা এখানে আসে। আড্ডা মারে, তথ্য সংগ্রহ করে চলে যায়। তারপর সময় সুযােগ মতাে রাতে এসে হানা দেয় বর্বরের দল। এলাকাবাসী বুঝতে পারে সব— কাদের সহযােগিতায় ওরা হানা দিচ্ছে। কাবুলীদের এ আস্তানাটি এলাকাবাসীর জন্য মরণ ফাঁদ হয়েছে। এদের তাড়াতেও পারছে না। আবার রাখতেও পারছে না। সবাই পড়ল মহাবিপদে। পাকসৈনিকদের নিত্য আগমনের কারণে তারা সাহস পেয়ে যায়। পূর্বে যারা জয় বাংলা, শেখ মুজিব, বাংলাদেশ বলতেন এখন তারা তাদের দেখলে টিটকারী দিচ্ছে। বিশ্রী ভাষায় মুক্তিযুদ্ধের সমালােচনা করছে। এলাকাবাসী না শােনার ভান করে চলে যেত। এ দলের সাথে এসে যােগ দেয় স্থানীয় অবাঙালি জামসেদ খান। পাঠানটুলী রােডে কর্ণফুলী বাের্ডিং-এর পাশে ছিল তার মটর ওয়ার্কসপ ও গ্যারেজ। পাকবাহিনীর সক্রিয় সহযােগিতা পেয়ে সে এলাকায় কায়েম করেছে ত্রাসের রাজত্ব। পাকবাহিনীকে রিপাের্ট করে ধরিয়ে দিচ্ছে অসহায় বাঙালিদের। এলাকার ধনীদেরকে বিভিন্ন রকম হয়রানি করে বিনিময়ে টাকা উসুল করছে। মুক্তিযুদ্ধের সহযােগী বলে সাধারণ মানুষকে পাকবাহিনীর হাতে ধরিয়ে দিচ্ছে। আবার সে নিজের টাকার বিনিময়ে ওদের ছুটিয়ে নিয়ে আসছে। সবই ঐ জামসেদ খানের কারসাজি। এলাকাবাসী বুঝে নিয়েছে। কিন্তু করার তাে কিছুই নেই।
পাঠানটুলীর বংশাল পাড়ায় মুসলীম খানের বাড়িতে KC-ll দল এবং আবদুর রহমান গ্রুপের সদস্যরা আশ্রয় পেত। এমনকি যখনই খাওয়ার প্রয়ােজন হত এখানে এলে মুক্তিযােদ্ধারা খাওয়া পেত। এ পরিবারের গৃহকর্তী নুরুন নাহার বেগম মুক্তিযােদ্ধা গরীব উল্লাহর বােন। সে সূত্রে তিনি সমস্ত মুক্তিযােদ্ধাদের বােনে পরিণত হন। মুক্তিযােদ্ধারাও তাকে বরণ করেন বােনের সম্মান দিয়ে। একদিন মুক্তিযােদ্ধাদের একটি দল এল বংশাল পাড়ার গফুর খান সওদাগরের বাড়িতে অর্থাৎ মুসলীম খানের ঘরে। এসে তারা শুনতে পান কাবুলীদের সহযােগিতায় পাকবাহিনী এলাকার একজন মানুষকে ভীষণ মার মেরেছে। লােকটির পাঁজরের একটি হাড় ভেঙ্গে দিয়েছে। এ সংবাদে মুক্তিযােদ্ধারা চঞ্চল হয়ে ওঠেন। কাবুলীদের আস্তানায় আঘাত হানার নিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। | সকাল তখন এগারােটা। কবীর তােরণের আশ্রয় কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে এলেন দু’জন। হাতে রেশন কার্ড ও একটি চটের ব্যাগ। রেশন তুলতে চলেছেন। এসে দাঁড়ালেন পাঠানটুলী খান সাহেব বালিকা বিদ্যালয়ের সামনে রেশন দোকানের পাশে। রাস্তার ওপার থেকে দাঁড়িয়ে তারা দেখে নিল ভবনটির অবস্থান। চার পাঁচজনের সবাই ঘরে রয়েছে। কেউ রান্না করছে। ক’জন মিলে বসছে তাস খেলতে। বাইরে থেকে স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে। কারণ রাস্তার উপরেই তাদের বাসভবন। এমনি সময় এসে থামল একটি মটর সাইকেল। নেমে এল সামরিক পােষাকে দু’জন পাকসৈনিক। মটর সাইকেল সামনে রেখে উঠে গেল দোতলায় তাসের আসরে। ঐ বাড়ির সামনে ছিল একটি ছােট্ট ফুলবাগান। গরীব উল্লাহ এবং মােঃ শফি মুন্সী দেখল তাসের আসরে তারা মসগুল।
কোন দিকে খেয়াল নেই। দু’জন চলে গেল আড়ালে। খুলে নিল গ্রেনেডের পিন। দু’জন বেরিয়ে এল আড়াল থেকে দ্রুত। চলে গেল বাড়িটির সামনে। চোখের পলকে ছুড়ে মারল গ্রেনেড ভবনের দোতলার দিকে। একই সাথে দুটো গ্রেনেড প্রচন্ড বিস্ফোরণে ফুটে গেল। বিস্ফোরণের শব্দে সবাই স্তম্ভিত। কেউ কিছু বুঝতে পারল না। ছুটোছুটি সর্বত্রই। দোকান-পাট বন্ধ হয়ে গেল। কেউই বুঝতে পারেনি কে গ্রেনেড ছুঁড়ে মেরেছে। ঝোপ ঝাড়ের আড়ালে দু’জন পালাল। কাবুলী আস্তানার সকলে আহত হল। দুপুরে ঝাঁকে ঝাঁকে পাক সৈনিকরা এল। এলাকাবাসীর ওপর চালাল অত্যাচার। এভাবে দু’দিন চলল। মানুষজনও পালাল এলাকা ছেড়ে। পাকবাহিনীর আরাে দু’দিন কাবুলীর আস্তানা পাহারা দিল। একদিন সকালে এলাকাবাসী দেখল কাবুলীদের আস্তানা খালি। সবাই পালিয়েছে। কুখ্যাত জামশেদ খানের আর দেখা পাওয়া যায়নি। সেও পালিয়েছে। এলাকাবাসী স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল। স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত আর এ এলাকায় পাকবাহিনী আসেনি। (সূত্র : রণাঙ্গনে সূর্য সৈনিক, সাখাওয়াত হােসেন মজনু )

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত