অপারেশন নেভী হেড কোয়ার্টার
যুদ্ধের গতি বেড়ে গেছে। স্বাধীনতা সংগ্রামীরা পাকহানাদারদের হৃদপিন্ডে আঘাত হানতে শুরু করেছে। জলে স্থলে সর্বত্রই গেরিলা যােদ্ধারা তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। হানাদারবাহিনী গেরিলা আক্রমণের ভয়ে ত্রস্ত। কখােন আবার গেরিলারা হামলা শুরু করে দেয়। গেরিলা যােদ্ধাদের তাে আর চেনা যায় না। তাই বাঙালিদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরার জন্য পাকসরকার কৌশল অবলম্বন করেছে। অবশ্য এ কৌশলের পেছনে রয়েছে পাকহানাদারের দোষর বাংলার সন্তান। যারা ইতিহাসের পাতায় চিরদিন ঘৃণিত হয়ে থাকবে। ‘পাকিস্তানের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে বেসামরিক প্রতিরক্ষা জোরদার করে পূর্বপাকিস্তানের জনগণের শান্তি ও নিরাপত্তা বিধানের জন্য ২৪ নভেম্বর সকাল ৯-৩০ মিনিটে চট্টগ্রাম নৌবাহিনী সদর দফতরে লােক নিয়ােগ করা হবে। আগ্রহী দেশপ্রেমিক জনগণকে বিস্তারিত তথ্যের জন্য চট্টগ্রামের টাইগার পাসস্থ নৌবাহিনী ক্যাম্পে যােগাযােগ করতে অনুরােধ জানানাে যাচ্ছে। এক অলস দুপুরে আবুল কাসেম পাকিস্তান রেডিওর এ ঘােষণা শুনলেন। আবুল কাসেম মুক্তিযােদ্ধার একজন সমর্থক এবং স্টীম মিলের একজন চাকুরে। আবাস বন্দরটিলার একটি মেসে। স্থানীয় মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে রয়েছে তার গােপন যােগাযােগ। বিকেলে এলেন আগ্রাবাদে। দেখা ফয়েজুর রহমানের সাথে। তাদের মধ্যে পূর্ব পরিচয় ছিল। একই সাথে দু’জন ছাত্র রাজনীতি করেছেন। দুপুরে রেডিওর ঘােষণার সংবাদটি জানালেন ফয়েজকে। অস্থির ফয়েজ তখনই কাশেমকে নিয়ে এলেন টাইগার পাশ নৌবাহিনীর তথ্য কেন্দ্রে। বাইরে টানানাে নােটিশ দেখে বিস্তারিত জানলেন । নােটিশের মূল বিষয় হল সেনা ও নৌ বাহিনীর তত্বাবধানে রাজাকার নিয়ােগ করা হবে। বেরিয়ে এলেন দু’জন।
দু’একদিনের মধ্যে কাশেমের সাথে যােগাযােগ হবে এ বলে বিদায় নিয়ে চলে এলেন ফয়েজ। রাজাকার রিকুটের সংবাদ পৌছে গেল গােপন শেল্টারে। দলীয় অধিনায়ক আলাপ করলেন সবার সাথে। সিদ্ধান্ত হল রাজাকার রিক্রুট বন্ধ করতে হবে। নৌবাহিনী সদর দপ্তর অপারেশন করতে হলে প্রয়ােজন স্থানীয় ছেলে। পুনরায় যােগাযােগ স্থাপিত হল। আব্দুল কাশেমের সাথে। কাশেম স্থানীয় মুক্তিযােদ্ধা জাহিদ, গনি ও জামিরের সাথে আলাপ আলােচনা করেন। তারা এ অপারেশনে একমত হলেন। সংবাদ দেয়া হল ফয়েজুর রহমানকে। তিনিও এলেন যথাসময়ে। সমস্যা দেখা দিল রেকি কে করবে? নৌবাহিনীর ভিতরে প্রবেশ করা সম্ভব নয়। অনেক ভেবে চিন্তে কাশেম গ্রহণ করলেন এ গুরু দায়িত্ব। তিনি পরদিন অফিসে গিয়ে টেলিফোন করলেন নেভী এক্সচেঞ্জে। লােক রিকুটের তথ্য জানতে চাইলেন। অপারেশন তথ্যের দায়িত্বে নিয়ােজিত একজনকে দিলেন। শুদ্ধ বাংলা কথা শুনে সন্দেহ হল। তার সাথে দেখা করতে চাইলেন। ভদ্রলােক তাকে আসতে আমন্ত্রন জানালেন। কাশেম কৌশলে জেনে নিলেন তার ডিউটি কতক্ষণ। জবাবে ভদ্রলােক বলল দুপুর ১টা পর্যন্ত। কাশেম তখন বললেন, ভাই আমার ডিউটি দুটা পর্যন্ত। এর মধ্যে আসা সম্ভব নয়।’ দ্রলােক বললেন, ঠিক আছে, আমি তাে ভিতরেই থাকি। আপনি ৩টার দিকে আসুন। আমি গেইটে আপনার জন্য পাশ অনুমােদন করিয়ে রেখে যাব। আপনি গেইটে এসে পরিচয় দেবেন। তারা আপনাকে পাস দিয়ে আমার কাছে পৌছে দেবে। ধন্যবাদ জানিয়ে কাশেম রিসিভার রেখে দিলেন।
বিকেল ৩টা। কাশেম এল নৌবাহনী সদর দপ্তরে। গেইটে পাহারারত একজনকে নিজের পরিচয় দিতেই একটি পাস কাশেমের হাতে দিলেন। একটি খাতায় স্বাক্ষর করে একজন নৌসেনার সাথে এলেন ভিতরে মেছ কোয়াটারে। তৌহিদ নামে ঐ ভদ্রলােকের সাথে আলাপ হল। তারপর দুজনে মিলে এলেন ক্যান্টিনে। কাশেম নৌসেনা তৌহিদের সাথে আলাপ করছেন আর সূক্ষ্মভাবে দেখছেন চারদিক। তৌহিদ সাহেবের নিকট থেকে জেনে নিচ্ছেন এটা কি ওটা কি। ক্যান্টিন থেকে বের হয়ে বৈকালিক ভ্রমণের মতাে করে তৌহিদ কাশেমকে নিয়ে এলেন নৌবাহিনীর পশ্চিম অংশে। আরাে বেশ ক’জন বসে আড্ডা মারছে। দূরের কোণে দেখা যাচ্ছে একটি বিদ্যুৎ পাওয়ার ষ্টেশন। সাথে একটি ছােট্ট ঘর। চারদিকে বড় বড় ঘাসে ভরা। মনে হল সেদিকে মানুষের তেমন চলাচল নেই। তৌহিদ কাশেমকে নিয়ে অফিস দেখালেন। বললেন, এই মাঠে লােকজনকে রিক্রুট হবে। বিস্তারিত তথ্য দিলেন। অনেক আলাপ পরিচয়। ভদ্রলােকের বাড়ি বরিশাল। পাকিস্তান নৌবাহিনীতে চাকুরী করছেন পাঁচ বছর। বিদায় দিলেন গেইট পর্যন্ত এগিয়ে এসে।
রাতে কাশেমের বাসায় এলেন ফয়েজ, গরীবউল্লাহ ও শফি। সমস্ত তথ্য জেনে তারা বাইরের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে তােক নিয়ােগ করলেন। কারণ ভিতরে অপারেশন দুঃসাধ্য। তবে বিদ্যুৎ ট্রান্সফরমারটিকে অপারেশনের আওতায় আনা যায়। গরীব উল্লাহ ও ফয়েজ দু’জন সাময়িক আস্তানা গাড়ল কাশেমের আবাসে। তারা স্থানীয়দের সহযােগিতায় প্রয়ােজনীয় রেকি শেষ করল। অবশেষে জাহেদ নৌবাহিনীর ক্যাম্পে গােপন প্রবেশ পথের সন্ধান দিলেন। বড় ড্রেনের মুখে রয়েছে লােহার জালি। এ জালি কেটে অনায়াসে ড্রেনের। ভিতর দিয়ে ট্রান্সফরমারের নিকট পৌছা যাবে। পরবর্তী দিন তারা ড্রেনের মুখ পর্যবেক্ষণ করলেন। ঠিক হল ঐ ড্রেনের লােহার জাল কেটেই তারা ভিতরে ঢুকবে। তুলনামূলকভাবে উত্তর অংশের ড্রেনের মুখ দিয়ে ঢুকতে পারলে ট্রান্সফরমার ধ্বংস সম্ভব হবে। ঘড়ির কাঁটা তখন বারােটা। নভেম্বর ২৩ পেরিয়ে ২৪ তারিখ এল। একে একে সবাই এসে গেছে। সফি, ইয়াকুব তারা দু’জন মুগলটুলী থেকে বের হয়ে হালিশহরের বিভিন্ন পথ, অলি-গলি বেয়ে এল বন্দরটিলার কাশেমের আবাসে। তারা সাথে এনেছে দুটি ষ্টেনগান ও প্রয়ােজনীয় বিস্ফোরক। অবশ্য রাতের আঁধারে তাদের বেশি অসুবিধে হয়নি। শীত সবে শুরু হয়েছে। হঠাৎ আকাশ থেকে বৃষ্টি ঝরতে লাগল। সামান্য বৃষ্টি। তবে অনবরত ঝরছে। বৃষ্টি দেখে সবাই মহাখুশী। আল্লাহর রহমতের বৃষ্টি। সকলে আল্লাহর ওপর নিজেদের সমর্পন করে দোয়া দরুদ পড়ে বেরিয়ে এল।
সবার পরনে কাল হাফ পেন্ট। মানুষজন দেখলে মনে করবে পাকমিলিশিয়া। গরীবউল্লাহ ও ফয়েজ বহন করছে বিস্ফোরক দ্রব্য। অবশ্য দু’জনের কাছে দুটি রিভলবার। জাহিদ, গনি ও জমির ষ্টেনগান নিয়ে প্রহরায় বসেছে। তারা দেয়ালের সাথে মিশে দাঁড়িয়ে অস্ত্র হাতে। শফি ও এয়াকুব মাটির সাথে বুক লাগিয়ে মাথা উঁচু করে শুয়ে আছে। সবাই তখন পজিশেন। বড় ড্রেনটির গায়ে রয়েছে ঝােপ-ঝাড়। ফলে সুবিধে হচ্ছে বেশি। সাপ, ব্যাঙ মানুষের আগমন টের পেয়ে ঝোপ ঝাড় থেকে পানিতে লাফিয়ে পড়ছে। গরীবউল্লাহ ও ফয়েজ লােহা কাটার করাত দিয়ে লােহার জাল কেটে ভিতরে প্রবেশ করল। ড্রেনের ভিতর দিয়ে ক্রলিং করে এল কিছু দূর। আর ৪/৫ হাত দূরে ট্রান্সফরমারটি। মাথা তুলে দেখেন কোন নিরাপত্তা প্রহরী নেই। ২০/২৫ গজ দূরে একটি একতলা ছােট কক্ষ। জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে একটি লোেক ঘুমােচ্ছে। তার পরণে সাধারণ পােষাক। সম্ভবত হালকা বৃষ্টির ছোঁয়া পেয়ে লােকটি ঘুমিয়ে গেছে। লােকটির পাশে রয়েছে একটি ষ্টেনগান। ফয়েজ ও গরীবউল্লাহ ট্রান্সফরমারের ভিতর প্রবেশ করেন। অতিদ্রুত বিস্ফোরক স্থাপন করে তার লম্বা করে দেয়ালের বাইরে নিয়ে এলেন। বাইরে অপেক্ষমানরা তখন চরম উত্তেজনায়। সবাই চলে এল নিরাপদ স্থানে। সবাই পৌছে যান বন্দর টিলাস্থ একটি নির্মানাধীন বাড়িতে।
প্রচন্ড বিস্ফোরণ ঘটল। অন্ধকার হল পুরাে নেভেল বেইজ। সেখান থেকে বেজে উঠল বিপদ সংকেত সাইরেন। বিস্ফোরণের আওয়াজ এবং বিপদ সংকেতের সাইরেন এলাকাটিকে ভীত করে তুলল। তারা সবাই জেগে গেছে। মুক্তিযােদ্ধারা আনন্দে একে অপরকে জড়িয়ে ধরেছে। পরদিন পূর্ব পাকিস্তানের শান্তি ও সংহতি রক্ষার জন্য আর লােক নিয়ােগ করা হয়নি। স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতারকেন্দ্র থেকে চট্টগ্রামের নৌবাহিনী সদর দপ্তরে মুক্তিযােদ্ধাদের গেরিলা আক্রমণের সংবাদ প্রচার করা হল। এ ছাড়াও বিবিসি মার্ক টালীর বিবরণ দিয়ে এ অপারেশন সংবাদ বর্হিবিশ্বকে জানিয়ে দিল । [ বিঃ দ্রঃ—এ অপারেশনের পূর্বে নেভেল বেইজের পাশের গফুর গ্রুপ, ফয়েজুর রহমান ও গরীবউল্লাহের নেতৃত্বে নৌবাহিনীর টহল দলের ওপর গ্রেনেড নিক্ষিপ্ত হয়। এতে দু’জন পাক নৌসেনা ঘটনাস্থলে মারা যায় এবং দু’জন আহত হয়।
(সূত্র ঃ রণাঙ্গনে সূর্য সৈনিক, সাখাওয়াত হােসেন মজনু)
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত